ভন্ড পীর
ভন্ড পীর
ফাইয়াজ এই সদ্য গ্রাজুয়েশন পাস করলো । মাস্টার্স করবে কিনা ভাবছে । বাড়িতে সবাই তাকে মাস্টার্স করে একটি চাকরি করতে বলছে । কিন্তু ফাইয়াজের চাকরি করার কোনো ইচ্ছা নেই । তার ইছা গোয়েন্দা হওয়ার , ফেলুদার মতো । যদিও সে মনে করে ফেলুদার একটি নখের যোগ্য হওয়া সম্ভব নয়। তবে ছোটখাটো গোয়েন্দা সে হতেই পারে- এইরকম ই তার কনফিডেন্স। তাই সে বাড়িতে একটি শর্তেই মাস্টার্স করতে রাজি হয়েছে যে তাকে পার্টটাইম গোয়েন্দার কাজ করতে হবে । বাড়িতে বাধ্য হয়ে রাজি হয় । কারণ ফাইয়াজ এর বাবা মা জানে যে তারা রাজি না হলে ফাইয়াজ কোনো মতেই মাস্টারর্স ডিগ্রী করবেনা।
ফাইয়াজের প্রথম কেস ফাইয়াজের বন্ধুর কাছ থেকেই আসলো । তার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু সত্যজিৎ । ফাইয়াজ তাকে সত্য বলে ডাকে । সত্য ফাইয়াজকে ভালোভাবে জানে। ফাইয়াজের গোয়েন্দাগিরি প্রতি তার পাক্কা বিশ্বাস আছে ।
সত্যর দাদা অমিতের বিয়ে হয়েছে মাত্র তিন মাস । কিন্তু সমস্যা হলো অমিতের বউ অর্থাৎ সত্যর বৌদি রুমির শরীরে নাকি মাঝে মধ্যেই ভুত ভর করে । সত্য ভুতে বিশ্বাস করেনা । কিন্তু তার বাড়ির লোক করে । সত্যর মনে হয়েছে যে এটা অন্য কোনো সমস্যা। ভুতের সমস্যা নয় । আর এ ব্যাপারে সে ফাইয়াজের সাহায্য চাই।
ঘটনাটা শুনে ফাইয়াজ প্রথমেই প্রশ্ন করলো , ভুত আসার লক্ষণ কি ?
এই উত্তরে সত্য একটি ঘটনা বললো -
বাসর রাত্রে দাদা ও বৌদি ক্লান্ত ছিল। তাই তারা দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ে। মাঝ রাত্রে প্রায় দুটোর দিকে বৌদি বলে বাথরুম যাবো । দাদা বৌদিকে নিয়ে বাথরুমে যায় । বাথরুমে বৌদি প্রবেশ করে , দাদা বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলো। কিছুক্ষন পরে বাথরুমের দরজা খুললো কিন্তু বৌদি বেরিয়ে আসছেনা। দাদা দুবার দরজায় টোকা মারে । কিন্তু তাতেও বৌদি বেরিয়ে না আসায় দাদা ভাবতে শুরু করে বৌদি হয়তো পড়ে গেছে বা কোনো বিপদ হয়েছে । দরজা খুলে দাদা ভেতরে ঢুকতেই বৌদির এক ভয়ানক মূর্তি দেখতে পায়। বৌদি দাঁড়িয়ে আছে , বৌদির শাড়ির আঁচল খুলে পড়ে আছে। বৌদির চুল এলোমেলো , সারা মুখমন্ডল ঢাকা আছে চুলে শুধু চোখ দুটো বাদে, চোখ দুটো লাল বড় বড় । বৌদি হাতটা তুলে নাকি ইশারা করে বলছে , " আই ...আই..." । দাদা একটু ভীতু টাইপের , সে চেঁচিয়ে বাড়ির সবাইকে উঠালো বৌদিকে দেখানোর জন্য। সবাই বাথরুমের কাছে এসেই দেখছে বৌদি রুমি স্বাভাবিক অবস্থায় বাইরে দাঁড়িয়ে আছে । সুন্দর শাড়ির সাজ , সুন্দর চুল গোছানো , আর স্বাভাবিক অবস্থায় কথা বলছে । দাদা তো দেখে অবাক। এই কিছুক্ষণ আগে ভুতুড়ে রূপে ছিলো আর এই স্বাভাবিক রূপ । এ কি করে সম্ভব !
