priyonkon chatterjee

Romance

3.3  

priyonkon chatterjee

Romance

ড্যাফোডিল

ড্যাফোডিল

6 mins
10.3K


জুন মাসের মহানগরী। প্রাক্তন সম্পর্ক নিয়ে হওয়া এক বাংলা সিনেমা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেলিত শহরের সিনেমাপ্রেমী মানুষ। আমিও বন্ধুদের সাথে দেখে আসার পর, রাতে চিলেকোঠার ঘরে বসে, ডাউন মেমোরি লেন ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটু পুরোনো কথা ভাবতে বসলাম।

সবার জীবনেই একটা প্রথম হাফ গার্লফ্রেন্ড‪ থাকে। যাকে কেউ সযত্নে স্মৃতিতে বাঁচিয়ে রাখে আর কেউ ক্রাশ বলে কয়েক বছর পর ভুলে যায়। শুধু কোন বর্ষার একলা রাতে 'হাসনুহানা' শুনে মন তোলপাড় করে, আর সেই হারিয়ে যাওয়া মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আজ আমারো হঠাৎ করেই বেশ কয়েক বছর আগের ফেলে আসা এক অতীতের কথা মনে এলো। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই এমনিতে আমি একটু কানহাইয়া টাইপের ছেলে। উঁহু, JNU এর নেতা নয়। পুরাণের কৃষ্ণর কথা বলছি। জীবনে প্রেম বহুবার হাফ, ফুল এমনকি কোয়ার্টার গার্লফ্রেন্ডের রূপে এসেছে। তাও হঠাৎই আজ এই বৃষ্টির রাতে রুমের উফারে গুরুদেব, মানে রুপম'দার একলা ঘর শুনতে শুনতে হঠাৎ সেই মুখটাই ভেসে উঠলো। প্রথম বলেই হয়তো।

ফিরে গেলাম, ক্লাস ইলেভেনের সেই রাতে।

প্রথম আলাপ-

জানিনা টেলিফোন আলাপকে ঠিক আলাপের পর্যায়ভুক্ত করা চলে কিনা। কিন্তু আমার শুরু ছিলো সেটাই।

রাত ১০টা ৪৫। ইংলিশ ব্যাচ থেকে ফিরে ডিনার করে সবে তাপগতিবিদ্যার হোম ওয়ার্ক করছি আর আমার মস্তিষ্কে তাপপ্রবাহ বেড়ে চলছে। উপায়ও নেই। কাল ভোরেই টিউশনে পরীক্ষা। সবে এক সপ্তাহ আগে মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে। আর এখনই এই। হাড়ে হাড়ে বুঝছি সায়েন্স নিয়ে কিরকম ঐতিহাসিক ভুল করেছি। এমন সময় ফোনটা কেঁপে উঠল।

 ”দাদা, ইংলিশে ড্যাফোডিলস এর বড়ো প্রশ্নগুলোর উত্তরের খাতাটা একটু দেবে। চাপ লাগছে।”, আমার স্যামসাং গুরুর ওপারে একটা মেয়ের গলা। সচরাচর আমার মোবাইলে তখন মেয়েদের খুব একটা ফোন আসতোনা। আসলে তখনো কানহাইয়া পর্যায়তে আসিনি। আর এটাই স্বাভাবিক। আমার মত এত সাধারণ ছেলেকে কারাই বা পাত্তা দেবে?

সকালে কার মুখ দেখে উঠেছিলাম কে জানে। “কাস্টমার কেয়ার” এর কর্পোরেট ঘ্যানঘ্যানানি ছাড়া অন্য রকম মিস্টি অথচ স্মার্ট গলা। কিন্তু মেয়েটা কে?। তাও আবার পড়াশোনার দরকারে ফোন। আমি এসবই ভাবছিলাম। এমন সময় আবার অধৈর্য গলা," হ্যালো, শুনতে পাচ্ছো?"

- “কে বলছো? আর কিসের উত্তর? রং নাম্বার”।

-"আরে না না। আমি তিতাস। আজই অসীম স্যারের ব্যাচে তোমার সাথে কথা হলো। তোমার উল্টোদিকে বসেছিলাম।আজই জয়েন করেছি!"

-" ওহ। তা আমার নাম্বার পেলে কিভাবে?"

- "স্যারই বলছিলেন তুমি নাকি ভালো স্টুডেন্ট।কথা শুনে মনে হলো স্যার তোমাকে বেশ ফেভার করেন। তাই তোমার সাথে যে দাদাটা আসে, তার থেকেই তোমার নাম্বার নিলাম। আসলে স্যার নেক্সট সোমবারেই পরীক্ষা নেবে। আর আমি তো লেটে জয়েন করলাম। বাবার ট্রান্সফার জব। সবে এই শহরে এসেছি। তুমি হেল্প করলে ভালো হত!"

একনিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো। আমার মনে পড়লো আজ আমি জুনিয়রদের ব্যাচে পড়তে গেছিলাম। সেখানেই একজনকে নতুন দেখলাম। স্যারের কাছে অনেকদিন ধরে পড়ছি, তাই অলমোস্ট সবাইকে চিনি। অচেনা মেয়েটাকে দেখেই বুঝেছিলাম নতুন এসেছে। আর স্যার আজ ওদের ব্যাচে আমাকে নিয়ে কথা বলছিলেন; মাধ্যমিকে স্যারের ব্যাচ থেকে আমি হায়েস্ট। স্যার খুব খুশী। তাই পুরো ব্যাপারটা ক্লিয়ার হলো।

আমি বললাম, "ঠিক আছে কাল বিকেলে দিয়ে দেবো!"

‪প্রথম দেখা‬-

"I wondered lonely as a cloud o'er vales & hills

all at once I saw a crowd

a host, of golden daffodils.."

ড্যাফোডিলস এর উত্তর দিতে গিয়ে, আমার মনবাগানে যে এত বড় “ড্যাফোডিলস” ফুটে যাবে তা বুঝিনি। হেল্প জিনিসটা চিরকালই আমার জাতীয় কর্তব্য মনে হয়। তার মধ্যে একটা মেয়ে! তাই পরদিনই গেছিলাম উত্তরের খাতা দিতে। 

কথামতো, উপস্থিত হলাম আমাদের এলাকার কফিশপে। ছোট দোকান। “ক্যাফে টেক”। ঠিক বিকাল সাড়ে ৫টা। পকেটে ২০০ টাকা। মাধ্যমিকের রেজাল্টের পর আত্মীয় স্বজনের থেকে যা পেয়েছি তার থেকে। জীবনের প্রথম ডেটিং, সৌজন্যে ড্যাফোডিলস।

গিয়ে দেখলাম তিতাস হাজির। নীল চুড়িদার-সাদা ওড়নায় সুসজ্জিতা। ভালো লাগলো ওকে দেখে; না না, ড্রেস দেখে নয়। সময়জ্ঞান দেখে। মেয়েদের মধ্যে সেটার খুব অভাব হয় কিনা তাই!

 যদিও সেটাই ছিলো আমার খুশী হবার প্রথম আর শেষ! কারণ এর পরে যতবারই দেখা হয়েছিলো কিছু নাহলেও ৩০ মিনিট অপেক্ষা করিয়ে নারী জাতির মুখ উজ্জ্বল করেছিলো।

 যাই হোক সেইদিন “কোল্ড কফি” তে চুমুক দিতে দিতে আমাদের বন্ধুত্ব জমাট বেঁধেছিলো। আমি শুধু ওর মুক্তোর মতো হাসিটা দেখছিলাম। একটা গজদাঁত সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলো। তিতাস বলেছিলো, 'এরপর কিন্তু কোন কিছুর দরকার হলেই ফোন করবো!' আমি বাধ্য ছেলের মতো মাথা নেড়ে সম্মতি দেওয়ার সময়েই বুঝে গেছিলাম যে ড্যাফোডিলস আমার জীবনে নতুন মোড় আনতে চলেছে।

প্রথম প্রেম-

যে কোন জিনিস, জীবনে প্রথমবারের যে অনুভুতি আর উত্তেজনা থাকে তা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মনে থাকে।

সেদিন বাড়ী ফিরেছিলাম এক আলাদা মন ভালো করা অনুভুতি নিয়ে। রাতে অর্গ্যানিক কেমিস্ট্রির ওই ঘর বাড়ীও দেখলাম বেশ ভালো আঁকতে পারছি (অর্গ্যানিক কেমিস্ট্রি কিছু বুঝতাম না; আর ওই অর্গ্যানিক যৌগগুলোকে ঘর বাড়ী আঁকা মনে হতো)। বুঝলাম পরিবর্তনের যুগে আমার মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে। একে অবশ্য নারী কেমিস্ট্রিও বলা যেতে পারে।

চোখের সামনে ভাসতে লাগলো, গজদাঁতের ঝিলিক দেওয়া একটা খুনখারাপি হাসি।

"Ten thousand saw I at a glance,

          Tossing their heads in sprightly dance."

পরের সপ্তাহে আবার অজুহাত দেখিয়ে ওই জুনিয়রদের ব্যাচে পড়তে গেলাম। মারাত্মক বৃষ্টি হচ্ছিলো সেদিন। পড়া শেষে বাইরে বেরোতেই তিতাস বললো, "ছাতা আনিনি। এগিয়ে দেবে আমাকে?"

 না করার প্রশ্নই নেই। এক ছাতার তলায় যাবার পথেই, ও হঠাৎ আমার হাত চেপে ধরে বললো, "আমাদের মাথার উপর এই একটা মাত্র ছাতার মতন, একটাই ছাদ হতে পারেনা?"

আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

" I gazed--and gazed--but little thought...."

সারা শহর ভিজছে; সাথে আমরা দুজন। এর আগে ইচ্ছা করে কখনো বৃষ্টি ভিজিনি। মরশুমি বৃষ্টি। অনুভুতিই আলাদা। ভালোবাসার মরশুম কি এটাই? শহরের সাথে আমার জীবনেও কি বর্ষা এলো?

ছন্দপতন-

সবই ঠিক ছিলো। কিন্তু ভালোবাসায় কিছুটা ভাগ্য লাগে। আর আমার মতোন ছেলের তো ব্যাড লাকটাও খারাপ যায়। আর ভাগ্য অনেকটা সেহওয়াগের ব্যাটিং-এর মতো। যে কোন সময়েই ডোবাতে পারে।

যাই হোক, আমাদের সেই যে পথ চলা এক মরশুমি বৃষ্টিতে শুরু হয়েছিলো, সেটা এক বছর পার করেছে। তিতাস ততদিনে আমার নয়নমণি।

আগের বছরের মতো সেরকমই আরেক সন্ধ্যায় আমি কলেজ ঘাটে বসে রয়েছি। বলা ভালো অপেক্ষা করছি। তিতাস হঠাৎ দুপুরে ফোন করে ডেকে পাঠিয়েছে। আকাশ আবার অন্ধকার করে এসেছে। মেঘ জমেছে আকাশ জুড়ে।

 আজ একদম ঠিক সময়েই এলো ও। একটু গম্ভীর মুখ। আমাকে উদাসীন ভাবে প্রশ্ন করলো, "আচ্ছা এই মেঘের মধ্যে কি থাকে জানো?"

- আমি স্বাভাবিক হেসে বললাম, "এটার জন্য ডেকেছো?" বলে ওকে ভূগোল বইয়ের জ্ঞান দিতে শুরু করলাম।

আমাকে থামিয়ে বললো,"ধুসস্! সেসব নয়। বহুদিন আগে শুনেছিলাম, মেঘের মধ্যে কষ্ট জমে থাকে। আর সেই কষ্টই হলো বৃষ্টি!"

- "কি হয়েছে বলোতো তোমার? উচ্চমাধ্যমিকে কি ফিলোজফি নেবে নাকি?"

- "প্রিয়, আমার বাবার ট্রান্সফার হয়ে গেছে গুয়াহাটিতে। আমরা সামনের সপ্তাহেই চলে যাবো। আর হয়তো কখনো দেখাই হবেনা!"

ঠিক এইসময়েই কাছে কোথাও সজোরে বাজ পড়লো। আমি বাজের শব্দে স্থির হলাম; নাকি ওর কথায়? ও চমকে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরলো!

দূরে টেক্সটাইল কলেজের ছেলেগুলো মেঘুদার দোকান থেকে দৌড়ে হোস্টেলে ফিরছে। কাছে পিঠে যে সব কাপল্ ছিলো, সবাই নিরাপদ জায়গা খুঁজছে। ব্যতিক্রম আমরা। দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরেছি। বৃষ্টি নামার আগে যেমন মাটি থেকে তাপ বেরোয়, আমরা তেমন একে অপরের দেহ থেকে নির্গত ওম নিয়ে নিচ্ছি। নোনাজলে গাল ধুয়ে যাচ্ছে।

বৃষ্টি নামলো শহরে।

আর এখন-

"For oft, when on my couch I lie

          In vacant or in pensive mood,

          They flash upon that inward eye

          Which is the bliss of solitude;"

না আজ আমার জীবনে তিতাস আর নেই। জীবনে এখন সেই বর্ষার মেঘ নতুন রূপে জমা হয়েছে। কাজ বলতে শখের লেখালিখি করা। কানহাইয়া নেচারটাও সময়ের সাথে চলে গেছে। সময় সব কিছু বদলে দিয়েছে। বদলে দিয়েছে চাহিদা। বদলে দিয়েছে মন। বদলে দিয়েছে ভালবাসা। যাবার আগে অনেক কেঁদেছিলাম দুজনেই। ও প্রমিস করেছিলো ওখানে গিয়ে মোবাইলে নতুন সিম নিয়েই ফোন করবে। কিন্তু এতো বছর পরেও সেই ফোন আসেনি।

জটিলতাটা ও ভালই বুঝত।আমি জটিলতাটা কোনদিনই বুঝতে পারিনি। না “অর্গ্যানিক কেমিস্ট্রির” না তো জীবনের। সেদিনের পর থেকে অনেক পাল্টেছি। ও চলে যাওয়ার পর বেপরোয়া ভাব এসেছিলো জীবনে। অনেকে এসেওছিলো ভালোবাসার মতো, যারা আমার সেই কৈশোরের সেই প্রথম বৃষ্টিভেজাকে ভুলিয়ে দিয়েছে কিন্তু আজও রাতে ঘুম ভেঙে গেলে, বারান্দায় দাড়িয়ে যখন রাতের চাঁদকে দেখি, আর গুরুদেবের 'হাসনুহানা' শুনি, তখন আমাদের দেখা “অপূর্ণ- একটা ছাদের" স্বপ্নগুলো আমাকে ধাওয়া করে। আর চোখের সামনে ভাসে এক কিশোরীর মিষ্টি হাসির ঝিলিক

"And then my heart with pleasure fills,

          And dances with the daffodils."

( জুন মাসের একলা রাতে হাসনুহানা শুনে আন্দোলিত মনের কানহাইয়া ছাড়া বাকী সব কাল্পনিক)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance