*আলো আমার আলো *(প্রথম পর্ব)
*আলো আমার আলো *(প্রথম পর্ব)
আজ আমি আলোর কথা বলি তোমাদের ,, হ্যাঁ সত্যিই সে আলো । আলোর মতনই তার রূপ। অনেক শখ করে মা এই নাম দিয়েছিল মেয়ের । কিন্তু কপালের এমনই ফের, ভগবান তাঁকে মা ডাক শুনতে দিল না। মেয়ের মুখে বুলি ফোটার আগেই দীপা ইহলোক ত্যাগ করেন। বিনয় যেন অথই জলে পড়েন, ছোট্ট আলো কে নিয়ে একেবারে নাজেহাল অবস্হা । নিজের সংসার ফেলে কেই বা কতদিন তাঁর বাচ্চা সামলাবে। তাই বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বিনয়ের আত্মীয়-স্বজনরা আলোর কথা চিন্তা করে পুনরায় তাকে বিয়ের জন্যে চাপ দেয়। কিন্তু সে বিয়ে করতে নারাজ । বাড়ির অতো জন বড়োদের কাছে তার এই না কথাটি টিকল না। কি আর করবে, ওই ছোট্ট আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত রাজি হতে হলো । তবে তাঁর ও একটা শর্ত ছিল , আলোর দেখাশোনার যেন কোন ত্রুটি না থাকে ।
অনেক সম্বন্ধ দেখে দেখে তবে তাঁরা বারাসাত নিবাসী শান্তিকে পছন্দ করেন। ওদিকে বিনয় থাকতো জয়নগরে। আর সে ছোট একটা কারখানায় ম্যানেজার ছিল । যাই হোক ওরা মেয়ের বাড়িতে বলেই দিয়েছিল যে আলোর যেন কোন ত্রুটি না হয়, শান্তি যেন নিজের সন্তানের মতনই আলো কে মানুষ করে । সব শুনে শান্তি ও তার বাড়ির লোক আলোর দায়িত্ব নিতে রাজি হয়ে যায় । শান্তির সাথে বিনয়ের কালীঘাটেই নমঃ নমঃ করে বিয়েটা হয়ে যায় । নতুন বউ বাড়ি এসে আলোকে কোলে তুলে নিল। বিনয় ও তাঁর বাড়ির লোক যেন নিশ্চিন্ত হলো ।কথাও রেখেছিল শান্তি , বুকে আগলে রাখতো আলোকে। কিন্তু বাদ সাধলো শান্তি যখন বছর দুয়েকের মধ্যে নিজে গর্ভবতী হলো । কানে কুমন্ত্র ঢাললো ওর মাসি- বোঝালো আলোকে ভুলে সে যেন তার নিজের যে সন্তান আসছে তাকে নিয়েই এখন থেকে ভাবে , নিজের সন্তান ফেলে সতীনের সন্তানকে দেখার মোটেই দরকার নেই । হায়রে অভাগী আলো। সে যে তীরে ছিলো সেই তীরেই রয়ে গেল ।
দেখতে দেখতে শান্তি মা হলো , তার কোলে ও আসলো কন্যা সন্তান , আনন্দে আত্মহারা হলো সে।মেয়ে কোলে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে শান্তি , দিনরাত মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত। বিনয় ভেবেছিল হয়তো ছেলে হবে কিন্তু মেয়ে হওয়াতে মনটা একটু খারাপই হয়ে গেল , আলোর দেখাশোনার কোনো ত্রুটি হবে নাতো মনে ভাবলেও তা প্রকাশ করতে পারল না। আর যাই হোক দীপার মতন নয় শান্তি, এটা সে ভালোই বুঝেছে এই দুবছরে।
শান্তি মেয়ের নাম রাখে সুনয়না। ওদিকে সেই কাজের মাসিই আলো কে স্নান করিয়ে দেয় , খাইয়ে দেয়, তারপর সে কখন কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে,যত্ন করে ঘুম পাড়িয়ে দেবার মতন ও কেউ নেই , ওর বাবা জানতে ও পারে না আজ তার আলো কত অসহায় । সেই রাতে যখন বিনয় ফেরে, তখনই আলো বাবার একটু আদর পায়।
এইভাবে নীরবে অত্যাচার সহ্য করে বড় হয়ে উঠতে থাকে আলো।বাবা কে জানাবার উপায় ও নেই , কি করে জানাবে সৎমা যে বলেছে ,"- পোড়ামুখী মাকে যেমন খেয়েছিস,বাবা কে যদি এসব কথা বলে দিস , দেখবি ভগবান তোর বাবা কেও তোর কাছ থেকে কেড়ে নেবে ।"
