অন্তর্মুখী থেকে বহির্মুখী পর্ব১
অন্তর্মুখী থেকে বহির্মুখী পর্ব১
একটি শিশু যখন পৃথিবীতে আসে তখন সে থাকে বহিরমুখী যাকে ইংরেজিতে বলে এক্সট্রাভার্ট ; কারণ তখন সে গোটা পৃথিবীকে জানতে চায়, জানতে চায় তার আসে পাশের মানুষজন কেও। কিন্তু যখন ই সে ধীরে ধীরে বড়ো হতে থাকে, আসে পাশের মানুষের ব্যবহার, দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অবগত হয় তখন সে কখনো ইন্ট্রোভার্ট আবার কখনো বা এক্সট্রাভার্ট হয়ে যায়। আসলে একটা মানুষ ইন্ট্রিভার্ট নাকি এক্সট্রাভার্ট এটা সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভর করে তার জীবনের অভিজ্ঞাতার উপর বা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উপর। যদি আরো ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে বলা যায়, একটি ছেলে বা মেয়ে ইন্ট্রোভার্ট হবে নাকি এক্সট্রাভার্ট হবে কিছুটা বয়সের সাথে সাথে বদলে যায়। এবার আশা যাক আসল কথায়।
নাম তার স্নিগ্ধা। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট গ্রাম ইচ্ছেগাও, যার রূপের বর্ণনা যতই দেবো অনেক কম। কেশাবটি কন্যার মতো ঝর্ণা অঝোরে ঝরছে একটা মিষ্টি শব্দ করে সারাক্ষন, পাহাড়ের কোলে র কাছে হওয়ায় মেঘেদের লুকোচুরি চলছে সারাক্ষন। পাহাড়ি নদী রংডং যেন স্নিগ্ধতার সাথেই বয়ে চলেছে। তার সাথেই যেন নাম মিলিয়ে রাখা হয়েছে ছোট্ট মেয়ে র নামনে স্নিগ্ধা। ছোট্ট মেয়েটির ছিল দু চোখ ভরা স্বপ্ন সে নৃত্যশিল্পী হবে। পাহাড়ের কোলে বৃষ্টি এলে সে যেন ময়ূরের মতোই পাখা মেলে নাচতে শুরু করতো। যেন প্রকৃতি তাকে নিজে থেকেই এই গুন দিয়ে পাঠিয়েছে। ঠিক যেমন স্বর্গে উর্বষীরা নাচলে পুষ্পবৃষ্টি হতো ঠিক তেমনই বৃষ্টির ফোটা গুলো পুষ্প হয়ে ঝরতো।
এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তার জন্ম হয়। ছোট থেকেই মেয়েটি যেন প্রকৃতিকে জানতে চাইতো। চাতক পাখি যেমন একটু বৃষ্টি র জন্য অপেক্ষা করতো ঠিক তেমনি স্নিগ্ধা যেন সব কিছু জ্ঞান নেয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকতো.
মায়ের নাম ছিল পার্বতী আর বাবা ছিলেন মেঘ। আসতে তাঁদের ছোট্ট মেয়ে বড়ো হতে থাকলো, তার নাচের প্রতি আগ্রহ আর পড়াশোনার ইচ্ছা দেখে পার্বতী আর মেঘ ভাবলো তাঁদের একমাত্র মেয়েকে তারা স্কুলে ভর্তি করবে। মাধ্যমিক পর্যন্ত সে ইচ্ছেগাও তেই কাটালো। এবার ইচ্ছা সে কলকাতা তে থেকে পড়াশোনা করবে আর নাচ টা আরো ভাবে শিখবে। এতদিন পর্যন্ত সে খোলা মনের হাসিখুশি মেয়ে ছিল। পাহাড়ের মানুষ রা খুব পরিশ্রমী হয় আর খুব সহজ সরল হয়। ওরা আমাদের কে নিচেকা আদমি বলে। স্নিগ্ধার জীবনে এবার আসলো স্বপ্ন পূরণের ইচ্ছা, যা তাকে ঘুমাতে দেয়না। কিন্তু পাহাড়ের ওই ছোট্ট গ্রামে থেকে তো আর স্বপ্ন পূরণ সম্ভব নয়।
আজ সেই দিন এলো যেদিন স্নিগ্ধা কলকাতার জন্য রওনা দেবে। কলকাতায় নাকি তার এক মাসির বাড়ি, সেখানেই সে থাকবে আর পড়াশোনা করবে আর নাচটাও শিখবে। আজ পার্বতী আর মেঘ এর একমাত্র মেয়ে তাঁদের ছেড়ে কলকাতা গিয়ে একা থাকবে এটা তারা ভাবতে পারছেনা; কিন্তু মেয়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য তার তাঁদের চোখের জল লুকিয়ে গেলো আর মেয়েকে ট্রেনে তুলে দিলো। ট্রেন ছাড়লো মা বাবার মুখটা আসতে আসতে দূরে সরে যেতে থাকলো একটা সময় আর তাঁদের দেখতে পাচ্ছেনা স্নিগ্ধা। চোখটা ভিজে আসছে এটা ভেবে যে কাল থেকে আর মা বাবা কে দেখতে পাবে না। মায়ের সেই আদর মাখা আঁচল টা আর হয়তো পাবেনা সে। এসব ভাবতে ভাবতেই অনেক পথ চলে এসেছে। বলে রাখি ইচ্ছেগাও হলো কালিম্পঙ জেলার একটি অংশ। কালিম্পঙ থেকে যেহেতু একটানা ট্রেন আসে না ; তাই শিলিগুড়ি তে তাকে নামতে হলো। তারপর তিস্তাতোর্সা এক্সপ্রেস ধরে সে পৌঁছাবে কলকাতায়। যথারীতি সে সে ট্রেন এ উঠলো এবং জানলার পাশের সিট্ টা সে নিলো কারণ প্রকৃতি কে সে তার বন্ধু মনে করে, প্রকৃতির সাথে যেন তার অনেকদিনের বন্ধুত্ব। চলে এলো সে কলকাতা। কলকাতা র বেহালা তার মাসির বাড়ি। নিজের মাসি নয়, দূরসম্পর্কের মাসির বাড়িতেই তাকে আশ্রয় নিতে হলো।
স্নিগ্ধা দেখতে ভারী মিষ্টি মেয়ে, একমাথা চুল আর টুকটুকে গায়ের রং, টানা কাজল কালো দুটি চোখ বেশ লম্বা আর চিপচিপে চেহারা। আসলে গ্রাম এর মেয়ে তো শহরের আদব কায়দায় সে সাজতে পারে না। কলকাতায় এসে সে চারিদিকে যত দেখে ততো তার জানার ইচ্ছা আরো বেড়ে যায়। কিন্তু সে হয়তো জানেনা যে শহরের মানুষরা তাঁদের গ্রামের মতো ওতো সহজসরল নয়। সে সবাইকে খুব অবাক চোখে দেখতে থাকে। হোস্টেলে থাকার কথা সে বলেছিলো কিন্তু তার মা বাবা বলেছিলো পড়াশোনার খরচ, তার নাচেরখরচ এসব জোগাতেই তাঁদের দিনরাত এক করে আরো পরিশ্রম করতে হবে। মা তাই বলেছিলো, '' একটু কষ্ট করে কটা বছর চালিয়ে নে মা। আর টা ছাড়া তোর মাসিরা খুব ভালো।'' আর কিছু বলেনি সে। মাসির বাড়িতে এসেই যা দেখলো তাতে তার বিস্ময় টা কিছতেই কমছে না, আরো বেড়েই চলছে। মাসির পরিবারে মাসি মেসো আর এক ছেলে আর এক মেয়ে আছে। তার বেশ স্মার্ট। আমায় দেখে তারা একটু ইতস্তত হলো আসলে আমি গ্রামের মেয়ে তো তাই চুড়িদার, কুর্তি তেই অভ্যস্ত। আমায় দেখে তারা যেন কেমন চোখমুখ টানাটানি করতে লাগলো। তাঁদের সাথে মাসি আমার পরিচয় করিয়ে দিলো। মাসি আমায় আমার ঘর দেখিয়ে দিলো। আমি ঘরে গিয়ে দেখলাম খুব ছোট একটা ঘর যেখানে শুধু একটা খাট আর একটা আলমারি আছে যার কিছু কিছু জায়গায় রং নেই। মাসি বলে দিল,'' আজ থেকে এই ঘরেই তোকে থাকতে হবে। এর থেকে ভালো ঘর আমার বাড়িতে নেই ''। আসলে বলতে গেলে নেই বলা ভুল আছে কিন্তু টা হয়তো আমার জন্য নয়। আমায় বলা হলো হাত পা মুখ ধুয়ে খেতে যেতে। ঘরে গিয়ে দেখলাম ঘরে ধুলো , ঝুল পরে গেছে। মনে মনে ভাবলাম,'' যা অবস্থা আমাকেই পরিষ্কার করে থাকতে হবে, মা আমায় কোনোদিন এসব করতে দেয় নি''। ভাবতে ভাবতে মায়ের কথা ভেবে চোখটা ছলছল করে এলো। যাইহোক, চোখ মুছে সে কোনোরকমে বিছানা পরিষ্কার করলো তারপর ফ্রেশ হয়ে নিচে গেলো। সবাই টেবিল এ খেতে বসেছে, আমি যেতেই মাসি বললো তোরা তো গ্রামে মাটিতে বসে খেতিস তাই তুই মাটিতেই বসে যা আর টা ছাড়া এই টেবিলএ চার জনের বেশি চেয়ার নেই। আমায় খেতে দেওয়া হলো রুটি ডাল আর সবজি । মাসির ছেলেমেয়েরা রুটি সবজি খায়না বলে তাঁদের জন্য অন্য খাবার আনা হয়েছে। সব কিছু যেন অন্য অন্য লাগছে, কেমন যেন ব্যবহার, আদবকায়দা সব অন্য। স্নিগ্ধা ভাবলো পারবেতো সে এখানে টিকে থাকতে? মনে হলো যে তার আপন বলতে এখানে কেউ নেই, মা কে ফোন করে সে বলবে অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করতে, আবার ভাবলো পড়াশোনা আর নাচের টাকা জোগাড় করতেই মা বাবা কে আরো পরিশ্রম করতে হবে, তাই কষ্ট করে সে চালিয়ে নেবে। এভাবেই চলতে থাকলো। একটা বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হলো সে। বাংলা মিডিয়াম স্কুল হলে কি হবে কলকাতা র স্কুল তো স্টুডেন্ট রা খুব স্মার্ট তাঁদের কাছে সে এক হাসির খোরাক হতে শুরু করলো। এভাবে যেতে মেয়েটি হাসিখুশি থেকে কেমন যেন মনমরা হতে থাকলো, কলকাতা শহর কে যে জানার ইচ্ছা নিয়ে সে এসেছিল, সেই ইচ্ছাতাও যেন আসতে আসতে মরে যেতে লাগলো ..... এক্সট্রাভার্ট মেয়েটা আসতে আসতে ইন্ট্রোভার্ট হতে লাগলো। নাচের স্কুলেও ভর্তি হলো কিন্তু সেখানেও এক অবস্থা সবাই হাসাহাসি করতে লাগলো। এভাবেই দুটো বছর চলে গেলো।
উচ্চ মাধ্যমিক পাস করলো সে । এবার তার ইচ্ছা সে নাচ নিয়ে পড়বে, মেয়েটা কিন্তু আগের মতো আর হাসিখুশি নেই । সে বুঝেগেছে যে এই শহরে টিকে থাকেটে গেলে তাকে আগে নিজেকে তৈরী করতে হবে। নাচ নিয়ে পড়বে সে এটা তার ছোট থেকেই স্বপ্ন ছিল। ভর্তি ও হলো সে। কলকতার রাস্তাঘাট কিছুটা হলে সে চিনেগেছে কারণ মাসি মেসো বা তাঁদের ছেলেমেয়েরা কেউ এ তাকে সাহায্য করতো না তারা শুধু তাকে ঠিকানা বলে দিতো,বাকি সব এ সে নিজে করতো। একদিন ডান্স কলেজ এ যাওয়ার সময় এক ছেলের সাথে আলাপ হলো। ছেলেটি রোজ ই দেখতো মেয়েটি কে কলেজ এ যেতে। একদিন ছেলেটি মেয়েটির সাথে পরিচয় করলো , এভাবেই মেয়েটির কলজের রাস্তায় ছেলেটি দাঁড়িয়ে থাকতো তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব বেড়ে উঠলো, ফোন নম্বর ও আদানপ্রদান হলো। মেয়েটি ভাবলো এই শহরে অন্তত একজন শুভাকাঙ্খী তো পেয়েছে সে, এভাবে একমাস কাটলো।
ছেলেটির নাম দেবারুন রায়। তার বাড়ি মালদহ জেলায়। পেশায় সে একজন সরকারি চাকুরী জীবি
। কলকাতায় সে কোনো একটি কাজে এসেছে , ঘর ভাড়া নিয়ে থাকছে সে। স্নিগ্ধা আসতে আসতে একটু আগের থেকে হাসিখুশি হতে শুরু করলো, সে ভাবতে লাগলো শহরের সব মানুষ সমান হয় না। ভালো মানুষ ও কিছু থাকে। তিন মাস এভাবে কাটলো ছেলেটি চলে গেলো সিকিম যেখানে তার পোস্টিং ,। মন খারাপ হয়ে গেলো স্নিগ্ধার। দেবারুন বললো, '' আরে পাগলী আমি চলে যাচ্ছি তো কি হয়েছে আমি তো মাঝে মাঝেই আসবো কলকাতা, আর তা ছাড় এখন ফন তো আছেই, ইচ্ছা করলেই তোমার সুন্দর মুখ খানা দেখে নেবো ভিডিও কল করে।'' দেবারুন ও নিজের কাজের জায়গায় ফিরে গেলো, স্নিগ্ধা র সাথে ফন এ রোজ কথা হতো । দেবারুন খুব disciplined ছেলে, অগোছালো জীবন তার মোটেই পছন্দ নয়। দিন দিন যত যেতে লাগলো দেবারুন এর ফোন কম আসতে শুরু করলো। কখনো কখনো স্নিগ্ধা বার বার ফন করলে সে রেগে যেত, স্নিগ্ধা ভাবতো হয়তো কাজে বাসায় আছে তাই হয়তো সময় নেই তার। তারা একে ওপরের সাথে তাঁদের ভবিষ্যতে নিয়েও কথা বলতো। স্নিগ্ধা র ইন্ট্রোভার্টনেস কিছুটা কমেছে আগের থেকে যখন সে প্রথম কলকাতা য় এসেছিলো।এখন সে স্বাভাবিক হয়েগেছে। কিন্তু সব কিছু আর স্বাভাবিক থাকে সবসময়? আকাশ ভেঙে পড়লো স্নিগ্ধার মাথায়।