সেই ঘাটনার পর আমাদের বাড়ির লোক বৌদিকে তার মায়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেয় । ওখানেও নাকি সেই একই অবস্থা । তাকে নাকি ভুতে পেয়েছে । এবং তাকে ভালো করার জন্য নাকি গোলাপী বাবা নামে একজন পীরবাবাকে দেখাচ্ছে। সে নাকি ভুত ঝাড়াতে পারে ।
সব ঘটনা শুনে ফাইয়াজ শুধু একটা কথাই বললো , "আচ্ছা।" তারপর ফাইয়াজ বললো , " গোলাপী বাবা কোথায় বসে ? "
-- " জবলপুরে ?"
-- "খোঁজ নে ঠিক কোন জায়গায় বাবার আস্তানা।"
-- "আচ্ছা" বলে সত্য চলে গেল।
পরের দিন সন্ধে বেলা সত্য ফাইয়াজের কাছে এসে গোলাপী পীরবাবার আস্তানার সমস্ত খবর দিলো। তেঁতুলতলাই নিজের বাড়িতে একটি রুমে বসে সে। পীরবাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হলে রীতিমতো টাকা দিয়ে নাম লেখাতে হয়।
ফাইয়াজ বললো ," তোর রুমি বৌদি নেক্সট কবে পীরবাবর সঙ্গে দেখা করতে , মানে চিকিৎসা করাতে যাবে জানাতে পারবি ?"
দুদিন পর সত্য খবর নিয়ে এলো যে বৌদি মাসে দুবার চিকিৎসা করাতে যায়। সামনে পরশু তার আবার যাওয়ার কথা আছে।
ফাইয়াজ সত্যকে আগামীকাল পীরবাবার কাছে চিকিৎসা করানোর জন্য তার নাম লেখাতে বললো। এ শুনে সত্য অবাক হয়ে বললো , " তোর আবার কি হোলো ?"
- " কিছুই হয়নি , শুধু পীরবাবাকে একবার দেখতে হবে আর তার ভুত ঝাড়ানোর পদ্ধতিটা জানতে হবে। "
- "কালকেই জাবি ?"
-" কালকেই যেতে হবে।"
- " ওকে , আমি নাম লিখে দেব তোর।"
- "তোকেও আমার সঙ্গে যেতে হবে । "
-" আমাকেও যেতে হবে ?"
-" হ্যা।"
- "আচ্ছা , জাব তাহলে।"
পরের দিন ফাইয়াজ ও সত্যজিৎ বেরিয়ে পড়লো। পীরবাবার আস্তানায় ভালোই ভিড়। ফাইয়াজের নাম পঁচিশ নম্বরে আছে। ফাইয়াজ চুপচাপ বসে চারিদিক নজরদারি করছে। অদ্ভুত ভাবে সে লক্ষ্য করলো যে রুগীদের আশি শতাংশ মহিলা। এবং ফাইয়াজ এটাও লক্ষ্য করলো যে গড়ে ত্রিশ মিনিট করে সবাইকে দিচ্ছে। কিন্তু মহিলা বা মেয়ে যদি সুন্দরী হয় তাহলে সেটা আধঘন্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক-ঘন্টাও হচ্ছে।
ফাইয়াজের পালা এলো। ফাইয়াজ ভেতরে প্রবেশ করলো । ভেতরে প্রবেশ করে সে দেখতে পেলো এক যুবক, তার বয়স খুব বড়জোর পঁয়ত্রিশ হবে। তিনিই পীড়বাবা । পীরবাবার চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে, গালে বর্তমান যুগের ছোট ছোট স্টাইলিশ দাড়ি, মাথায় সবুজ পাগড়ী , পরনে গোলাপি পাঞ্জাবি। পীরবাবাকে রীতিমতো বললিউডের নায়ক মনে হচ্ছে।
ফাইয়াজ পীরবাবার সামনে গিয়ে বসলো। একটি ভুলভাল মনগড়া ভুতের গল্প বললো। পীরবাবা জানালো তাকে নাকি ভুতে পেয়েছে। ফাইয়াজ শুনে মনে মনে হাসলো। কিন্তু কিছু প্রকাশ করলোনা। বাবা কিছু ঝড় ফুঁক করে , তারপর একটি মিনারেল ওয়াটারের বোতল নিয়ে তাতে কিছু মনে মনে পড়ে ফু দিয়ে দিল। পীড়বারার ভিজিট তিনশ টাকা। ফাইয়াজ সেটা দিয়ে বেরিয়ে এলো।
পীরবারার আস্তানা থেকে বেরিয়েই ফাইয়াজ জলটাকে ফেলে দিলো। সত্য ফাইয়াজকে জিজ্ঞাসা করলো , " কি বুঝলি?"
- " পরে সব বলবো " বলে ফাইয়াজ চুপ চাপ কিছু ভাবতে ভাবতে বাড়ি চলে গেল।
রাত তখন দশটা , ফাইয়াজ পকেট থেকে ফোন বার করে সত্যকে ফোন করলো...
- " হ্যালো সত্য , কাল সকালে তুই তোর বৌদির বাড়ি গিয়ে বৌদিকে পীড়বাবার কাছে নিয়ে আসবি। তার সঙ্গে তোর দাদাকেও নিয়ে আসবি। কিন্তু তোর দাদাকে একাই আসতে বলবি। তোর বৌদি যেন জানতেও না পারে যে তোর দাদা এসেছে তোর সঙ্গে। তোর দাদাকে অন্য কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে বলবি। "
- " আচ্ছা , ঠিক আছে। " বলে সত্য ফোনটা রেখে দিলো। সত্যর পুরো বিশ্বাস আছে ফাইয়াজের উপর।
সত্যজিৎ পরের দিন তার দাদাকে পীরবাবার আস্তানায় কাছে যেতে বললো কিন্তু লুকিয়ে থাকতে বললো ।
পরের দিন ভোর ভোর সত্য পৌঁছে গেল বৌদির বাড়ি। বৌদির কাছে গিয়ে বললো , " বৌদি কেমন আছো ? "
- " ভালো আছি । " বৌদি হাসিমুখে উত্তর দিলো ।
- " তুমি কেমন আছো ?"
- " আমিও ভালো আছি ।"
- " তোমার পীরবাবার কাছে কবে এপইনমেন্ট আছে?"
- " আজকেই । "
- " তাই ! এত দারুন খবর। "
- " কোনো ? "
- " না , আমার ঐদিকে একটু ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা আছে । যদি তুমি বলো-তো তোমাকে আমি আজ পীরবাবার কাছে নিয়ে যাই ? " আনন্দের সুরে সত্য বললো।
- " তুমি যাবে....? " বৌদির একটু অস্বস্তি মাখা উত্তর।
- " না , না , বৌদি ... আজ আমিই তোমাকে নিয়ে যাবো। " একটু আবদারের সুরে বললো সত্য ।
বৌদি রুমির অনিচ্ছা থাক সত্ত্বেও রাজি হলো , যাকে এক কথায় বলে নিমরাজি ।
সত্যজিৎ সঠিক সময়ে বৌদিকে নিয়ে পৌঁছে গেল আস্তানায়। কিছুক্ষন পরে ফাইয়াজ এসে চুপ করে বসে পড়লো সত্যর পাশে। পাশে বসেই সত্যর পকেটে কি একটা ভোরে দিলো আর মাথা নেড়ে ইশারা করে কথা বলতে মানা করলো।
সত্যজিৎ পকেটে হাত ভোরেই কাগজ খুঁজে পেল। বার করে চুপ করে কাগজটি দেখলো । উর্দু ভাষায় লিখা আছে , " এই এটি বৌদির ভ্যানিটি বাগে ভোরে দে ।" আরেকবার পকেটে হাত দিয়ে কিছু খুঁজে পেল। সেটি বার করে চুপ করে সে বৌদির ভ্যানিটি ব্যাগে ভোরে দিলো।
বৌদির ডাক এলো কিছুক্ষণ পরেই। লাইনে নাম অনেক ছিল , কিন্তু আশ্চর্য ভাবে রুমির ডাক আগেই চলে এলো । রুমি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো।
রুমি বৌদি ভেতরে ঢুকতেই ফাইয়াজ সত্যকে ডেকে নিলো। বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো অমিত । তিনজন একসঙ্গে হতেই পকেট থেকে ফাইয়াজ বার করলো একটি ছোট্ট রেডিও। সেটি সে অন করলো । আর অন করতেই শুনতে পেলো কিছু কথা , কিছু শব্দ - " অনেক দিন পর এলে , কাছে এসো রুমি( ভান্ডার গলার স্বর)... চুক , চুক , আহ , আহ ( শব্দ) , লাগছে , আস্তে , ধীরে ধীরে(রুমির গলার স্বর) ...। " রুমির গলার স্বর স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। (সাতজিতের হাত দিয়ে ফাইয়াজ মইক্রোফোনটি রুমির ব্যাগে ভোরে দেয়।)
ফাইয়াজ , অমিত ও সত্যজিৎ ছুটে গেল ভন্ড পীরের আস্তানার দরজার দিকে। ভন্ড পীরের কম্পাউন্ডার ফাইয়াজকে আটকানোর চেষ্টা করলো। ফাইয়াজ এক ঘুষি দিয়ে তাকে মাটিতে ফেলে দিলো। সজোরে দরজা খুলে তারা ভেতরে প্রবেশ করলো। ভেতরে প্রবেশ করেই ভন্ড পীর আর রুমিকে এক অস্বস্তিকর অবস্থায় দেখতে পেলো। রুমি বৌদি কোনোরকমে নিজের কাপড় গুটিয়ে নিলো। ভন্ড পির চেঁচামেচি করতে শুরু করলো , " হু আর ইউ ? গেট আউট ফ্রম হেয়ার ।"
ফাইয়াজ " বাস্টার্ড " বলে এক ঘুষি দিলো ভন্ডর নাকে। ভণ্ড পীর মাটিতে গিয়ে পড়লো। ততক্ষনে বাইরের লোকের মধ্যে হুলুস্থুলস পড়ে গেছে। সবাই চলে এসেছে রুমের ভেতর। ভন্ড পীর আর রুমির অবস্থা দেখে সবাই ছি: ছি: করতে শুরু করলো। অমিতের চোখ মুখ রাগে , লজ্জায়, ঘৃণায় লাল হয়ে উঠলো।
ফাইয়াজ , অমিত ও সত্য বেরিয়ে এলো রুম থেকে। তারা সোজা রুমিকে নিয়ে অমিতের শশুর বাড়ি পৌঁছালো ।
আমিত রুমির হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে একদম শশুরের পায়ে নিয়ে গিয়ে ফেললো , তারপর রাগি স্বরে বললো , " ফাইয়াজ শুরু কর ..."
-" আপনার মেয়েকে কোনো ভুতে পাইনি। আপনার মেয়ে ভন্ড পীরের সঙ্গে নোংরা সম্পর্কে জড়িত। আর ওই ভন্ড পীরের পরামর্শেই অমিতের বাড়িতে রাতে আপনার মেয়ে ভুতের নাটক করে , যাতে তাকে ওখানে থাকতে না হয়, যাতে তাকে ওই ভন্ড পীরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় , যাতে বিয়ের পরেও ভন্ড পীরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারে তাই । এই নিন আপনার মেয়ের কর্মকান্ডের সাউন্ড- রেকর্ডিং। " ফাইয়াজ এক নিশ্বাসে সব বলে ফেললো , আর সাউন্ড- রেকর্ডারটি রুমির বাবার দিকে এগিয়ে দিলো।
রুমির বাবা মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো ...
পরের দিন পেপারে খবর ছাপানো হলো , " ভন্ড পীরকে হাতেনাতে নোংরা কাজে ধরলেন 'গোয়েন্দা ফাইয়াজ '।" ফাইয়াজের বাবা মা সেটা পড়ে খুব খুশি হলেন। ফাইয়াজও খুশি তার প্রথম গোয়েন্দা কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করে । অমিত আর সত্যজিত পরের দিন একটা গিফ্ট নিয়ে হাজির হলো 'গোয়েন্দা ফাইয়াজ ' -এর কাছে।
