STORYMIRROR

Sree Mondal

Inspirational Others

4  

Sree Mondal

Inspirational Others

অন্দর মহল থেকে সিংহদুয়ার

অন্দর মহল থেকে সিংহদুয়ার

6 mins
220

একুশ শতকে দাঁড়িয়ে বনেদি বাড়িতে বড়ো হওয়া খুব বেশি চোখে পড়েনা। এখন সবাই নিজ নিজ কাজের জন্য বা স্বার্থের জন্য আলাদা থাকে। কিন্তু বনেদি বাড়ি আর সাথে একান্নবর্তী পরিবার একরা আলাদাই মজা। সবাই কিছুতেই, আর সবসময়ই একটা হাসিখুশি পরিবেশ। এরকমই পরিবারে বড়ো ওঠা একটা মেয়ে অর্চিসা। মা বাবার একমাত্র মেয়েতো বটেই, বাড়ির ও একমাত্র মেয়ে। বাড়ির সদস্য বলতে ঠাম্মা, দাদু, বড়ো জেঠু,বড়ো জেঠিমা, কাকাই, কাম্মা,আর মা বাবা তো আছেই। এনারা হলেন বাড়ির বয়জেষ্ঠ সদস্য। আর আছে বড়ো জেঠুর দুই ছেলে যাদের একজন কলেজে পড়ছে আর একজন পড়ছে একাদশ শ্রেণীতে আর একজন সবাই চেয়ে ছোট সদস্য যার বয়স চার বছর।

অর্চিসা বাড়ির সবার খুব আদরের মেয়ে। বয়স এখন ১৫ বছর। এই বছর সে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবে।

মেয়েটির পুরো নাম অর্চিসা সেন। বাবার নাম রাঘব সেন, মা অহনা সেন। বড়ো জেঠু নির্মল সেন আর কাকাই সুবিনয় সেন। এই বনেদি বাড়ির অবস্থান হলো সুন্দরবনের হরিখালী গ্রাম। সেন বাড়ি বললে গ্রামে সবাই এক ডাকে চেনে। চাষবাস আর সোনার বিসনেস এই বাড়ির কর্তাদের জীবিকা। সেই বাড়ির মেয়ে অর্চিসা সেন। দেখতেও বেশ সুন্দরী। নিজের রূপ নিয়ে সব সময়ই সে একটু দেমাক দেখায় সে। রূপচর্চা নিয়েই মনে হয় দিনের ৮ ঘন্টা তার কেটে যায়। সেন বাড়ির মেয়ে তাই স্কুলে যায় গাড়িতে, আর প্রাইভেট টিচার সে তো বাড়িতে আসে। পড়তে তার বেশি ভালো লাগেনা। এবছর মাধ্যমিক পরীক্ষা তার, তাই টিচার কে আরো বেশি টাকা দেওয়া হয়েছে দুইবেলা আসার জন্য। বাড়ি একমাত্র মেয়ে সুন্দরী তাকে কি বাইরে বাকি মেয়েদের সাথে মিশতে দেওয়া যায়? বাড়ি থেকেই পড়াশোনা করবে এমনটা বাড়ির বাকি পুরুষদের আদেশ।পরীক্ষার দিন অর্চিসা সেন পরীক্ষা দিতে যাবে সে এক বিশাল ব্যাপার। গাড়ি বাইরে দাঁড়িয়ে  আছে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। পরীক্ষা শেষ হলো। ঠিক দুইমাস পরে রেজাল্ট বেরোলো ৪০ পার্সেন্ট মার্ক্স্ পেয়েছে সে। রেজাল্ট তার ভালো হয়নি। বাড়িতে আসলো মন খারাপ করে। বাড়ির বাকিরা বললো নাম্বার টা কোনো ব্যাপারই না। পাস তো করেছে সে।অর্চিতা সেন নামেই যেন একটা অহংকারী ভাব। তার দুনিয়াটা বাড়ির অন্দর মহল থেকে সিংহ দুয়ার পর্যন্ত। বাইরের জগৎ টা তার কাছে স্বপ্নের মতো। সেই জগতে সে একাই শ্রেষ্ঠ। এভাবেই উচ্চমাধ্যমিক পাস করলো সে। কিন্তু এবার গ্রাজুয়েট হওয়ার জন্য তো তাকে কলকাতা যেতেই হবে। কিভাবে মানিয়ে নেবে অর্চিতা? কি করে চলবে কলকাতার রাস্তায়। বাড়ির লোকের চিন্তা র শেষ নেই। অনেককিছু ভেবে বাবা জেঠু কলকাতায় একটি ফ্লাট কিনলো। ওখানে থেকেই অর্চিতা পড়াশোনা করবে সাথে গ্রাম থেকেই কাজের মহিলা পাঠানো হবে।


 গ্রাম ছেড়ে কলকাতা তে এসে থাকতে শুরু করলো। বাস্তব সম্পর্কে মেয়েটার কোনো আইডিয়া নেই।

 আজ অর্চিতার কলেজে প্রথম দিন, গাড়িতে গেলো কলেজে, হেটে যাওয়া বা বাসে ট্রেনে যাওয়ার অভ্যাস তার কোনোদিনই ছিল না।কলকাতার কলেজে কেমন স্টুডেন্টরা হয় কোনো আইডিয়া নেই তার। তার অহংকার ই তাকে সমস্যার সম্মুখীন করবে। তার বড়লোকি চাল আর নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবাইকাল হয়ে দাঁড়ালো। ক্লাসে ঢুকতেই তার অহংকারী ভাব অন্য স্টুডেন্টদের নজর কাড়লো। একবেঞ্চে সে অন্য মেয়েদের সাথে বসতে তার প্রবলেম। ছেলে মানেই তার কাছে এটাই যে কোনো খারাপ ইনটেনশন আছে। আর কলকাতার কলেজ মানেই এখানে এসব জেন্ডার বিয়াসিটি চলে না। তার পাশে একটি ছেলে বসায় সে ছেলেটিকে যাচ্ছেতাই কথা শোনালো। প্রথম প্রথম ক্লাসের সবাই ভাবলো হয়তো ছেলেটার ই দোষ, কিন্তু আসতে আসতে যত দিন যেতে থাকে, ক্লাসের সবাই ধীরে ধীরে বুঝতে পারে আসলে সমস্যা মেয়েটারই। অর্চিতা ক্লাসের বাকি সবার সাথে একই ব্যবহার করতো। একদিন ক্লাসের সবাই মিলে ঠিক করলো এইমেয়েটার একটা উচিত শিক্ষা প্রয়োজন।

 

আজ সকাল থেকেই অর্চিতার মন টা ভালো নেই। কারণ একটাই তার একটা ৫০০০০ টাকার ফোন চাই, কিন্তু তার বাবা বলেছে টাকাটা পাঠাতে একটু দেরি হবে। আর তা ছাড়া ৫০০০০ টাকা টা তার কাছে খুব সামান্য টাকা। যাইহোক কলেজে গেলো, কিন্ত কলেজে গিয়ে দেখলো ক্লাসরুম ফাঁকা, অথচ আজ ফার্স্ট ক্লাস টা ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধু একা অর্চিতা ক্লাসে এসেছে। তাই স্যার এসে বললেন, "আজ যেহেতু কোনো স্টুডেন্ট আসেনি তাই ক্লাসে হবেনা।" বলে রাখি অর্চিতা philosophy honours ভর্তি হয়েছে তাও কিছুটা তার বাবার টাকা দিয়ে ব্যবস্থা করেছে তাই। কারণ ৫৫ % নম্বর নিয়ে কি করে ভালো কলেজে চান্স পাবে সে?

যাই হোক, ক্লাস আজ হবেনা জেনে সে যখন নিজের গাড়িতে তে করে ফিরে যাবে তার বাড়িতে, তার জন্য ড্রাইভার কে ফোন করলো সে গাড়ির কাছে এসে। ড্রাইভার এসে যখন গাড়িতে স্টার্ট দিতে গেলো তখন দেখলো গাড়িতে স্টার্ট নিচ্ছে না কোনোমতেই, গাড়ি ঠিক করতে অনেক টাইম লাগবে, এমন টাই জানালো ড্রাইভার। কিছু করার নেই আজ তাকে পাবলিক ট্রান্স পোর্টেই তাকে ফিরতে হবে। জীবনে প্রথমবার সে কোনো পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াত করবে সে। ১০ মিনিট হেটে বড়ো রাস্তায় উঠার পর, আবার ১০ মিনিট অপেক্ষা করে সে উঠলো বাসে, সেই বাসে সেদিন খুব ভিড়, বসার জায়গা পেলো না সে, দাঁড়িয়ে আছে কোনোমতে। ভালো লাগছে না মোটেও, ভিড় জায়গায় কোনোদিনই যায়না সে, তার উপর আজ আবার বাস, তাতে আবার সেটা ভিড়। ভগবান ও যেন চাইছে মেয়েটা বাস্তব টা বুঝুক। কোনোরকমে সে নামলো বাস থেকেই। ড্রাইভার পরদিন ও জানালো যে গাড়ি ঠিক হতে এখনো দুদিন লাগবে। সে ঠিক করলো দুদিন কলেজে যাবে না সে। কিন্তু assignment সাবমিট করবে কি করে সে, ক্লাসের কারোর সাথেই সে ভালো বন্ধুত্ব করে উঠতে পারেনি। বাধ্য হলো বাসে করে কলেজে যেতে। বাসে উঠেই দেখা হলো সৃজিতা র সাথে, মুখ চেনা বন্ধু, বলতে গেলে ক্লাসমেট, কথা হয়নি বেশি। সেদিন বাসে উঠে সৃজিতার পাশের সিটেই বসলো। কথা বলতে শুরু করলো। অর্চিতা কে বাসে করে কলেজে যেতে দেখে সৃজিতা অবাক হলো। সৃজিতাকে জানালো তার গাড়ি খারাপ হয়েগেছে 

