Mousumi Chatterjee

Romance Others

2  

Mousumi Chatterjee

Romance Others

আবার আসব ফিরে-১

আবার আসব ফিরে-১

7 mins
9.9K


ছোট্ট থেকেই জুঁই সব জিনিসেই পারদর্শী । এ এক অদ্ভুত ব্যাপার , মনে হবে কেউ যেন ওকে শিখিয়ে দিয়েছে।কিন্তু না,সেই পাঁচ-ছয় বছর বয়স থেকেই এত সুন্দর গান গাইতে পারে , তেমনি পড়াশোনায়, আকাঁতেও পারদর্শী । আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার সেটা হচ্ছে ও নয়-দশ বছর বয়স থেকেই খুব সুন্দর রান্না করতে পারে । ওর বাড়ীর লোক তো অবাক বিশেষ করে ওর মা সোমাদেবী।

উনি জুঁইকে বলেন,'' - হ্যাঁরে তোকে তো কক্ষনো আমি রান্না শেখাইনি তাহলে, এই এত সুন্দর সুন্দর রান্না তুই কি করে করছিস!''

দুষ্টুমিষ্টি হেসে জুঁই বলে,'' - সেই তো আমি ও তো তাই ভাবছি মা।''

মা , মেয়ের কথা শুনে জুঁইয়ের ঠাকুমা বলে ওঠেন,'' - দেখ বৌমা, আমাদের জুঁই হয়তো আগের জন্মে বড় কোন রাধুঁনী ছিল'' বলেই উনি হাসতে থাকেন ।

জুঁই অমনি গাল ফুলিয়ে বলে,'' ইস মোটেই না।''

এইভাবেই ওদের ছোট সংসার হাসি ঠাট্টায় চলতে থাকে ।

এরপর জুঁইয়ের যখন বছর চোদ্দ তখন ওর ঠাকুমা ওদের ছেড়ে পরলোক গমন করেন । খুব কষ্ট পায় জুঁই কারণ, ঠাকুমার কাছেই ও ঘুমাতো৷তাঁর কাছে গল্প শোনা , যত আব্দার ছিল তাঁর কাছেই ।

এরপর জুঁই মাধ্যমিক দিল,, স্কুলে সবচেয়ে টপ নাম্বার ওর ছিলো। স্কুলের সবারই খুব প্রিয় ছিল ও। এরপর ও মেয়েদেরই কলেজে ভর্তি হলো ক্লাস ইলেভেনে ( এটা আশি শতকের কথা , তখন ইলেভেন থেকেই কলেজে ) ।

প্রথম প্রথম বেশ কিছুদিন আনন্দ করেই কলেজ যাচ্ছিল হঠাৎ কি যে হলো ওর! কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যেতে থাকল। কি যে চিন্তা করে তা কে জানে । এসব দেখে জুঁইয়ের মা, বাবা খুব চিন্তায় পড়ে যায় । ওদের সেই প্রানচঞ্চল মেয়ের যে কি হলো !

যে মেয়ে সারা বাড়ী দাপিয়ে বেড়ায়, এমন কি সারা পাড়াময় করে বেড়ায় ,সেই মেয়ে কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চায়। কি যে ভাবছে সারাটা দিন , জানতে চাইলে মুখে কিছু বলছেও না। অতো সুন্দর চাঁদপানা মেয়েটার মুখে যেন ঘোর অমাবস্যার ছায়া নেবে এসেছে ।

মানস আর মোহিনী খুব ছোট্টবেলাকার বন্ধুত্ব ওদের। একসাথেই বড়ো হয়েছে দুজনে , খুনসুটি থেকে ভালোলাগা, মন্দলাগা, সবকিছুর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত দুজনে। পাশাপাশি পাড়ায় দুজনের বাড়ী । প্রাইমারী স্কুলে পড়াকালীন কখনও মানস, মোহিনীদের বাড়ী আবার কখনও মোহিনী মানসদের বাড়ী গিয়ে সারাটা দিন থাকত।

শিশুশ্রেনী থেকে ক্লাস ফোর পর্যন্ত একই স্কুলে ছিল দুজনে ।এরপর ওরা যে যার মতন ছেলেদের ও মেয়েদের স্কুলে ভর্তি হয়। ওদের দুই পরিবারের মধ্যেও সুন্দর এক আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে । ওরা আলাদা স্কুলে পড়লেও প্রাইভেট টিউশানে যেত একই জায়গায় ।

মোহিনীর মা খুব সুন্দর রান্না করত আর তাই দেখে দেখে ওর ও রান্নার শখ হয়,আর তাই ছুটির দিনগুলোতে প্রায়ই নিত্য নতুন রান্না করত ,নিজেরাও খেত আবার মানসের জন্যেও দিয়ে আসত। তাছাড়া মানস আবার পেটুক ও ছিল যে।

এইভাবে শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবনে পা দিল ওরা। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে আবার একসাথে একই কলেজে ভর্তি হল। একে অপরকে কবে যে গভীর ভাবে ভালোবেসে ফেলেছে তা তারা নিজেরাও বলতে পারবে না।দুজন দুজনকে না দেখে থাকতে পারে না। এই অনুভূতি হয়তো টেরও পেত না, যদি না মোহিনী হঠাৎ কিছুদিনের জন্যে এই প্রথম কলকাতার বাইরে গেল ওর মামাদের সাথে ঘুরতে দিল্লি ।এই প্রথম ওরা বুঝল কতখানি নিবিড় ভালোবাসা ওদের নিজেদের মধ্যে কিন্তু, আজ পর্যন্ত ও কেউ কাউকেই মুখ ফুটে বলেনি আমি তোকে ভালবাসি ।

মোহিনী না থাকাতে দিনগুলো যেন কাটতে চাইছিল না। ওই দশটা দিন ওদের কাছে যেন দশ বছরের সমান হয়ে গিয়েছিল।

এরপর মোহিনী যেদিন ফেরে , সেদিনই বাড়ীতে ফিরে মা, বাবার সাথে দেখা করেই ছোটে মানসের সাথে দেখা করতে ওদের বাড়ী ।

কিন্তু গিয়ে দেখে মানস বাড়ী ছিল না, তাই ও ওর মা, ঠাকুমা ওদের সাথেই দেখা করে ৷ বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে , তাদের জন্যে আনা উপহারগুলো দিয়ে বাড়ী ফিরে আসে । তবে মনটা বেশ ভারাক্রান্ত নিয়েই ফেরে , সেটা মানসের মায়ের চোখে এড়ায়না। উনি মুখে শুধু বললেন,'' - অতো দুর থেকে ফিরেছিস যা গিয়ে বিশ্রাম কর একটু ,মুখটা খুব শুকিয়ে গেছে, সে এসে শুনলেই দেখবি তোর সাথে দেখা করতে ছুটবে।

তারপরে বিকেলে মোহিনী ঘুম থেকে উঠে ছাদে ঘুরছে ৷এই ছাদটা ওর খুব প্রিয় ,এই খোলা আকাশের নিচে মনের কথা যেন উজাড় করে বলা যায় । এই ছাদ, এই খোলা আকাশ ওর সুখ-দুঃখের সাথী।

এমন সময়ে তখনই মানস এসে হাজির । ওকে দেখেই মোহিনী অভিমান করে বলে,'' - কিরে কোথায় ছিলি সারাদিন?এতক্ষণে তোর আসার সময় হল বুঝি !অতদুর থেকে এসেছি আমি তাও বিশ্রাম না করেই তোর কাছে ছুটে গেলাম। কিন্তু তুই বাড়ী ছিলিস না। তা কোন রাজকার্য করতে গিয়েছিলিস শুনি একবার।'' (কোমরে হাত দিয়ে ঝগড়া করছিল )

মানস এসব দেখে বেশ মজা নিচ্ছিল, এই মান-অভিমানটাই তো ও খুব মিস করছিল ।

মোহিনী সেই দেখে রেগে বলে ওঠে ''আমি তখন থেকে একাই বকে যাচ্ছি আর তুই মিচকে মিচকে হেসে যাচ্ছিস। আমার কিন্তু খুব রাগ বেড়ে যাচ্ছে ।''

মানস বলে,'' -আচ্ছা বাবা আচ্ছা, আর হাসবো না,দয়া করে মাথা ঠান্ডা কর। আর দেখ তুই যে আমায় ফেলে এই দশটা দিন কেমন ঘুরে এলি তার বেলা । আর এসেই আমাকে দেখতে না পেয়ে এত্তো রাগ! ভাব তাহলে, আমার এই দিনগুলো কেমন কেটেছে ।'' বলেই ওর মাথাটা ধরে আলতো করে নেড়ে দেয় ।

অভিমানে মোহিনী মানসের বুকে দুমদুম করে মারতে থাকে , আর বলে,'' - বারে আমি কি যেতে চেয়েছিলাম বল, মামারাই তো জোর করে ঘুরতে নিয়ে গেল।''

মানস অমনি বলে ওঠে,'' - ভাগ্যিস নিয়ে গিয়েছিল , না হলে কি আমরা বুঝতাম বল?''

''কি?'' বলে ওঠে মোহিনী।

''এই যে এই পেত্নীটা আমায় কতটা ভালবাসে,'' বলেই ওর গাল দুটো টিপে আদর করে দেয় ।

''ও আচ্ছা তাই বুঝি , শুধু এই পেত্নীটাই তোকে একা ভালবাসে বুঝি !আর এই ভুতটা ভালবাসে না তাহলে বল,''বলেই মোহিনী মানসের নাকটা জোরে টিপে দেয় ।

তারপর দুজনেই হেসে ওঠে ।

হঠাৎ মোহিনীকে চমকে দিয়ে মানস নতজানু হয়ে বলে,'' - তা এই ভুতটাকে কি তুই বিয়ে করবি?''

''তোকে ছাড়া আমি একমূহুর্তও থাকতে পারব না রে।''

''আজ তুই আমায় কথা দে , আর কোনদিন ও আমাকে ফেলে রেখে কোথাও যাবি না। তুই যে কবে আমার এত কাছে এসে গেছিস আগে তা কখনও বুঝিনি রে।''

শুনে খুশি তে মোহিনীর চোখে জল এসে যায় - সব অভিমান নিমেষে উধাও হয়ে যায় ।

মানসের হাত দুটো তুলে ধরে বলে,'' - সত্যিই রে আমরা কি বোকা বল। সেই ছোট্টবেলাকার বন্ধু অথচ আমাদের নিজেদের মনের কথাটা জানতে এত বছর লেগে গেল । আজ আমি কথা দিলাম ,আমি শুধু তোর হয়েই থাকব, কখনও তোকে ফেলে যাব না রে। আর যদিও যাই, দেখবি আবার আমি তোর কাছেই ফিরে আসব।''

সঙ্গে সঙ্গে মানস ওর মুখে হাত দিয়ে বলে,'' - আজ এই শুভদিনে এমন কথা বলিস না, শুধু আজ কেন ,কোনদিন বলিস না রে, আমি তোকে কোথাও যেতে দেব না দেখিস। এইভাবে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকব'' বলেই সে মোহিনী কে জড়িয়ে ধরে ।

মোহিনীও আজ নিজেকে সঁপে দেয় তার ছোট্টবেলাকার সাথীর কাছে।

এরপর মানস মোহিনীর উষ্ণ ঠোঁট দুটিতে গভীর এক চুম্বন এঁকে দেয়। মোহিনীর ঠোঁট দুটি থরথর করে কাঁপছিল। ও চোখ দুটো লজ্জায় বন্ধ করে নেয়,বাধা দেওয়ার ক্ষমতা ও নেই। আজ সে তার ভালোবাসার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছে ।

এইভাবে যে কতক্ষন ছিল তা ওরা জানে না, হঠাৎ নিচে মায়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরে আসে দুজনের । লজ্জায় মানসের চোখের দিকে যেন তাকাতে পারে না, ছুট্টে নিচে নেমে যায় সে।

এরপর ওদের প্রেম গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে । এরপর ওরা দুজনেই পড়া শেষ করে । তারপর মানস তার বাবার ব্যবসায়ে হাত দেয় ।

ওদের এই মেলামেশা দেখে বাড়ীর লোক ও বুঝতে পারে যে এবারে চার হাত এক করে দেওয়ার সময় এসেছে । তাই দেরী না করে মানসের মা একদিন মোহিনীদের বাড়ী যায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ।

মোহিনীর মায়েরাও তো ভালোই জানে যে এদের আলাদা করবে কার সাধ্যি, দুজন দুজনের জন্যেই জন্মেছে । ''ওদের সেই ছোটবেলাকার ভালবাসা দিদি ,বড়ই পবিত্র ভালোবাসা , আজকালকার দিনে এমন ভালোবাসা কজনা পায় বলো তো'' বলেন মোহিনীর মা।

''তাই তো ছুটে এলাম তোমাদের কাছে , যত শীঘ্র পারো, তত শীঘ্রই ওদের এই চার হাত এক করে দি এসো আমরা'' বলেন মানসের মা।

যথাক্রমে পুরোহিত ডেকে বিয়ের দিন ঠিক হয়, আর পনেরো দিন পরে । হাতে খুবই অল্প সময় , তাই দুই বাড়ীর থেকেই বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় ।

মোহিনী যেহেতু বাড়ীর একটিই মেয়ে , সেহেতু ওর বাড়ীর লোক বিয়েতে কোন ত্রুটিই রাখতে চায়না। মেয়েকে একেবারে সোনায় মুড়ে দিতে চায় । তাছাড়া যেহেতু মানসের বাড়ী থেকে বলেই দিয়েছে যখন তাদের কিছুই লাগবে না, তাদের সব আছে । তাই মেয়ে -জামাই কে যতটা সাজিয়ে দেওয়া যায় ততটাই দেওয়ার আপ্রান চেষ্টা করছে ওর বাবা ,মা।

এরপর ঠিক বিয়ের দিন পাঁচেক আগে দুবাড়ী থেকে বলে ''- এখন এই কদিন আর দুজনে দেখা করিস না, এক্কেবারে বিয়ের পিঁড়ি তে। এতে ভালবাসা আরও বাড়বে বুঝলি ।''

মাথা নেড়ে দুজনেই সায় দেয় বাড়ীতে, কিন্তু ভবি ভোলার নয়, মানস পরিষ্কার বলেই দিয়েছে -''শোন, খবরদার বাড়ীর কথা শুনে দেখা বন্ধ করবি না। আমরা মিনিট কুড়ি হলেও দেখা করব রোজ বুঝলি , জানিসই তো তোকে একদিন না দেখলে আমার দিনটাই ভাল যায় না।''

তাই তারা লুকিয়ে ওদের সেই ঝিলের ধারে প্রিয় কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় দেখা করত আর বিয়ের পর কোথায় ঘুরতে যাবে ,কি কি করবে , তার স্বপ্নের রঙিন জাল বুনতো।

কথায় বলে সবার কপালে সুখ চিরস্হায়ী হয়না । ওদের ও তাই হল, কার যে নজর লাগল , উপরে ভগবান ও মনে হয় ওদের এই ভালবাসা দেখে চরম পরীক্ষা নিলেন , নইলে এমনটা হত না।

বিয়ের ঠিক তিনদিন আগেই মোহিনী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় আর সব স্বপ্ন কে চোখের নিমেষে শেষ করে দিয়ে মানসকে একা রেখে চিরতরে চলে যায় মোহিনী।

তবে যাবার সময়ে বারংবার একটা কথাই জড়ানো গলায় মানসের হাত ধরে বলে যায়, ''-আমি আবার আসব ফিরে তোর কাছে , তুই আমার জন্যে বসে থাকিস।'' বলেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।(চলবে)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance