ঘরের কথা
ঘরের কথা
কাল ঠিক এইসময় অর্থাৎ কিনা সন্ধ্যাবেলায় আমাদের এই স্বল্প সময়ের পরিচিত বন্ধুটিকে চিরতরে বিদায় জানাতে হবে। হয়তো বা পরে দেখাও হতে পারে,কিন্তু এমনিভাবে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার সম্ভাবনা যে খুবই কম। এই অল্পকালে গড়ে ওঠা কত বেদনাময় স্মৃতি, আলো- আঁধারের মাঝে কত কত পথ একসাথে চলা, বলা - না বলা কত মনের কথা, কত কত রাতজাগা স্বপ্ন, কত সুপ্ত ইচ্ছা মনের সবকিছুই নিমেষের মধ্যে যেন অতীত হয়ে যাবে। মন যেন কিছুতেই এই কঠিন সত্যকে মেনে নিতে পারছে না। বিদ্রোহ করেও ওই কঠিন সত্যকে পরাস্ত করার চেষ্টা যে বৃথাই, তা অনুভব করেই হয়তো আমার অন্তঃকরণ নিজেকে একেবারে অশান্ত করে তুলেছে , ঠিক যেন শান্ত সমুদ্রের মাঝে হঠাৎই কোনো দুষ্ট আত্মা বিধ্বংসী প্রলয়ের আহ্বান জানিয়েছে।
এখন কৌতূহলী পাঠকমহলে একটি প্রশ্ন অবশ্যই জাগবে। কি কারণে শুরুতেই এমন অস্বস্তিকর উপস্থাপনা করা হল? রচনার শুরুটাই যদি এরূপ বিষাদময় হয়, তবে রচনার আদ্যোপান্ত না জানি কতটা বিরক্তিকর হবে! না, না, এমনও তো হতে পারে রচনাটির প্রথম অংশটিতেই কেবল বিষাদের প্রলেপ পড়েছে কিন্তু বাকি অংশটি বেদনাময় স্মৃতিতে পরিপূর্ণ! এমন কত কত সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে তা হয়তো কোনো গনিতবিদই নির্নয় করতে পারেন। আমি লেখক, গনিতের বিন্দু- বিসর্গ কিছুই বুঝি না। অতএব কোনো যুক্তিসম্মত উত্তর আমার কাছে নেই। তবুও পাঠকমহলে আমার একটিই অনুরোধ যেন আপনারা রচনাটি অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে পাঠ করেন।
আমাদের সংসারে শুধু আমি ও আমার মা। অতএব এই বিশেষ দ্রষ্টব্য শোনার পর পাঠক সহজেই অনুমান করতে পারবেন যে আমাদের সংসারটা কতটা বৃহৎ আকৃতির। সুতরাং আমাদের সংসার সম্বন্ধে যদি কেউ জানতে বিশেষ আগ্রহী হন, তবে দু- একটি কথা খরচ করলেই যথেষ্ট। আশা করি আমাদের সংসারও সর্বসমক্ষে নিজের এরূপ অতিকায় আকৃতির বর্ননা দিতে লজ্জা বোধ করবে।
সে যাই হোক, এবার রচনার মূল অংশে অর্থাৎ ঘরটির প্রসঙ্গে আসা যাক। হ্যাঁ, এই ঘরটিতেই গত তিন মাস যাবৎ আমি ও আমার মা আছি। লোকে প্রশ্ন করলে বাড়ির অধিপতি বলেন যে ওরা কয়েক মাস হল ভাড়া এসেছে। অতএব বুঝতেই পারছেন যে এটা আমার পৈত্রিক সম্পত্তি নয়। এখানে আমরা কিছুদিনের জন্য ভাড়া ছিলাম মাত্র। ছিলাম বললে হয়তো খুবই ভুল হবে, কেননা আমরা এখনও এই বাড়িতেই আছি। অতএব কাল সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত আছি বলাটাই শ্রেয়। নতুবা কাল( সময়) পরিমাপে যে আমি একেবারেই অজ্ঞ, তা পাঠকের সূক্ষ দৃষ্টিতে অতি সহজেই ধরা পড়বে। অতএব এরকম ভুল আমি সচেতন মনে করতে পারি না।
যদিও পাঠকের আনুবীক্ষণিক দৃষ্টি এড়িয়ে আমি ইতিমধ্যেই যে আমার কাল পরিমাপের ক্ষেত্রে সামান্য মাত্রায় অজ্ঞতার প্রমাণ দিয়েছি পাঠক ইতিমধ্যেই তা জানতে পারবেন। আমি ও আমার মা প্রায় তিন মাস হল এ বাড়িতে আছি। তিন মাস মানে প্রায় নব্বইটা দিন। এখন নব্বই দিন আমার কাছে তথাপি গোটা মনুষ্যজাতির কাছে কিছুদিন মনে হলেও সময় পরিবার নব্বই দিনকে কিছুতেই কিছু দিনের আওতায় ফেলতে পারবেন না।
অতএব, পৃথিবীতে বসবাসকারী ওই বিশেষ পরিবারটির কাছে আমি বিশেষভাবে লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থীও আমার কাল পরিমাপের এরূপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্য । নব্বই দিন অর্থাৎ প্রায় তিন মাস আমার কাছে খুব বেশি না হলেও এই সময়টাকে যদি সময় পরিবারের ক্ষুদ্র সদস্যটি গুনতে শুরু করে তবে তা কিরূপ দৈত্যাকার চেহারা নেবে সেটা হয়তো সেই বলতে পারবে। আমি কিঞ্চিৎ অনুমান করতে পারি মাত্র। সময় পরিবারের এই ক্ষুদ্র সদস্যটিকে ফাঁকি দেওয়া বেজায় মুশকিল। তার কাজের প্রতি সততা ও দ্রুততার কাছে আমি বরাবরই পরাজিত। আমি তাকে ফাঁকি দিয়ে সামান্য মাত্রায় বিশ্রাম নিলেও সে যে সর্বদাই সততার সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করেছে এ ব্যাপারে আমি একেবারেই নিশ্চিত। বোধ করি গোটা জগতের সকল জড় ও জীব এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে সহমত হবে। ইতিমধ্যেই আমি গোপন সূত্রে জানতে পেরেছি যে, এই ক্ষুদ্র সদস্যটিই জগতে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনার আয়-ব্যয়ের হিসাব তার অফুরন্ত মেমোরিতে সঞ্চিত রাখে। বোধ করি আমার সব সময়ের আয়-ব্যয়ের হিসাবও তার কাছেই রয়েছে। অতএব আমি ঈশ্বরের আশীর্বাদ ধন্য সময় পরিবারের এই লক্ষী ছেলেটিকে ফাঁকি দিয়ে কোনো
মিথ্যা কথা পাঠককে বলতে পারব না পাছে ইনি এসে আমার সব কুকীর্তি ফাঁস করে দেন।
আমি এই পুরো সময়টা রবি ঠাকুরের বিভিন্ন গল্প পড়ে অপচয় করেছি।হ্যাঁ, অপচয়ই করেছি। তবে কিভাবে অপচয় করেছি তা সংক্ষেপে বলা আবশ্যক নতুবা পাঠক মহলে অহেতুক এক বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। সময় পরিবারের সকল সদস্য নিজেদের সবসময় পার্থিব কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন বহির্জাগতিক কাজেও ব্যস্ত রাখে আর তার একটিমাত্র কিন্তু নিষ্ঠুর দাবি এই যে জগতের প্রত্যেকেই যেন তার এরূপ নিষ্ঠুর নিয়মকে বিনাবাক্যে স্বীকার করে নেয় নতুবা তাকে কঠিনতম শাস্তি দেওয়া হবে। বলাবাহুল্য জগতের প্রত্যকেই কোনো না কোনো অবস্থায় তাদের নিয়মকে লঙ্ঘন করতে চেষ্টা করেছে। তখনই তারা যথাযোগ্য শাস্তি পেয়েছে।কিন্তু আমি কোনোকালেই এই নিয়মকে মান্যতা দিইনি। কেননা তাদের এরূপ ব্যস্ততা আমার চিরকালই অপছন্দের। বোধ করি এই কারণেই তারা আমাকে তাদের হৃদয়ভেদী, সুতীক্ষ্ণ তির দিয়ে বারেবারে আঘাত করে তাদের শাস্তি প্রদান করে।
এবার সময়ের নিষ্ঠুর দাবি ছেড়ে আমাদের ঘরের সুমধুর দাবি সম্বন্ধে পাঠককে জানানো যাক। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, ঘরটি যে খুব বড়ো আকারের তা নয়, তথাপি আমাদের দুজনের থাকার জন্য যথেষ্ট।তবে দুজন বললে হয়তো ভুল হবে, ঘরটি আপাতত চারজনের। কেননা আমি ইতিমধ্যেই আরও দুজনের উপস্থিতির প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছি। দুজন মহান দেবদেবী তাদের সূক্ষ শরীরে আমাদের ঘরে আমাদের সাথেই থাকে। চলুন তাদের সাথে একটু পরিচয় করিয়ে দিই। প্রথম জন হলেন অর্থদেব আর অপরজন বিবাদ দেবী। গোপন সূত্রে জানা গেছে যে তারা নাকি জন্ম- জন্মান্তরের সঙ্গী। একে অপরকে ছাড়া এক মূহুর্তও চলতে পারেন না। কি অপূর্ব তাদের প্রেমকাহিনী! ঠিক যেন রাধাকৃষ্ণ। এখানে অর্থদেবের বিবরণ কিছু সবিস্তারে বলা আবশ্যক। ইনি দেব-দেবীদের মধ্যে অত্যন্ত প্রাচীন। তাই সকল আধুনিক দেবগণ এই দেবতাকে বয়স ও অভিজ্ঞতার খাতিরে অনেক সমীহ করে চলেন। তবে বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পাওয়া গেছে যে শনিদেব নাকি এই দেবতার নামে বেশ কিছুটা ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। তবে প্রকৃত কারণ সকলেরই অজানা। তবে এদিক- ওদিক থেকে দু- চার কথা শোনা যায় এ ব্যাপারে। অর্থদেব একটু বিচিত্র মানসিকতার। এই প্রাচীন দেবতার দুটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যে আছে যার মধ্যে একটি হল এই দেবতা যে স্থানেই বিরাজ করেন, সে স্থানেই তার নামের কোনো বস্তুই টিকতে পারে না। আর দ্বিতীয়টি হল এই দেব প্রচন্ড আগ্রাসী তার সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে। গোটা পৃথিবীটাই যেন তার বিচরণক্ষেত্র।তবে তার কোষাগার পূর্ন করার জন্য এই মহান দেবতাকে পার্থিব মানুষের সংসারের ওপর নির্ভর করতে হয়। পার্থিব সংসারগুলি থেকেই তিনি তার যেমন ইচ্ছা তেমনি খাজনা আদায় করে থাকেন। দয়া- মায়ার লেশমাত্র তখন তার মধ্যে দেখা যায় না।বন্যার ভরাডুবির মতো কোনো কোনো সংসার তখন ঋনের ভারে দেউলিয়া হয়। এটা বলা আবশ্যক যে, যে মূহুর্তে কোনো সংসার তার সঙ্গ লাভ করতে সমর্থ হয় তারা সেই মূহুর্ত থেকেই নিজেদের করুন পরিনতির কথা ভেবে অতিমাত্রায় শঙ্কিত হয়ে পড়ে, খানিকটা এইচ আই ভি আক্রান্ত এইডস রোগীর মতো। অতএব বুঝতেই পারছেন যে পার্থিব নরনারীরা সবসময় ই অর্থদেবের এরূপ উদার দৃষ্টি থেকে নিজেদের সংসার গুলিকে প্রানপনে রক্ষার চেষ্টা করে প্রতিনিয়ত।অতএব পার্থিব নরনারীগন সপ্তাহে কোনো মতে একটিবার শনিদেবের পূজা করে থাকলেও এই উদার দৃষ্টিসম্পন্ন দেবতাকে সদাই সন্তুষ্ট রাখার জন্য সর্বক্ষণ তার নাম জপ করতে থাকে। আর প্রতিনিয়তই তার পার্থিব ভক্তদের সংখ্যা যেন গুনোত্তর প্রগতিতে বাড়ছে। শনিদেব ও বা এই অন্যায় মেনে নেবে কেন! শনিদেবের কুদৃষ্টিও তো কম শক্তিশালী নয়। কিন্তু একথা সত্যি যে শনিদেবের কুদৃষ্টির তীব্রতা অপেক্ষাও যে অর্থদেবের উদার দৃষ্টি আরও গভীরতর ও তীব্র এবং অধিক প্রভাব- শালী সে কথা বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। অতএব পার্থিব নরনারীরা শনিদেবের চেয়েও এই দেবতার ভয়ে যে অধিকতর ভীত হয়ে থাকে তা বলাই বাহুল্য। সম্ভবত এটিই অর্থদেবের প্রতি শনিদেবের ঈর্ষার কারণ।
এবার বিবাদ দেবী সম্পর্কে কিছু জানা- অজানা তথ্য জেনে নেওয়া যাক। পূর্বেই আপনারা জানতে পেরেছেন যে ইনি অর্থদেবের জন্ম- জন্মান্তরের সঙ্গী। অর্থদেবের সুখ- দুঃখে সবসময়ের একমাত্র সঙ্গিনী ইনি। তবে ওনার প্রকৃত কাজটি সকলেরই অজানা।পূর্বেই বলেছি অর্থদেবের সঙ্গ ছাড়া উনি এক মূহুর্তও থাকতে পারে না। অর্থদেব যতকাল কোনো সংসারে থাকেন বিবাদ দেবীও ঠিক ততদিনই সেখানে থেকে যান তার সঙ্গে। লজ্জা - স্মরণের কোনো বালাই নেই কিনা।
আমি লক্ষ্য করেছি আমাদের এই ঘরে বসবাসের শুরু থেকেই অর্থদেব ও বিবাদদেবী তাদের বসবাস একেবারে পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন। তবে তারা কিভাবে আমাদের এই ঘরের সন্ধান পেল, কেই বা তাদের সন্ধান দিল এ বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। তবে আমি নিশ্চিত যে তারা নিশ্চয়ই তাদের সূক্ষ শরীরে এ গৃহে বাস করেন। তবে এই মহান দেবদেবীর আমাদের ঘরে উপস্থিতি সম্পর্কে কোন গাণিতিক প্রমাণ না দিতে পারলেও মৌখিক প্রমাণ সামান্য মাত্রায় ব্যাখ্যা করতে পারি। যেমন ধরুন আমি নিজে এই তিন মাসে মোট যত অর্থ রোজগার করেছিলাম বাড়ির মালিক গলায় পা দিয়ে তা আমাদের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে আর মা তো চিরকালই খেটে মরে, অর্থের বিন্দুবিসর্গ ধরা দেয় না। অতএব এর থেকেই অর্থ দেবের উপস্থিতি নিশ্চিতরূপে প্রমাণ হয় আর এই তিন মাসের মধ্যে এমন একটি দিনের সন্ধান পাওয়া দুঃসাধ্য যেদিন আমার সঙ্গে মায়ের বিবাদ বাধেনি। কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে এক - দু পশলা বিবাদ হয়েই যেত। অর্থাৎ বিবাদ দেবীও উপস্থিত। তবে জানিয়ে রাখি আমি ইতিমধ্যেই আরও এক প্রকার দেবতার সন্ধান পেয়েছি। তিনি হলেন পীড়নদেব। এই দেবতার বিশেষ নাম শুনেই আপনারা আন্দাজ করতে পারছেন যে এই মহান ব্যক্তিটির বৈশিষ্ট্য কি হতে পারে। আমি পাঠকের আশ্বাস কিছুমাত্র বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এটা জানাবো যে তাদের ধারণা একেবারেই ভ্রান্ত। এখন আমি নিশ্চিত যে পাঠক এতক্ষণে নিশ্চয়ই উতলা হয়ে উঠেছেন। হঠাৎ কেন আমি এইরকম একটা উৎকট নামের দেবতার প্রসঙ্গ উত্থাপন করলাম। তিনি আবার কোত্থেকে হাজির হলেন,কী তার পরিচয় ইত্যাদি ইত্যাদি।আমি নিশ্চয়ই তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব। বাড়ির মালিক ঘরের ভাড়া আদায়ের জন্য যেরূপ অত্যাচার শুরু করেছেন তাতে আমাদের এ গৃহে টিকে থাকাটা ক্রমেই দুঃসহ হয়ে পড়েছে। তার অত্যাচারে যে আমরা কিভাবে পীড়িত হয়ে চলেছি দিনের পর দিন তার হিসেব একমাত্র পীড়নদেবই জেনে থাকবেন কারণ তিনি এরূপ অদ্ভুত নামের অধিকারী হলেও তার হৃদয় যে আর পাঁচটা প্রতিষ্ঠিত দেবতার চেয়েও অধিকতর দয়ালু সে ব্যাপারে আমি একেবারে নিশ্চিত। পরের পীড়নে এই একটিমাত্র দেবতাই অতিশয় কাতর হয়ে পড়েন। এই তিনমাসে কোনো কোনোদিন একবেলা ভাত জুটেছে তো কোনো কোনো দিন অনাহারেও কাটাতে হয়েছে। এই অবস্থা দেখে পীড়নদেবও বেশ ব্যাথা পান। তবে তার কৃপা দৃষ্টি সকলের ওপর সমভাবে বন্টিত। এই ধরুন বাড়ির মালিকের ওপরই পীড়নদেবের কৃপা দৃষ্টির একটি নমুনা। তিনিও সদাই মনে মনে এটা ভেবে পিড়িত হন যে তার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম আতিথেয়তার ভার আমাদের যদি সহ্য না হয়, আমরা যদি ভাড়া ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে ফেলি তাই তিনি যথাসম্ভব মিষ্টি সুরে আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন। তখন যেন মনে হতো জীবনে বুঝি কোনদিনই তেতো কিছুর স্পর্শই করেননি কিন্তু বাড়ি ভাড়া আদায়ের সময় যে তিনি সামান্য হলেও তেতো খেয়ে আসতেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই পীড়নদেব বাড়ির ঠিক কোন ঘরটিতে থাকতেন যেমন আমাদের ঘরে নাকি মালিকের আরও দুটি ঘরের যেকোন একটিতে, সেটা অনুমান করা কোন কঠিন কাজ হবে না। কেননা কোনো অবস্থাতেই পীড়নদেব আমাদের ঘরে স্থান নিতে পারবেন না কারণ ইতিমধ্যেই অর্থদেব তার জন্ম জন্মান্তরের সঙ্গিনী বিবাদদেবীকে নিয়ে সুখে- শান্তিতে আমাদের ঘরে বসবাস করতে শুরু করেছেন। অতএব কোনমতেই বিবাদদেবী পরপুরুষকে নিজের ঘরে স্থান দিতে পারবেন না পাছে তার সতীত্ব ক্ষুন্ন হয়। এর থেকেই এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে পীড়নদেব নিশ্চয়ই মালিকের যে কোন একটি ঘরেই স্থান লাভ করেছে । তাই বুঝি তিনি মালিকের ওপর একটু অধিকতর কৃপাদৃষ্টি বর্ষন করেন। সে যাই হোক আমাদের এই সমস্ত মহান দেবদেবীকে নিয়ে ঘরটা বেশ ভালই আনন্দে ছিল। ঘরের মাঝে যে আলোটা স্বল্পকাল হল জ্বলে উঠেছিল, যে আলোতে এই বিশ্বাসঘাতকতাটা দৃষ্টি ফিরে পেয়েছিল। আর সেই দৃষ্টি দিয়েই আজ আমাদের এরূপ অবস্থা দেখে উপহাস করার নানারূপ চেষ্টা করছে। এই বিশ্বাসঘাতকটাই অতি সন্তর্পণে অর্থদেব ও বিবাদদেবীকে এঘরে স্থান দিয়েছে এ খবর আর অজানা নয় আমার কাছে। জানিনা এরকম কত দেবদেবী এ ঘরে লুকিয়ে আছে। সবাই কি তাহলে এরূপ অবস্থা দেখে কৌতুক করছেন! তবে যদি সকলেই কৌতুক করে থাকেন তবে তাদেরকে ও এই বিশ্বাসঘাতক ঘরটাকে জানাবো যে তাদের সমস্ত কৌতুকের দিন শেষ হয়ে এসছে। কাল সন্ধে সাতটায় হয়তো চিরকালই শেষ হয়ে যাবে। কারণ আমাদের বিদায়ের সাথে সাথেই তাদের মৃত্যু ঘটবে। একথা তো তাদেরও অজানা নয়। তবুও আজ যেন এই বিশ্বাসঘাতকটার প্রতি মায়া আরও তীব্রতর হয়ে উঠেছে কেননা কাল সে অন্ধ হয়ে যাবে। যে আলোতে সে দেখেছিল কিছুকাল, সে আলোও হঠাৎই নিভে যাবে। যে জানলা দিয়ে সে কিছুকাল মুক্ত শ্বাস গ্রহণ করেছিল সেই জানলাও কাল বন্ধ হয়ে যাবে। কিভাবে তখন বেঁচে থাকবে সে! কোন উত্তর না পেয়ে আমার মনটা আজ বড়ো অশান্ত হয়ে উঠেছিল।