বেনীমাধব দাস
বেনীমাধব দাস
শিক্ষক শব্দটিতে তিনটি আদর্শ লুকিয়ে আছে। শি – শিষ্টাচারী, ক্ষ – ক্ষমাশীল, ক – কর্তব্যনিষ্ঠ। এই তিনটেই যাঁর চরিত্রে থাকে তাঁকে বলা যেতে পারে আদর্শ শিক্ষক।
একজন আদর্শ শিক্ষক হিসাবে যিনি আজো তিনি বহু মানুষের কাছে পরম শ্রদ্ধার পাত্র হিসাবে পূজিত হয়ে চলেছেন। তিনি আর কেউ নন, শ্রী বেনীমাধব দাস। দর্শনশাস্ত্র, অর্থনীতি ও ইতিহাসে পন্ডিত মানুষ।
১৮৮৬ সালে চট্টগ্রামে জন্ম। চট্টগ্রাম ও ঢাকা কলেজের শিক্ষক, কটকের র্যাভেনশ এবং কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক, পরে কলকাতার বহু স্কুল ও কলেজের শিক্ষক। বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলনের এক ফাদার ফিগার বলা যেতে পারে। নিজের মেয়েদের ও বিপ্লব থেকে দূরে সরে থাকতে দেন নি। বিপ্লবী কল্যানী দাস ও বীনা দাসের পিতা। কিন্তু নেতাজীর মাস্টারমশাই হিসাবেই তাঁকে জগতের লোক চেনে। দাদা শরৎ বোস এবং বন্ধু হেমন্ত সরকারের ও মাস্টারমশাই তিনি। এ ছাড়াও দেশে বিদেশে বহু কৃতি ছাত্রের শিক্ষকমহাশয় তিনি। এমন মানুষেরই তো শিক্ষক দিবসে জাতীয় শিক্ষকের সম্মান প্রাপ্য।
১৯০২ থেকে ১৯০৮ এই সাত বছর টানা কটকের প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুল বা পি ই স্কুলের ছাত্র ছিলেন সুভাষচন্দ্র। সব কিছু এখানে শিখতে হয়েছে তাঁকে ইংরাজিতে। আয়ত্ব করতে হয়েছে ব্রিটিশ আদপকায়দা। প্রাপ্তি বলতে ডিসিপ্লিন বা নিয়মানুবর্তিতা যা আজীবন সুভাষের সঙ্গী ছিল। এরপর ঘটে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। স্যার আশুতোষ মুখার্জী ম্যাট্রিকুলেশানে বাংলা ভাষাকে কম্পালসারি করে দেন। ফলে সুভাষকে বাংলা শেখার জন্য সাহেবী স্কুল ছেড়ে ভর্তি হতে হয় দেশী সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। র্যাভেনশ কলিজেয়েট স্কুলে তাঁর আগমন হয়। এখানেই শ্রী বেনীমাধব দাসকে তিনি প্রধান শিক্ষক হিসাবে পান। যেমন মাস্টার তেমন ছাত্র। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত এক বর্ণ বাংলা ও সংস্কৃত না জানা সুভাষ দুটো সাবজেক্টেই একশোয় একশো নম্বর পেয়ে প্রথম বছরেই ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
তারুন্যের স্বপ্নমাখা সুভাষ। তখন স্কুলছাত্র সে।
প্রথম দিন সুভাষের মুখোমুখি বেনীমাধব বাবু।
– তোমার নাম কি ?
– সুভাষচন্দ্র বসু।
আগে কোন স্কুলে পড়তে ?
– প্রটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুলে।
অবাক হলেন বেনীমাধব। সংক্ষেপে নয়, পুরো স্কুলের নাম ঝরঝরে ইংরাজিতে, স্পষ্ট তেজোদীপ্ত ভঙ্গিমায় উচ্চারন করল সুভাষ। ক্লাস সেভেনে ভর্তি হতে এসেছে সে। একটা অ্যাডমিশান টেস্ট নেয়া দরকার। সেটা নিতে গিয়ে দেখলেন বেনীমাধব তার বসবার ভঙ্গি, লেখবার ভঙ্গি। ঋজু, ভয়শূন্য, আকর্ষনীয়।
আগের দিন সাহেবী পোষাক পরা সুভাষ পরের দিন দেশী পোষাকে স্কুলে এল। সেটা নজর এড়ালো না বেনীমাধবের। হেডমাস্টারের সাথে দেখা হতেই নমষ্কার করলে সুভাষ।
– কাল তোমায় অন্য পোষাকে দেখেছিলাম না ?
– আজ্ঞে ওটা মিশনারী স্কুলের পোষাক ছিল। কিন্তু এখানে যখন দেখলাম সবাই দেশী পোষাক পরে আসে তখন মনে হল আমার ও ওদের মত পোষাক পরে আসা উচিত।
– ঠিক করেছ। আমাদের দেশের সংস্কৃতি, জাতীর বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুন্ন রাখতে হবে। কিছুতেই তাকে অপদস্ত হতে দেয়া নয়। আমাদের দেশ আমরা ছাড়া আর কার মুখের দিকে চাইবে ?
নিজের দেশকে জানো, নিজের দেশকে ভালোবাসো। পড়াশুনার বাইরে নিজের আচার আচরন ও জীবন দর্শনে এই শেখাতেন বেনীমাধব। ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করতেন বিভিন্ন রকমের বই পড়তে। তার বাড়িতে গিয়েই প্রথম বিবেকানন্দ পড়ার স্বাদ পান সুভাষ যা তার পুরো জীবনটাকেই বদলে দেয়। সারা জীবন এই দুই শিক্ষাগুরুকে সম্মান দিয়েছেন তিনি। বেনীমাধব দাস ও স্বামী বিবেকানন্দ। একজন প্রত্যক্ষ আরেকজন পরোক্ষ ভাবে আজীবন তাঁকে অনুপ্রানিত করেছেন। নিজের লেখা বইতেও বেনীমাধবকে স্মরন করেছেন সুভাষ। দেশ ছাড়ার আগে তাঁর আশীর্বাদ ও নিয়েছেন।
র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুল, কটক। এখান থেকেই সুভাষ ম্যাট্রিকুলেশান পাশ করেছিলেন। বেনীমাধব দাস এই স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক ছিলেন
সুভাষের নেতৃত্বে ১৯১১ সালে র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলের ছেলেরা ক্ষুদিরামের ফাঁসির দিন অর্থাৎ ১১ আগস্ট, তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শহীদ দিবস পালন করল। সবার অনশন তাই স্কুলের হোস্টেলে সেদিন রান্না হল না। কিন্তু ছেলেরা ক্লাসে এল। ছুটির পর সবাই মিলে একটি সভার ও আয়োজন করল। এ কথা চারিদিকে রটে গেল। ব্রিটিশ সরকারের কানে এ কথা যেতেও বাকি রইলো না। এর পুরো দায় চাপিয়ে বেনীমাধবকে কৃষ্ণনগরে বদলি করে দেয়া হল। সেই দিনটা ছিল সুভাষের জীবনের সব থেকে দুঃখজনক দিনগুলির একটি। যদিও মাস্টারমশাইয়ের সাথে কখনোই মানসিক দূরত্ব তৈরি হয় নি সুভাষের। চিঠিতে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। সুভাষকে তিনি শিখিয়েছিলেন প্রকৃতিকে ভালবাসতে, মানুষের সেবা করতে। পরে এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষ সাহায্যের জন্য বেনীমাধববাবুই তাঁর আরেক সুযোগ্য ছাত্র হেমন্ত সরকারকে সুভাষের কাছে পাঠিয়েছিলেন যে হেমন্তের প্রভাবে সুভাষ হয়ে উঠেছিল রাজনীতি সচেতন, সমাজসেবক, জাতীয়তাবোধে পরিপুষ্ট ভারত মাতার একজন খাঁটি সুসন্তান। নিজের মুক্তি ও দেশের মুক্তি কামনায় প্রথমবার এই হেমন্তকে সঙ্গী করেই সন্ন্যাসী হয়ে সে ঘর ছেড়েছিল।
বেনীমাধব দাস নিজে অনেক সুকীর্তির অধিকারী ছিলেন। শিক্ষকতা ছাড়াও ব্রাহ্মসমাজের দুটি পত্রিকার তিনি ছিলেন নিয়মিত লেখক। শুধু নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেননি, দেশ সেবাকেও গুরুত্ব দিয়েছেন। কৃতি ছাত্র সুভাষের গর্বে আজীবন গর্বিত ছিলেন তিনি, এমন ছাত্র যে কিনা দেশের জন্য সর্বোচ্চ চাকরিকেও ত্যাগ করতে পারে। সুভাষের অন্তর্ধান হলেও তিনি বিশ্বাস করতেন না তার মৃত্যু হয়েছে। দেশভাগ এবং দাঙ্গা তাঁকে প্রচন্ড আঘাত দিয়েছিল। ছাত্র সুভাষের দাপটে স্বাধীনতা পাওয়া এই ভারতে ১৯৫২ সালের ২রা সেপ্টেম্বর তাঁর প্রয়ান ঘটে।
