Bishwadeep Mukherjee

Thriller

4  

Bishwadeep Mukherjee

Thriller

অবলোকন

অবলোকন

9 mins
291


পর্ব - ১

***********

বৃষ্টি পড়লে রাস্তায় জল জমার সমস্যাটা কোলকাতাতে খুব হয়। সেই কারণে রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যামের সমস্যা বেড়ে যায়। নিত্য অফিস যাওয়ার জন্য যারা বাড়ি থেকে সকাল নয়টায় বেরতো, এখন তাদের আটটা বা সাড়ে আটটায় বেরিয়ে পড়তে হয়। নায়তো নির্ধারিত সময়ে অফিস পৌঁছনো যাবে না। শুভঙ্করের মধ্যে কিন্তু কোনো পরিবর্তন আসে না। বর্ষাকালে প্রায় দিনই দেরি করে অফিস পৌঁছনো তার নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। মাঝে-মাঝে ম্যানেজারের গালমন্দ খেতে হয় ঠিকই, কিন্তু বিশেষ অঘটন কিছু ঘটে না। এক ইনস্যুরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হয়ে যা প্রফিট কোম্পানিকে সে দেয়, সেটার ধারে কাছে অন্য কোনো স্টাফ আসে না। তাই তার বিলম্ব হওয়াটা ম্যানেজারকে মেনে নিতে হয়। কিন্তু অসুবিধেটা হয় তার বাড়িতে। ঘুম থেকে কিছুতেই তাড়াতাড়ি উঠতে পারে না শুভঙ্কর। স্নান সেরে পুজো করতে তার বেশ সময় লাগে। ঠিক এই সময়টাতেই ঝামেলা হয় পৃথার সাথে। রান্না করা, মেয়েকে স্নান করানো, খাওয়ানো এবং তৈরি করে স্কুল বাস পর্যন্ত পৌঁছে আসা। এতগুলো কাজ একা হাতে পৃথা সামলাতে পারে না। শুভঙ্কর থেকে পৃথার একটিই দাবি।

'একটু তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে মেয়েকে খাইয়ে আর তৈরি তো করে দিতে পারো। যখন তুমি জানো তোমার পুজো করতে সময় লাগে, তখন একটু তাড়াতাড়ি উঠলেই তো হয়।'

'তোমায় তো বলেইছি, যে একটা কাজের মেয়ে দেখো। হাতে হাতে কাজ করে দিলে তোমার তো সুবিধে হয়।' শুভঙ্কর জবাব দেয়।

'আজকের দিনে কাজের মেয়ে পাওয়া যে কতটা কঠিন সেটা হয়তো তুমি জানো। আগের মেয়েটাকে তো চোর বলে তাড়িয়ে দিলে।'

'হ্যাঁ, ও চুরি করতো তো চোর বলবো না তাকে? পৃথা, অনেক কষ্টে দু পয়সা আয় করে একটা একটা করে জিনিস গড়ে তুলেছি এই বাড়িতে। কোনো জিনিস চুরি হয়ে গেলে ঠিক মনে হয় কেউ শরীর কেটে রক্ত বের করে নিয়েছে।'

এগুলো নিত্য দিনের কথোপকথন স্বামীস্ত্রীর। না, নতুন কোনো কাজের মেয়ে এখনো আসেনি।

অফিস বেরোবার আগে পৃথা আজ শুভঙ্করকে বলে দিলো - 'সাগরিকাদের বাড়ি যেতে হবে আজ। জানো তো?'

'কেন বলো তো?' জামার বোতাম লাগাতে লাগাতে জিজ্ঞাসা করলো শুভঙ্কর।

'তোমার মাথায় কি কিছুই থাকে না আজকাল? ওর মেয়ের প্রথম জন্মদিন আজ। সেটাও ভুলে গেলে নাকি? একসময় আমাদের প্ৰতিবেশী ছিল। শুধু প্রতিবেশী নয়, বরং ভালো প্ৰতিবেশী ছিল তারা। নিমন্ত্রণ রক্ষা তো করতেই হবে।' বলল পৃথা।

'কখন যাবে?'

