STORYMIRROR

Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational

4  

Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational

দি কার্গিল গার্ল

দি কার্গিল গার্ল

4 mins
233

রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের যাত্রা শুরুর পর প্রথমদিকের একটি প্রতিষ্ঠান ছিল সামরিক আমলাতন্ত্র, যেটি পরিচিত সামরিক বাহিনী নামেও। রাষ্ট্রকাঠামোতে সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনীয়তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় হবসের রাজনৈতিক দর্শনে। হবসিয়ান দর্শনানুযায়ী, প্রাকৃতিক কারণেই একজন মানুষ আরেকজন মানুষের চেয়ে শক্তিশালী হয়। একজন মানুষ আরেকজনের চেয়ে শক্তিশালী শারীরিক কারণে হতে পারে, হতে পারে মানসিক দক্ষতার মাধ্যমেও। কিন্তু, একজন শক্তিশালী মানুষ স্বাভাবিকভাবেই চায় দুর্বল মানুষের অধিকার হরণ করতে, দুর্বলকে প্রাপ্য রাজনৈতিক সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত করতে। অনেক সময় কিছু শক্তিশালী মানুষ একত্রিত হয়ে বিপুল সংখ্যক দুর্বল মানুষের অধিকার হরণ করে।


রাষ্ট্র প্রাতিষ্ঠানিক কারণেই মানুষকে কিছু জন্মগত অধিকার নিশ্চিত করতে দায়বদ্ধ, আধুনিক সময় এসে এই দায়বদ্ধতার সাথে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অধিকার চর্চার নিশ্চয়তা দানের দায়িত্ব। সবলের হাত থেকে দুর্বলের জন্মগত এবং রাজনৈতিক অধিকার জন্য রাষ্ট্র তাই নিজেকে গড়ে তুলেছে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে, অর্জন করেছে সংঘাত তৈরিতে একক কর্তৃত্ব। ফলে, পুকুরের ইকোসিস্টেমে বড় মাছ যেভাবে ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে, সেভাবে সবল মানুষ যাতে দুর্বলের অধিকার হরণ করতে না পারে সেজন্য রাষ্ট্র যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে, সামরিক বাহিনী তার একটি।

ভারতের মতো দেশে অভ্যন্তরীণ এই দায়িত্বের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীকে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে মোকাবেলা করতে হয়, প্রতিনিয়ত যুদ্ধ-পরিস্থিতির মধ্যে দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়। ভারতের সামরিক বাহিনীর এই দায়িত্বের গর্বিত অংশ হয়েছে নারীরা, নিজেদের অধিষ্ঠিত করেছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। এই দায়িত্ববান নারী অফিসারদের একজন, গুঞ্জন সাক্সেনা।


গুঞ্জন সাক্সেনা (Gunjan-Saxena) হলেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রথম মহিলা অফিসার যিনি সহযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শ্রীবিদ্যা রাজনের সঙ্গে ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। গুঞ্জন সাক্সেনা হেলিকপ্টার নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র প্রবেশ করে প্রবল সাহসীকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিবর্ষণের মধ্য দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আহত ভারতীয় সৈন্যদের উদ্ধার করেছিলেন৷


১৯৭৫ সালে ভারতে গুঞ্জন সাক্সেনার জন্ম হয়৷ তাঁর বাবা অনুপ সাক্সেনা এবং ভাই আয়ুষ্মান সাক্সেনা ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন৷ এমন পরিবারে বড় হয়ে ওঠার কারণে অল্প বয়স থেকেই তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন ৷ গুঞ্জন সাক্সেনা একটি সাক্ষাৎকারে তাঁর বাবার সম্পর্কে বলেছেন, “বাবা সবসময় আমাকে আর দাদাকে বলতেন যে তিনি চান আমরা আমাদের তিনচাকার সাইকেল ছেড়ে একদিন যেন এরোপ্লেন চালাই। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় আমার এক আত্মীয় যিনি পাইলট ছিলেন তিনি যখন আমাকে প্লেনের ককপিট দেখান সেদিনই আমি ঠিক করে নিই আমাকে প্লেন চালাতেই হবে একদিন।”


গুঞ্জন সাক্সেনা তাঁর বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করার পর দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের হানসরাজ কলেজ (Hansraj College) থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন৷ কলেজের দিনগুলিতে পড়াশোনার পাশাপাশি বিমান চালনার মূল বিষয়গুলি জানার জন্য তিনি নয়াদিল্লীর সাফদারজং ফ্লাইং ক্লাবে (Safdarjung Flying Club) যোগ দেন৷ বিমান চালনার প্রাথমিক শিক্ষা তিনি এখানেই পেয়েছিলেন।


