আলো আমার আলো (শেষ পর্ব)
আলো আমার আলো (শেষ পর্ব)


এসব দেখে সুজয়ের মা রানু মাসি আলোর বাবাকে লুকিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সব কথা খুলে বলেন এমনকি এতদিন যে তাকে আলো মিথ্যে কথা বলে রেখেছে সেটাও জানায়। সব শুনে বিনয় তো বাকরুদ্ধ হয়ে যান। তার সেই ছোট্ট আলো এত বছর ধরে এত অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করেছে, অথচ তাকে একটু ও বুঝতে দেয়নি । ও এতই সরল, ভাবলো কিনা বাবাকে জানালে পাছে সে মারা যাবে। হায় রে কি কপাল তার। আলোর দুঃখে তার চোখে জল বেরিয়ে এল। কিন্তু পরক্ষনেই নিজেকে শক্ত করে উঠে দাঁড়ালো, না আজ তাকে এর বিহিত একটা করতেই হবে ।
সুজয়রা বাধা দিল ।বললো, "না - এখন কিছু বলার দরকার নেই বাড়িতে। তার থেকে আয়ুষদের বাড়ি চলুন ।" বলে ওরা বিনয় কে আয়ুষদের বাড়ি নিয়ে যায় ।সে তো ওদের বাড়ি দেখে অবাক হয়ে যায় , ভাবে আলোর আমার এত ভাগ্য ভালো, রাজপুত্রের মতন ছেলে , এত বড় দোতলা বাড়ি , গাড়ি আমি তো কখনও আশা ও করিনি । তাঁর দুচোখ জলে ভরে এলো ।
জয়াদেবী বললেন আমার কিছু শর্ত আছে আপনার কাছে , সে বলল- "বিয়েতে আমাদের কিছু লাগবে না, এক কাপড়েই আমরা আলো কে নিয়ে আসবো ,তবে বিয়ে হবে চারদিনের মধ্যেই।"
বিনয় একটু থতমত খেয়ে যায় , এই চারদিনের মধ্যে কি করে মেয়ের বিয়ের টাকা জোগাড় করবে ?
ওনার মুখ দেখে জয়াদেবী বলেন -" আপনি খালি সম্প্রদান করুন ,বিয়ের সব খরচা আমাদের ।
বিনয় বলেন -" তা কি করে হয়? আলো আমার মেয়ে হয়, ধুমধাম করে না পারি, কিন্তু আমার সাধ্যমত খরচা করে মেয়ের বিয়েটা আমাকে করতে দিন , এটুকু আমার নিবেদন ।"
তাতে জয়াদেবী বলে ওঠেন," আহা, আপনি আমায় ভুল বুঝছেন, আপনার কথা চিন্তা করেই আমি ওই প্রস্তাব দিয়েছি । কিন্তু এটা ঠিক যে আমরা কোনো জিনিসপত্র নেবো না।আর একটা শর্ত হচ্ছে যে- আমার বলতে খুব খারাপ লাগছে কিন্তু না বলে পারছি না, ব্যাপার টা হচ্ছে বিয়ের পর আলো কিন্তু কোনদিনের জন্যে ও বাপের বাড়ি যেতে পারবে না, তবে হ্যাঁ আপনি যখন খুশি এসে মেয়েকে দেখে যেতে পারবেন , ফোনে যোগাযোগ রাখবেন আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আরও একটা কথা হচ্ছে, এই বিয়েতে কিন্তু আলোর সৎমা বা সৎবোন কেউই যেন না থাকে । এটা আমাদের অনুরোধ বলতে পারেন । ভালো করেই জানেন আজ ওদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যই কিন্তু এতো হুটোপাটা করে বিয়েটা দেওয়া। সুতরাং আমরা চাই না ওদের কালো ছায়া এই শুভ অনুষ্ঠানে পড়ে । বেশ,আর কিছু বলার নেই আমার । জানি আপনার খারাপ লাগছে , কিন্তু আমি নিরুপায় ।"
"না না আপনারা ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন , আমিই অভাগা না হলে আজ আমার জন্যই আলো এতো কষ্ট পেলো। আপনারা যা যা চাইছেন তাই হবে , তবে আজ আমি চলি, বলে বিনয় হাত জোড় করে উঠে দাঁড়ালো।"
ওমা তা কি করে হয! মেয়ের হবু শ্বশুরবাড়ি এসেছেন খালি মুখে যাওয়া যায়? হরেক রকমের মিষ্টি ও লুচি মাংস খাইয়ে তবেই বিদায় দেন হবু বেয়াই কে। আতিথেয়তার কোনরূপ ত্রুটি করেননি । তবে যাওয়ার সময়ে শুধু বলে দিলেন, "ও আরও একটা কথা, আলোকে কিন্তু আজই সুজয়দের বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন । আজ থেকে আলো ওখানেই থাকুক , আমি চাই না কোন রিস্ক নিতে ।" "বেশ তাই হবে "বলে বিনয় ফিরে গেলেন ।
