priyonkon chatterjee

Others

3  

priyonkon chatterjee

Others

বোধনের সুর

বোধনের সুর

5 mins
9.3K


"আরে এই হতচ্ছাড়া, তোর জন্য এটা নয়। হেঁটে আয়। এই চিরকুটে ঠিকানা সব লেখা আছে। আর নে এই ঢাক! এটা নিয়ে ভ্যানগাড়িতে উঠতে দেবেনা।"- মুখ খিঁচিয়ে শানুকে কথাগুলো বললো হারানকাকা। শানু ঢাকটা পিঠে নিতে নিতে দেখলো,একরাশ ধুলো উড়িয়ে পলাশগঞ্জের রাস্তা দিয়ে ভ্যান রিক্সাটা চলে গেলো। যেতে যেতে হারানকাকার গলার আওয়াজের কয়েকটা টুকরো ভেসে এলো, "নবাবপুত্তুর...বেশী দেরী করলে কিন্তু..সকাল ৮টায় বোধন..." ছলছল চোখে সেদিকে তাকিয়ে শানু কথার টুকরোগুলো মনের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলো। আর বাকী কথার টুকরোগুলো কি হতে পারে, তা সে ভালোভাবেই অনুমান করতে পারছে!

এই অবস্থায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে শানুর ওর বাড়ীতে মা'র কথা খুব মনে পড়তে লাগলো। পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে ওদের বাড়ী। বাবা দিনমজুরের কাজ করে, আর মা গ্রামের পুকুরপাড়ের লাগোয়া ওই জমি থেকে শাক-পাতা তুলে নিয়ে গিয়ে হাটে বিক্রি করে। বাড়ীতে ওর আরেক ছোটবোন আছে, ৭ বছরের। শানুর থেকে ঠিক ৫ বছরের ছোট। বাড়ীর যা অবস্থা তাতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তার মধ্যেও ওদের বাবা অনেক কষ্ট করে ওদের দুই ভাই-বোনকে স্কুলে পাঠাচ্ছে। গ্রামের ওই স্কুলেই শানু ক্লাস সিক্সে আর ওর বোন ক্লাস টু'য়ে পড়ছে। গতসপ্তাহে স্কুল থেকে বাড়ী ফিরে দেখে, হারানকাকা এসে, ওদের বাড়ীর দাওয়াতে বসে আছে। শুনতে পেলো বাবাকে বলছে, " বলছি শোন, তোর ছেলেকে নিয়ে যাই। সবকাজ কি আর একা পারি! অনেক বড়ো বাড়ী। পুজোর ক'দিন ভালো খেতে পরতে পারবে।তাছাড়া হাজার খানেক টাকাও দেবো।" - হারানকাকা গ্রামের নামকরা ঢাকী। প্রতিবার পুজোয় বিভিন্ন জায়গা থেকে ডাক আসে। ও দেখলো ওর বাবা একবাক্যে রাজী হয়ে গেলো। শানু বুঝলো না, হাজার টাকার লোভে ছেলেকে এক সপ্তাহের জন্য বিক্রি করলো, নাকি খেতে পরতে পাঠালো। কিন্তু শানু যে এসব কিচ্ছু চায়না। সে চেয়েছিলো, পুজোয় বাবা,মা, বোনের সাথে গ্রামের রায়বাড়ীর পুজো দেখতে যাবে। বিলু, পল্টুদের সাথে ঘুরবে, মিত্তিরদাদুর বাগানে বসে সারা দুপুর গল্প করবে। সেই সব প্ল্যান মাটি হয়ে গেলো।

এসবই ভাবতে ভাবতে শানু রাস্তা ধরে ওই বিশাল ঢাক নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো, পলাশগঞ্জের বিখ্যাত দত্তবাড়ীর উদ্দেশ্যে। একসময়ে এনারা নাকি এখানকার জমিদার ছিলেন। এখন সেই রাম, বা রাজত্ব না থাকলেও, পুরোনো প্রথা গুলো রয়ে গেছে। হারানকাকা বলেছিলো তিন মাইল রাস্তা! কিন্তু এই ভারী ঢাক নিয়ে, এই ভাদ্রমাসের দুপুর রোদে, সেই রাস্তা ছয় মাইল মনে হচ্ছে। হারানকাকার সাথে সেই সকালে একটু পান্তাভাত খেয়ে বেরিয়েছে, তারপর এই দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো, পেটে কিচ্ছু পড়েনি। কিচ্ছু খাওয়ায়নি। উপরন্তু বাজে ভাবে ব্যবহার করেছে, সারা রাস্তা! এই বিকেলে খাবারের কথা ভেবে, ওর পেট চুঁইচুঁই করতে লাগলো। পকেটে আছে মাত্র ১৫টাকা। মা আসার সময় দিয়েছিলো। তাই দিয়েই কিছু খাবে? আবার তার জন্য দেরী হয়ে গেলে, হারানকাকা আরও বকবে! তার থেকে বরং..... দুম! ভাবনাটা শেষ হওয়ার আগেই জোরে ধাক্কা। ঢাকটা শুদ্ধু ওর ছোট্ট শরীরটা ছিটকে পড়লো রাস্তার ধারে। ঢাকটা মনে হলো, ফেটে গেলো। একটা বাইক জোরে চালিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময়, ওকে ধাক্কা মেরে গেলো। ও চোখে অন্ধকার দেখলো। ওর ঠোঁটের পাশে নোনতা স্বাদ অনুভব করতে পারলো। মাথাটা প্রচণ্ড ভার লাগছে। চারপাশ থেকে লোকজনের হইহই শব্দ শুনতে পাচ্ছে। শানুর চোখে অন্ধকার নেমে এলো।

চোখ খুললো যখন, শানু রাস্তার পাশেই একটা গাছতলার বেদীতে শুয়ে। সেই বেদীর পাশেই একটা ছোটো কালীমন্দির আছে। কয়েকজন লোক তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক, তার ঝোলা থেকে জলের বোতল বার করে শানুর চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছিলো। শানুকে চোখ মেলতে দেখে, সবাই নিজেদের মধ্যে নানারকম কথা বলতে লাগলো। ও দেখলো, ওর কনুই আর হাঁটুটা ছড়ে গেছে। ওরা সেখানটা জল দিয়ে ধুয়ে দিলো। একজন জিজ্ঞাসাও করলো, যে ও কোথায় যাবে। ওর গন্তব্য শুনে বললো, এখনও দেড় মাইল মতো। তারপর সবাই একে একে সেখান থেকে চলে গেল। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে। শানুর খেয়াল পড়লো, ঢাকটার দিকে। গাছতলাতেই পড়ে আছে। ওর মনে পড়লো অ্যাক্সিডেন্টের সময়, সেই ঢাকটাও ছিটকে পড়েছিলো। ও তাড়াতাড়ি ঢাকটার কাছে গিয়ে দেখলো,চামড়াটা ফেটে গেছে। ভয়ে ওর শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেলো। এবার কি হবে! কি করে পুজো হবে! হারানকাকা কি আর ওকে আস্ত রাখবে! ততক্ষণে ওই পাশের মন্দিরে সন্ধ্যারতি শুরু হয়েছে। জনা তিন-চার জন পুজো করছে। কেউ ওর দিকে লক্ষ্যও করলো না। ও ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতে শুরু করলো। কিন্তু লাভ কি! যা হওয়ার হয়ে গেছে! ওর খুব কান্না পেলো। ইচ্ছা করছিলো একছুট্টে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যেতে। ও খুব অসহায় বোধ করলো। আজ মহাপঞ্চমী। রাস্তা দিয়ে দু-তিনটে প্রতিমা নিয়ে গেলো লোকজন। পাশের মন্দিরের আরতি অনেকক্ষণ হলো শেষ হয়েছে। সবাই চলেও গেছে। ও সেই মন্দিরের সিঁড়িতে বসে কাঁদতে লাগলো। ভয়েতে, খিদেতে অবসন্ন হয়ে ও সেখানেই কাঁদতে কাঁদতে শুয়ে পড়লো।

