একটি পাখি ও ডলফিন
একটি পাখি ও ডলফিন
চট্রগ্রামের শাহাবাড়ি এলাকার একটি মাঠে কয়েকজন বাচ্চা ছেলে মেয়ে মনের আনন্দে চিৎকার,চেচামেচি আর লাফালাফি করছে৷বাচ্চাগুলো, যে খেলায় মেতে উঠেছে তার কোন বাধাধরা নিয়ম নেই৷বাচ্চারা কখোনই খুব বেশি নিয়ম কানুন তোয়াক্কা করে খেলতে পারেনা৷নিয়মের জালে বন্দি হতে সম্ভবত কোন বাচ্চাই চায়না৷ওরা হয় বাধন হারা এবং ছটফটে স্বভাবের৷সেই সকাল থেকেই ওদের খেলাধুলা শুরু হয়েছে যা দুপুর পর্যন্ত স্থায়িত্ব পেয়েছে কিন্তু ওদের বাবা-মা এখনো খোঁজ করতে আসেনি৷ওদের কারো গায়েই ঠিক মত জামা কাপড় নেই৷বেশ ময়লা লেগে থাকা খালি গায়ে ওরা দিকবেদিক মনের সুখে ছুটে বেড়াচ্ছে৷এই বাচ্চাগুলোর অবস্থা দেখে স্পষ্টই বুঝা যায়,ওরা চরম দরিদ্র পরিবারের সন্তান এবং সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠি যাদের বেশির ভাগই বস্তিতে গাদাগাদি করে বসবাস করে৷বস্তিতে থাকা অধিকাংশ মানুষই তার সন্তানদেরকে বাড়িতে রেখে প্রতিদিন কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে যার ফলে তাদের সন্তানরা কি করছে,কই যাচ্ছে বা কার সাথে মিশছে ঐ বিষয়ে কোন খোঁজ তাদের কাছে থাকে না৷বস্তির বেশির ভাগ বাচ্চারা একত্রে শাহাবাড়ির মাঠটিতে নিয়মিত খেলাধুলা করে ৷খেলাধুলার পাশাপাশি বাচ্চাগুলো আরো একটি কাজ করে আর সেটি হলো,“ কাগজ কিংবা ময়লা টোকানো”৷ ওদের কাছে কাগজ আর ময়লা টোকানোর জন্য আদর্শ জায়গা হলো,শাহাবাড়ি মাঠ সংলগ্ন ময়লার স্তূপ যেখানে কাগজ ও উচ্ছিষ্ট থেকে শুরু করে পলিথিন সবই স্তূপ করে প্রতিদিন ফেলে রাখা হয়৷
পাখি,শাহাবাড়ি বস্তিতে জন্মলগ্ন থেকেই বসবাস করে৷পাখির বাবা ভ্যান চালায় আর মা মানুষের বাড়িতে গৃহপরিচালিকার কাজ করে৷পাখির বাবা-মা দুজনই প্রতিদিন সকালে পেটের দায়ে বেরিয়ে পরে৷পাখি, বস্তির অন্যান্য বাচ্চা ছেলে মেয়েদের সাথে মাঠে খেলাধুলা করে আর সকাল বিকাল ময়লার স্তূপ থেকে উচ্ছিষ্ট,কাগজ আর পলিথিন টোকায়৷দুপুরে পাখির মা কিছু সময়ের জন্য এসে পাখিকে কাজের বাড়ি থেকে দেয়া খাবার খাওয়ায় আর নিজে দুমুঠো ভাত নাকে মুখে খেয়ে মেয়েকে রেখে দ্রুত আবার কাজে ফিরে যায়৷পাখির বয়স কিছুদিন আগে সাত পেরিয়ে আট হয়েছে৷এই বয়সেও বস্তির অন্যান্য বাচ্চাদের মত পাখির স্কুলে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি যার কারণ সীমাহীন দারিদ্রতা আর শিক্ষার ব্যাপারে উদাসিনতা৷
কোন এক বৈশাখের সন্ধায় বেশ গরম অনুভূত হচ্ছে৷পাখি সারাদিন পর তীব্র ক্লান্তি নিয়ে বাসায় এসে বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিয়েছে৷এর কিছুক্ষণ পর কাকতালিয় ভাবে ওর বাবা-মা দুজনই একই সময় বাসায় উপস্থিত হলো৷তারা বাসায় প্রবেশ করে দেখলো পাখি শুয়ে আছে৷সাধারণত এমনটা হয়না,পাখির কখনোই সন্ধায় ঘুমানোর নজির নেই৷পাখির বাবা-মা ওর কাছে গিয়ে দেখল,পাখির অনেকটা বেহুশের মত অবস্থা৷খানিক্ষণ পর পাখি ওর মায়ের কোলে বমি করে দিল৷পাখি বলল,ওর নাকি মাথা ঘুরাচ্ছে৷মাথা ঘুরানোর কথা বলতে বলতে সে বেহুশ হয়ে পরলো৷পাখির বাবা-মা অস্থির হয়ে পরলো৷কি থেকে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিলনা৷পরে তারা সিদ্ধান্ত নিলে তাদের একমাত্র মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে৷একটা সি,এন,জি যোগে পাখিকে চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হলো৷জরুরি বিভাগে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়ার পর পাখিকে শিশু বিভাগে ভর্তি নেয়া হলো৷রাত-ভোর পাখির চিকিৎসা চলল৷ডাক্তারের প্রচেষ্টায় রাতেই পাখির হুশ ফিরে আসলো৷সেই রাতেই জরুরি ভিত্তিতে পাখির কিছু পরিক্ষা নিরিক্ষা করা হয়৷পরদিন সকাল পেরিয়ে বিকেল পর্যন্ত পাখির বাবা-মা দুষ্চিন্তার অতল সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকে৷পরে ডাক্তারের রুমে ডাক পড়ে তাদের৷ডাক্তার তাদের সামনেই রিপোর্টগুলোকে অনেক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করেন৷বেশ কিছু সময়ক্ষেপনের পর ডাক্তার বলেন,“আপনারা কি পাখির বাবা-মা”?ওনারা উত্তর দিলেন,“জ্বি স্যার”৷ডাক্তার আবার বলা শুরু করলেন,“দেখেন আপনারা বাবা-মা আপনাদেরকে বিষয়টা খুলে বলি,পাখির শারিরির অবস্থা খুব বেশি একটা ভালো নয়৷ওর ব্রেনে টিউমার আছে৷আর সেই টিউমার থেকে ইতিমধ্যে ক্যান্সার হয়ে গেছে এবং কি ক্যান্সার ওর ব্রেনকে পুরোপুরি এফেক্ট করছে”৷এই কথা শুনে পাখির বাবা-মা স্তম্ভিত,বাকরুদ্ধ এবং তাদের চোখে বাজঁ পড়ার মত বোবা দৃষ্টি৷ডাক্তার আরো বলল,“দেখেন আপনাদেরকে শক্ত হতে হবে৷ক্যান্সার যেই পর্যায়ে আছে সেখান থেকে খুব বেশি আশার আলো দেখতে পাচ্ছিনা, বাকি সব কিছু আল্লাহ্ ভালো জানেন”৷ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে পাখির বাবা-মা যেনো তাদের সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন৷পাখির মা তার স্বামিকে জড়িয়ে ধরে বাধ ভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পরে তাছাড়া পাখির বাবাও তার একমাত্র মেয়ের এই করুণ পরিণতিতে নিজেকে সামলে রাখতে পারলেননা,হাসপাতালের বারান্দায় তিনিও চিৎকার করে কেদেঁ উঠলেন৷একমাত্র সন্তান,এই রকম মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হবে তা তারা ঘুনাক্ষরেও আচঁ করতে পারেনি৷ফলে চট্রগ্রাম মেডিকেলের শিশু বিভাগের বারান্দায় এক মর্মাহত চিত্র ফুটে উঠল যেখানে অসহায় মা-বাবা তাদের সন্তানের ভবিতব্য পরিণতির কথা চিন্তা করে বিলাপ করতে থাকল৷
পাখি বেশ কয়েকদিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে৷ওর বাবা-মা ওকে বুঝতে দেয়নি যে ও এত বড় বিপদকে সাথি করে চলছে৷এর মাঝে খবর পাওযা গেলো শাহাবাড়ি বস্তির আরো দুই শিশু গত কয়েকদিনে শিশু বিভাগে ভয়াবহ অসুস্থতা নিয়ে ভর্তি হয়েছে৷একদিন পর ডাক্তার পাখির বাবা-মাকে ডাকলেন৷তারা গিয়ে দেখলেন ডাক্তারের চেম্বারে তাদের বস্তিরই প্রতিবেশি কয়েকজন উপস্থিত আছে৷ডাক্তার সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,“আচ্ছা আপনারা আমাকে কিছু কথা বলেনতো৷আপনাদের বাচ্চারা কি একসাথে খেলাধুলা করে”?বস্তি থেকে আগতরা উত্তর দিল,“জ্বী স্যার ওরা এক সাথেই খেলে৷ডাক্তার আরো প্রশ্ন করলো,“আচ্ছা বাচ্চারা কি খেলা ধুলা ছাড়া অন্য কোন কিছু করে?দেখুন সত্যি করে বলবেন৷সত্যি জানাটা খুবই জরুরি”৷বস্তির বাসিন্দারা উত্তর দিলো,“সত্যি কইতে স্যার,বাচ্চারা মাঝে মাঝে যেই মাঠে খেলে ঐ মাঠের পাশে একটা ময়লার স্তূপ আছে,সেইখানে ওরা ময়লা আর পলিথিন টোকায়৷পাশে কিছু ভাঙ্গারির দোকান আছে ঐ খানে টোকানো জিনিস বিক্রি করে”৷ডাক্তার বিস্ময় নিয়ে বলল,“আচ্ছা ওরা কি পলিথিন পোড়ায়”?বস্তিবাসী বলল,“না স্যার ওরাতো পলিথিন পোড়ায় না,ওরাতো পলিথিন বিক্রি করে কিছু টাকা রোজগাড় করে”৷ডাক্তার বলল,“বুঝছি আমাকে বাচ্চাগুলোর সাথে কথা বলতে হবে,আপনারা বাচ্চাগুলোর সম্পর্কে জানবেন কি করে!আপনারাতো ওদেরকে নামকাওয়াস্তে রেখে প্রতিদিন কাজে চলে যান৷এরপর বাচ্চারা কি করে,কই যায় তারতো কোন খোঁজও নেননা”৷ক্রন্দণরত পাখির বাবা-মা সহ উপস্থিত বাকি বল্তিবাসিরা ডাক্তারের কথা শুনে মাথা নিচু করে রাখল৷মাথা নিচু করা ছাড়া তাদের আর কোনো জবাব নেই৷পাখিসহ বস্তির বাকি দুই শিশুর সাথে কথা বলার জন্য ডাক্তার চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেল৷ডাক্তার যখন শিশু ওয়ার্ডে ঢুকল তখন পাখি মনটা ভীষন খারাপ করে শুয়ে আছে৷বেশ কয়েকদিন হলো সে হাসপাতালের চারদেয়ালে বন্দি তাই বাহিরের হাওয়া বাতাসের স্পর্শ পাওয়ার আকুলতা তাকে ভর করেছে৷পাখি ও তার বাকি দুই খেলার সাথিকে ডাক্তারের মুখোমুখি বসান হলো৷ডাক্তার পাখির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,“ মা ,আমি শুনেছি তুমি খুবই লক্ষী একটা মেয়ে৷তোমার বাকি দুই বন্ধুও খুব লক্ষী৷আমি শুনেছি তোমরা যে মাঠে রোজ খেলাধুলা করো তার পাশে নাকি একটা ময়লা রাখার জায়গা আছে আর সেখান থেকে নাকি তোমরা ময়লা আর পলিথিন টোকাও৷আচ্ছা তোমরা তিনজনই লক্ষী বাচ্চার মত বলতো,তোমরা কি পলিথিন আগুনে পোড়াও”?পাখি বলে উঠল,“না স্যার আমরা তো পলিথিন,ময়লা এগুলা পুড়াইনা৷এগুলা আমরা বিক্রি করে যা টাকা পাই তা দিয়া চকলেট খাই,আইসক্রিম খাই”৷পাখির বোকা বোকা কথা শুনে ডাক্তার হেসে ফেলল৷ডাক্তার বলল,“সত্যি তো!তোমরা পলিথিন আগুনে পোড়াও না”?পাখির পাশে বসে থাকা ওর খেলার সাথি সোহেল বলে উঠল,“স্যার আমরা পুড়াইনা কিন্তু ঐখানে যেইসব পলিথিন পইরা থাকে সেইসব পলিথিন প্রতিদিন আগুনে পুড়ানো হয়”৷পাখি আর সোহেলের আরেক জন বন্ধু জবা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,“জ্বী স্যার প্রতিদিন আমরা যখন খেলি তখন আমাগো পাশেই পলিথিনগুলা পুড়ায়,কয়েকটা পোলা মিল্লা অনেক্ষণ লাগায়া পুড়ায়”৷এবার পাখি বলে উঠল,“স্যার,পলিথিন পুড়াইলে অনেক ধোয়া আর খারাপ গন্ধে আমাগো খেলার মাঠ ভইরা যায়৷স্যার, ধোয়ায় আমগো প্রতিদিন খেলতে সময্যা হয় তারপরও আমরা ঐ ধোয়ার মধ্যে খেলি”৷ডাক্তার তার উত্তর পেয়ে গেছে৷সে দ্রুত তার চেম্বারে চলে যায়৷চেম্বারে অপেক্ষমান পাখি,সোহেল আর জবার পরিবারের সদস্যদেরকে ডাক্তার জানায়,“পাখি,সোহেল আর জবার অসুস্থতার মূল কারণ পলিথিন পোড়ানোর বিষাক্ত ধোয়া আর গন্ধ”৷ডাক্তার সহজ ভাষায় তাদেরকে বুঝায়,মাত্রাতিরিক্ত পলিথিন পোড়ানোর ধোয়া যদি কারো শরিরে নিয়মিত প্রবেশ করে তাহলে এই ধোয়া থেকে শরিরে ক্যান্সার,টিউমার এবং কি ফুসফুসে মারাত্বক সমস্যা হতে পারে৷ডাক্তার বললেন,“পাখির ব্রেন ক্যান্সার,সোহেলের টিউমার আর জবার ফুসফুসের সমস্যা পলিথিন পোড়ানোর ধোয়া থেকে সৃষ্টি হয়েছে”৷ডাক্তারের কথা শুনে বস্তিবাসি মা-বাবারা চূড়ান্ত বিস্ময় নিয়ে কেদেঁ উঠলো৷পলিথিন পোড়ানোর ধোয়া থেকে তাদের সন্তানদের এত বড় ক্ষতি হবে তা তারা কল্পনাতেও আনতে পারেনি৷সম্পূর্ণ বিষয়টি তাদের ধারণারও বাহিরে৷বাচ্চাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়ে গলো পাখির৷ সোহেলের টিউমার অপারেশন করার পর বুঝা যাবে প্রকৃত অবস্থা আর জবার ফুসফুসের ইনফেকসন হয়তো ধিরে ধিরে সেরে উঠবে৷পাখির বাবা-মা হয়তো পলিথিন পোড়ানোর ধোয়াকে মেয়ের এই করুণ পরিনতির জন্য দোষারোপ করতে পারে কিন্তু তাদের নিজেদের ব্যার্থতাও কম নয় কারণ তারা তাদের একমাত্র সন্তানকে তীব্র অবহেলা আর অযত্নে বড় করছে৷
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার বেশ কয়েদিন পর পাখির বাবা-মা পাখিকে নিয়ে চট্রগ্রামের হালদা নদীর তীরে ঘুরতে যায়৷পাখির মা-বাবা পাখির শেষ দিনগুলোতে চেষ্টা করে যাচ্ছে পাখির ইচ্ছা গুলো পূরণ করতে তাছাড়া বাবা-মা হয়ে সন্তানের প্রতি যে অবহেলা এতদিন তারা করেছে তা থেকে বেরিয়ে এসে এখন তারা একমাত্র সন্তানকে সবসময় আগলে রাখছে৷পাখিকে নিয়ে তারা প্রায়ই ঘুরতে বের হচ্ছে৷জমানো টাকা পয়সা যা ছিলো তার সবই তারা পাখির জন্য ব্যয় করছে৷এত সব করেও আকাশের পথে পাখির চির উড়ান হয়ত থামানো যাবেনা কারণ বড্ড দেরি হয়ে গেছে৷হালদা নদীর পার ধরে প্রকৃতির অপরুপ দৃশ্য দেখতে দেখতে পাখি ও তার বাবা-মা হেটে যাচ্ছে,ঠিক সে সময় তারা তিনজনই দেখতে পেলো, নদীর তীরে বেশ কিছু মানুষের জটলা ৷জটলাটির কাছাকাছি গিয়ে তারা দেখল,একটা ডলফিন মৃত অবস্থায় পরে আছে আর ডলফিনটির রক্তাক্ত মুখে অনেকগুলো দলা পাকানো পলিথিন৷ ডলফিনটি হয়ত ঐ দলাপাকানো বিষাক্ত পলিথিন খেয়ে তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে মারা গেছে৷
