আত্মসম্মান
আত্মসম্মান
প্রতিদিনের মত আজও বাড়ীর কাছের পার্কটাতে গিয়ে বসে একটু খোলা হাওয়ায় নিশ্বাস নিচ্ছিলাম। হঠাৎ সেই মেয়েটিকে দেখলাম,আজ বেশ কয়েক দিন ধরেই দেখছি মেয়েটাকে এই পার্কে বেঞ্চের এক কোণায় বসে থাকতে। প্রথমে ভেবেছিলাম কারও জন্য হয়তো অপেক্ষা করছে, কিন্তু না । সাধারণত পার্কে একা একা লোক কমই আসে। তারপর আবার মেয়ে মানুষ। কারণ পার্কে সবাই বন্ধু বান্ধব অথবা প্রেমিক প্রেমিকা আরো অনেকের সঙ্গে আসে। অবশ্য আমিও একা একাই আসি। কিন্তু আমি তো আসি আমার অফুরন্ত সময় কাটানোর জন্য। বেকার মানুষ কাজ কর্ম নেই এখানে এসে ঘুরে বেড়াই । এখানে নানা রকমের মানুষ দেখা যায়। নানা রকমের মানুষের আচরণ দেখতে বেশ ভালোই লাগে। আর এভাবেই আমার সময়টা কেটে যায়। কিন্তু ঐ মেয়েটার কি কাজ! ও কি আমার মতো এখানে সময় কাটাতে এসেছে? নাকি অন্য কোন ধান্দা আছে মেয়েটার। কিন্তু ও তো কারো সাথে কথাও বলে না, চুপচাপ বসে থাকে একই জায়গায়।
আমি আসার ঘণ্টা খানেক পরেই মেয়েটা আসে। কেমন যেন এখানে আসাটা আমার নেশা হয়ে গেছে। গত তিন মাসের মধ্যে গুনে হয়তো তিন থেকে চার দিন এখানে আসা হয় নাই। আর এই তিন মাসের মধ্যেই কত রকমের মানুষ দেখলাম। কিন্তু এই মেয়েটাকে আমার কাছে কেমন যেন অদ্ভুত মনে হচ্ছে। চোখে মুখে সব সময় একটা ভয় ভয় ভাব কাজ করে। কেমন যেন জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে। আর কখনও কখনও চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোঁটা জল।
আমার খুব কৌতূহল মেয়েটার সাথে কথা বলার। কিন্তু কিভাবে বলব , এরকম একটা মেয়ের সাথে কথা । কথা বলতে গিয়ে যদি কোন ঝামেলায় পড়ি। ওর তো কোন খারাপ উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। অথবা আমাকে যদি ভুল বোঝে। আর এই বয়সে একটা মেয়ে? আঠার উনিশ হবে হয়তো বয়স। আর দেখতে শুনতেও খারাপ না। না নিজের কৌতূহলকে আর দমিয়ে রাখতে পারলাম না। যা হয় হবে সে পরে দেখা যাবে। আমি এক পা দু পা করে মেয়েটার কাছে গেলাম। মেয়েটি আমাকে দেখে ভয়ে আরো জড়োসড়ো হয়ে বসলো। আমি স্বাভাবিক হওয়ার জন্য বললাম-ভয় পেওনা, আমি কী তোমার এখানে বসতে পারি। মেয়েটি কাঁপা কাঁপা গলায় বললো কেন? আমি কোন ভনিতা না করেই বললাম আসলে আমি তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই । আর তুমি যদি বলতে না চাও-তাহলে আমি চলে যাব। এই বলে আমি চুপ করে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। মেয়েটি মাথা নীচু করে থেকে কিছুক্ষণ পরে বললো-বলুন। আমি বললাম,তাহলে আমি এখানে বসি। মেয়েটির পাশে কাগজে মোড়ানো কি যেন একটা ছিল, সেটা সে তার কোলের উপর রেখে হাত দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করলো। আমি ওদিকে তাকিয়ে বসতে বসতে বললাম-ওটা কী? মেয়েটা নির্দ্বিধায় বললো ছুরি। আমি একটু চমকে গেলাম-ছুরি! হ্যাঁ, আমি বললাম ছুরি কেন? মেয়েটি এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো-নিজেকে বাঁচানোর জন্য। এখানে তো খারাপ লোকের অভাব নেই। কিন্তু তুমি এখানে প্রতিদিন আসো কেন? তোমার বাড়ি কোথায়? আর কেনই বা তুমি প্রতিদিন এখানে এসে বসে থাকো। মেয়েটি এবার অন্য দিকে তাকিয়ে বললো-নিজেকে বাঁচানোর জন্য। মেয়েটির কথায় আমার কেমন যেন সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। কী বলছে মেয়েটা। কি সমস্যা তোমার আমাকে কী বলা যায়। মেয়েটা আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো-আপনাকে বলে আমার কী লাভ। হ্যাঁ, আমি জানি তোমার কোন লাভ নেই। কিন্তু তারপরও আমার যে খুব জানার ইচ্ছা।
তারপরও অনেকক্ষণ দু’জনই চুপচাপ বসে রইলাম। এর পর মেয়েটি বলতে শুরু করলো। আমার যখন আট বছর বয়স তখন আমার মা মারা যায়। আমার কোন ভাই বোন নেই, আমি মা বাবার একমাত্র সন্তান । আমার বাবা ছোট খাটো একটা চাকুরী করতো। আমাদের তিন জনের বেশ ভালোই চলে যেত। কিন্তু মা মারা যাবার পর থেকে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। বাবা আস্তে আস্তে পাল্টে যেতে লাগলেন। একদিন এক মহিলাকে নিয়ে এসে বললো-উনি নাকি আমার নতুন মা। তবে আমি তাকে কোনদিনও মা বলে ডাকি নি। নানা অনিয়মের কারণে বাবার চাকুরিটাও চলে গেলো, আমি ছোট বলে সঠিক কারণটা বুঝতে বা জানতে পারিনি । এরপরই সংসারে অভাব নেমে এলো। সংসারে এটা নেই ওটা নেই এই নিয়ে প্রায়ই ঐ মহিলার সাথে বাবার ঝগড়া লেগে থাকতো, এমন কী কোন কোন দিন মারামারিও হয়ে যেত। আর আমার সাথে তো কখনো ভালো ব্যবহার করতেন না। সেজন্য পড়াশুনাটাও আর করা হলো না। তবে বাবার সামনে তেমন কিছু বলতে পারতো না। আর এভাবেই কাটতে লাগলো আমাদের দিন। আর কিছুদিন আগে বাবা রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। কোথায় গেছেন আমি জানি না। তারপর থেকে আমার উপর অত্যাচার বেড়ে যেতে লাগলো। অনেকদিন ধরেই ঐ মহিলা বাবা বাইরে গেলে বিভিন্ন ধরনের লোক নিয়ে আসতো। আর আমি কিছু বললেই আমাকে মেরে ফেলার ভয় দেখাতো। বলতো তোর বাপকে যদি বলিস, তাহলে জানে মেরে ফেলবো। ভয়ে আমি কিছুই বলিনি বাবাকে। কিন্তু এই ক’দিন ধরেই সে আমাকে…
কথাটা বলেই মেয়েটা কাঁদতে লাগলো। মেয়েটির কথা শুনে আমি একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম-মেয়েটার প্রতি কেমন যেন একটা মায়া জন্মে গেল আমার। আমি জিজ্ঞাসা করলাম তারপর কী হলো? মেয়েটি কান্না থামিয়ে আবার বলতে শুরু করলো-আর ক’দিন আগে আমাকে বলে, তোকে এই ধান্দায় নামতে হবে। তুই থাকলে আরও বেশি টাকা পয়সা রোজগার হবে। আমি রাজি না হওয়ায় আমাকে অনেক মেরেছে। কিন্তু আমার তো কেউ নেইও এ শহরে, আর বাবা কোথায় গেছে তাও জানি না। এটাও জানি যে, আমি মরে গেলেও ওনার কথায় রাজি হব না। এখন আমি কোথায় যাব, কী করবো-কিছুই ভেবে পাই না। তবে গ্রামের বাড়িতে আমার
এক পিসি আছে। কিন্তু সেখানে যেতে হলে তো টাকার প্রয়োজন। আর সে জন্য প্রতিদিন এখানে আসা। আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাহায্য বা ভিক্ষা চাইতেও পারবো না। প্রতিদিন বসে বসে ভাবি কী করা যায়? কিন্তু বিবেকের কাছে হেরে গিয়ে শূন্য হাতে ঐ নরকে ফিরে যেতে হয়। কোনদিন খাবার জোটে আবার কোনদিন কিল-চড়।
আমি শুধু ভাবলাম মানুষের জীবন কত বিচিত্র। আর এই বিচিত্র জীবনের সমস্যা গুলোও বিচিত্র।
মানবিক কারণে আমি বললাম-তোমার পিসির ওখানে যেতে যা টাকা লাগে সেটা যদি আমি দেই তোমাকে। আমার কথায় মেয়েটা কেমন যেন অদ্ভুত ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো-আপনি এখন আসুন। কথাটা শুনে আমি বিব্রতকর অবস্থায় পড়লাম। তারপরেও বললাম-কেন তুমি টাকাটা নেবে না, তোমার তো প্রয়োজন। মেয়েটি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো-আমি তো আমার দুঃখ কষ্টকে আপনার কাছে বিক্রি করি নি যে আপনি আমাকে টাকা দেবেন - এই বলে মেয়েটি ওঠে চলে গেলো। আমি মেয়েটির এই ব্যবহারে অবাক হয়ে গেলাম, কিন্তু ভালো লাগলো এটা ভেবে যে এতো দুঃখ দুর্দশায় থেকেও সে তার আত্মসম্মানকে হারিয়ে ফেলেনি।