ঘুম ভাঙলো একটা ঠান্ডা হাতের ছোঁয়ায়। সাথে কেমন যেন একটা মা-মা গন্ধ! চোখ মেলে দেখলো,ওর মায়ের মতোই একজন ওর সামনে এসে বসে, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। শানু জেগে উঠতে ওকে বললো, " কি হয়েছে? তুমি কাঁদছো কেন? কোথায় যাবে?" - অনেক কষ্ট আর অভিমানের মেঘ জমাট বাঁধার পর,প্রথম ভালোবাসার স্পর্শতে অঝোরে বৃষ্টি নামলো। শানু কাঁদতে কাঁদতে সব বললো। শেষে ঢাকটা দেখিয়ে বললো, "এটাও ফেটে গেছে। হারানকাকা খুব মারবে!" সব শুনে সেই ভদ্রমহিলাটি নিজের আঁচল থেকে একটা ঠোঙা বের করে ওকে দিয়ে বললো, "আচ্ছা আগে কিছু খেয়ে নাও। তারপর দেখছি!" শানু ঠোঙাটা নিয়ে দেখলো, তাতে রুটি আর বাতাসা আছে। ও রুটিটা খেতে যাবে, ওই ভদ্রমহিলাটি এগিয়ে গেলেন ঢাকের দিকে! ঢাকের গায়ে হাত বুলিয়ে শানুকে চমকে দিয়ে বললেন, "কই! ফাটেনি তো! ঢাক তো একদম ঠিক আছে। এটা তো পাথরে ঘষা লাগার দাগ শুধু!" শানু অবাক হয়ে ঢাকের দিকে দেখতে যাবে, এমনসময় একটা কোলাহলের আওয়াজ এলো। আর গায়ে একটা কিসের যেন ধাক্কা লাগলো।

ও চমকে উঠে দেখলো, হারানকাকার সাথে আরও কয়েকজন লোক এসেছে। হারানকাকার চোখে জল। ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বললো, "আমাকে ক্ষমা করে দে বাপ আমার! আমার ভুল হয়েছে! সন্ধ্যের মুখে যখনই দত্তবাড়ীতে খবর দিয়েছে একটা বাচ্চা ঢাকির অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, আমার বুকটা কেঁপে উঠেছে। তোর কিছু হলে, তোর বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারতুম না রে।"

শানু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে, হারানকাকাকে দেখছিলো আর চারপাশে তাকাচ্ছিলো। ওই ভদ্রমহিলাটিই বা কোথায় গেলেন? তাহলে কি এতক্ষণ ও স্বপ্ন দেখছিলো? দৌড়ে গিয়ে ঢাকটাকে দেখলো। সত্যিই তো, ঢাকটা একদম ঠিক আছে! কিন্তু ওর স্পষ্ট মনে পড়ছে ও সন্ধ্যের মুখে যখন দেখেছিলো, ঢাকটা ফেটেছিলো। এখন সেখানে শুধু, পাথরের ঘষা লাগার দাগ। হারানকাকা এসে ওকে সরিয়ে বললো, " ঢাকটা আর তোকে বইতে হবেনা রে! আমিই নিয়ে যাচ্ছি। চল তুই!" ও অবাক হয়ে হারানকাকাকে দেখছিলো। মানুষটার হঠাৎ এরকম পরিবর্তন। অবাক হওয়ার তখনো বাকী ছিলো। তাকিয়ে দেখলো, যেখানে ও ঘুমোচ্ছিলো, সেখানে একটা ঠোঙা পড়ে আছে। ও ঠোঙাটা তুলে দেখলো, রুটি আর বাতাসা রয়েছে। ও সেই ঠোঙাটা নিয়ে দত্তবাড়ীর দিকে চললো। কাল সকাল থেকে দেবীর পুজো শুরু! যাওয়ার আগে, কালীমন্দিরে প্রণাম করে গেলো। মনে হলো, মা যেন হাসছেন!

পরদিন সকাল। মহাষষ্ঠী। দেবীর বোধন। শুভর সূচনা, আর অশুভের বিনাশ। শানু ভোরবেলা উঠে স্নান করে নিয়েছে। বাড়ীর বড়োগিন্নি ওকে একটা নতুন জামা-প্যান্ট দিয়েছে। সেটা পরে ও মন্ডপে কাঁসর হাতে এসে দাঁড়ালো। দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। কাল রাতে যে ভদ্রমহিলা এসেছিলেন, হুবহু তার মতোই মুখের আদল। সেরকমই চোখ, ঠোঁটের কোলে হালকা হাসি। শানুর চোখ জলে ভরে গেলো। চোখ বন্ধ করে প্রণাম করলো। আসলে সব মায়ের মুখই বোধহয় একইরকম হয়!

(পুজোর উত্তেজনা, আবেগ আর শৈশবকালের পুজোর হারানো দিনগুলোকে ফিরে পাওয়ার ইচ্ছার মতোই, এই গল্পের প্রতিটি অংশ চিরন্তন সত্য)


Rate this content
Log in