বাঙালি আর কি কি খাবি
বাঙালি আর কি কি খাবি
এক সময়ে বাঙালির প্রিয় খাবার ছিল হরিণের মাংস, সেই সঙ্গে কচি পাঁঠার মাংস তো রয়েছেই। এ দিকে, আর্যভারতের বাঙালির কাছে গরু-শুয়োর, শামুক, মোরগ, সারস, বক, হাঁস, উটের মাংস ছিল অভক্ষ্য। কিন্তু কেন?.........
ন্যায়শাস্ত্রী ছিলেন,গোটা দেশের পণ্ডিতমহল একডাকে তাঁকে চিনত। তা শাস্ত্রীয় পণ্ডিত হলেও আগাপাশতলা বাঙালি ছিলেন ভদ্রলোক। বলছি ভবদেব ভট্টের কথা।হাল আমলের বাঙালি অবশ্য এই নামের সঙ্গে পরিচিত নয়। সমস্ত কীর্তির কথা বাদ দিয়ে তাঁর পরিচিতিতে শুধু এটুকুই বলে রাখি যে বাঙালির মেনুতে আজকাল মচ্ছি-কোর্মা-কাবাব-পোলাও-বিরিয়ানির যে এত দস্যিপনা, সে কিন্তু এই ভট্টমশাইয়ের দৌলতেই। আর্য-ভূখণ্ডের ব্রাহ্মণদের মুখে ঝামা ঘষে তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে মাছ-মাংস খাওয়া মোটেই শাস্ত্রবিরুদ্ধ নয়। তা নইলে আমাদের ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ পরিচয় ঘুচে যেত কবেই!শুধু কী আর মাছে-ভাতে! বাঙালি যে গোড়া থেকেই মাংসাশী। জৈন শাস্ত্র আচারঙ্গ সূত্রে এর জন্য বাঙালির কম পিণ্ডি চটকানো হয়েছে! মহাবীর বাংলাদেশ ভ্রমণে এসে ভোজনযোগ্য খাবারের অভাবে উপোস করে কাটিয়েছেন-- এমন সব কথা লেখা আছে সেই সূত্রে।
ভট্টমশাই এর যোগ্য জবাব দিয়েছিলেন। মনু-যাজ্ঞবল্ক্য-ব্যাস-ছাগলেয়দের সব উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি প্রমাণ করেই ছাড়লেন যে চতুর্দশীর মতো বিশেষ কিছু তিথি বাদ দিলে মাছ-মাংস ভক্ষণ মোটেই দোষের নয়। উৎসাহীরা তাঁর ‘প্রায়শ্চিত্তপ্রকরণ’ পড়ে দেখতে পারেন। দশম-একাদশ শতকের লোক ছিলেন তিনি। পরবর্তীতেও এই যুক্তি-তক্কের ধারা চলেছে বহুদিন।শুধু স্মৃতিশাস্ত্রে নয়, সাহিত্যেও। ‘নৈষধচরিত’ যেমন। প্রাচীন পাঁচটি মহাকাব্যের অন্যতম এই ‘নৈষধচরিত’। বইটির লেখক শ্রীহর্ষ ছিলেন বাঙালি। নল-দময়ন্তীর বিয়ে উপলক্ষে ভোজের বর্ণনা দিচ্ছেন কবি। সেখানে মাছ-মাংসের বিভিন্ন পদের ছড়াছড়ি। বলাবাহুল্য, আর্যভারতের খানাপিনার দস্তুরকে বেশ বুড়ো আঙুল দেখানো হয়েছিল এতে।তা বাঙালি মাংসাশী হলেও গরু-শুয়োরের মাংস তখন তাদের কাছে অভক্ষ্য। এই অভক্ষ্যের তালিকায় ছিল শামুক, মোরগ, সারস, বক, উটের মাংসও। জাত যেত পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধে। আর হাঁসের মাংস খেলে। লাল টুকটুকে কাঁকড়ার ঝোলের প্রেমিক যারা, তাদের বলছি-- নিষিদ্ধ মাংসের তালিকায় ছিল কাঁকড়াও। কাঁকড়া-সুন্দরীর রমরমা শুরু হাল আমলে। এক জমানায় তাকে অলক্ষুণে বলে কম গালাগাল দিয়েছে বাঙালি! এমনকী যাত্রাকালে যাতে তার নাম মুখে আনতে না হয়, এর জন্য নাম রেখেছে দশরথ। দশ পা কিনা, তাই।মাংসাশী বাঙালির প্রিয় খাদ্য তখন হরিণের মাংস। সাধে কি আর ‘অপণা মাংসেঁ হরিণা বৈরী’! হরিণের মাংসের ‘ঝালঝোল রসা’ খাওয়ার জন্য সেকালে বাঙালির নোলা সকসক করত। আর গাওয়া ঘিয়ে সপসপে করে ভাজা মৃগমাংস! আহা! সেই তুরীয় আস্বাদের তুলনা হয় না। পছন্দের তালিকায় ছিল কচ্ছপ, সজারু, খরগোশ আর গোসাপের মাংসও। এই তথ্য দিয়ে গেছেন খোদ ভট্টমশাই।আর পাঁঠার মাংস! কচি পাঁঠার ঝোলের জন্য সেই আমলেও বাঙালির জান কোরবান। জিভ লকলক করত খাসির মাংসের জন্যও। চাঁদ সদাগরের ছেলের বিয়েতে তেজপাতা ধনেবাটা দারচিনি নারকেল দিয়ে ভাজা হয়েছিল বুড়ো খাসির চর্বি। শুনে অবাক লাগছে তো! প্রাচীন পুথিপত্র ঘাঁটলে এমন সব অবাক করা রেসিপির খোঁজ পাবেন, সে নিশ্চিত।