, ঠিক হতে এখনো দুদিন লাগবে। বেশ কথা বলতে বলতে দুজনে কলেজ পৌঁছে গেলো। এভাবেই পরের দিন ও বাসে করেই কলজে গেলো। Assignment নিয়ে সমস্যা হলো, বাধ্য হলো ক্লাসে এর বন্ধুদের সাথে মিশতে। এভাবেই আস্তে আস্তে বন্ধুদের সাথে বেশ ভাব জমে উঠলো। এর মধ্যে ঘটলো এক ঘটনা, কলকাতায় যে সোনার দোকান তাঁদের ছিল, সেখানে ডাকাতি হলো, এরপর চাষবাস ছাড়া আর কিছু নেই। এই ঘটনার ছয় মাস পর সুন্দরবনের যে বাদা জমিতে চাষবাস হতো সে বছর বন্যায় সব ফসল নষ্ট হয়ে গেলো। অর্চিতার পরিবারের অবস্থা এখন খুব ই শোচনীয়। আস্তে আস্তে তার বাবা অর্চিতা কে যে পরিমান টাকা পাঠাতো তার পরিমান কমে গেলো। এখন অর্চিতা বন্ধুদের সাথে বাসে করেই যাওয়াআসা করে। এখন তার রান্নার করার জন্য যে লোক রাখা ছিল তার টাকা দিতে দেরি হওয়ায়, দুমাস পর সে ও আসা বন্ধ করে দিল। যে মেয়ে কোনোদিন জল গড়িয়ে খাইনি সে এখন রান্না করে খায়, কখনো বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করে কোনটা কিভাবে রান্না করবে। এই ভাবেই চললো দুই বছর। এই বছর graduation কমপ্লিট হবে তার। এরপর কি করবে সে? বাড়িতে financial condition এখন আর আগের মতো নেই। কলেজের ফী দিতে হলো মায়ের গয়না বিক্রি করে। এবার আস্তে আস্তে কলকাতার রাস্তায় ফুটপাতে পরে থাকা মানুষ গুলোকে যেতে আসতে প্রায়ই লক্ষ্য করতো। কলজের বন্ধুদের সাথে মিশতে মিশতে মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে ধীরে ধীরে অবগত হতে থাকলো। তার এখন যা অবস্থা তা মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনের সাথে মিলে যায়। আগের মতো পোশাকআসাকের বিলাসিতা আর নেই তার। অথচ এই অর্চিতার একটা সময় জগৎ ছিল অন্দর্ মহল থেকেই সিংহ দুয়ার পর্যন্ত। আজ তার জগৎ তা অন্যরকম হয়েগেছে। 

          গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হলো তার। জীবনে কোনোদিন চাকরি করার কথা ভাবেনি সে। ভাবেনি কোনোদিন ইন্টারভিউ এর জন্য লাইনে দাঁড়াতে হবে। তবে পরিস্থিতি তাকে সেই ইন্টারভিউ এর লাইনে ই দাড়করলো। ১৫০০০ টাকার চাকরি পেলো সে। মাথার উপর ছাদ টুকু ছিল এটুকু যেন ভগবানের আশীর্বাদ। অফিসে যাওয়া শুরু হলো। ভাবেনি কোনোদিন এভাবেই চাকরি করতে হবে। সে আস্তে আস্তে উপলব্ধি করতে থাকলো প্রতিটা মানুষের উচিত নিজের জগৎ এর বাইরেও অন্য একটা জগৎ থাকে, সেটা সম্পর্কে ও অবগত হওয়া। সময় আর পরিস্থিতি সব সময় একরকম থাকে না। মানিয়ে নিতে না পারলে বিলীন হয়ে যেতে হবে। অর্চিতা বুঝলো জগৎ টা অন্দর মহল থেকে সিংহদুয়ার পর্যন্ত নয়। যা আমাদের কাছে খুশি তা হয়তো অন্য কারোর জীবনের দুঃখ। তবে নিজের জগৎ থেকে বাইরে বেরোলেও অনেক মানুষের সাড়া পেয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কবিতার লাইন মনে পড়লো অর্চিতার, "আপন হতে বাহির হয়ে. বাইরে দাঁড়া,. বুকের মাঝে বিশ্বলোকের. পাবি সাড়া। "


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational