STORYMIRROR

Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational

4  

Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational

ভালোবাসার নববর্ষ

ভালোবাসার নববর্ষ

8 mins
286

মানুষের জীবনটা নানা রকম বৈচিত্র্য দিয়ে ভরা, মানুষ জানেনা যে কখন তার সব থেকে আনন্দের সময়টা পরিণত হবে এক চরম দুঃখের কাহিনীতে।আজ থেকে কয়েক বছর আগেকার কথা সেদিনটাও ছিল এক বর্ষবরণের দিন, আর সেদিন দত্ত 

 বাড়িতে বধূবরণ হচ্ছিল তখন । নতুন বউ রূপা দুধে আলতায় পা দিয়ে সবে দুপা হেঁটেছে, খবর এল এ বাড়ির মেয়ে রীনা বর্ধমান থেকে বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে তার দু'বছরের ছেলে আর স্বামী নিয়ে রওনা হয়েছিল কিন্তু সেi ট্রেনের সাংঘাতিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। রূপার শ্বশুরবাড়ির সবাই হায় হায় করতে করতে রাগে রক্তরাঙা চোখে রূপার দিকে তাকাতে লাগলো। রূপার কানে গেল, ' কি অপয়া বউ রে বাবা!' সব শুনে রূপা ভাবছিল ভাগ্যের কি অদ্ভুত পরিহাস বিনা দোষে তাকে অপরাধী হতে হচ্ছে, এসব ভাবতে ভাবতে রূপা টাল খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল । শাশুড়ি কমলা তাকে ধরে ফেলল। ছেলেকে বলল, ' যা বৌমাকে নিয়ে ঘরে যা । আমি নিজের ঘরে যাচ্ছি।' বিয়ে বাড়ির আনন্দ সব দুঃখ আর রোষে পরিণত হল। আত্মীয়-স্বজন সবাই নতুন বউএর তীব্র সমালোচনা শুরু করল। বিয়ের আর কোনো অনুষ্ঠান হলো না।

বাবা মারা গেছেন বেশ কিছুদিন হল। ছেলে জয় মাকে নিয়ে দুর্ঘটনাস্থলের দিকে রওনা দিলো । প্রায় সব আত্মীয়-স্বজন চলে গেলেও জয়ের মামা মামী ছিলেন এ বাড়িতে। নতুন বউ একা তার ঘরে। কেউ আসে না তার কাছে, শুধু কাজের লোকের হাতে খাবার পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সে খাবার পড়ে থাকে। রূপা খাবার মুখে তুলতে পারে না । ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে । এখন বিয়ে হয়ে নতুন শ্বশুরবাড়িতে পা দিতে না দিতেই একি অঘটন ! সবাই যা বলছে সত্যিই কি সে তাই ? অপয়া? এবার সে কি করবে? কিরকম হাল ছাড়া হয়ে বসে থাকে রূপা। 


দুদিন পরে জয় মা আর দিদি রীনাকে নিয়ে ফিরলো । রীনাকে দেখে সবাই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো । কেঁদে কেঁদে রীনার চোখের জল ফুরিয়ে গেছে । সে সদ্য স্বামী সন্তান হারা । দুর্ঘটনাস্থলের কাছে হাসপাতালে রীনার শ্বশুর শাশুড়ি ছেলে - নাতির দেহ নিতে এসে জানিয়ে দিয়েছে অমন অলুক্ষণে বউয়ের আর মুখ দেখতে চায় না তারা। তাদের সঙ্গে রীনা যেন কোন সম্পর্ক না রাখে । রীনার শুকনো চোখ হতাশায় ভরা । সে জানেনা তার দিন কিভাবে কাটবে এখন থেকে । সে খেতে শুতে ঘুমোতে পারেনা । শুধু নির্বাক হয়ে বসে থাকে। দিদিকে দেখে রূপার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে যন্ত্রণায়। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয় । স্বামী তাকে বোঝায় , 'নিজেকে অপরাধী ভাবছো কেন তুমি? যুক্তি দিয়ে নিজেকে বোঝাও , তোমার হাত এখানে কোথায় ?' রূপা কাঁদে স্বামীর বুকে মাথা রেখে অঝোরে । কিছুতেই শান্ত হতে পারে না। এক প্রচণ্ড দ্বিধায় ননদের কাছে সে যেতেও পারে না । ভীষণ ভয় করে দীপার ওর কাছে যেতে। কমলা মেয়েকে কিছুতেই কথা না বলাতে পেরে, খাওয়াতে না পেরে অসহায় ভাবে ছেলেকে বলে, 'কি করবো রে !' জয় চিন্তান্বিত ভাবে বলে, ' ডাক্তারবাবু তো দেখে গেছেন । দেখি এখন !' ডাক্তারবাবু বলেছেন , 'ওকে কাঁদাতেই হবে যেমন করে হোক । তা না হলে না খেয়ে আর মনের যন্ত্রণায় ও তো মরেই যাবে । ওষুধও খেতে চাইছে না । যেমন করে পারেন ওকে কথা বলান ,কাঁদান, কিছু খাওয়ান।'

 

তিনদিন ধরে ওই 'পাথরের মূর্তির মুখ' দূর থেকে দেখতে দেখতে মরিয়া হয়ে রূপার নিজের মধ্যে কিরকম যেন আত্মবিশ্বাস ফিরে এল । সে উঠে রীনার ঘরে গেল কিছু খাবার নিয়ে। সামনে বসল ।'দিদি একটু কিছু খাও। দেখো , আমিও খাইনি তুমি খাচ্ছোনা বলে ।' কোন সাড়া নেই রীনার দিক থেকে । হঠাৎ রূপা পাগলের মত রীনাকে দুহাতে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলতে লাগল , 'দিদি আমায় তুমি মারো ধরো যা খুশী করো আমি তো অন্যায় করেছি । তুমি শাস্তি দাও আমায় -!' এভাবে এলোমেলো যা মুখে আসে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বলতে লাগল রূপা আর সজোরে দিদিকে ধরে নাড়াতে লাগলো । হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেল রীনা । দীপার গালে ঠাস ঠাস করে চড় কষিয়ে বলল, 'শাস্তি পেতে চাস? এই নে। এই নে । কেন আর খাবি ? ওদের খেয়ে তো তোর সব ভরে গেছে। এবার আমায় খাবি । খা খা কত খাবি ! বলে ওর মুখের কাছে দুহাত বাড়িয়ে দেয় ।' অঝোর ধারে জল ঝরে রূপার চোখে। রীনা চিৎকার করে ওঠে, ' আমাকেও খা এবার ! তুই একটা রাক্ষুসী , ডাইনি !' বলতে বলতে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল রীনা। দরজায় দাঁড়িয়ে মা আর ছেলে স্থির নির্বাক ! ডাক্তারবাবু এলেন । রূপার দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন , 'তুমি পারলে মা। এভাবে ও যদি পাথরের মত বসে থেকে আর দু-একটা দিন কাটাতো তবে কি যে হতো ভেবেই ভয় পাচ্ছি । মনের যত ব্যথা সব উগরে দিয়েছে রীনামা। এবার ও সুস্থ হয়ে উঠবে। রীনা মা যা বলেছে তুমি কিছু মনে রেখো না রূপা মা । এগুলো ওর অবচেতন মনের জমে থাকা অন্ধকার। এসব কথা ওর আর কিছুই মনে থাকবেনা। ' একটু পরে জ্ঞান ফিরতে ডাক্তারবাবু রীনাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'কেমন আছো মা?' মৃদু হেসে রীনা ক্লান্তিতে চোখ বুজলো । ডাক্তারবাবু ওষুধ দিয়ে চলে গেলেন।


রীনাকে সবাই ঘিরে রয়েছে । কেবল রূপা দরজার কাছে দাড়িয়ে । রীনা আস্তে আস্তে বাঁ হাতটা বাড়িয়ে দিল, অস্ফুটে ডাকল , 'ভাই !' জয় তাড়াতাড়ি দিদির হাতটা ধরে বলল, 'বল্ দিদি।' রুনা খুব কষ্টে বলে, 'ওকে ডাক'। রূপা তাড়াতাড়ি সামনে আসে, ' আমায় খাইয়ে দে ।' রূপা খাইয়ে দিতে দিতে কেঁদে কূল পায় না। রীনা অল্প একটু খাবার মুখে দিয়ে ধীরে ধীরে বলে, ' তুই এবার খা ।খাস নি তো ।' রূপা ধরা গলায় বলে , 'আমার ওপর রাগ করে আছো দিদি ?' 'না রে ! কি বলতে কি বলেছি ধরিস না। যা বলেছি তোর মনে যদি কষ্ট হয়, ভুলে যা । আমি জানি না কি বলেছি। আমায় মাফ করে দে !' 'এ বাবা, কী বলছ দিদি ?' দিদির হাত দুটো ধরে রূপা বলে। দুজনের অল্পস্বল্প খাওয়া হলে রীনা বলে, ' যা তোরা । আমি এখন ঘুমোবো।' 'আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিই দিদি, তুমি ঘুমোও ।' ওষুধ খাইয়ে দিদিকে ঘুম পাড়িয়ে রূপা ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো । কমলা বৌমাকে জড়িয়ে ধরে । জয় স্ত্রীর দিকে নিবিড় চোখে তাকিয়ে থাকে। কমলা মেয়ের সব ভার ছেড়ে দিল বৌমার হাতে। কাটলো কয়েকটা মাস । রীনা ক্রমশঃ খুব খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছিল । বাড়ির সবাই তটস্থ । মেয়ের মন যে কখন খারাপ হয়ে যাবে তা কিছুই বলা যায় না।


এদিকে কলেজ থেকে পাস করার পরেই রূপার বিয়ে হয়েছিল। গ্রাজুয়েশনের পর রীনারও আর পড়া হয়নি । রূপা দিদির সঙ্গে বাড়ির সবাইকে বুঝিয়ে রাজি করালো ওরা দুজনেই এমএ পড়বে বলে। দুজনেই ভর্তি হয়ে গেল ইউনিভার্সিটিতে । আস্তে আস্তে রুনার সেই খিটখিটে মেজাজের পরিবর্তন হতে লাগল। শেষে ওরা যেন দুই বোন। একসঙ্গে পড়াশোনা , গল্পগুজবে মেতে উঠল। রান্নার দিদি রান্না করে, মা তদারকি করেন । খুশি খুশি মনের স্ত্রীকে সঙ্গী পেয়ে জয়ের মন ভরে যায়। বাড়ির বউ হিসেবে যেটুকু করার রূপা তা শেষ করে পড়াশোনায় মন দেয়। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।


এভাবে জীবন চলছিল কিন্তু সময় তো বসে থাকে না, তিন বছর পর বাংলা নববর্ষর কয়েক দিন আগেকার কথা –


ওরা এমএ পাস করার পর মাস ছয়েক হলো রূপা স্কুলে, রীনা অফিসে চাকরি পেয়েছে। একদিন রূপা দেখল একটি ছেলের সঙ্গে খুব গল্প করতে করতে রীনা হাঁটছে । রূপা সুযোগ পেয়ে দিদিকে চেপে ধরলো । ওই ছেলেটির সঙ্গে তার যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে সে কথা জানিয়ে ভয়ে রীনা কেঁদে ফেলল। বলল, ' মাকে বলিস না। মা মেরে ফেলবে এসব কথা শুনলে।' রূপা কিছু বলল না। বাড়ি ফিরে রাতে জয়কে সব কথা জানালো । আর নিজের ইচ্ছার কথাও বলল। জয় খুব খুশি হলো। রূপা সুযোগমতো শাশুড়িমার সঙ্গে গল্প করতে বসলো । কথায় কথায় জানতে চাইল, ' মা, দিদির তো এত অল্প বয়স। ওর বিয়ের কথা কিছু ভেবেছো?' চুপ করে রইল কমলা । তারপর বিষন্ন কণ্ঠে বলল, 'আমার চোখের সামনে মেয়েটা সর্বহারার মত ঘুরে বেড়ায় আমার কি ভালো লাগে দেখতে বৌমা ? কিন্তু সমাজ-সংসার আত্মীয়-পরিজন বলেও তো কথা আছে। তাদের কথাও তো ভাবতে হয়। তাই যে মেয়ের স্বামী ছিল ,একটি ছেলে ছিল - তার কি আবার বিয়ে দেওয়া যায়? লোকে কি বলবে?'

রূপা বলে ওঠে, ' তারা তো সবাই ''ছিল'' মা ! এখন তো কেউ নেই ! তাই যে আছে সে সারাটা জীবন একলা কি করে কাটাবে বল মা ! দিদির বিপদে ওই আত্মীয়-স্বজনরা কি এসে পাশে দাঁড়াবে ? বলতে নেই, তুমি তো সারাজীবন দিদিকে আগলে রাখতে পারবে না । আর আমরা দুজন ? ' মুখ নিচু করে বলল, ' তোমাকে লজ্জায় বলতে পারিনি ! তোমার বাড়িতে নাতি/নাতনি আসছে। আমরাও তো ব্যস্ত হয়ে পড়বো ! দিদির দিকে তাকাবার সময় পাবো কি করে ?' 'তাই নাকি বৌমা? জানাওনি কেন এমন সুখের খবর ?' উচ্ছ্বসিত হয়ে কমলা তাকে বুকে টেনে নেয়। 'লজ্জা কি মা, এতো মেয়েদের গৌরব ! তুমি আমায় সবচেয়ে বড় উপহার দিলে বৌমা ! ' রূপা সোজা হয়ে বসলো, ' তাহলে মা আমাকেও একটা উপহার দাও।' কমলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল রূপার দিকে । 'তুমি, তোমার ছেলে, আমি - সবাই আনন্দ পাবো শুধু দিদি কোন আনন্দ পাবে না ? কেন মা, দিদির কি দোষ ? তার নিঃস্ব জীবনের জন্য দিদি কি কোনও ভাবে দায়ী ? বল মা ?' শাশুড়িমার মুখে কথা সরেনা । খানিকক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে রূপাকে অস্ফুটে বলে, ' এমন ভাবে তো আমি কোনোদিন ভাবি নি ! সত্যিই তো মেয়েটা কি দোষ করেছে ! দোষ কিছু না করে কেন শাস্তি পাবে জীবনভোর ? তুমি আমার চোখ খুলে দিলে বৌমা ! তুমি যা ভালো বোঝো করো। আমার কোন আপত্তি নেই। ' এবার রূপা আর কালবিলম্ব না করে জয়কে বলল ছেলের বাড়ীর সাথে কথা বলার জন্য। পহেলা বৈশাখের শুভদিনে দুপক্ষের কথা পাকা হয়ে গেল। রূপা অপার শান্তি পেল । আনন্দে মনটা ভরে গেল। সেদিন রাত্রি বেলা জয় খুশীর গলায় রূপাকে বলে, ' এ আমার রাজপুত্র/ রাজকন্যা যেই আসছে তারই কেরামতি! না হলে মা মেনে নেয় দিদির বিয়ের কথা ? ' রূপা বলে, ' কে না কে আসছে তারই কেরামতি ? আমি বুঝি কেউ নই ?' স্ত্রীকে কাছে টেনে গভীর গলায় বলে, ' অনেক ভাগ্য করে তোমাকে আমি পেয়েছিলাম - বিশ্বাস করো রূপা !' স্বামীর হাতের বাঁধনে মুখ লুকিয়ে রূপা বলে 'আমিও !' এর সঙ্গে সঙ্গে রূপা যেন অভিশাপ মুক্ত হলো - ওর মনে হতে লাগলো যে সেদিনের সেই নববর্ষের নরক থেকে আজকের নববর্ষে স্বর্গে উত্তরণ। গোটা পরিবার বহুদিন পর এক নববর্ষের দুঃখ মুছে আরেক নববর্ষে হাসিমুখে জীবনের পথে এগিয়ে চলল।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational