আমার ভারতবর্ষ
আমার ভারতবর্ষ
সদ্য দেবদত্তাদির কথায় স্টোরিমিররে জয়েন করেছি। শুনলাম এক প্রতিযোগিতা চলছে। বিষয় #Positive_India
তা বেশ! যখন চারদিকে খবরের চ্যানেল খুললে, বা সকাল হলেই কাগজের পাতায় খুন, ডাকাতি, রাহাজানি আর রাজনীতিবিদদের মুখোশের আড়ালে থেকে বিভিন্ন কাজের বিশ্লেষণ দেখতে হয়, সেখানে পজিটিভ মানে শুধু ক্যাটায়নই বুঝি। এই বিষয় নিয়ে কি আর লেখালিখি হয়!
কি আর করি, লিখবো যখন ভাবছি ডায়েরি-পেন নিয়ে বসে পড়ি; দেখি কি লেখা হয়।
এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো। এই হলো আরেক উটকো ঝামেলা। শান্তিতে কোনও কাজ করা যাবেনা। ঠিক বাষ্পমোচনের মতো, এই মোবাইল হলো জীবনের প্রয়োজনীয় ক্ষতিকর সঙ্গী।
ফোন করেছেন, আমার স্কুল রামকৃষ্ণ আশ্রমের বাংলার শিক্ষক দীপ স্যার। আমাদের স্কুলেরই ক্লাস নাইনের এক মেধাবী দুঃস্থ ছেলের সায়েন্স পার্টের পড়ানোর দায়িত্ব নিতে হবে। আমি নিজে এই কয়েকমাস হলো, এই স্কুলেই শিক্ষকতা করছি। আর শিক্ষকতার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ পেয়ে আমি বেশ খুশি। তাই এককথায় রাজি। দীপস্যার বললেন, একটু পরেই সেই ছাত্রকে নিয়ে তার বাড়ীর লোক আসবে।
ঠিক তাই। একটু পরেই বাড়ীর ডোরবেল বেজে উঠলো। দরজা খোলায়, দেখি একজন ভদ্রমহিলা, এক কিশোর কে নিয়ে এসেছে। কিশোরের মুখটা চেনা মনে হলো। বুঝলাম স্কুলে বারকয়েক দেখেছি। ভদ্রমহিলার উপস্থিতিতে দারিদ্রতার ছাপ স্পষ্ট। আমি ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, "তোর নাম কিরে?"
-"স্যার, আমি বীরসা মান্ডি খান মন্ডল।"
অবাক হয়ে তাকালাম! মুখের মধ্যে আদিবাসী ছাপ স্পষ্ট। আবার পদবীটা কেমন যেন....ঘেঁটে গেলাম। নিজেকে স্বাভাবিক স্মার্ট রাখার চেষ্টা করলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, "থাকিস কোথায়?"
-"ওই তো স্যার, পেয়ারাপুরে।"
-"আচ্ছা বুঝলাম। এবারে রেজাল্ট কেমন হয়েছে? এনেছিস রেজাল্ট?"
মাথা নীচু করে ব্যাগ থেকে রেজাল্ট বার করে হাতে দিয়ে বললো, "অঙ্কে বেশ কম হয়েছে।"
রেজাল্ট নিয়ে দেখলাম, মোটামুটি বেশ ভালোই রেজাল্ট। গড়ে ৬০-৬৫ করে পেয়েছে, যেটা আমাদের স্কুলের সাপেক্ষে যথেষ্ট ভালোই। শুধু অঙ্কে ৪৭ হয়েছে।
আমি রেজাল্ট ফেরত দিয়ে বললাম, "আচ্ছা! তা বইপত্র জোগাড় হয়েছে? লাগবে তো!"
-"স্যার বাবাকে বলেছি। জোগাড় করে দেবে!"
-"আচ্ছা! বাবা কি করে? বাবার নাম কি?"
-"বাবা ওই বাজারে সবজি বিক্রি করে। বাবার নাম সাদ্দিক খান!"
এইবার ছিলো চমকে ওঠার পালা। কারণ আমার সামনে যে ভদ্রমহিলা এসে বসে আছেন, তাঁর হাতে শাঁখা-পলা আর কপালে সিঁদুর দেখতে পাচ্ছি।
ভদ্রমহিলা বোধহয় আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছেন। তিনি বললেন,"আসলে আমাদের পরিচয়টা দিয়ে রাখা দরকার। আমি সরস্বতী মন্ডল। ভালোবেসে বাড়ীর অমতে ওর বাবার হাত ধরে নিজের ঘর ছেড়েছিলাম। আর ওর বাবা বলেছিলো, আসল ধর্ম মানুষের অন্তরে মনুষ্যত্বে থাকে। তাই আমাকে মুসলিম ধর্ম নিতে ওই বারণ করে। ফলে বুঝতেই পারছেন। ওর বাড়ী থেকেও মেনে নেয়নি। আমরা দুজন এসে পেয়ারাপুরে নিজেদের ঘর বাঁধলাম।"
-এইসময় দেখলাম বীরসা তার বুদ্ধির পরিচয় দিলো। আমার পোষ্য কুট্টুসের সাথে খেলার জন্য পাশের ড্রয়িংরুমে চলে গেলো।
ওর মা, আবার বলা শুরু করলেন...
"আমাদের বিয়ের পরেও নিজেদের ধর্ম মানবতায় বিশ্বাস রেখে প্রায় দুই বছর একসাথে কাটাই। এরপরে একদিন এক রাতে পাশের বাড়ীতে এক দুর্ঘটনা ঘটে। তাতে সেই বাড়ীর ব্যাটাছেল
েটা প্রাণ হারায়। বউটা পোয়াতি ছিলো। তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাই আমি আর আমার স্বামী। তাদেরই সন্তান বীরসা। তারা ছিলো আদিবাসী। সন্তান জন্ম দেওয়ার কিছু সময় পরেই সে মারা যায়। সেই অনাথ বাচ্চাটাকে ফেলে দিতে মন চায়নি। আর মারা যাওয়ার আগে, জেনে নিয়েছিলাম ছেলের কি নাম রাখতে চায়। সেটাই করেছি সাথে শুধু নিজেদের পদবীটা জুড়েছি।
এরপরে ১৫টা বছর কেটে গেছে। আমরা নিজেরা কোনও সন্তান নিইনি। পাছে বীরসার ভালোবাসায় ভাগ বসে। জানেন স্যার, ওই আমাদের নয়নের মণি।"
-যখন কথা বলা থামালো তাঁর চোখে আমি এক অদ্ভুত পরিতৃপ্তি দেখতে পেলাম। অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম।
বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে প্রশ্ন করলাম, "ছেলের সব দায়িত্বই কি বাবা নেয়?"-প্রশ্ন করে বুঝলাম বোকা বোকা প্রশ্ন করছি। আসলে চারদিকে যখন ধর্ম নিয়ে লড়াই দেখি, তখন এরকম কিছু শুনলে মাথা তো হ্যাং করবেই।
এদিকে তিনি আবার বলা শুরু করেছেন। "দায়িত্ব নেয় মানে? মাথায় করে রাখে। রোজ বাজার থেকে ফিরে সন্ধ্যেতে নামাজ সেরে, ছেলেকে সামনে বসিয়ে পড়তে বলে। ছেলে সোহাগী বাবা, পড়ায় খামতি দেখলে পিঠে দু-এক থাবড়াও বসিয়ে দেয়।"
-"আর ছেলে কি পুজো করে?" বুঝতে পারছিলাম আমি একটা অত্যন্ত নিম্নরুচির মানুষের ন্যায় ধর্ম ধর্ম করছি। কিন্তু অদম্য কৌতুহল আমাকে চুপ থাকতে আটকাচ্ছিলো।
-"কি আবার! ছেলে বাপের দেখাদেখি নামাজে বসতে চায়, আবার আমার পুজোর সময় এসে ধূপ,দীপ জ্বালিয়ে প্রণাম করে। নামাজ পড়তে উনি বারণ করেন। বলেন , তুই তোর আসল বাপ-মায়ের পরিচয় তো সবই জানিস। তাই এখনই এই আল্লা-শিবের জালে নিজেকে ফেলিসনা। সবচেয়ে বড়ো ঠাকুর তোর স্কুলে আছেন। রামকৃষ্ণ ঠাকুর, সারদামা আর বিবেকানন্দ ঠাকুর। এদেরই পুজো কর। বড়ো হয়ে যদি ইচ্ছা হয়, যার ইচ্ছা উপাসনা করিস! স্যার আপনারাই ভরসা! ও আমাদের সবকিছু। ওর দিকে চেয়ে আছি আমরা। ওকে মেরে, বকে, পড়া করিয়ে ওকে আপনাদের মতো বড়ো মানুষ করে দেবেন।" এরপরে কথা শেষ করে কুট্টুসকে আদর করে ছেলের হাত ধরে পড়ার দিনক্ষণ ঠিক করে চলে গেলেন উনি।
আমি কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম! আমরা নাকি ভরসা! আমরা যারা ধর্মের কীট, ঠাকুর বললে মন্দির, মসজিদ, গীর্জা বুঝি। ধর্ম দিয়ে মানুষের ভাগ করি, তারা কি আদৌও ভরসা হতে পারি নাকি বড়ো মানুষ হতে পারি, যে আমাদের মতো করে ওই ছেলেটাকে বড়ো করবো!
আসলে এদের দেখে আমিই ভরসা পেলাম। বিরাট এক ভরসা। মানুষ জাতটায় এখন পুরোপুরি পচন ধরেনি। মানবতা আজও রয়েছে। হিন্দু মা আর মুসলমান বাপের ঘরে একান্ত আদরে মানুষ তৈরী হচ্ছে এই দেশের আদিপুত্রের বংশজ সন্তান। আসলে আমরা এইরকম মানুষদের দেখে, মানুষ হতে শিখবো। পুঁথিজ্ঞানে বড়ো হওয়া যায়না। মানুষ বড়ো হয় মানবতাবাদে। চারদিকে যখন মানুষে মানুষে হানাহানি, খুন, ধর্ম নিয়ে লড়াই; বিরোধীতা করলে অভিজিৎ রায় কিংবা গৌরী লঙ্কেশের মতো হত্যা করে দেওয়া হয়, সেখানে তো এরকমই সাদ্দিক খানের মতো মানুষ আর বীরসার মতো সুযোগ্য সন্তান চাই। আর ঠিক তাই, এইরকম মানুষেরা আছে বলেই আজও আমার স্কুলে গেলে বিবেকানন্দ মন্দিরে ঢুকে বিবেকানন্দের প্রস্তর মুর্তির চোখে চোখ রেখে বলতে পারি, "এটাই আপনার ভারতবর্ষ!"
তারপর দেখলাম, লেখার কনটেন্ট না হলেও সব পাঠকবন্ধুর সাথে শেয়ার করার জন্য পসিটিভ ভারতের একটা চিত্র তো পাওয়া গেছে। আপাতত এটুকুই থাক। বাকী লেখালিখি পরে হবে।
#positiveindia