'তাড়াতাড়ি চলে এলে ভালো হয়। একসাথে গিয়ে গিফ্টটা কিনে নেবো।'

আর বিশেষ কিছু বলল না শুভঙ্কর। বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।

বাস স্টপে দাঁড়িয় বাসের অপেক্ষা করছে সে। স্টপে খুব একটা ভীড় নেই আজ। ঘড়ির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো শুভঙ্কর। সকাল দশটা তিরিশ। আজও অফিস পৌঁছতে একটু দেরিই হবে। হঠাৎ করেই শরীরটা কেমন আনচান করতে শুরু করলো তার। মনে হল মাথাটা একটু ঘুরছে। ঘামও হচ্ছে বেশ। বাস স্টপে একটা খালি চেয়ার পেয়ে সেখানে গিয়ে বসতেই চোখের সামনে অন্ধকার দেখলো শুভঙ্কর। হয়তো কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিল সে। মুখে কেউ জলের ঝাপটা মারতে জ্ঞান ফিরে পেল সে।

'আপনার শরীর তো খারাপ মনে হয়।' কেউ একজন বলল।

খুবই ধীর গতিতে চোখ মেলে দেখলো শুভঙ্কর। একজনের হাতে বেশ বড় পিতলের জল ভর্তি গ্লাস। সেটা দিয়েই লোকটা বারবার জলের ঝাপটা মেরে যাচ্ছে শুভঙ্করকে। লোকটার দিকে খানিক তাকিয়ে কিছু একটা অদ্ভুত মনে হল শুভঙ্করের। লোকটা মাঝ বয়সী। পরনে হাফ হাতা পাঞ্জাবি ও ধুতি। দেখতে খুবই সামান্য।

'এখন একটু ভালো মনে হচ্ছে আপনার?' লোকটা জিজ্ঞাসা করলো শুভঙ্করকে।

'হুম।' গলা দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ বেরোলো শুভঙ্করের।

শুভঙ্কর তাকালো আশেপাশে। বেশ কিছু ফিটন গাড়ি রাস্তা দিয়ে যেতে দেখলো সে। যে বাস স্টপের খালি চেয়ারে সে বসে ছিল, সেটাও উধাও। যারা বাসের অপেক্ষা করছিল, তারাও কেউ নেই। প্রায় প্রত্যেকের পরনের ধুতি-পাঞ্জাবি কিম্বা পায়জামা-পাঞ্জাবি। আশেপাশের বাড়ি গুলোও কেমন অদ্ভুত। লোকেরা ছুটে চলেছে এদিক ওদিক। যে ভদ্রলোক শুভঙ্করের মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছিল, তাকে একজন জিজ্ঞাসা করলো- 'Can you tell me where is Star Theater?'

শুভঙ্কর তাকিয়ে দেখলো তার দিকে। সুট-বুট পরা এক সাহেব এক মেমকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাঙালি লোকটি পরিষ্কার ইংরেজি ভাষাতেই তাকে ঠিকানা বলল। সন্তুষ্ট হয়ে ইংরেজ দম্পতির চলে যাওয়ার পর বাঙালি ভদ্রলোকটি শুভঙ্করকে বলল - 'মনে হয় নতুন কোলকাতায় এসেছে। না তো এখানে এমন কেউ আছে যে "স্টার থিয়েটার" চেনে না। যাই হোক, আপনি কোথায় যাবেন?'

'আ.. আমি নিজের অফিস যাবো।'

'কোথায় আপনার অফিস?'

'সেক্টর ফাইভে।'

ভদ্রলোকটি আশ্চর্য হল।

'সেটি আবার কোথায়?'

'কোথায় মানে? আপনি কোলকাতায় থাকেন আর সল্ট লেক সেক্টর ফাইভ চেনেন না?'

