Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational

4  

Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational

জনগনের হৃদয়ের রানী

জনগনের হৃদয়ের রানী

4 mins
373


২০ বছর বয়সে সোনালী ছোটচুলের সেই মেয়েটিকে বিশ্ববাসী চিনেছিলো ব্রিটেনের রাজবধু হিসেবে। তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে রাজপ্রাসাদ ছাড়বার পরও তিনি ছিলেন সমান জনপ্রিয়। পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছেন ২৫ বছর হতে চললো। এখনো তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী, আজও তাঁর বেদনাবিধুর বিদায় অশ্রুসিক্ত করে কোটি ভক্তকে। অসহায়ের কাছে ‘জনগণের যুবরানী’, ফ্যাশন সচেতন বিশ্বের কাছে স্টাইল আইকন আর সন্তানদের কাছে একজন মমতাময়ী মা- এই তিন কারিশমায় ব্রিটেনের (সাবেক) রাজবধুর পরিচয়ের বাইরেও তিনি যেন বিশেষ কিছু! 


১৯৬১ সালের ১ জুন তার জন্ম হয়েছিল ব্রিটেনের অন্যতম অভিজাত স্পেন্সার পরিবারে। সেই স্পেন্সার পরিবার, যারা উত্তরাধিকার সূত্রে মার্লবোরোর ডিউক, ভিস্কাউন্ট চার্চিল ও স্যান্ডারল্যান্ডের আর্লের মতো রাজকীয় খেতাব বহন করে চলেছেন। তার বাবা ছিলেন ভিস্কাউন্ট অ্যালথর্প এডওয়ার্ড জন স্পেন্সার এবং মা ভিস্কাউন্টেস অ্যালথর্প ফ্রান্সেস শ্যান কিড। ৬ বছর বয়সেই বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ দেখতে হয়েছিল ডায়ানাকে। তার জিম্মা নিয়ে বাবা ও মায়ের কদর্য আইনি লড়াই প্রভাব ফেলেছিল ডায়ানার শিশুমনে। শেষ পর্যন্ত লেডি ডায়ানা স্পেন্সারের শৈশব কেটেছিল বাবার কাছেই।


‘৮ম আর্ল অব স্পেন্সার’ খেতাব পাওয়ার পর অ্যালথর্প থেকে সপরিবারে নর্দাম্পটনে চলে আসেন ডায়ানার বাবা এডওয়ার্ড স্পেন্সার। সেখানে তার বাবা বিয়ে করেন বিখ্যাত লেখিকা বারবারা কার্টল্যান্ডকে। সৎমায়ের সঙ্গে কোনোদিনই বনিবনা হয়নি ডায়ানা ও তার ভাই চার্লসের। বাবার মৃত্যুর পর মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সেই বংশীয় খেতাব ‘৯ম আর্ল অব স্পেন্সার’ পান ডায়ানা।


কেন্টের ওয়েস্ট হেলথ পাবলিক স্কুলের কয়েক বছর পড়ার পর তিনি আবাসিক স্কুল রিডলসওয়ার্থ হলে পড়েছেন। পড়াশোনায় অতটা ভালো কখনই ছিলেন না। ফেল করেছিলেন ‘ও’ লেভেলে। পড়াশোনা শেষ করেছিলেন সুইজারল্যান্ডের ইনস্তিতুত আলপিন ভিদেমানেত্তে থেকে। পড়াশোনায় খারাপ হলেও খেলাধুলা ও সাঁতারে কিশোরী ডায়ানা ছিলেন খুবই পারদর্শী। ভালোবেসেছিলেন ব্যালে নৃত্যকে, কিন্তু পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি উচ্চতার ডায়ানা এই নাচের জন্য ‘একটু বেশিই লম্বা’ হওয়ায় ইচ্ছা সত্ত্বেও এতে ক্যারিয়ার গড়তে পারেননি।


পাঠপর্ব চুকিয়ে লন্ডনে ফিরে ডায়ানার তারুণ্য কেটেছিল খুবই সাদামাটাভাবে। ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল শিশুর পরিচারিকা হিসেবে। পরবর্তী সময়ে কিছুদিন খণ্ডকালীন বাবুর্চির কাজ করে ১৯৭৭ সালে যোগ দেন লন্ডনের নাইটসব্রিজের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে সহকারী শিক্ষিকা পদে। সেই বছরই ডায়ানার সঙ্গে চার্লসের প্রথম আলাপ হয়। সময়ের ব্যবধানে সে আলাপ গড়ায় প্রেমে। শুধু বয়সেই ১৩ বছরের বড় ফারাক নয়, ব্যক্তিত্বের দিক থেকেও দুজন ছিলেন দুই মেরুর। লাজুক আর ফ্যাশন সচেতন ডায়ানার বিপরীতে রাশভারী, বাগানপ্রিয় প্রিন্স চার্লস।


ডায়ানার সঙ্গে যে কেবল তখন থেকে ব্রিটিশ রাজপরিবারের পরিচয়, তা নয়। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছোট দুই ছেলে প্রিন্স অ্যান্ড্র–ু ও প্রিন্স এডওয়ার্ডের ছোটবেলার খেলার সাথী ছিলেন ডায়ানা। ব্রিটিশ রাজমুকুটের পরবর্তী উত্তরাধিকার হওয়ায় প্রিন্স চার্লসের এই প্রেম নজর কেড়েছিল বিশ্ব মিডিয়ার। তাদের চার বছরের প্রণয় পরিণতি পায় ১৯৮১ সালের ২৯ জুলাইয়ের এক মাহেন্দ্রক্ষণে। লন্ডনের সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালে অনুষ্ঠিত বিয়ে সরাসরি সম্প্রচারিত হয় বিশ্ব মিডিয়ায়, যার সাক্ষী হয়েছিল কোটি কোটি মানুষ।


বিয়ের ১১ মাসের মাথায় ১৯৮২ সালের ২১ জুন জন্ম নেয় চার্লস ও ডায়ানার ভালোবাসার প্রথম উপহার প্রিন্স উইলিয়াম আর্থার ফিলিপ লুইস। ১৯৮৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয় তাদের দ্বিতীয় সন্তান প্রিন্স হেনরি চার্লস অ্যালবার্ট ডেভিড (প্রিন্স হ্যারি)।


‘ব্রিটিশ রাজবধূ’র বাইরে এসে তিনি গড়তে চেয়েছিলেন নিজের আলাদা একটি পরিচয়, এখানেই ব্যতিক্রম তিনি। পোশাক সচেতনতা দিয়ে ফ্যাশন আইকন বা কোটি তরুণের চোখে মোহময়ীই তিনি কেবল হননি, তার চোখ ছিল সাধারণ মানুষের দিকে। এইচআইভি সম্পর্কিত সচেতনতা তৈরিতে নানা ক্যাম্পেইনে সরাসরি যুক্ত থাকার পাশাপাশি এইডস আক্রান্তদের জন্যও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ডায়ানা। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কাজ করাসহ দাতব্য সংস্থাগুলোর অনুদান জোগাড়ে সহযোগিতা করতেন তিনি।


ক্যামিলা পার্কার-বাওলেসের (বর্তমান ডাচেস অব কর্নওয়াল) সঙ্গে স্বামী চার্লস পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ায় দিশাহারা ডায়ানা নিজেও জেমস গিলবের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে যান। ১৯৯২ সালে এই দুই সম্পর্কের কথা গণমাধ্যমের কল্যাণে ভাইরাল হয়ে যায়। ফলে রাজপরিবারের আদেশে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজর পার্লামেন্টে চার্লস-ডায়ানার বিচ্ছেদের ঘোষণা দেন। ১৯৯৬-তে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর হয়।


১৯৯৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে চার্লস ভাঙনের পেছনে নিজের বিশ্বাসভঙ্গ ও অন্যাসক্তির দায় স্বীকার করেছিলেন। দ্য সান পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ডায়ানার সঙ্গে বিয়ের অনেক আগে থেকেই ভাঙাগড়ার মধ্যেই চলছিল চার্লস-ক্যামিলার প্রেম।


বিচ্ছেদের পর খ্যাতির চূড়া থেকে পতন হল ডায়ানার, যখন তিনি প্রেম করা শুরু করলেন মিসরীয় চলচ্চিত্র প্রযোজক দোদি ফায়েদের সঙ্গে। অথচ দু’জনেই সবসময় নিজেদের কেবল ‘ভালো বন্ধু’ হিসেবে দাবি করে গেছেন। বলা হয়, খ্যাতির বিড়ম্বনার কারণেই ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-এর শিকার হয়েছিলেন তিনি। ডায়ানা-ফায়েদ যুগল কোথায় যাচ্ছেন, কী খাচ্ছেন- এ নিয়েও নেতিবাচক চর্চা ও সমালোচনা চলতে লাগল গণমাধ্যমে। অবশ্য গণমাধ্যমের এই সমালোচনার পেছনে দোদি ফায়েদের ‘প্লেবয়’ সুলভ একটি ইমেজের ভূমিকাও ছিল। সেই থেকে ব্যক্তিজীবন নিয়ে সাংবাদিক ও অতর্কিত ছবি শিকারি ‘পাপারাজ্জি’দের থেকে পালিয়ে বাঁচতে লাগলেন প্রিন্সেস ডায়ানা।


পাপারাজ্জি থেকে এই পালিয়ে বাঁচতে চাওয়ার নীতিই হয়তো কাল হয়েছিল ডায়ানার জীবনে। ১৯৯৭ সালের আগস্টে ফ্রান্সে প্রমোদ ভ্রমণে এসেছিলেন ডায়ানা ও ফায়েদ। ৩১ আগস্ট সকালে ‘হোটেল রিজ’ থেকে একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িতে করে বেরোতেই পথিমধ্যে তাদের ধাওয়া করে পাপারাজ্জির একটি দল। তাদের চোখে ধুলো দিয়ে দ্রুতগতিতে গাড়ি আকস্মিক মোড় নিতে গিয়েই ঘটল অঘটন। এক টানেলের রাস্তায় তাদের বহনকারী গাড়িটি অন্য গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষে দুমড়ে মুচড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান দোদি ফায়েদ ও গাড়িটির চালক। কোনোমতে বেঁচে যান ডায়ানার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী। ওদিকে দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত ডায়ানাকে দ্রুত একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। শরীরে অজস্র জখম নিয়ে তীব্র যন্ত্রণার সঙ্গে কয়েক ঘণ্টার লড়াই শেষে পরপারে পাড়ি জমান প্রিন্সেস ডায়ানা।


ডায়ানার বিখ্যাত কয়েকটি উক্তি:


* আমি আমার হৃদয়কে আস্তিনে পরিধান করি।


* প্রত্যেকেরই মূল্যবান হতে ইচ্ছে করে। প্রত্যেকেরই কিছু ফেরত দেয়ার (সমাজকে) সম্ভাবনা থাকে।


* দয়াপরবশ হতে থাকুন কোনো পুরস্কারের আশা না করেই, কেউ একইভাবে আপনাকে এই দয়া ফেরত দেবে।


* পরিবার হচ্ছে পৃথিবীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।


* আপনার হৃদয় যা বলে সেটাই করুন।


* জীবন শুধুই একটা ভ্রমণ।


আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘জনগণের হৃদয়ের রাণী’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া লেডি ডায়নাকে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলী ।

তথ্য : আন্তর্জাল, উইকিপেডিয়া ও পত্র পত্রিকা।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational