চলো পাল্টাই
চলো পাল্টাই
“তোমার ডান হাতটা বাড়াও দেখি” জ্যোতিষীর কথামতো সান্তু হাতটা বাড়িয়ে দিলো। শনিবারের কাগজে নামী জ্যোতিষীর ঠিকানা জোগাড় করে দেখাতে এসেছে। খুব মন দিয়ে দেখতে দেখতে নানা রকম প্রশ্ন করছিলেন উনি আর সান্তু তার সাধ্যমতো উত্তর দিচ্ছিলো। হঠাৎই এইসব প্রশ্নমালার মাঝে উনি জিজ্ঞেস করলেন “প্রেমে ধোঁকা খেয়ে জানতে এসেছো কি ভাবে প্রেমিকাকে শায়েস্তা করা যায়?”
প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলো সান্তু। যে অবিশ্বাস নিয়ে এসেছিল জ্যোতিষীর দরবারে সেটা এক মুহূর্তেই উবে গেলো আর তার বদলে ভক্তিভাবটা উতলে উঠতে লাগলো। এতদিন এইসব ভাগ্য ভবিতব্য কিছুই মানতো না ও। সচ্ছল পরিবারে জন্ম ওর, যখন যা চেয়েছে পেয়ে গেছে। কোন জিনিসই একবারের বেশি দুবার চাইতে হয়নি। ও সবসময়ই মনে করতো সবই ওর যখন যেটা পেতে চাইবে, নেবে। স্কুল জীবনে প্রচুর বন্ধুবান্ধব ছিল ওর, বেশীরভাগ যারা ওর বন্ধু হতে পেরে নিজেদের ধন্য মনে করতো। স্কুল জীবন শেষে যখন বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়তে ভর্তি হল সেখানেও বন্ধু বান্ধবী পেতে সময় লাগলো না। ততদিনে সুরা আর নারী নিয়ে ফুর্তি কিভাবে করতে হয় সব জেনে গেছে ও। অতএব বান্ধবী মুড়িমুড়কির মতো আসতে যেতে থাকলো ওর জীবনে। এরকম সময়ে মাস ক্যমুনিকেশন পড়তে কলেজে ভর্তি হল রাই।
প্রথম কয়েকদিন খেয়াল না করলেও নবীন বরণের দিন সান্তু খেয়াল করলো ওকে আর দেখার পরই ওর মন বলল একে এবার গার্লফ্রেন্ড করতে হবে। চেষ্টা শুরু করলো ওর সাথে আলাপ জমানোর কিন্তু এ মেয়ে ক্লাস শেষ হওয়ার পরপরই হাওয়া হয়ে যায় ক্যাম্পাস থেকে তাই ওর নাগাল আর পায় না ও। ঠিক সেই সময় সান্তুর স্টেডি গার্লফ্রেন্ড হল পরমা। দেখতে মোটামুটি হলেও খুবই স্মার্ট। সান্তু ওর সাথে সময় কাটায় বটে কিন্তু ওর মন পরে থাকে রাইয়ের দিকে। পরমা অবশ্য বুঝতেই পারে যে সান্তুর মন থেকে ও আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে, রাগ হয়না ওর বরং করুণা হয় সান্তুর ওপর। খুব মন দিয়ে বোধহয় খেয়াল করছিলো সান্তুর গতিবিধি তাই বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে এবার ওর দৃষ্টি রাইয়ের ওপর। ও’ই একদিন সান্তুকে বলে “কলেজের ওই মেয়েটাকে চিনিস?” আঙুল তুলে দেখালো ক্যান্টিনের দরজা দিয়ে সেই মুহূর্তে ঢোকা রাইকে। ওরা তখন ক্যান্টিনে বসে চা ডিমের চপ খাচ্ছে আর গল্প করছে। সান্তু যথারীতি উত্তর দিলো “না রে। কে ও?”
পরমা বলল “ও রাই। মাস ক্যমুনিকেশন পড়ছে”
“তোর সাথে আলাপ আছে নাকি?”
“তা আছে, ওর ভাই আমার ভাইয়ের ভালো বন্ধু”
“আলাপ করিয়ে দে না” আব্দার ঝরে পড়লো সান্তুর গলা থেকে। পরমার মনে হল সান্তু যেন লোভনীয় খাবারের দিকে তাকিয়ে আছে। পরমা হাত তুলে ডাকলো রাইকে । ও কাছে আসতে বলল “বস আমাদের সাথে। ক্লাস কেমন চলছে তোর?”
“ভালোই চলছে পরমাদি”
“আয় তোর সাথে আমার বন্ধুর পরিচয় করিয়ে দিই... এ সায়ন্তন, আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট ছেলে, যেমন পড়াশোনায় তেমনই খেলাধুলায়”
রাই হেসে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করে। সেদিন সান্তু সাধারণভাবে কথাবার্তা চালায় রাইয়ের সাথে। প্রথমদিন নিজের চেহারা দেখিয়ে দিলে পাখি হয়তো কাছেই আসবে না। এরপর যা এতদিন হয়ে এসেছে এবারও তাই হল পরমা ধীরে ধীরে বাতিলের খাতায় চলে গেলো আর তার বদলে সেখানে আসন পেতে বসলো রাই। তবে রাইয়ের সাথে ঘোরাফেরা কথা বার্তার মধ্যেও সান্তু টের পেতো রাই পুরোপুরি ওর নয়, মাঝখানে কোথাও ফাঁক আছে কিন্তু সেই ফাঁকটা কি সেটা ধরতে পারছিলো না ও।
হঠাৎই ওর মনে হল তাহলে কি রাই বিশ্বাসঘাতকতা করছে? কথাটা মনে আসতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো ও। এবার তো প্রমাণ বার করতেই হবে যে রাইয়ের সাথে অন্য কোন পুরুষের সম্পর্ক আছে কি না। যেমন ভাবা তেমন শুরু করলো কাজ। নিজে তো বটেই অন্য ছেলেদেরও দায়িত্ব দিলো খুঁজে বার করার। কিছুদিন বাদে বার হয়েই গেলো একটা গণ্ডগোল। ওর চাটুকার দলের প্রবীর এসে খবর দিলো “সান্তুদা একটা খবর আছে রাইয়ের ব্যাপারে”
সান্তু তখন এক বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে উপস্থিত। খবরটা জানার জন্য ও বেরিয়ে এলো ওখান থেকে। প্রবীর বলল “রাই অয়ন নামে এক ছেলের বাড়িতে প্রায়ই যাতায়াত করে। আমি ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি ও রাইয়ের কেউ হয় না”
“প্রমাণ আছে?”
“হ্যাঁ এই দেখো ছবি তুলে এনেছি”
পরেরদিন রাই কলেজে আসতেই সান্তু বলল “এদিকে এসো রাই, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে”
রাই বলতে চেয়েছিল “কিন্তু আমার ক্লাস...”
“পরে করবে” তারপর ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গিয়ে সরাসরিই প্রশ্ন তুলেছিল “অয়ন কে? তোমার সঙ্গে কিভাবে পরিচয়?”
রাই অবাক হয়ে বলেছিল “অয়ন আমার দাদার মতো তবে বেশীদিন হয়নি পরিচয় হয়েছে”
“দাদা” ব্যঙ্গ ঝরে পড়েছিল সান্তুর গলা থেকে। “জানা আছে কেমন দাদা। ছ্যাঃ ছ্যাঃ কেমন মেয়ে গো তুমি? আমার সাথেও খেলছো আবার ওর সাথেও। একজন পুরুষে মন ভরে না বুঝি?”
রাই প্রথমে কিছু বলতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু সান্তু ওকে সুযোগ দেয়নি বলার। আর সান্তুকে সেদিন যেন ভূতে ধরেছিল যা নয় তাই বলে অপমান করেছে ওকে। রাই তারপর আর একটা কথারও উত্তর দেয়নি, চুপচাপ চলে গেছে। এতে সান্তুর মনের আগুনে আরও ঘৃতাহুতি পড়েছে। কি করলে রাইকে ওই ছেলের কবল থেকে ছাড়িয়ে নিজের করে নেওয়া যায় সেই চিন্তাই ওকে পেয়ে বসলো। বহু জনের সাথে কথা বলে আর কাগজে পড়ে জেনেছে বশীকরণ একমাত্র উপায়। সেরকমই একজনের সন্ধান কাগজে পেয়ে ও আজ দেখা করতে এসেছে।
ও উৎসাথের সাথে বলল “হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন জ্যোতিষ ঠাকুর। কি করা যায় বলুন তো”
“সেটা বলছি কিন্তু তার আগে বলো ওই অন্য ছেলেটার সাথে ওর সম্পর্কটা ঠিক কতটা গভীর”
“তা ভালোই গভীর বলে মনে হয় আমার”
“ছেলেটাকে তুমি সামনে থেকে দেখেছো?”
“না”
“বেশ আমি তোমার জন্য সব ব্যবস্থা করে দেবো কিন্তু তার আগে তোমাকে ওর ছেলেটার বাড়ি যেতে হবে। জানতে হবে ওর সাথে তোমার প্রেমিকার সম্পর্কটা কত গভীর”
“সেটা জেনে কি হবে?”
“দরকার আছে। সেটা জানার পরই তো ওষুধ কেমন তৈরি করতে হবে তা জানবো”
সান্তু ফিরে এলো খুশি হয়ে শুধু একটাই বিরক্তিকর কাজ পেলো সেটা হল অয়নের বাড়ি যেতে হবে ব্যাপারটা কতটা গভীর হয়েছে জানতে। কি আর করা, প্রেমিকাকে শায়েস্তা করতে এটুকু তো করতেই হবে। ও প্রবীরকে ফোন করে জানতে চাইলো অয়নের ঠিকানা তার সাথে এও জেনে নিলো রাই কখন যায় ওই বাড়িতে। প্রবীর জানতে চেয়েছিল কি কারণে ও ঠিকানাটা চাইছে কিন্তু সান্তু বলেছে পরে জানাবে।
পরেরদিন সকালেই ও চলল অয়নের বাড়ি। প্রবীর যেমন বলে দিয়েছিল সেভাবে বাড়ি খুঁজে পেতে সময় লাগলো না। কিন্তু রাই পৌঁছে গেছে কিনা বুঝতে পারলো না। সেটা বোঝার জন্য খানিকক্ষণ বাড়ির গলির মুখে যে পান গুমটি রয়েছে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো। শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকলে লোকে সন্দেহ করবে তাই প্রথমে একটা সিগারেট কিনলো তার পর দোকানদারের কাছে দেশলাই চেয়ে নিয়ে সেটায় অগ্নি সংযোগ করলো। খানিকক্ষণ ওই বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ও দোকানদারকে কথার ছলে প্রশ্ন করলো “ওই বাড়িতে অয়ন থাকে না?”
দোকানদার নিজের কাজ করতে করতে উত্তর দিলো “হ্যাঁ”
“কি করে?”
“পুলিশে কাজ করে তবে এখন ছুটিতে আছে”
“কেন?”
“আজকালকার শহরে যা সব ঘটনা ঘটছে তারই ফল স্বরূপ ওর বাড়িতে থাকা”
“কি রকম?”
“কেন কাগজে পড়েননি মাস দেড়েক আগে এক মেয়েকে একটু বেশি রাতের দিকে রাস্তায় কিছু বদমাইশ ঘিরে ধরেছিল খারাপ কিছু করার উদ্দেশ্যে। মেয়েটা নিজেকে বাঁচাতে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চেঁচিয়েছিল। সেইসময় ওই রাস্তা দিয়ে অয়ন আসছিলো মোটর সাইকেলে ডিউটি ফেরত। ও’ই ঝট করেই এগিয়ে যায় ওকে বাঁচাতে কিন্তু একা একজন মানুষ কিভাবে অতগুলো মোকাবিলা করবে। তবে সেই মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছে। গুণ্ডাগুলো হেরে পালিয়ে যাওয়ার সময় ওকে মেরে ধরে আধমরা করে চলে যায়। তবে যে মেয়েটাকে বাঁচাতে এতো কাণ্ড সে অবশ্য পালিয়ে যায়নি। গুণ্ডারা পালিয়ে যেতেই ও দৌড়ে চলে আসে অয়নের পাশে। তারপর পুলিশে ফোন করে, হাসপাতালে ফোন করে। তারপর রাস্তার গাড়ি দাঁড় করিয়ে ওকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। মারধোরের চোটে অয়নের মাথায় লেগেছিল আর পা ভেঙ্গেছিল। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে আসতে প্রায় মাসখানেক লেগেছে। আর প্রতিদিন ওই মেয়েটি এসে হাসপাতালে খবর নিয়ে গেছে। বাড়ি ফিরে আসার পরও ও প্রতিদিন দেখতে আসে অয়নকে”
সান্তু এতক্ষণ হাঁ করে দোকানদারের কথাগুলো গিলছিল। ও ভাবতেই পারছে না যে এরকমও হয়। আর এতদিন ও রাই সম্পর্কে কত কি উল্টো পাল্টা ভেবেছে। নিজের মনেই নিজেকে ধিক্কার দিলো ও। আর এই ভাবনার মাঝেই দোকানদার হঠাৎ বলে উঠলো “ওই দেখুন সেই দিদিমণি আসছে”
সান্তু তাকিয়ে দেখলো রাই আসছে হাতে ফলের প্লাস্টিক ঝুলিয়ে। ও ভেতরে ঢুকে যাওয়ার পর সান্তুও পায়ে পায়ে ওই বাড়িতে গিয়ে ঢুকলো। পুরনো আমলের বাড়ি। মাঝখানে উঠোন রেখে চারপাশ দিয়ে ঘর। সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই বাঁদিকের ঘরের ভেতর থেকে রাইয়ের আওয়াজ পেলো ও। সেই মুহূর্তে রাই অয়নের পাশে গিয়ে বসেছে সবে। বলছে “দাদা জানো আজ কটা মুসাম্বি নিয়ে এসেছি তোমার জন্য। এখন খাবে নাকি পরে?”
অয়ন হেসে বলল “দূর পাগলি। সকালবেলাই ফল খাওয়াবি কি রে এখনো জল খাবার খাওয়া হয়নি আমার”
“সে কি কাকিমা এখনো তোমায় জলখাবার দেয়নি। দাঁড়াও আমিই গিয়ে নিয়ে আসছি” বলে ও রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো। ও বেরিয়ে যেতেই সান্তু গিয়ে ঢুকলো ওই ঘরে। অয়ন খাটের ওপর বসেছিল, ওকে দেখে অবাক হয়ে বলল “আপনি কে? আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না?”
সান্তু নিজের পরিচয় দিয়ে বলল “আজ আমি এসেছিলাম দাদা বোনের ভালোবাসার সাক্ষী হতে”
“তার চেয়ে বললে ভালো হয় নিজের সন্দেহের নিরসন করতে” পেছনে ততক্ষণে রাই এসে দাঁড়িয়েছে জলখাবারের থালা হাতে। সান্তু প্রতিবাদ না করলেও অয়ন বলল “এটা কিরকম কথা হল রাই। এতো রুক্ষভাবে কেউ কথা বলে নাকি?”
রাই বলল “তুমি জানো না দাদা, ও তোমাকে আমাকে জড়িয়ে কত নোংরা কথা বলেছে। নিজে ছেঁড়া কাপড়ের মতো সম্পর্ক পালটেছে তাই ভাবে সবাই ওর মতোই”
অয়ন রাইকে বাধা দিয়ে কিছু বলতে যেতেই সান্তু বলল “না দাদা ওকে মানা করো না। ও যা বলছে সব ঠিক। আমি স্বীকার করছি সব তবে আজ তোমাদের দেখে আমার মনে হচ্ছে আমার নিজেকেও পাল্টানো উচিত। আর আমি চেষ্টাও করবো খুব শুধু যদি তোমরা আমার পাশে থাকো তাহলে খুব ভালো লাগবে”
অয়ন বলল “আমি সবসময়ই তোমার পাশে আছি। তবে রাইয়ের কথা ও’ই বলতে পারবে তবে আমি আশা করবো ও তোমার পাশে থাকবে”
সান্তু রাইয়ের দিকে তাকালো । ওর মুখে সম্মতির চিহ্ন দেখে সান্তু বলল “ধন্যবাদ রাই। আমি পাল্টাবোই”