সেই ভয়ে সবকিছুই মুখ বুজে সহ্য করে , কারণ তার আপন বলতে তো শুধুই তার বাবা, আর কেউ ই নেই ।
দেখতে দেখতে আলো মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো। অতো কষ্টের মধ্যেও প্রথম বিভাগে পাশ করে। বিনয় তো খুব খুশি , আজ পর্যন্ত আলোর জন্যে তাকে কোনো মাস্টার দিতে হয়নি । সে নিজেই নিজের পড়া রেডি করত, তবে স্কুলের দিদিমনিরা তাকে খুব স্নেহ করত বলে ওকে গাইড করত।
অথচ সুনয়নার মাস্টার রেখেও প্রতি ক্লাসে এক চান্সে পাশ করতে পারে না। সে নিয়েও শান্তিদের হিংসে কম নয়। প্রথম বিভাগে পাশ করে যেন কাল হলো আলোর। মা মেয়ের অত্যাচার ততোধিক বেড়ে গেল । ওরা এতই সেয়ানা যে বিনয় বাড়ি থাকলে কিন্তু দেখায় যে তারা আলো কে কত ভালোবাসে ।আলো শুধুই নীরবে কাঁদে ও ভগবানের কাছে প্রাথর্না করে - "তুমি আমাকেও তুলে নাও ভগবান , মায়ের কাছে আমায় পাঠিয়ে দাও । এ পৃথিবীতে আমি আর বাঁচতে চাই না।"ওদিকে পাড়া-প্রতিবেশী সব্বাই আলো কে খুব ভালোবাসে , তারা তো চোখের সামনে দেখতে পায়, সৎমা, আর সৎবোন কিভাবে আলো কে অত্যাচার করে । ঠিক মতন খেতেও দেয় না। তাই তারা ভালো কিছু রান্না করলেই আলো কে ডেকে লুকিয়ে খাইয়ে দিত। প্রতিবেশীদের মধ্যে পাশের বাড়ি রানু মাসিই ওকে বেশী ভালোবাসে। এমনকি তার ছেলে সুজয়ও তো নিজের বোনের মতো দেখে ওকে । পাড়ার লোকেরা বিনয় কে আলোর উপর এই অত্যাচারের কথা জানায়। কিন্তু সে যখন আলোকে জিজ্ঞেস করে তখন সে বলে," - এমা এসব তোমায় কে বলেছে ? না না, মা, সুনয়না তো কত ভালোবাসে আমায় । তুমি একদম কানে নিও না ওসব কথা ।" বলে বেমালুম চেপে যায় বাবার কাছে ।
বিনয় ও বিশ্বাস করে মেয়ের কথা ।
এইভাবেই চলতে থাকে দিনের পর দিন।এরপর আলো কলেজে ঢোকে , তাও হতো না,শান্তির তীব্র আপত্তি ছিল , এই প্রথম বিনয় শান্তির বিরুদ্ধে গিয়ে মেয়েকে কলেজে ভর্তি করালো।
হঠাৎ একদিন সুনয়না মায়ের কাপড় ইস্ত্রি করতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলে এবং মাকে বলে -"দ্যাখো দ্যাখো মা কি সাংঘাতিক কান্ড করেছে ওই শয়তানী, তোমার দামী কাপড় পুড়িয়ে ফেলেছে"।
এই শোনা মাত্র শান্তি ছুটে আসে এবং আলো কে চুলের মুঠি ধরে ঘর থেকে টানতে টানতে উঠোনে নিয়ে এসে বেধড়ক মারতে থাকে, সুনয়নার এগিয়ে দেওয়া লাঠি দিয়ে ।
অন্যদিকে সুজয়ের বাল্যবন্ধু আয়ুষ এসেছিল এবং ওরা ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আয়ুষের চোখ চলে যায় আলোর উপরে । এসব দেখে তার মনে খুব দাগ কাটে , সে জানতে চাওয়ায় সুজয় তাকে সব খুলেবলায়,, আয়ুষ বলে -" তোরা এইভাবে চুপ করে দেখিস, মেয়েটা কে রক্ষা করতে পারিস না?" আমরা হলে ওর ওই সৎমা কে এর জন্যে শাস্তি দিতাম ।
সুজয় বলে, আমরা অনেক চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু কোন সুরাহা করতে পারিনি । কি করব বল , আলোই যে বড্ড নরম আর সরল মেয়ে নইলে এইভাবে মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করে ।
সুজয় এও বলে -" জানিনা ভগবান কবে ওকে এই নরক থেকে মূুক্তি দেবে । আমার কি মনে হয় জানিস আয়ুষ, ও একমাত্র বাঁচতে পারবে তখনই , যখন কোন ভালো ছেলে এসে ওকে বিয়ে করবে এবং এই নরক থেকে তবেই ও মুক্তি পাবে।"বলতে বলতে সুজয়ের চোখ জলে চিকচিক করে উঠল ।
সেদিনের ওদের সেই আড্ডাটা ওখানেই থেমে যায় । আয়ুষ বাড়ি ফিরে যায় , সেই দেখার পর থেকে ওর মন বড়ই ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে । ঠিকমতো না খেতে পারছে সে, না পারছে ঘুমাতে , আসলে সে ও যে বড়ই নরম মনের ছেলে । অন্যের দুঃখ কিছুতেই সহ্য করতে পারে না।
সেই ক্লাস নাইন থেকে সুজয়ের সাথে ওর বন্ধুত্ব, এখন তো একই অফিসে কাজ ও করে। কি অদ্ভুত ব্যাপার, সুজয় কতবার এসেছে ওর বাড়িতে , ও গেছে ঠিক্ ,তবে কিছুক্ষণের জন্যে ।কিন্তু এইরকম অবস্হার মুখোমুখি কখনও হয়নি ।
আয়ুষ বাবা - মায়ের একমাত্র ছেলে । দোতলা বাড়ি , একটা গাড়ি আছে ,আবার ওর নিজের বাইক ও আছে ।আয়ুষের মাও খুব ভালো, ওরই মতো নরম মনের এবং ছেলে ও মায়ের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের । কদিন ধরেই ছেলের এই অবস্থা তার ও চোখ এড়ায়নি , সে বিচলিত হয়ে পড়ে । ছেলে কে জিজ্ঞেস করে -" কি হয়েছে তোর "? সে কি কোনো মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছে , যা তাকে খুলে বলতে পারছে না।
শুনে আয়ুষ বলে -" আমি যদি কাউকে ভালোবাসতাম তাহলে তুমি জানবে না, তা কখনও হয়?" আসলে তা নয় মা, আমি নিজের চোখের সামনে একটা মেয়েকে তার সৎমায়ের হাতে অত্যাচারিত হতে দেখে আসার পর থেকে আমার মন বড়ই ব্যাকুল , বলেই সে মা কে দেখা সব ঘটনা বিস্তারিত খুলে বলে এবং জিজ্ঞাসা করে -" আচ্ছা মা আমরা কি ওই মেয়েটাকে কোনভাবে বাঁচাতে পারি না"?
মা কিছুক্ষণ ভাবার পর শুধু সুজয়ের সাথে দেখা করতে চায় ।
এরপর সুজয়কে নিয়ে আসে একদিন মায়ের কাছে । আয়ুষের মা জয়া দেবী সুজয়ের মুখে আলোর পুরো ঘটনা শোনে এবং তার ও মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
জয়াদেবী ছেলে কে বলেন -"আয়ুষ একমাত্র তুমিই পারো ওই আলো কে বাঁচাতে "।আয়ুষ একটু হতভম্ব হয়ে পড়ে , বলে "তা কি করে সম্ভব মা! আমি কি করে আলো কে বাঁচাবো?"
জয়াদেবী বলেন - "হ্যাঁ তুমিই যদি ওকে বিয়ে করো, তবেই ওকে আমরা বাঁচাতে পারবো। এখন তুমি চিন্তা করো, ভেবে দেখো ওই অভাগী মেয়েটাকে কি পারবে বিয়ে করতে ?"
আয়ুষ কিছুই বলতে পারে না ওই মুহূর্তে , সে দু - তিনদিন সময় চেয়ে নেয় মায়ের কাছে ।অবশেষে তিনদিন পর আয়ুষ তার মাকে জানায় হ্যাঁ, সে আলো কে বিয়ে করবে এবং মা যেন যত শীঘ্রই পারে তত শীঘ্রই এই বিয়ের ব্যবস্থা করে ।
এই বিয়েতে আয়ুষের বাবার ও অমত নেই , কারণ উনি জানেন জয়া যেটা করেন তা ভেবেচিন্তে করেন, নিজের বউয়ের উপর তাঁর অগাধ বিশ্বাস ।
যথারীতি জয়াদেবী সুজয় কে ডেকে পাঠিয়ে আলোর বাড়িতে ওর বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় । কিন্তু শান্তি জানতে পেরেই সুনয়নাকে গছাবার চেষ্টা করে। বলে," না না ,আলোর এখন বিয়ে হবে না।"(চলবে)