তিনদিনের মধ্যে হুটোপাটা করে বিয়ের জোগাড় হতে থাকলো, ছেলের বাড়ির কথানুযায়ী, আলো কে সুজয়দের বাড়ি এনে রাখা হয়েছে । এবারে শান্তি কিন্তু আর নিজের ভালোমানুষীর রূপটা ধরে রাখতে পারলো না। তীব্র আপত্তি তার আলোর বিয়েতে , সে চায় সুনয়নার বিয়ে হোক , কিন্তু পেরে ওঠে না, এবারে যে বিনয়ের সাথে পাড়ার লোক ও একত্রে আছে । উল্টে মা, মেয়ে কে একঘরে করে রাখা হয় বিয়ে সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত ।
ওদিকে একটা ছেলের বিয়ে বলে কথা, বিশাল আড়ম্বর করেছেন , বাড়ি সাজানো থেকে যাবতীয় জিনিস একদম টপ ক্লাস । দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এলো , বরের বাড়ি থেকে মাত্র দশ-বারো জন এসেছিল আশী়র্বাদে আলো কে সোনায় মুড়ে দিয়েছিল । তাই দেখে পাড়া-প্রতিবেশীদের তো চক্ষু ছানাবড়া। বিনয় খুব আড়ম্বর হয়তো করতে পারেননি, কিন্তু খুব ভালোয় ভালোয় বিয়েটা অবশেষে সম্পূর্ণ হলো ।
এবং পরের দিন সকাল সকাল নতুন বউ নিয়ে রওনা দিল আয়ুষ। আলো অচেনা জায়গায় একা যাবে সেই চিন্তা করে আয়ুষ সুজয় কে ও সঙ্গে নিয়ে নেয় । বিনয় হাত জোড় করে আয়ুষের কাছে বলে - " আমি তো মেয়েটাকে সুখ দিতে পারিনি , তুমি বাবা দেখো ওকে , সুখে - দুঃখে ওর পাশে থেকো , দেখো ও যেন আর কষ্ট না পায়। সেই ছোট্ট থেকে মা মরা মেয়েটা আমার বড্ড কষ্ট করে এসেছে , আমাকে বুঝতেও দেয়নি কখনও , মুখ বুঝে সহ্য করে এসেছে," বলেই উনি কাঁদতে থাকেন । আয়ুষ ও প্রতিশ্রুতি দেয় সে কোনোদিনের জন্যে ও আলোকে কষ্ট পেতে দেবে না। আলো কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নেয় , আলোর জন্যে পাড়ার সবাই কাঁদে । এবারে ওরা রওনা দেয় ।
শ্বশুরবাড়ী এসে পৌঁছাতে সেখানকার অবস্থা দেখে তো আলোর মনে হয়, সে যেন কোনো স্বর্গদ্বারে এসেছে । এ যেন তার নবজন্ম হলো ।ওর মনে হচ্ছে ও যেন স্বপ্ন দেখছে ।
জয়া দেবী সাদরে ছেলে -বউ কে বরণ করে ঘরে তোলে । আত্মীয় -স্বজনে বাড়ি ভর্তি । নতুন বউ দেখে সবারই এক কথা -" এবারে আর তোকে মেয়ে পুতুল কিনতে হবে না রে জয়া, তোর ছেলে যে তোর জন্য জ্যান্ত পুতুল নিয়ে এলো । "জয়া ও হাসতে হাসতে সায় দেয়, "হ্যাঁ ঠিক বলেছ।আর চিন্তা কি, আমি আমার মেয়ে পেয়ে গেলাম ।" আসলে জয়াদেবীর মেয়ের খুব শখ ছিল । কিন্তু হয়েছিল ছেলে , তাই তিনি যেখানেই যেতেন সেখান থেকেই সুন্দর সুন্দর মেয়ে পুতুল কিনে আনতেন, এবং একটা ঘর খালি মেয়ে পুতুলেই ভরা । এতদিনে তার মেয়ের আশা পূরণ হলো আলোকে পেয়ে ।
আলো ওরই ঘরের জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে সে কোনো স্বপ্ন দেখছে না তো! সুজয়ের ডাকে সম্বিত ফিরে পায়- সুজয় কে বলে ওঠে -" দাদা আমি কোনো স্বপ্ন দেখছি না তো ? তুমি আমার হাতে একটু চিমটি কাটো তো"। সুজয় হো হো করে হেসে ওঠে এবং ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে -" আরে না না পাগলি বোন আমার , কেন স্বপ্ন দেখবি? এ যে তোর নবজন্ম হলো । দেখবি তোর জীবনে এখন অন্ধকার ঘুচে গেছে , এখন শুধুই আলোই আলো । ভগবানের কাছে প্রাথর্না করি আর যেন কোনদিন তোর ওই দুচোখে জল না আসে । জানিস তোর জীবনের সবথেকে যা অপূর্ণতা ছিল তা আজ পূর্ণতা পেল। কি বলতো?''
আলো মৃদু হেসে জানালো-" হুম জানি গো দাদা, "মা" , মা ছিলো না বলে আমার খুব ক্ষোভ ছিলো সেই ছোট্ট থেকেই ।"
"আর সে ক্ষোভ তোর থাকবে না, দেখিস," বলে সুজয়। "মাসিমনি খুব ভালো মানুষ , শুধু তাই নয়, খুব বড় মাপের খোলা মনের মানুষ । দেখবি তোকে কত ভালোবাসবে। ওনার মেয়ের খুব শখ ছিলো । আমি জানি তুই ওনার মনের বাসনা পরিপূর্ণ করবি। আর তাছাড়া এই বাড়ির মেসোমশাই ও আযুষ ওরা ও খুবই ভালো । আয়ুষের মতন তো ছেলেই হয় না। ও তো আমার প্রিয় বন্ধু , কত বছরের সম্পর্ক বল তো। কত সুন্দর দেখতে, পড়াশোনায় কত ভালো , বড়লোকের ছেলে, তবুও মনে কোনো অহংকার নেই । তোর আগের জন্মের কোনো পূণ্যির ফলেই এত সুন্দর ঘর, বর সব পেলি বুঝলি"।
এই সময় আয়ুষ ঘরে ঢোকে আর বলে, "ও এইখানে ভাই -বোনের গল্প চলছে ওদিকে যে তোকে মা খুঁজছেরে।""ও তাই নাকি ," বলেই সুজয় বেরিয়ে যায় ঘর থেকে ।ঘরে এখন খালি দুজনে , এই প্রথম আয়ুষ আলো কে একটু একা পেল। না ভালো করে দেখার সুযোগ পেয়েছিল, না কথা বলার । অপলক দৃষ্টিতে আয়ুষ আলো কে দেখতে থাকে আর মনে মনে ইচ্ছে করে ওর হাত টা একটু যদি ধরতে পেতাম । ওইভাবে দেখছে দেখে আলোর লজ্জায় মুখ লাল হয়ে ওঠে , ঠোঁট দুটো কাঁপতে থাকে থরথর করে । আয়ুষ গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে , আলো কে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসায়, পাশে নিজেও বসে । এবারে আলোর বুকের ভেতরটা যেন তোলপাড় হতে থাকে । পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বা , চওড়া বুকের লোমশ ছাতি, যেমন গায়ের রং, তেমনি তার চোখ মুখ, যেকোনো মেয়ে পাগল হয়ে যাবে আয়ুষ কে দেখলে ।আয়ুষ আলোর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে নিজেই পরিবেশটাকে সহজ করার জন্যে বলে উঠল -"তোমার কেমন লাগছে আমাদের বাড়ি ? যখনই যা কিছু লাগবে আমায় বিনা সংকোচে বলবে কেমন "।
আলো মাথা নেড়ে সায় দেয় ।
ওদিকে আয়ুষের মোবাইলের রিংটোন বাজতে থাকে আমাদেরই চির-পরিচিত রবি ঠাকুরের গানখানি-*আলো আমার আলো ওগো, আলোয় ভূবন ভরা ....বারবার ফোন বাজতে থাকে , আর আয়ুষ ফোন টা কাটতে থাকে । নিজের মনেই বলে ওঠে উফ্ ..... নিজের বউয়ের সাথে একটু কথা বলবো তার উপায় নেই। বলতে না বলতেই সুজয় ও আরও দুজন বন্ধুরা দরজা খুলে একেবারে ভেতরে চলে আসে - সুজয় বলে," বাব্বা তর সইছে না দেখছি, আরে কালরাত্রি টা কাটতে দাও গুরু ," সবাই মিলে হাসতে থাকে ।আলো আরও লজ্জায় পড়ে যায় ।
এরপর ধুমধাম করে রাজসিকভাবে বউভাত হয়। প্রচুর লোক উপস্থিত ছিলো । আলোর সৎমা, বোন বাদ দিয়ে পাড়ার প্রতিটা লোক কে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিলো । আলোর বাবা তো মেয়েকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন, এই দুদিনেই মেয়ে যেন তার অপ্সরা হয়ে গেছে । আজ তো মনে হচ্ছে কোন পরি নেমে এসেছে। আলোকে লেহেঙ্গা পরানো হয়েছে আর অলংকারে মোড়ানো। বিউটিপার্লার থেকে সাজানো হয়েছে ।ওর বাবা মেয়ে কে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করে বিদায় নিল। আলোর চোখ জলে ভরে এলো । বউভাত খুব সুন্দর করে সুসম্পন হলো ।ওকে এখানে কেউ কোন কাজ ও করতে দেয় না। আলো সবার মন জয় করে নিলো এই কদিনেই। ও এখন সবার চোখের মনি। এরপর আয়ুষের বাবা ছেলে ও বউমার জন্যে গোয়ার টিকিট কেটে আনেন। দুই কপোত- কপোতি মধুচন্দ্রিমায় পাড়ি দিল, একে- অপরকে আর ও কাছাকাছি নিজেদের করে পাবে বলে। আবার সেই ফোনের রিংটোন টা বেজে ওঠে ,,,,,, আলো আমার আলো ওগো,,,,,, আলোয় ভূবন ভরা।
সমাপ্ত