অধিকারের লড়াই
অধিকারের লড়াই
মানুষ যখন সৃষ্টি হয়েছিল, তখন মানুষ জন্মাত মুক্ত, বাঁচত মুক্ত এবং সারাজীবন সে বাঁচত মুক্ত হয়েই। সামাজিক বিবর্তনের সাথে সাথে অসাম্য বাসা বাঁধলো। একদল লোক যারা ক্ষমতাবান তারা অপেক্ষাকৃত দুর্বলের উপর নিজেদের জোর খাটাতে শুরু করল। ক্ষমতাবানরা আরও ধনী হল আর অন্যদের শাসন করতে শুরু করল। তখন আর মুক্ত শাসন চলল না, চলল শাসকের আইন।
ইঁটকাঠের ইমারতের ভিড়ে দম আটকে আসে একরত্তি মেয়েটার। কতই বা বয়স হবে আর, বারো-তেরো? পড়াশোনা করার জন্যে তাকে আসতে হয়েছে এখানে। সে শুধু জানে, পড়াশোনা করতে হবে তাকে। অনেক পড়াশোনা।বড় হয়ে উঠতে হবে। কিছু একটা করবে সে, যাতে তার মায়ের দুঃখ ঘুচে যায়। তাদের বাড়িটা যেখানে ছিল, সেখানে এরকম দম আটকানো ধোঁয়া থাকত না। জানলাটা খুললে দূরে পাহাড় দেখা যেত। নীল নীল আবছায়া মতন। হাতছানি দিয়ে ডাকত তাকে। শীতের দিনে টুকটুকে কুয়াশামাখা সূর্যটা উঁকি দিত পাহাড়ের পিছন থেকে। ওপরের আকাশটা ছিল যেন নীল পেয়ালা একটা। কোত্থাও এতটুকু ময়লা নেই। আর এখানে নীল আকাশ দূরের কথা, আকাশটাই দেখতে পাওয়া যায় না। সারি সারি নিয়ন বাতির সাইনবোর্ডে ঢাকা পড়ে যায়। আগে রাতে সে বাড়ির ছাদে গিয়ে বসত। বাবা বসে থাকতেন আগের থেকেই। খানিক পরে কাজ সেরে মাও এসে বসতেন তার পাশে। কি সুন্দর মন্দির মন্দির গন্ধ উঠত একটা মায়ের গা থেকে। খোলা গলায় মা গান গাইতেন। এক একদিন এক এক রকমের গান। বাবা তাল মেলাতেন মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে। আর সে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখত, কুচকুচে কালো আকাশটার গায়ে যেন তারার ঝড় উঠেছে। মাঝে মাঝে এক আধটা তারা খসে খসে পড়ত। ঈশানে, নৈঋতে, দক্ষিণে,পশ্চিমে। ওদের দেখতে দেখতে কখন জানি মেয়েটা একাত্ম হয়ে গিয়েছিল ওদের সাথে। ওই যে খসে পড়া তারাগুলো, ওদের সাথে ওও খসে পড়ত। হুউউউস করে। খুব মজা লাগত ওর।
একদিন রাতে ওরা বাড়ির ছাদে বসে আছে, কে একজন ওর বাবাকে নীচের থেকে ডেকে নিয়ে গেল। সেদিন রাতে আর বাবা ফেরেনি। পরেরদিন সকালে মা মেয়ে খবর পেল মেয়ের বাপকে নাকি খালের জলে ভাসতে দেখা গেছে। চোখের জলের সাথে ভাসিয়ে দিয়ে এসেছিল বাপির অস্থি মেয়েটা। চিতার আগুন তো নিভে যায়, কিন্তু চোখের জলের আগুন? বোধহয় না।
তারপরের ঘটনা ইতিহাস। তাদের বাড়িতে সারাদিন লোক আসছে আর যাচ্ছে, কেউ হয়ত হাতে করে একবাক্স মিষ্টি এনে ততোধিক মিষ্টি কথা শুনিয়ে যাচ্ছে, যাওয়ার সময় ‘আবার আসব’ বলে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ একবার জানতেও চাইছে না তাদের কি হবে, কোথায় যাবে তারা। তারপর একদিন পাড়ার পাঁচুকাকু এলো লাল লাল চোখে, কটমট করে তার দিকে তাকাতে তাকাতে ঘরে ঢুকে মাকে কি সব বলল, তার পরদিনই মা তাদের বাক্স বিছানা গুছিয়ে চোখ মুছতে মুছতে তাকে নিয়ে চলে এল এখানে, এসেই ভর্তি করে দিল তাকে এই স্কুলটায়। তার পাড়ার পোষা ভুলু কুকুরটার সে কি কান্না তার ট্রেনে চাপার সময়, অবশ্য সেও কাঁদতে ছাড়েনি, মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে গিয়েছিল সারাটা রাস্তা। তারপর তো এইখানে এসে পরে সারাদিন বন্দির মতন ঘরে আটকা থাকতে হয়, দরকার ছাড়া ঘরের বাইরে বেরোনোর নিয়ম নেই এখানে। চারদিকে সব গোমড়ামুখো সাদা সাদা আলখাল্লা পরা দিদিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ একটু নিয়ম ভাঙলেই সঙ্গে সঙ্গে হেডমিসের ঘরে নিয়ে যাচ্ছে, তারপর হাতের তালু লাল করে, কখনও সখনও রক্ত মেখে সে মেয়ে ফিরে আসছে। প্রথম প্রথম এখানকার রকম সকম সে দেখে শিউরে উঠত, এখন গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। তার ওপর আরেক উৎপাত তার ক্লাসের ডেঁপো মেয়েগুলো। সে টিফিনে মুড়ি খায় বলে তাকে গাঁইয়া বলে ক্ষ্যাপায়, সে কি করে বোঝাবে তার মায়ের জন্য তাকে এর বেশি দেওয়া সম্ভব না? সে একদিন ক্লাস কামাই করেছিল জ্বর হয়েছিল বলে, পরেরদিন একজনের কাছে নোটস চাইতে গেলে সে মেয়ে তো তাকে গোটা ক্লাসের সামনে অপমানই করে বসল। তার পরদিন থেকে সে হাজার শরীর খারাপ হলেও ক্লাস করতে আসে। তাও এই শৃঙ্খলার মাঝে তার ওই স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে বৃদ্ধলোকটা / বুড়োদাদুর জন্য। এখানে তাঁকে নাকি সবাই ফাদার বলে। রোজ সকালে উনি ওদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে প্রার্থনা করান, ওর সাথে দেখা হলেই গালটা আলতো করে টিপে দেন। এখানে আসার আগে ও একবর্ণও ইংরিজি জানত না, রোজ ক্লাসের পর ও দাদুর ঘরে গিয়ে বসে ইংরিজি শেখে। দাদু ক্লাসের মিসদের মতন একটুও রাগ করেন না, বরং হাসিমুখে ধৈর্য ধরে তার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যান। দাদুর জন্যেই ওর এখন ক্লাসের পড়া বুঝতে একটুও অসুবিধে হয় না। ও ঠিক করে রেখেছে, বড় হয়ে ও বাপির কাছে যাবে, ওই তারাগুলোর কাছে। ও নিশ্চিত জানে, ওর বাপি ওইখানেই লুকিয়ে আছে। বাপির সঙ্গে ছোটবেলায় লুকোচুরি খেলত যেমন, ঠিক তেমনি করে পিছন থেকে গিয়ে ‘ধাপ্পা!’ বলে চমকে দেবে বাপিকে। তাই ও পড়াশোনায় একটুও ফাঁকি দেয় না। দাদু ওকে বলেছে, বড় হলে ও ওই তারাগুলোর কাছে পৌঁছতে পারবে, ছোটদের নাকি যাওয়ার নিয়ম নেই ওখানে। ক্লাসের পড়া রোজ করে করে ও একদিন পরীক্ষায় প্রথম হয়ে গেল। যখন ও পুরস্কার নিল হেডমিসের থেকে, তখন খুব আনন্দ হচ্ছিল ওর। কিন্তু ও খেয়াল করেনি হেডমিসও কেমন যেন দূর থেকে পুরস্কারটা তুলে দিচ্ছিলেন ওর হাতে। তারপর ক্লাসে আসার পর থেকেই বাক্যবাণ মারা শুরু হল ওর ওপর। বাইরে যারা হাততালি দিয়েছিল ওর জন্যে, তারাই নানারকম অভিযোগ আনা শুরু করল ওর ওপর। ও নাকি আগের থেকে জেনে গিয়েছিল প্রশ্নপত্র, টুকলি করে লিখেছিল পরীক্ষার সময়, এইসব। শেষে যখন ওর বুড়োদাদুর দিকে আঙুল তুলে ধরল কয়েকজন, আর চুপ করে বসে থাকতে পারেনি ও। উঠে ছুট্টে বেরিয়ে গিয়েছিল ক্লাস থেকে। গিয়ে পাঁচিলের এক কোণে বসে কোলে মাথা গুঁজে কাঁদতে শুরু করেছিল। ওর ইচ্ছে হচ্ছিল, এক্ষুণি বাপির কাছে চলে যেতে। বা কিছু একটা হোক, যাতে ওর ওই সব ক্লাসমেটগুলো স্কুলটা সমেত মিশে যায় ধুলোয়। পিঠে কোমল হাতের একটা স্পর্শ পেয়ে তাকিয়ে দেখে বুড়োদাদু দাঁড়িয়ে। উদ্বিগ্ন মুখে জানতে চাইলেন,
-হোয়াই আর ইউ ক্রায়িং মাই চাইল্ড?
একনিঃশ্বাসে সব বলে গিয়েছিল ও। ওর বাপির মারা যাওয়া থেকে আজকের রেজাল্টের পর কি হয়েছিল, ওর কেমন ইচ্ছে করছিল, সঅঅঅব। দাদু চুপ করে শুনে গিয়েছিলেন। তার পর বলেছিলেন,
-মাই চাইল্ড, দেয়ারস নাথিং টু বি সো স্যাড। অ্যাজ লং অ্যাজ ইউ লিভ উয়িথ ইয়োর ড্রিমস, ইউ কিপ লিভিং, মাই গার্ল!
কয়েদিখানার মতন জানলাটার ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ও তাই ভাবছিল। ওর বুড়োদাদু আজ ওকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ও আর ছোট নেই। ওর সেই খোলামাঠের বিকেলগুলো ও আর কোনদিন ফিরে পাবে না।এখন ওকে এই ইঁদুরদৌড়ে নামতে হবে নিজেকে নিংড়ে দেওয়ার জন্য। এখন বড় হয়ে গিয়েছে ও। সত্যিকারের বড়। ওকে যে লড়াই করে ওর অধিকার জয় করতে হবে, হয়ত অনেক বাধা বিপত্তি আসবে পথে কিন্তু সব কিছুকে সরিয়ে ওকে যে ওর অধিকার যা জন্মগত প্রাপ্য তাকে আদায় করতে হবে। ওকে জিততেই হবে আর ওর সাথীদেরও তৈরী করে জেতাতে হবে,নাহলে যে এই কুৎসিত ব্যাধি সমাজ থেকে দূর হবে না।