Debanjoly Chakraborti Chakraborti

Drama Romance Tragedy

3  

Debanjoly Chakraborti Chakraborti

Drama Romance Tragedy

বিচার

বিচার

6 mins
804


ঠাকুর মসাই,,,,,, ও ঠাকুর মসাই বাড়িতে আছেন?

রমা- কে?

রতন- আমি রতন বৌদি,,, ঠাকুর মশাই বাড়িতে নাই??

-- ও,, রতন ঠাকুর পো,,,আছেন, ওই তো আহ্নিকে বসেছে।কেন খুঁজছো ওকে?

-- বলছি বৌদি আমারও খুব তাড়া,, এদিক সেদিক তাকিয়ে,,,,ঠাকুর মশাইকে বলে দিবেন যে ঈশান খুড়ো আজ সন্ধ্যা ওই বিজুর বাড়িতে মিটিং ডেকেছে। আপনি জানেন তো কেন? না বৌদি?(একটা অশ্লিল ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিয়ে)

রমা প্রথমে লজ্জায় ঘৃনায় গা গুলিয়ে এলে মাথা নিচু করে কিছুটা সাহস যোগায়।তার পর মুখের ভাবটা কঠিন করে তাকায় রতনের দিকে চোখে কঠিন দৃষ্টি হেঁনে বলে,,,, """না ঠাকুরপো সবটা পরিস্কারভাবে জানি না। তবে এ গ্রামে চরিত্রের শুদ্ধতা যে অনেকেরই নেই, সেটা খুব ভালো করে জানি। কাজলি সহায় সম্বলহীন একটা বিধবা মেয়ে তাই আজ তার বিচার বসেছে। নইলে এ দলে যে আরও অনেকে আছে, যাদের বিচার করা সম্ভব নয়।""'

কথাটা যে তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে তা ভালো করেই বুঝলো ধূর্ত রতন তবু রমা বৌদির সাদা সরল মুখখানিতে হঠাৎ কাঠিন্যের প্রলেপ যে বুকের ভীতরে ভয়ের সৃষ্টি করলো তা অগ্রহ্য করতে পারলো না।তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাওয়ার পথ ধরে বললো,,,আসি গো বৌদি খুব তাড়া বোঝেনই তো যত ঝামেলা এই রতনের ঘাড়ে।

রমা( একটা চাপা শ্বাস ফেলে) -- তা আসো,,, 

বিষ্ণুপদো ঠাকুর ঘর থেকে বেড়িয়ে এলেন,,,

"""কে এসেছিল গিন্নি? বাহিরে কারও গলা শুনলাম মনে হয়? ""

--(রমা, জল খাবার দিতে দিতে) রতন এসেছিল তোমাকে ডাকতে। বিজুর বৌয়ের বিচারের জন্য মিটিং ডেকেছে সেখানে যাওয়ার কথা বললো।

বিষ্ণুপদো মুখ অন্ধকার করে,,,""ও ""

রমা----যাবে ?

বিষ্ণুপদো -----দীর্ঘশ্বাস ফেলে,,,"""না গিয়ে উপায় আছে,,,সেই তো ঠুটো জগন্নাথ করে বসিয়ে রাখবে। তবুও আমাকে না নিলেই নয়। আর ভালো লাগেনা গিন্নি জানো?( রমার বানানে পছন্দের জলখাবারও যেন হঠাৎ বিস্বাদ লাগলো বিষ্ণুর মুখে)

রমা----- ভালো না লাগলে তুমিতো ওদের মুখের উপর বলতে পারো যা করার ওরাই করুন, তোমাকে না নিতে।

বিষ্ণুপদ -- তা কি হবে গিন্নি ওদের তো ছক কষা আছে,,, আমায় নিয়ে গেলে ওরা বলবে যে ওরা যা করবে তাতে শাস্ত্রীয় সম্মতি আছে। আর আমি কিছু বলতে গেলেই বলবে"" আপনি গোবিন্দ সেবাই করুন ঠাকুরমসাই এ গুলো সামাজিক বিষয় আপনার মাথায় ডুকবেনা।"" কিছু বলতেও দেবে না আবার না গেলেও নয়।

রমা---- তাহলে?

বিষ্ণুপদ---- যেতেই হবে। (খাবারটা রেখেই উঠে গেলো বিষ্ণুপদ। রমাও না করলো না। লোকটা যে ভিতর থেকে বড্ড বেশি নরম।)

"""এই ফুলছরি গ্রামের জমিদার বংশের শেষ বংশধর ঈশান বাবুর গ্রাম। তিনি আর তার ডানহাত রতন, এই গ্রামের প্রধান। এমন কোন কাজ নেই যা রতন করতে পারে না খুন থেকে মানুষ গুম করা পর্যন্ত। ঈষানবাবু শুধু আদেশ করলেই হয়। আর তাই গ্রামে রতন নামটা একটা ত্রাস। চিরকুমার ঈষান বাবুর ঘরে নিত্য নতুন মেয়ের ব্যবস্থাও করে এই রতন, তাই রতনের বিরুদ্ধে বলা মনেই ঈশান বাবুর আতে ঘা লাগা। গ্রামের সমস্ত মানুষগুলো ওদের দেখলেই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে । """

রতন গ্রামের মানুষকে বিচারে জড়ো হওয়ার জন্য পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতে লাগলো। সাইকেল চালাতে চালাতে বিরবির করে ওঠ রতন,,,,"""শালা বিজুটা মরার পর বেশ মাঝে মাঝে কাজের জন্য,টাকা পয়সার লোভে বা অন্য কোন প্রয়োজনে কাজলির সাথে রাত কাটছিল, জ্যেঠারও আর আমারও। মাঝখান থেকে সুরেশ এসে কেমন ঘেঁটে দিল। শালী এখন শুধু কাছে না আসার বায়না করে। সন্দেহ হলে একটু খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সুরেশের সংগে ভেগে যাবার চেষ্টায় আছে। অনেক কষ্ট করে রাতে পাহারা দিয়ে কাল দুজনকে হাতে-নাতে ধরেছি।এবার দেখ রতনের সাথে বেইমানির মজা,,,"""' ভাবতে ভাবতে পৈশাচিক আনন্দে সাইকেল এর প্যাডেলটায় জোড়ে এক চাপ দেয় রতন।

মিটিংএ গ্রামের সবাই একজোট হয়েছে। সবার মুখে চলছে এই দুস্কর্মের প্রতিক্রিয়া।অদুরে সুরেশ একটি আম গাছের সাথে বাঁধা। সারা শরীরে মারের কালসিটে দাগ ও জায়গায় জায়গায় শুকনো রক্তের চিহ্ন। কাজলি মাটিতে বসে স্থির হয়ে আছে আর বিচারকেরা একটি পরিস্কার জায়গায় চেয়ারে বসে কি শাস্তি দিবে সেই আলোচনায় মত্তো।

এবার একটু গলাটা পরিস্কার করে ঈশান বাবুর উদ্দেশ্যে বললো

ঈশান বাবু--- কাজলি তোর কিছু বলার আছে?

কাজলি সম্বিত ফিরে পেয়ে,,, চারদিকে তাকিয়ে বুকের কাপড়টা ঠিক করতে করতে ঈশান বাবুর কাছে গিয়ে হাত জোর করে বলতে লাগলো ""বাবু আমাদের কোনো দোষ নেই, আমরা তো চলেই যাচ্ছিলুম।"""

ঈশানবাবু ----তোর লজ্জা করে না একটা সোমত্ত মেয়ে ঘরে রেখে ছেলের বয়সি পুরুষের সাথে ভেগে যাওয়ার চিন্তা করিস?

সুরেশ ছেলের বয়সি না হলেও কাজলির থেকে বছর পাঁচেকের ছোট হবে।

কাজলি চুপ করে থাকে,,, ও জানে ভুল করছিল কিন্তু সুরেশের ছোঁয়া, ওর সোহাগকে একান্ত নিজের করে পাবার আর কোন রাস্তা ওর জানা ছিল না। সে তো ভালোবেসেছে সুরেশ কে। সুরেশও তাকে ভালোবেসেছে তাই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুজন মিলে। আর এই সমাজ? এই সমাজকেই তো ত্যাগ করে চলেই যাচ্ছিল চিরকালের মতো। 

মেয়েকে অনেক আগেই কাজলি তার বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। নয়তো সেও হয়তো ঈশান বাবুর হাত থেকে রেহাই পেতো না। ঠিক সে যেমন রক্ষা পায় নি। স্বামী মারা যাওয়ার পর কাজের কথা বলে, রতন ও ঈশান বাবু ওকে খুবলে খেয়েছে প্রতিরাতে। তার মতো আরও কত হতভাগি যে এ গ্রামে রয়েছে যারা এই নরপিশাচ দের শিকার। আজ সেই ঈশান বাবুই নাকি এই বিচারের বিচারক! কাজলির চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে """তাইলে ওই জমিদার ও তার চেলারও বিচার করো তোমরা। অপরাধ তারাও কোরেছে। আমার থেকেও অনেক বেশিই কোরেছে।"""" কিন্তু কোন শব্দ বের হচ্ছে না কাজলির মুখ থেকে। তাকে ঘিরে থাকা চেনা লোকগুলোর অচেনা চাহুনি ওকে শূলের মতো আঘাত হানছে।


আজ কাজলির বাবার বাড়ির সবাইকে নিয়ে এসেছে এরা। মেয়েটার সামনে মায়ের এরকম বিচার লজ্জায় শেষ করে দিচ্ছে কাজলিকে। একজন জন্মদাত্রী মায়ের এ প্রকার বিচার তার মেয়ের সামনে যেন মৃত্যু যন্ত্রণার থেকেও বেশি অনুভূত হচ্ছে। ভালোবেসে কি খুব ভুল করেছে কাজলি? ওর কি মন নেই? শুধু সমাজের পুরুষদের নিজের মনের কথা শোনার অধিকার আছে? সে নারী বলে কি এ দাঁড় তার বন্ধ?

অনেক আলোচনার-সমালোচনার পর ঈশান বাবু এই সিদ্ধান্তে উপনিত হলেন যে, সুরেশের সাথে আজই কাজলির মেয়ে কাকলির বিয়ে দেয়া হবে। যাতে আবার কাজলি সুযোগ বুঝে সুরেশের সাথে চলে যেতে না পারে। সারা গ্রামের লোকজন ঈশান বাবুর সিদ্ধান শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। তবে সুরেশের পরিবার কৃতজ্ঞতার সাথে সিদ্ধান্ত এ মেনে নেয়। চরিত্রহীন, বিধবা কাজলীর বদলে ওর মেয়ে কাকলি ওদের যোগ্য বউ। এর থেকে ভালো বিচার আর কি হতে পারে?

গ্রাম বাসির সিদ্ধান্তে স্তব্ধ কাজলি। বিজুর মৃতুশোকের থেকেও যেন বড় আঘাত পেলো সে। মুখচোরা, সরল সুরেশকে কত রসিকতা কত ভালোবাসা দিয়ে পুরুষ করেছে। আর সেই প্রেমিক পরুষ অন্যের হচ্ছে,, হোক সে মেয়ে ওর নিজের মেয়ে, তবুও যেন সহ্য করতে পারছে না সে। নিদারুণ যন্ত্রণায় করুন সুরে কান্না শুরু করলো কাজলি।

কাজলির বছর পনেরোর মেয়েটা ভয়ে, লজ্জায় অবনত মাথায় মামার বুকের মধ্যে ঢুকে যেতে চাইলো। এতোক্ষণ তার মায়ের কর্ম তার কাছে লজ্জার ছিল এখন তো তা ভয়ে পরিনত হলো। কিন্তু ওর মামার হাতও আজ ওকে রক্ষা করতে পারবে না। এ যে বিচারের সিদ্ধান্ত এর বাইরে গেলে আরও বড় সমস্যা হবে।

বিষ্ণুপদ এতোক্ষণ শুধু দর্শকের মতো দেখছিল। কিন্তু আর পারলো না বিবেকের দহন উপেক্ষা করতে। এবার বলেই উঠলো,,, """ঈশানকাকা এটা কি ঠিক হচ্ছে যেখানে এই সুরেশের ওর মায়ের সাথে সম্পর্ক, সেখানে মেয়েটিকে সুরেশের সাথে বিয়ে দেওয়া কি উচিত হবে? ""

ঈশান বাবু -----বাবা বিষ্ণু তুমি তো এই সমাজ,এই সব ছোটলোকের সম্পর্কে ততটা জানে না বাবা । আজ এই সমাধানটা না হলে ব্যপারটা খুব খারাপ হবে। এই মেয়েছেলের জন্য ওর ওই ছোট মেয়েটার জীবন নষ্ট হবে। সে যাই হোক তোমার সরল মন এতো নোংড়া কথা তোমার মাথায় ঢুকবে না। তবুও তুমি ব্রাহ্মণ মানুষ, একবার যখন বলেছো, তোমার জন্য না হয় সুরেশকে একবার জিজ্ঞাসা করি।এই কে আছিস সুরেশকে একবারটি সামনে আনতো।

রতন বাঁধন খুলে সুরেশকে টানতে টানতে নিয়ে আসে ঈশান বাবুর সামনে।

ঈশান বাবু সুরেশের দিকে বেশ সহমর্মিতার স্বরে জিজ্ঞেস করলো """তা বাবা কাজলির মেয়ে কাকলিকে বিয়ে করতে তোমার কি কোন আপত্তি আছে?""

সুরেশ একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবং কাকলির দিকে তাকায়, কাকলির বছর পনেরোর রুপে নিজের চোখ দুখানি জুরিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে মাথা নামিয়ে নেয়,,, তারপর অতি মৃদুস্বরে বললো ""আপনি যা ভালো বুঝবেন,,,,।""

কথাটা শুনে লজ্জায় মুখ নিচু করে বিষ্ণুপদো। সমাজটা সত্যি তার বড় অচেনা।

অবাক কাজলিও,,, তার বিশ্বাসের এই প্রতিদান? যার জন্য ঘর ছাড়ছিল সে, আজ তার মেয়েকে দেখে ওকে ভুলে গেলো! র্নিলজ্জের মতো কাকলিকে বিয়ের জন্য হ্যা বলে দিল সুরেশ!

একটা জয়ে হাসি ছড়িয়ে পরে ষাট উর্দ্ধ ঈশান বাবুর মুখে বলে,,,

 """এই বেশ হলো বুঝলে হে বিষ্ণুঠাকুর। গ্রামখানি এত বড় একটা পাপ থেকে বেঁচে গেলো। তা কাজলি কাল থেকে তুই সকাল সন্ধ্যা আমার বাড়িতে কাজ করবি খাবি দাবি থাকবি।কোন বিশ্বাস নেই তোকে আবার কোন বিপদ ঘটাবি। তাই সব সময় চেখের সামনে থাকবি। রতন তোর উপর নজর রাখবে।""'

ঈশান বাবুর কথার মাঝে ওই লোলুপ দৃষ্টি বাকি সবার চোখ এড়ালেও কাজলির ক্রন্দনরত চোখকে ফাঁকি দিতে পারলো না। সেই দৃষ্টি কাজলির বুকের রক্তকে শুষে নিতে লাগলো। পাশেই রতনের মুখের কোনায় ফুটে ওঠা বিজয়ের হাসি ওকে বুঝিয়ে দিলো কি হতে চলেছে।

সমাপ্ত



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama