জীবনযুদ্ধের গল্প
জীবনযুদ্ধের গল্প
"This is so much better than anything else!” আট বছর বয়সী এলিস নিউটনের কথায় মেয়ের হাতের পান্ডুলিপির দিকে দেখলেন লন্ডনের ব্লুমসবেরি প্রকাশনীর চেয়ারম্যান ব্যারি ক্যানিংহ্যাম। একজন দরিদ্র মহিলা কোনো এক আকাশ কুসুম গল্প নিয়ে লেখা পান্ডুলিপিটি দিয়ে গেছেন। এর আগে ১২টি প্রকাশনীতে এই লেখা দেয়া হলেও কেউই তা প্রকাশ করতে রাজি হয়নি। কিন্তু মেয়ের অনুরোধে গল্পটি প্রকাশ করতে রাজি হলেন ক্যানিংহ্যাম। আর মহিলাকে বললেন ছোটখাটো একটি চাকরি নিতে কারণ বাচ্চাদের জন্য লেখা বই থেকে খুব একটা টাকা পয়সা উপার্জন হবে না। ঐ মহিলা নিজের অতীত সময়ের বর্ণনা দেন এভাবে, “Poor as it is possible to be in modern Britain, without being homeless.” তার মানসিকতা বুঝতে হলে প্রফেসর ডাম্বালডোরের সেই উক্তি মনে পড়ে! জীবনের চূড়ান্ত অন্ধকার সময়ে দাঁড়িয়েও তিনি তাঁর কিশোর ছাত্র হ্যারিকে দেখিয়েছিলেন কীভাবে ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’ ব’লে শিখিয়েছিলেন অন্ধকারকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হয়। আধুনিক পাশ্চাত্য রূপকথার এই দুই অমোঘ চরিত্রের সৃষ্টিকর্তা এক নারী। আর তিনিও মনে করেন ‘ব্যর্থতাই সাফল্যের সিঁড়ি’। ব্যক্তিগত জীবনে প্রবল হতাশার মধ্যেও আলোর আশা কখনও ছাড়েননি তিনি। চরম দারিদ্র্য, হতাশা, দুঃখকে জয় করে তিনি আজ পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম বিত্তবান লেখিকা, যার বইয়ের প্রায় ৪৫ কোটি কপি বিক্রি হয়েছে সারা পৃথিবী জুড়ে। তাঁর লেখা সেই গল্প অনূদিত হয়েছে নানা ভাষায়। আনুমানিক মোট আয় ৭৭০ কোটি মার্কিন ডলার ! হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন তিনি জে কে রাওলিং, যার সৃষ্ট হ্যারি পটারের জাদুতে বিশ্বের কোটি কোটি শিশুকিশোরের সঙ্গে বুঁদ হয়ে থাকেন প্রাপ্তবয়স্করাও।
জে কে রাওলিং-এর জন্ম ১৯৬৫ সালের ৩১ জুলাই, ইংল্যান্ডের দক্ষিণে গ্লুসেস্টারশায়ারের ছোট্ট একটি শহরে। তাঁর বাবা পিটার রাওলিং ছিলেন একজন এয়ারক্রাফট ইঞ্জিনিয়ার আর মা অ্যান রাওলিং ছিলেন একজন সায়েন্স টেকনিশিয়ান। ছোটবেলা থেকেই লেখালিখির প্রতি একটা আশ্চর্য টান ছিল রাউলিং-এর। স্বপ্ন দেখতেন দুমলাটের ভিতরে নিজের লেখা বইয়ের। কিন্তু মেয়ের এই স্বপ্নের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ান রাউলিংয়ের অভিভাবকেরা। অনুপ্রেরণা তো দূর, বরং শাসন করে মেয়েকে ক্রমাগত পারিবারিক ধারা অনুসারে প্রযুক্তিবিদ্যার পড়াশোনার দিকে ঠেলে দেন বাবা-মা। কিন্তু শুধু কেরিয়ারের খাতিরে অপছন্দের বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে চাননি রাউলিং। তাই বাড়ির অমতেই ফ্রেঞ্চ আর ক্লাসিকস নিয়ে পড়াশোনা করে ১৯৮৬ সাল নাগাদ তিনি গ্র্যাজুয়েট হন আর চলে আসেন লন্ডনে।
নতুন শহরে এসেই এক জায়গায় সেক্রেটারি হিসেবে একটা ছোটো কাজ জুটিয়ে নেন রাউলিং। কিন্তু সে কাজেও মন বসছিল না। অভাব হচ্ছিল মনঃসংযোগের। রাউলিং-ইয়ের কল্পনাপ্রবণ মন সব সময় তাঁকে অমনোযোগী করে রাখত, ফলে গতেবাঁধা কাজ করতে ভালো লাগত না। কিছুদিন কাজ করার পরেই তিনি অনুভব করেন সেক্রেটারি হওয়া তাঁর কাজ নয়, তাই ১০টা-৫টার চাকরির আশা ছেড়ে তিনি ঠিক করেন ইংরেজির শিক্ষক হবেন। সেই উদ্দেশ্যেই ইংল্যান্ড ছেড়ে পাড়ি জমান পর্তুগালে।
নতুন শহরে ছাত্র পড়িয়ে দিনগুলো ভালোই কাটছিল। সেখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় এক পর্তুগিজ সাংবাদিকের। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব, সেখান থেকে প্রেম। কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে করেন তাঁরা, সন্তানও হয়। কিন্তু মেয়ের জন্মের চার মাসের মাথাতেই রাউলিং-য়ের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যায় তাঁর স্বামীর। সেই দাম্পত্যবিভ্রাটের পর পর্তুগালে আর মন বসল না, ছোট মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে দেশে ফিরে এলেন রাউলিং।
এই সময়টাকেই বলা যায় রাউলিং-এর জীবনের সবথেকে কষ্টের সময়। ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে বেঁচে থাকার সে এক অসহনীয় লড়াই। দেশে ফিরে তো এলেন, কিন্তু রোজগার কই! হাতে টাকা নেই। কাল কী খাবেন তাও জানেন না। মাথা নীচু করে বাবা-মায়ের কাছেও ফিরে যেতে চাননি তিনি। সবমিলিয়ে, জীবন সম্পর্কে এক তীব্র অনিশ্চয়টা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে তাঁকে। এতটাই অস্থির হয়ে পড়েন যে আত্মহত্যার কথা পর্যন্ত ভেবে ফেলেছিলেন। এই চরম হতাশা কাটাতে তিনি বাধ্য হন একজন মনোবিশেষজ্ঞর পরামর্শ নিতে। এই ডাক্তারবাবুই তাঁকে কিছুটা সাহায্য করেন আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে। অন্ধকার, হতাশার মধ্যে বসেও আবার নতুন করে লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন রাওলিং।
অনেকদিন আগে ম্যানচেস্টার থেকে ট্রেনে লন্ডনে যাওয়ার সময় একটা বেশ অভিনব গল্পের চিন্তা মাথায় এসেছিল রাওলিং-য়ের। গল্পটা একটা ছোট্ট ছেলের, যে জাদুবিদ্যা শিখতে পাড়ি দিয়েছিল এক জাদুকরের এক স্কুলে। সেই ইস্কুল আর পাঁচটা গড়পড়তা স্কুলের মতো নয়। শিবঠাকুরের আপন দেশের মতো সেই বোর্ডিং স্কুলেরও নিয়মকানুন অভিনব। বহুদিন আগে ভেবে রাখা সেই প্লট নিয়েই নতুন করে কাজ শুরু করলেন রাউলিং। সমস্ত বাধা অতিক্রম করে তিনি নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন লেখার মধ্যে। স্কটল্যান্ডের এডিনবরার এক ক্যাফেতে তিনি একটু নিরিবিলি পেতেন, তাই লেখালিখির জন্য বেছে নিয়েছিলেন সেই ক্যাফেটেরিয়ার একটা ছোট্ট টেবিল। এভাবেই ১৯৯৫ সালে তিনি শেষ করেন তাঁর লেখা সেই আশ্চর্য রূপকথার প্রথম পাণ্ডুলিপি।
পাণ্ডুলিপি তৈরি হল, বটে, কিন্তু সে লেখা ছাপাবে কে! সংসার চালাতেই যাকে হিমসিম খেতে হয়, সেখানে নিজের তাগিদে বই প্রকাশ করার মতো টাকা কই! কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্রী নন রাওলিং। পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকদের দরজায় দরজায় ঘুরতে শুরু করলেন। কিন্তু শুরুর দিকে কোনো প্রকাশক সংস্থাই তার বইটি ছাপতে রাজি হননি। ফল হয়নি অনুরোধ উপরোধেও। কিন্ত তাতেও দমে যাননি রাউলিং। পুরো এক বছর ধরে প্রায় ১২ জন প্রকাশকের কাছে ঘুরে বেড়ান তিনি। বহু চেষ্টার পর শেষমেশ ব্লুমসবারি নামে এক প্রকাশনী তাঁর বইটি ছাপাতে রাজি হয়। তারই ফলশ্রুতিতে ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হল হ্যারি পটার সিরিজের প্রথম বই ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোজফার্স স্টোন’।প্রাথমিকভাবে ১০০০ কপি ছাপা হয় বইটির। যার মধ্যে প্রায় ৫০০ কপি বই-ই বিক্রি করা হয় বিভিন্ন স্কুল, কলেজের লাইব্রেরিতে। হ্যারি, রন আর হারমাইনি নামের মিষ্টি তিনটে ছেলেমেয়ের এই উদ্ভট ইস্কুলজীবনের গল্প ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে থাকে কমবয়েসীদের মধ্যে। কিছুদিনের মধ্যেই ওই হাজার কপি শেষ হয়ে গেলে আবারও নতুন করে ছাপা হয় বইটি। সেই শুরু, এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি রাউলিংকে। এর আগে ইংরেজিতে শিশুসাহিত্যের উপর অনেক জনপ্রিয় বই বেরোলেও বিশ্বসাহিত্যে জনপ্রিয়তার সংজ্ঞাই পালটে দিল এই নতুন হ্যারি পটার সিরিজ। মাত্র পাঁচমাসের মধ্যেই বইটি জিতে নেয় শিশুসাহিত্যের সেরা পুরস্কার।
এরপর একে একে হ্যারি পটার সিরিজের আরও ছটি বই বের হয় – এবং প্রতিটি বইই আগেরটির থেকে বেশি সাফল্য লাভ করে। ২০০৫ সালের জুলাই মাসে বাজারে আসে হ্যারি পটার সিরিজের ষষ্ঠ বই ‘হ্যারি পটার এ্যান্ড দি হাফ ব্লাড প্রিন্স’। অবিশ্বাস্য শোনালেও, প্রকাশের প্রথম ২৪ ঘন্টার মধ্যেই বইটির প্রায় সাত মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়ে যায়। প্রকাশনার ইতিহাসে কোনো বই প্রকাশের প্রথম দিনে এত বেশি বিক্রি কখনও হয়নি।
হ্যারি পটার সিরিজের মোট সাতটি বই আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বে ৪৫ কোটি কপিরও বেশি বিক্রি হয়েছে, বইবিক্রির ইতিহাসে যা সত্যিই এক দৃষ্টান্ত। নানা দেশের প্রায় ৩৫টি ভাষায় অনুদিত হয়েছিল বইগুলো। শুধু বই-ই নয় হ্যারি পটারের গল্প অবলম্বনে মোট আটটি চলচ্চিত্র হয়েছে, যেগুলোও বক্স অফিসে চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করে। এর বেশ কয়েকবছর পর ২০১২ সাল নাগাদ হ্যারি পটারের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে প্রকাশ পায় লেখিকার নতুন বই “ক্যাজুয়্যাল ভ্যাকেন্সি (Casual Vacancy)”। এই বইটিও দারুণ প্রশংসা কুড়ায় পাঠক সমালোচক মহলে।
২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফোর্বস পত্রিকা তার সম্পত্তির পরিমাণ £৫৭৬ মিলিয়ন (১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কিছু বেশি) বলে তথ্য প্রকাশ করেছে, যা তাকে বই-লিখে বড়লোক হওয়া প্রথম বিলিয়নিয়ার (আমেরিকান ডলারে) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।২০০৬ সালে ফোর্বস পত্রিকা তাকে অপরাহ উইনফ্রের পর পৃথিবীর দ্বিতীয় সেরা মহিলা ধনী হিসেবে তথ্য প্রকাশ করেছে।
বই হোক বা সিনেমা, বিশ্বজুড়ে হ্যারি পটারের সিরিজের অন্ধ ও গুণমুগ্ধ ভক্তের সংখ্যা কম নয়। দেশে বিদেশে রয়েছে হ্যারির অগণিত ফ্যান। অসামান্য এই আধুনিক রূপকথার সাফল্যের আড়ালেই লুকিয়ে আছে তার স্রষ্টার দুঃখ-কষ্টে ভরা এক অজানা অন্ধকার জীবনকাহিনি, তাঁর হার না মানা জেদের গল্প। সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা, আর ইতিবাচক জীবনদর্শন যে একটা মানুষকে খাদের ধার থেকে তুলে এনে জীবনযুদ্ধে জয়ী করতে পারে, বসাতে পারে বিজয়ীর সিংহাসনে- তারই সার্থক উদাহরণ যেন জে কে রাউলিং-য়ের জীবন।
বৃটিশ লেখিকা ও সিনেমার চিত্রনাট্যকার জোয়ান রাওলিং এর জেকে রাওলিং ছদ্মনাম নেয়ার পেছনেও কিন্তু একটা ইতিহাস আছে । একজন মহিলার লেখা বই কম বিক্রি হতে পারে এই কারনে তিনি তাঁর মূল নামের বদলে শুধুমাত্র আদ্যক্ষর দিয়ে তাঁর ছদ্মনামটি তৈরী করেন। তাঁর মূল নামের সাথে কোনও মধ্যবর্তী নাম (middle name) না থাকলেও তিনি ছদ্ম নামের সাথে ‘K’ অক্ষরটি যোগ করেন তাঁর দাদী ক্যাথরিনের সম্মানে।
এত এত সাফল্যের পরও রাউলিং খুবই সাধারন জীবনযাপনের চেষ্টা করেন। রাওলিং এর সবথেকে প্রশংসিত দিক গুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে তিনি এত সাফল্যের পরও নিজের অতীত ভুলে যাননি। রাওলিং এর মতে মানুষের জীবনের দুঃখকষ্টগুলোই তার জীবনে সফল হওয়ার সবথেকে বড় অনুপ্রেরণা হতে পারে যদি সে সেগুলোকে মেনে নিয়ে নিজের উন্নতির উদ্দেশ্যে কাজ করে যেতে পারে। পৃথিবীতে অনেক লেখকই আছেন যাঁরা ‘মুড’ না থাকলে কাজ করতে পারেননা। খাওয়া থাকা, সবকিছু ঠিক মত না চললে তাঁদের কলম দিয়ে লেখা বের হয় না। রাওলিং কিন্তু তাঁর জীবনের সবথেকে কঠিন মূহুর্তে তাঁর সৃষ্টিশীলতার জাগরণ ঘটিয়ে তাঁর জীবনের সবথেকে সেরা কাজটি করে তাঁর নিজের কথাকেই সত্যিতে পরিনত করেছেন। তাঁর জীবন থেকে শুধু লেখক নন, আমাদের সবারই কিছু শেখার আছে।
তথ্য : আন্তর্জাল, উইকিপেডিয়া।