'সল্ট লেক? মানে লবণের পুকুর?'

শুভঙ্কর উঠে দাঁড়ালো। সে এতক্ষণ সিমেন্টের একটা ছোট্ট চাঁইয়ের উপর বসেছিল।

'আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে মশাই। যেতে হবে আমায়। আপনি সাহায্য করলেন, তার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।'

ভদ্রলোকটি আশ্চর্য হয়ে শুভঙ্করের দিকে তাকালো এবার। অদ্ভুত তার দৃষ্টি।

'আপনি কি সত্যিই কোলকাতায় থাকেন?'

শুভঙ্কর এই অদ্ভুত প্রশ্নটা আর নিতে পারলো না। যে মুহূর্তে পাশ ফিরে এগোতে যাবে, ঠিক সে সময় এক চরম ধাক্কাতে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়লো সে। সুট-বুট পরা কে একজন তাকে প্রবল বেগে ধাক্কা মেরে দৌড়ে যাচ্ছে। মুখ ফিরিয়ে শুভঙ্করের দিকে চেয়ে বলল - 'I am extremely sorry man.'

শুভঙ্করের এরপর আর কিছু মনে নেই।

পুনরায় যখন শুভঙ্কর হুঁশে এলো তখন নিজেকে আবার সেই বাস স্টপেই পেলো সে। মাথাটা অল্প ভার হয়ে আছে তার। বেশ কিছু দিন ধরেই এই একই সমস্যায় ভুগছে সে। সমস্যাটা কী সেটার বিষয় কিছুই জানে না সে। আজ একবার ফোন করতেই হবে ঐন্দ্রিলা কে। ঐন্দ্রিলাকে আগেও এই সমস্যাটা শুভঙ্কর বলেছিল। পাতি একটা ঘুমের ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল সে। বলেছিল- 'এক্সেস চাপ নিচ্ছো তুমি নিজের মাথায়। এত চাপ নিলে চলবে না। ব্রেনকে একটু রেস্ট দেওয়া দরকার।'

ঘুমের ওষুধ খেয়ে অন্য এক সমস্যা শুরু হল শুভঙ্করের জীবনে। না, আর বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে চায় না সে।

দুয়েকটা ক্লাইন্ট মিটিং শেষ করার পর অফিসে এসে যখন স্থির চিত্তে শুভঙ্কর বসলো ঠিক সে সময়ই তাকে ম্যানেজার কুন্তল দেবনাথ ডেকে পাঠালেন।

ভদ্রলোকের বেশ মোটাসোটা চেহারা। মাথায় চুল নেই বললেই চলে। বয়স পঞ্চাশ ঊর্ধ্বে। চোখে এক দামি ফ্রেমের চশমা। দেবনাথ বাবু বেশ হাসিখুশি মানুষ। শুভঙ্করের সামনের চেয়ারে বসার পর তিনি বললেন - 'ব্যাপারটা তো তুমি বুঝতেই পারছো শুভঙ্কর। তোমার প্রায় রোজ অফিসে দেরি করে আসা নিয়ে রীতিমত চর্চা শুরু হয়ে গেছে। হেড অফিস আমার কাছ থেকে উত্তর চেয়েছে। তাদের বক্তব্য কোম্পানিকে বিজনেস দেওয়া প্রতিটা এমপ্লইয়ের কাজ। তুমি ভালো বিজনেস দিচ্ছ মানে এটা নয় যে তুমি নিজের ইচ্ছের মত কাজ করবে।'

শুভঙ্কর চুপ করে শুনছিল। কী বলবে কিছুই বুঝে পাচ্ছিল না সে। নিজের সমস্যা সে বলতে পারবে না। বললেই হাসির খোরাক হয়ে যাবে সে। তাহলে কি পুজোর সময় কমিয়ে দেবে? ঈশ্বরের প্রতি তার অসীম ভক্তি। না, পুজোর সময় কমাতে পারবে না সে। তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার। রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠা প্রায় অসম্ভব। ঘুমের ওষুধ তাকে ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু তার আগে একবার ইন্দ্রিলা'র সাথে দেখা করতেই হবে। শুভঙ্করের মোবাইলের নেট অন ছিল। হঠাৎ তার হোয়াটসঅ্যাপে একটা ম্যাসেজ এলো -'তাড়াতাড়ি আসবে।'

পৃথার ম্যাসেজ।

হঠাৎ মিস্টার দেবনাথ বলে উঠলেন- 'বেহালাতে মিস্টার ধনঞ্জয় বর্মন নামের একজন থাকে। আমার বন্ধু। তুমি এখন তার কাছে যাও। সে মোটা টাকার ইন্সুরেন্স করাতে পারে। আমি চাই সেই ইন্সুরেন্সটা তোমার মাধ্যমে হোক। আমি তোমায় ঠিকানা বলে দিচ্ছি। চলে যাও।'

'আজকেই যেতে হবে স্যার?' জিজ্ঞাসা করলো শুভঙ্কর।

'হ্যাঁ। আজ রাতেই সে বেরিয়ে পড়বে। কোনো বিশেষ কাজে ইংল্যান্ড যাচ্ছে। তোমার কি কোথাও যাওয়ার আছে নাকি?'

'ন....না স্যার। আ..আমার কোথাও যাওয়ার নেই।'

শুভঙ্কর এই মুহূর্তে বলতে পারবে না ম্যানেজারকে কি তাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে আজ। খবর যখন হেড অফিস পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, তার মানেই পরিস্থিতি অনুকূল নয়।

ম্যানেজারের কেবিন থেকে বেরিয়ে শুভঙ্কর পৃথাকে ম্যাসেজ করলো- 'কাজে ফেঁসে গেছি। তুমি মেয়েকে নিয়ে চলে যাও। গিফ্ট কিনে নিও তুমি।'

শুভঙ্কর পরিষ্কার বুঝতে পারলো, যে পৃথা ম্যাসেজটা পড়েছে, কিন্তু রিপ্লাই দিলো না কিছু।

ঐন্দ্রিলা হালদারের চেম্বার খোলা থাকে রাত আটটা পর্যন্ত। সে মনোচিকিৎসক, যাকে ইংলিশে বলা হয় সাইক্রিয়াট্রিস্ট। মিস্টার বর্মনের সাথে মিটিং সেরে শুভঙ্কর যখন ইন্দ্রিলা'র কাছে পৌঁছল তখন প্রায় রাত সাড়ে সাতটা। শুভঙ্কর ও ঐন্দ্রিলা ছোট বেলাকার বন্ধু। পড়াশোনাতে ঐন্দ্রিলা চিরকাল ভালো ছিলো। সে আজ ডাক্তার। নিজের জীবনের পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছে সে। কিন্তু শুভঙ্কর? হাড় ভাঙা খাটুনির পর বাড়িতে দু পয়সা নিয়ে আসে সে। ঐন্দ্রিলা'র সাথে দেখা করা মানে নিজেকে তার সামনে ছোট করা মনে হত তার। বহুদিন ঐন্দ্রিলা'র সাথে সে দেখা করেনি। একদিন হঠাৎ বাস স্টপে দেখা হয়ে গেল ঐন্দ্রিলা'র সাথে। না, মেয়েটার মধ্যে অহংকার বলে কিছু নেই। ঐন্দ্রিলা আগেও যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে। ঠিক আগের মতই হাসিখুশি।

ঐন্দ্রিলা'র চেম্বারে পেশেন্ট ছিল না।

'ছ'টা থেকে বসে আছি। পেশেন্ট বলতে দুজন। একজন এসেছিল, আরেকজন তুই। মার্কেট খুব খারাপ রে।' ঐন্দ্রিলা বলল।

ঐন্দ্রিলাকে দেখতে মন্দ না। মাঝারি উচ্চতা, চোখ দুটি বেশ বড়-বড়। ববকাট চুল এবং বেশ ছিপছিপে চেহারা। এক কথায় বলতে গেলে বেশ আকর্ষণীয়।

'আমাকেও তুই পেশেন্টের লিস্টে ফেলে দিলি?' ঐন্দ্রিলা'র সামনের চেয়ারে বসে শুভঙ্কর বলল।

'যদি তোকে পেশেন্ট না ভাবি তাহলে তোর চিকিৎসা করা কঠিন হবে আমার জন্য। বল, প্রবলেম কী হল?'

'সমস্যা। চারিদিকে সমস্যা ছাড়া আর কিছুই নেই। মাথায় সমস্যা, বাড়িতে সমস্যা, অফিসে ভালো কাজ দিয়েও সমস্যা। পুরো দুনিয়াটা মনে হচ্ছে মিক্সচার গ্রাইন্ডার, আর আমি নিরন্তর পিষে চলেছি তাতে। সব থেকে বেশি কালপিট তো আমার মাথা। আমি বুঝতে পারছি, যে আমার মাথাটা ঠিক হয়ে গেলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। মাথা ঠিক করার দায়িত্ব তোকে দিলাম। তুই কী একটা ঘুমের ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দিলি। সেটা খেয়ে তো কিছুই ঠিক হল না উল্টে বৌয়ের সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেল।'

'ঘুমের ওষুধ খেয়ে বৌয়ের সাথে সম্পর্ক খারাপ হল কী করে?'

'সম্পর্ক খারাপ হবে না? রাত দশটা বাজতে না বাজতেই ঘুমের ওষুধ খেয়ে নাক ডেকে ঘুমিয়ে পড়ি। বৌয়ের সাথে সম্পর্ক খারাপ হবে নাতো কি ভালো হবে?'

নিজের হাসি রুখতে পারলো না ঐন্দ্রিলা। হাসি থামার পর বলল - 'বৌয়ের সাথে সম্পর্ক ভালো করার পর খাবি ওষুধটা।'

'হ্যাঁ, সেটাই। এমনিতেই সকালে ঘুম ভাঙে না, তখন তো দুপুরে উঠবো ঘুম থেকে। প্রায় রোজ দেরি করে পৌঁছই অফিসে। এই এম টোটালি ডিস্টার্ব। আজ এক নিমন্ত্রণ ছিল। সেখানে না গিয়ে তোর কাছে এলাম। ইন্দ্রিলা, প্লিজ কিছু কর। নেওয়া যাচ্ছে না এত চাপ।'

'আবার কি তেমন কোনো ভিসন এসেছে?' জিজ্ঞাসা করলো ঐন্দ্রিলা।

'আজকেই। অফিস যাওয়ার সময়। এই নিয়ে চারবার হল।'

'আয় আমার সাথে।'

ঐন্দ্রিলা শুভঙ্করকে পাশের একটা ঘরে নিয়ে গেল। ঘরটা খুব বড় না। একটা চেয়ার এবং আধুনিক যুগের এক আরাম কেদারা পাতা আছে সে ঘরে। দুটোর মাঝে ঝুলছে হালকা সবুজ রঙের কম পাওয়ারের বাল্ব। শুভঙ্করকে আরাম কেদারায় বসার ইশারা করে নিজে সামনের চেয়ারে বসলো ঐন্দ্রিলা। সবুজ লাইটটা জ্বলছে।

'চোখ দুটো বন্ধ কর।' ঐন্দ্রিলা বলল।

কথা মত কাজ করলো শুভঙ্কর।

'শুভঙ্কর, সব কিছু ভুলে গিয়ে তুই এখন সেই পুরনো দিনে ফিরে যা। আশেপাশে অনেক অজানা লোকের ভিড়। অচেনা বাড়ি, অচেনা গাড়ি। ঠিক তুই যেন এক অন্য পৃথিবী থেকে সেখানে গিয়ে হাজির হয়েছিস। কিছু দেখতে পাচ্ছিস এখন? কী দেখতে পাচ্ছিস শুভঙ্কর?'

খানিকক্ষণ চুপ থেকে শুভঙ্কর চোখ বন্ধ করেই বলল - 'একটাকেও চিনি না যে। কেমন অদ্ভুত পরিবেশ। না, এটা বর্তমান নয়। এটা কোনো মতেই বর্তমান হতে পারে না। না, এটা বর্তমান না। আমি কোথায়? কোথায় আমি? এরা সব কে?'

হঠাৎ করেই উত্তেজিত হয়ে পড়লো শুভঙ্কর।

'শান্ত হয়ে যা শুভঙ্কর। তুই ঠিক কোথায় আছিস এই সময় বলতে পারবি?'

খানিকপর শুভঙ্কর বলল - 'আ..আমি কোথাও বসে আছি। চেয়ারে। আশেপাশে বেশ ভিড়। দেখে কোনো ডাক্তারখানা মনে হচ্ছে।'

ঐন্দ্রিলা'র কোলে একটা খাতা ছিল। কিছু একটা লিখলো তাতে।

'আশেপাশে কোনো ক্যালেন্ডার দেখতে পাচ্ছিস?' জিজ্ঞাসা করলো ঐন্দ্রিলা।

আবার খানিকপর শুভঙ্কর বলল - 'হ্যাঁ, একটা ক্যালেন্ডার দেখতে পেয়েছি।'

'কী লেখা আছে তাতে? মানে ঠিক কোন সাল? একটু ভালো করে দেখে বল শুভঙ্কর।'

'সাল..সাল তো 1942 লেখা আছে। মাস ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ক্যালেন্ডারে একটি পাতা। তাতেই সব মাসের নামগুলো লেখা আছে।'

শুভঙ্করের কথা শেষ হওয়ার পর ঐন্দ্রিলা নিজের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। ঘরের এক বড় লাইট জ্বালিয়ে শুভঙ্করকে বলল - 'উঠে পর।'

ধীর গতিতে চোখ খুললো শুভঙ্কর। ইন্দ্রিলা'র সাথে বাইরের ঘরে এলো সে।

'প্রশ্ন হলো, তুই যতবার এমন দৃশ্য দেখিস, সব বারেই কি 1942 সালের দৃশ্য?'

একটু ভেবে শুভঙ্কর বলল - 'মনে হয়। আমার মনে আছে ঐন্দ্রিলা, এর আগে যখন আমার এমন হয়েছিল তখন আমি হাওড়া স্টেশন থেকে বাইরে বেরোচ্ছি। অফিসের একটা কাজে ব্যান্ডেল গিয়েছিলাম। হাওড়া স্টেশন থেকে বেরোবার সময় হঠাৎ করেই চোখের সামনে পুরনো আমলের দৃশ্য চলে আসে। এখনো স্পষ্ট মনে আছে ঐন্দ্রিলা, আমি হাওড়া ব্রিজ তৈরি হতে দেখছিলাম চোখের সামনে। হাওড়া ব্রিজ 1942 সালে তৈরি হচ্ছিল সেটা আমরা সবাই জানি।'

একটু চুপ থেকে ঐন্দ্রিলা বলল - 'আপাতত আজকের রাতটাও ঘুমের ওষুধটা খা। আগামীকাল সন্ধ্যায় একবার আয়। কিছু জিনিস জানতে হবে আমায়।'

শুভঙ্করের চলে যাওয়ার পর ঐন্দ্রিলা নিজের চেম্বারে বেশ অনেকক্ষণ বসে রইল। তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, বেশ চিন্তিত সে।


(ক্রমশঃ....)


Rate this content
Log in

More bengali story from Bishwadeep Mukherjee

Similar bengali story from Thriller