নবাবি আমলে হিঁদুর হেঁশেলের খোশবাই কিছুটা পাল্টে গেলো। মোগলাই দস্তরখানের প্রভাবেই অবশ্য। ভারতচন্দ্রের কাব্যে আছে কোফতা আর শিক কাবাবের কথা। সাহিত্যে সেই প্রথম। এর ষোলোআনা ক্রেডিট দিতে হয় মুর্শিদাবাদের নবাব খানদানকে।মুর্শিদাবাদের কথা যখন উঠলই, তখন সেখানের নবাবদের প্রিয় ডিশ মুর্গ ইয়াখনির কথাটাও এখানে বলে ফেলি। ইয়াখনির মুর্গ বাছাই প্রক্রিয়াটিই এমন যে, নবাব-বাদশারা বুঝি সেজন্যই এর দিওয়ানা ছিলেন! তা বেশ জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই নবাবদের এই স্পেশাল ডিশের জন্য মোরগ বাছাই হতো। এর জন্য শুরুতেই টগবগে এক যুবক মোরগকে বিষ মেশানো আটা খাইয়ে মেরে ফেলা চাই। তারপর সেই মৃত মোরগের শরীরের এক টুকরো মাংস কেটে আটার সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে অন্য একটি মোরগকে। এভাবে একের পর এক মোরগকে মাংস কেটে খাওয়ানো আর একের পর এক মোরগের মরে যাওয়া। শেষ মোরগটি অবশ্য বেঁচে যেত, তবে শরীর থেকে সমস্ত পালক খসে পড়ত তার। ইয়াখনির জন্য বেছে নেওয়া হত সেই মোরগটিকেই।তা ইয়াখনির দিওয়ানা ছিলেন মুগল বাদশারাও। ‘আইন-ই-আকবরি’ খুলেই দেখুন না, আকবরের প্রিয় ইয়াখনির রেসিপি তখন আপনার হাতের মুঠোয়। আস্ত ভেড়া দিয়ে কীভাবে তৈরি হত ‘বিরিয়ান্’, কিংবা আকবরের প্রিয় কাবাব, দোপেঁয়াজা আর মুসম্মন-- রয়েছে সেসবের রেসিপিও। চাইলে নিজেদের হেঁশেলেও ট্রাই করে দেখতে পারেন।জিভে জল আনা এই মোগলাই খানার রেসিপি নিয়ে বাংলায় প্রায় এক মহাকাব্যই লিখে ফেলেছিলেন এক বাঙালি। নাম তাঁর বিশ্বেশ্বর তর্কলঙ্কার। আর বইটির নাম ‘পাকরাজেশ্বর’। বাঙালির লেখা এটিই প্রথম রান্নার বই। প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৩১-এ। ভবদেব ভট্টের মতোই বিশ্বেশ্বরও ছিলেন নৈয়ায়িক পণ্ডিত। বইটির ভূমিকায় লিখছেন তিনি, মহারাজা বিক্রমাদিত্যের সংগ্রহে থাকা প্রাচীন সংস্কৃত রান্নার বই ‘ক্ষেমকুতুহল’ আর বাদশা শাজাহানের পসন্দিদা পারসি রেসিপির বই ‘নিয়ামৎ খান’ থেকে বাছাই করা সব সহজ রান্নার পদ্ধতি নিয়ে লেখা হয়েছে বইটি। ঠাঁই পেয়েছে বর্ধমান রাজ মহতাব চাঁদের পছন্দের কিছু রেসিপিও।‘ক্ষেমকুতুহল’-এর উল্লেখ দেখে বইটিকে সাবেকি রান্নার বই ভাবলে ভুল হবে। শাকসব্জির প্রিপারেশন এখানে গৌরচন্দ্রিকার কাজ করেছে মাত্র। মূলত এর পাতার পর পাতা জুড়ে মাংসের প্রিপারেশনের ছড়াছড়ি। রয়েছে মাছের প্রিপারেশনও। লেখক তাঁর টার্গেট পাঠক ঠিক করে নিয়েছিলেন আগেই। ‘বিষয়ী ব্যক্তি সকলের’ জন্যই এই বই, ভূমিকায় সেকথা স্পষ্ট জানিয়েছেন। সোজা কথায় বললে সাহেবি কেতায় অভ্যস্ত নব্য বাঙালিদের জন্যই লিখেছিলেন তিনি বইটি।‘পাকরাজেশ্বর’-এর রেসিপি তালিকাও চমকে দেওয়ার মতো। হাঁস-ভেড়া-হরিণ-কচ্ছপ-খরগোশের কোর্মা থেকে শুরু করে মাংসঘণ্ট, মাংস দমপোক্ত, ছাগলের মাথা আর নাড়ি রান্নার প্রণালী-- কী নেই এতে! কোর্মা অর্থে অবশ্য তিনি প্রলেহ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আর ছাগলের মাথা ও নাড়ি রাঁধতে হবে তিল তেল দিয়ে, সেকথাও বলে দিয়েছেন পইপই করে। শুধু কী আর রান্নার প্রণালী! বিশ্বেশ্বরের কড়া নির্দেশ, মাংস রান্না করে লোহা, কাঠ, রূপা কিংবা সোনার পাত্রে তুলে রাখতে হবে। শিখিয়েছেন, মাংস পরিষ্কারেরও পদ্ধতিও। যেমন হাঁসের মাংস ধুতে হবে দই-চন্দন-মুলতানি মাটি মিশিয়ে। একবার নয়, চার চারবার। আর ছাগল! সে নাহয় ‘পাকরাজেশ্বর’ পড়েই জানলেন।