গুঞ্জন সাক্সেনার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। তিনি আরও ২৫ জন মহিলা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাইলট সহ ভারতীয় বিমানবাহিনীতে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এটিই ছিল মহিলা আইএএফ(IAF) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাইলটদের প্রথম ব্যাচ। তাঁর প্রথম পোস্টিং ছিল জম্মু ও কাশ্মীরের উধামপুরে। প্রবল শারীরিক পরিশ্রম এবং মানসিক চাপের কারণে মহিলাদের যুদ্ধক্ষেত্রে বিমান বা হেলিকপ্টার চালনার জন্য তখন পাঠানো হতনা। কিন্তু ভারত পাকিস্তানের মধ্যে হওয়া কার্গিল যুদ্ধের সময় সেই প্রতিবন্ধকতা ভেঙে যায় এবং তিনি দেশ সেবা করার সুযোগ লাভ করেন৷


১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনী দুটি বড় পরিকল্পনা করেছিল। এই দুই পরিকল্পনার মধ্যে একটি ছিল অপারেশন বিজয় এবং অপরটি অপারেশন সাফেদ সাগর। অপারেশন বিজয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট গুঞ্জন। তিনি আহত সৈন্যদের উদ্ধার করা, যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানের ওপর নজরদারী রাখা এবং দ্রাস ও বাল্টিক সেক্টরে ভারতীয় সেনা ইউনিটগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম সরবরাহ করার দায়িত্বে ছিলেন৷ গুঞ্জন এবং শ্রীবিদ্যাকে এই কাজের জন্যে চেতক হেলিকপ্টার দেওয়া হয়। এই হেলকপ্টার কোনওভাবেই সমরাস্ত্রে সজ্জিত ছিল না। বলা যায় নিরস্ত্র অবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্রে নামতে হয়েছিল গুঞ্জন এবং শ্রীবিদ্যাকে। এমন পরিস্থিতিতে একদিনের ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখ্য যেদিন গুঞ্জন সবে হেলিকপ্টারে উঠতে যাবেন সেইসময় তাঁকে লক্ষ্য করে পাকিস্তানের দিক একটি রকেট উড়ে আসে যেটি সৌভাগ্যবশত লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গিয়ে পিছনের পাহাড়ে আছড়ে পড়ে। যুদ্ধক্ষেত্রে কোনওভাবে গুঞ্জনদের হেলিকপ্টার ভেঙে পড়লে যাতে তাঁরা শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারেন তার জন্য তাঁদেরকে একটি করে ইনস্যাস রাইফেল এবং একটি করে অত্যাধুনিক পিস্তল দেওয়া হয়েছিল। এটাই ছিল তাঁদের একমাত্র সুরক্ষা কবচ।


সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে দেশের জন্য লড়াই করার স্বপ্ন সকলের মনে থাকলেও সে সুযোগ কম জনই পায়। গুঞ্জন তাঁর স্বপ্নের উড়ানকে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন৷ যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে এক অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন গুঞ্জন এবং তাঁর সহযোদ্ধা শ্রীবিদ্যা। গুঞ্জন সাক্সেনাকে ‘কার্গিল গার্ল’ নামে অভিহিত করা হয়৷ কার্গিল যুদ্ধের পর ৭ বছর গুঞ্জন হেলিকপ্টার চালিয়েছিলেন। পরে তিনি যুদ্ধবিমানও ওড়ান কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে বিমান ওড়ানোর স্বাদ আর তিনি পাননি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইতিহাসে গুঞ্জন এবং শ্রীবিদ্যা এক অসামান্য কীর্তির অধিকারিনী হয়েই থেকে গিয়েছেন। তাঁরাই হলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম দুই মহিলা পাইলট যাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রে যোগদান করেছিলেন।

NDTV’র একটি ইন্টারভিউতে তিনি বলেছিলেন, “It was the evacuation of the injured Indian Army soldiers that motivated me the most during the war. I think it is the ultimate feeling that you can ever have as a helicopter pilot. That was one of our main roles there – casualty evacuation. I would say it’s a very satisfying feeling when you save a life because that is what you’re there for.”


কার্গিল যুদ্ধে তাঁর সাহস এবং দৃঢ় সংকল্পের জন্য লেফটেন্যান্ট গুঞ্জন সাক্সেনাকে ‘Shaurya Chakra Award’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়৷ ভারতীয় বিমান বাহিনীর ইতিহাসে প্রথম মহিলা হিসেবে তিনি এই পুরস্কার পেয়েছিলেন। চপার পাইলট (Chopper Pilot) হিসেবে দীর্ঘ সাত বছর দায়িত্ব পালন করার পর গুঞ্জন ভারতীয় সেনা হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন৷ পরবর্তীকালে গুঞ্জন সাক্সেনা একজন আইএএফ অফিসারের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন যিনি পেশায় একজন পাইলট ছিলেন। ২০০৪ সালে তাঁদের একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়৷ বর্তমানে তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে জামনগরে (গুজরাটের একটি শহর) বসবাস করছেন৷ গুঞ্জন সাক্সেনার জীবনী নিয়ে একটি চলচ্চিত্রও নির্মান হয়েছে ৷ অভিনেত্রী জাহ্নবী কাপুর তাঁর চরিত্রে অভিনয় করেছেন।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational