বিচার
বিচার
বিচার
স্মরজিৎ দত্ত
কোর্টে থীক থীক ভিড়। সবারই আগ্রহ বারাসাতের অতীনের মামলা আজ উঠবে। অতীনের বয়স মাত্র পাঁচ বছর। অথচ তারই নামে উঠেছে খুনের মামলা। আইনের চোখে যাকে খুন হিসেবে ধরা হয়েছে সেই ব্যক্তি তারই বাবা। পক-সো আইনে অতীনের মামলা চলছে।
অপরাধ ধারালো অস্তের আঘাতে সাংঘাতিক আহত হয়েছে তার বাবা। ঘটনার দিন পাড়ার প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসাও করা হয়েছিল কিন্তু আঘাত সইতে পারেনি অতীনের বাবা অভিক রঞ্জন দাস। চারদিনের লড়াইয়ে সে সকলের মায়া কাটিয়ে চলে গেছে এই পৃথিবী ছেড়ে। এত ঘটনার পরও পাড়ার সকলে ওই ছেলেটিকেই সমর্থন করছে।
অতীন অভিক আর মালবিকা এই নিয়েই ছিল ওদের সুখী পরিবার। অভিক তেমন ভালো না কাজ করলেও ভালোবেসে বিয়ে করা তাই সামগ্রিক হাল ধরার দায়িত্ব নিয়েছিল মালবিকা নিজেই। মালবিকা একটা হাসপাতালে কাজ করতো। আর সময়ের ফাঁকে নিজের ছেলের সাথে আরও কিছু ছেলে মেয়ের শিক্ষায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে ছিল সে। পাড়ায় তার ভালো সুনামও ছিল। কেবল ওই চাপা স্বভাবের মেয়েটির ছিলনা শান্তি। সংসারের এই বিপুল ভার বহন করেও ওষ্ঠাগত প্রাণ হত তার প্রিয় স্বামীর নেশার পয়সা জোটাতে। অনেক চেষ্টাও করেছে সে , তার প্রিয় স্বামীর এই নেশা কাটাবার জন্য। অনুরোধ, অভিযোগ, প্রতিবাদ তার প্রতিদানে তার মিলেছে অকথ্য অত্যাচার। আর তার সাক্ষী মালবিকার সারা শরীর জুড়ে ক্ষতচিহ্ন।
ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সে। অথচ স্বামীর এই বাউন্ডুলে পানায় অতিষ্ঠ হয়ে সে চাইনি সন্তান নিতে। সেখানেও জোর খেটেছে স্বামীর। সাথে স্বামীর পরিবারের অন্যজনের। এক সময়ে পাড়ায় সে পরিচিত হয়ে গিয়েছিল বাজা বলে। টিকা টিপ্পানি, হাসি ঠাট্টা ইত্যাদির জ্বালায় সে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। অথচ কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারেনি তার স্বামীর কিংবা স্বামীর পরিবারের অত্যাচারের কাহিনীকে। পাড়ার রমা কাকিমা আর তার মেয়ে ছিল তার একমাত্র সুখে দুঃখের সাথী। সে এবং তার মেয়েই প্রতিক্ষেত্রে মালবিকার পাশে এসে দাঁড়াতো। একসময়ে তারাও প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল চেষ্টা করেছিল পাড়ার আরো পাঁচজনকে মালবিকার পাশে দাঁড় করিয়ে এ সমস্যার সমাধান হোক, তার জন্য। কিন্তু প্রতিবারই বাঁধ সেজেছে মালবিকাই। প্রতিবারই সে বলেছে কাকিমা আমার যা ভাগ্যে আছে আমাকে তা মেনে নিতে দাও। ভালোবেসে বিয়ে করেছি বাবা-মার কাছে ফিরে যাবার মতন রাস্তা আমার নেই। আর স্বামীকে ভালো করতে না পারা সেটাও আমার অকৃতকার্যতা। আশীর্বাদ করুন অন্তত আমার সন্তানটাকে মানুষ করতে যেন পারি। অসহ্য যন্ত্রণা অত্যাচার সব দেখেও রমা কাকিমা ও তার মেয়ে মুখে কুলুপ আঁটতে বাধ্য হয়েছিল।
রোজের মত সেদিনও অনেক রাতে ফিরেছিল অভীক মত্ত অবস্থাতেই। তখনো ফেরেনি মালবিকা হাসপাতাল থেকে। বাড়িতে ছোট্ট অতীন তার একমাত্র সাথী মোবাইল ছেড়ে গেটের কাছে ছুটে গিয়েছিল দেখতে কে এসেছে? বাবার এমন অবস্থায় অভ্যস্ত থাকলেও সেদিনের অব্যবস্থায় প্রস্তুত থাকেনি ছোট্ট অতিন। দরজার পাশে রাখা ওই চাবি দিয়ে বাবাকে দরজা খুলে দিতেই বেশ অপ্রস্তুতি পড়ে যায় ছোট্ট অতিন। হঠাৎই তার বাবা তার গলা ধরে তুলে ফেলে মাটি থেকে উপরে। অসহায় অপ্রস্তুত অতীন কি করবে বোঝার আগেই ভয়ে কাঁদতে থাকে সে। তারপর হঠাৎই মত্ত বাবা তাকে ছুড়ে ফেলে দেয় মাটিতে। অকথ্য গালাগালে সারা ঘর ভরিয়ে তোলে অভীক। ব্যথায় কাতর অবস্থাতেও ছোট্ট অতীন বারবার বলে ওঠে "তুমি মাকে গালাগাল দিচ্ছ কেন? মা কি করেছে?"পুনরায় আঘাত ধেয়ে আসে ছোট আতিনের ওপর। ইতিমধ্যেই অতীনের মা বাড়িতে ঢুকলে এই অবস্থা দেখে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ছুটে যায় সে তারা একমাত্র সন্তান ছোট্ট অতীনকে বাঁচাতে। প্রতিদানে পেতে হয় তাকে কোমরের বেল্টের মার, গালাগাল, সাথে তার হাতের কাছে চটি জুতো থেকে আরম্ভ করে আরো ইত্যাদির মার। ছোট্ট অতীন বুঝতে পারেনা কি করতে হবে তাকে? রাত বাইরে অন্ধকার তবুও সে ছুটে যায় রমা ঠাকুমা আর তার মেয়ের কাছে। তারা প্রথমে তাকে বলে ও তোদের বাড়িতে রোজের কীর্তন। বরং তুই আমাদের কাছে থাক, তোর বাবার নেশা কেটে গেলে এমনিই আবার চুপ হয়ে যাবে। তখন তোর মা এসে তোকে বরং নিয়ে যাবে। ছোট্ট অতীন উতলা হয়ে ওঠে। সে বারবার বলে ঠাকুমা আজ বাবা অন্যরকম। আমার ভয় হয় বাবা যদি মাকে মেরে ফেলে। রমা কাকিমা তাকে হাজার বোঝাবার চেষ্টা করলেও ছোট্ট অতীন বোঝেনা। হঠাৎই সে ছুটে ফিরে আসে তার মায়ের কাছে। ঘরে ঢুকে ছোট অতীন আরো দিশাহারা হয়ে যায় মা ঘরের মেঝেতে পরে আছে মাথা থেকে রক্ত ঝরছে। সে প্রথম ছুটে যায় মার কাছে । মা তোমার কি হয়েছে? বাবা তোমাকে এমন করে মারল কেন? ছুটে যায় সে তার নিজের ঠাকুমা দাদুর কাছে। পাশের ঘরে থেকেও তারা একবারের জন্য ছুটে আসেনি। ছোট্ট অতীন অনেক আকুতি জানিয়েও তার দাদু ঠাকুমাকে আনতে পারিনি তার মা-বাবার কাছে। ছোট হলেও অতীন এমন ঘটনার বহু সাক্ষী ছিল বলেই নিজে হাতে মগে করে জল নিয়ে এসে মার মাথায় জল ছিটিয়ে মার জ্ঞান ফেরাতে চেষ্টা করে সে। অথচ তখনও থামেনি তার বাবার গাত্রদাহ অশালীন কথার বর্ষণ। নিজে হাতেই ঘরে থাকা ঔষধ দিয়ে তুলো দিয়ে তার মায়ের মাথার যেখান দিয়ে রক্ত বেরচ্ছিল তা ঢেকে দেয়। এতক্ষণ ধরে অতীনের বাবা দূর থেকে গালিগালাজ চালালেও পর্যবেক্ষণ রাখেনি বন্ধ। অতীনের মা উঠে বসায় পুনরায় যেন রাগের বর্ষণ বেড়ে ওঠে তিন গুণ। ছোট্ট অতীন ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে সে বাবাকে বারবার তার ক্ষমতা অনুসারে গরজাতে থাকে পুনঃ পুনঃ। তাতে থামা দূরের কথা অত্যাচারের দিশা পাল্টে তার দিকেও ছুটে আসে সমান ভাবে। ছোট্ট অতীন বার বার কখনো পালিয়ে কখনো লুকিয়ে সে মারের হাত থেকে নিজেকে করে প্রতিহত। এক সময় হঠাৎ তার বাবা কোথা থেকে নিয়ে আসে একটা বড় ছুরি তাই নিয়ে ছুটে যায় অতীনের মায়ের দিকে। ছোট্ট অতীন কি করবে দিশা পায় না হঠাৎই তার ঘরের কোণে নজর পরে তাদের তরকারি কাটার বটির। এক মুহূর্ত চিন্তা না করেই সে সেটাকে তুলে নিয়ে কোন রকমে বাবার দিকে ছুটতে যাবার মুহূর্তেই তার বাবার নজরে পড়ে। তাকে তার যেন মনে হয় তার বাবার আরো বেশি ক্রোধ বেড়ে যায় সামনে অসহায় অতীনের মা সে ছুটছে, তার প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে। পেছনে অতীনের বাবা। সর্বশেষ অতীন হাতে তার বটি। দিশা হারিয়ে ছোট অতীন ছুঁড়ে দেয় বটিটি। বটিটা গিয়ে লাগে তার বাবার গায়েও কিন্তু তাতে যতটা বিপদ হয়েছিল; বিপদ বাড়ল তার পরের ঘটনায়। বাবা ক্ষণিকের তরে এই ঘটনায় থতমত খেয়ে পা পিছলে পড়ল চিত হয়ে এবং তা ওই বটির উপরেই। খানিকক্ষণ ছটফট করে একসময় নিস্তেজ হয়ে পড়ল সে। এদিকে তার সামনে অতীনের মা পেছন ঘুরে হঠাৎই দেখে তার প্রিয় স্বামী মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে আর দূরে তার ছোট্ট অতীন ভয়ে জড়োসড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চিৎকার করে কেঁদে ওঠে মালবিকা ছোট্টু তুই কি করলি ? তোর বাবা যে আর কোনদিন ফিরে তাকাবে না। কাজের ফেরত অকথ্য অত্যাচার যন্ত্রণা সহ্য করেও তার প্রিয় স্বামীর জন্য হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। এবার তার কাদার শব্দ শুনে তার শ্বশুর শাশুড়ি যারা এতক্ষন ঘর বন্ধ করে ছিল তারাও ছুটে এলো তাদের চিৎকার আর মালবিকার কান্নায় ছুটে এলো পাড়ার আরো কিছু লোক। তারপর এলো পুলিশ তারা অতীন এর বাবার লাশ নিয়ে পাঠালো ময়না তদন্তে। আর ছোট্ট অতীন তার নিজের বাড়ি ছেড়ে, তার আস্তানা হল অন্যত্র, গরাদ যার নাম।
কোর্টে বিচারকের সামনে এমন করেই ছোট্ট অতীন সমস্ত ঘটনা বললো। সারা ঘর জুড়ে বসে থাকা সমস্ত লোক একটা শব্দ পর্যন্ত করল না। ছোট্ট অতীন এবার বলল, স্যার আমি জানি আমি বাবাকে মেরে ফেলেছি। আমার তার জন্য শাস্তি হবে। তবে আমার মাকে তো আর কেউ মারবে না। তবে তোমরা আমার মাকে ওই দাদু ঠাকুমার কাছে রেখো না। ওরা মাকে খেতেও দেবে না। মা যা কষ্ট করে পয়সা নিয়ে আসবে তা ওরা নিয়ে নেবে। মাকে তোমরা অন্যখানে কোথাও রেখো আমি ছোট্টবেলা থেকে দেখে এসেছি মাকে ওরা সবাই মারে। অথচ মা ওদের আমার সকলের জন্য খাবারের পয়সা নিয়ে আসে। তোমরা আমাকে যা শাস্তি দেবে আমি নেব । কিন্তু তোমরা আমায় কথা দাও আমার মা আর কোনদিন কষ্ট পাবে না তো?
মাননীয়া বিচারপতি এতক্ষন সমস্ত ঘটনা শোনার পর পারলেন না আর নিজের চোখের জলকেও আটকাতে। অনুরোধ জানালেন ছেলেটিকে তার কাছে নিয়ে আসতে। আর বললেন বিবাদী পক্ষের কোন উকিল সওয়াল করবেন? বিবাদী পক্ষের উকিল উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে বিচারকের সামনে বললেন ম্যাডাম আমি অপারক। বিচারক নিশ্চুপ। সারা হলের গুঞ্জন একটু একটু করে বাড়তে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ পর অতীনকে পাশে নিয়েই বিচারক বললেন অনেক সময়ে অন্যায় ন্যায় হয়। আর তার বিচার আমাদের কারো হাতে থাকে না। শিশুটি অন্যায় করেছে। কিন্তু আরও বড় শাস্তি দিয়েছে নিয়তি আসামিকে। হয়তো ওই অস্ত্রের আঘাত পেলেও অতীনের বাবা মারা যেতেন না। অতীনের বাবা পড়ে গিয়েছিলেন বলেই ওই অস্ত্র আরো গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছিল আর তাতেই তার মৃত্যু। ফরেনসিক রিপোর্টও তাই বলছে। কিন্তু যারা পাশাপাশি ছিল পরিবারের অন্যতম লোক হয়েও তারা অতীনের বাবার অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়েছে বারবার। ঘটনার সময়ও তারা এগিয়ে আসেনি। তাই আমি অতীনকে বেকসুর খালাস করলাম। পরিবর্তে অতীনের দাদু এবং ঠাকুমাকে আমি পাঁচ বছর সশ্রম কারাদন্ডে দণ্ডিত করলাম। অনেক সময় এমনই বিচারের বাণী নীরবেই কাঁদে। দোষীও অনেক সময় দোষী হয় না।
