আবার আসব ফিরে-২
আবার আসব ফিরে-২
সেই দেখে মানসকে ধরে রাখা যায় না।
দুটো বাড়ীতে যেন কালো মেঘের ঘনঘটা নেমে আসে । বজ্রাঘাত পড়লে ও মনে হয় মানুষের এতটা করুন অবস্হা হয়না । দিশেহারা হয়ে যায় সকলে । সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয় মানসের।
মোহিনীর সমস্ত কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর মানস নিজেকে ঘরে বন্দি করে রাখল। তার মা তো ছেলের জন্যে পাগলের মতো অবস্হা।মন্দির , মসজিদ , কোনও জায়গা বাকী রাখেনি ঘুরতে, শুধুমাত্র ছেলেটা যাতে ভালো হয়ে যায় ।
কিন্তু সবই বৃথা ।এই শোক সামলাতে না পেরে মানসের বাবা বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন , হাঁটা-চলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললেন , ব্যবসার সব দায়িত্ব গিয়ে পড়ল ওর বড়দার ঘাড়ে ।
ওদিকে মোহিনীর মা ও অসুস্থ হয়ে পড়লেন , ওর বাবা যেন বড় বেশী ভগবানের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লেন দিনের বেশীর ভাগ সময়ই ওই ঠাকুর নিয়ে পড়ে থাকেন ।
হঠাৎ বছর খানেক পর ঘর থেকে মানস বেরোল ঠিকই কিন্তু, সেই সুপুরুষ মানস আর রইল না।
একগাল দাড়ি , মুখে চোখে কালির ছোপ । সবাইকে চিনতে পারে কিন্তু, ওর স্মৃতি থেকে মোহিনীর মৃত্যুটা মুছে গেছে । ওর কাছে মোহিনী এখনও জীবিত ৷ও ভাবে মোহিনী কোথাও ঘুরতে গেছে ,চলে আসবে । তাই সে সারাদিন মোহিনীর ছবির সাথেই কথা বলে চলে । যেখানে যেখানে মোহিনীকে নিয়ে ঘুরতো সেখানে সেখানে সে ঘুরে বেড়ায় আপন মনে । আর একে তাকে ডেকে ডেকে জিজ্ঞেস করে,'' তোমরা আমার মোহিনীকে দেখেছ গো?''
ওদিকে জুঁই কোন এক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়েই দিন কাটাতে লাগল । সেই আগের মতন আর নেই। ও আছে কিন্তু, ওর মনটা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে । মাঝে মধ্যেই ওর কলকাতায় খুব যেতে ইচ্ছে করে । ওর মনে হয়,ওই শহরটা ওর খুবই চেনা , অথচ অবাক কান্ড ওদের আত্মীয় -স্বজন বা বন্ধু -বান্ধব কেউই থাকে না সেখানে ।
মাঝে - মধ্যে সেটা বাবাকে বলেও ফেলে যে, 'আমায় কলকাতায় নিয়ে যাবে গো'। বাবা বলেন,'' ওখানে গিয়ে কি হবে রে, আমাদের তো কেউ থাকে ও না ওখানে ।''
''তা জানি না বাবা, শুধু কেন জানি না আমার চোখের সামনে যেন ভাসছে কলকাতা শহর টা।''
এই দোলাচল মন নিয়ে জুঁই দেখতে দেখতে আঠারো বছরে পা দিল।
ওর মা, বাবা ওকে না জানিয়ে ওর খুব কাছের চার -পাঁচজন বান্ধবী দের নিমন্ত্রণ করেন, ভাবেন ওই দেখেও যদি মেয়ে টা একটু খুশি হয়।
যাই হোক অনেকদিন পর মেয়ের মুখে তারা আজ হাসি দেখতে পেলেন ।
যাইহোক বান্ধবীরা সবাই যে যার চলে গেল , ওনারাও খেয়ে -দেয়ে শুয়ে পড়লেন । বড় হলে কি হবে, জুঁই ওর মায়ের সাথেই শোয়।
হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় জুঁইয়ের,ধড়ফড় করে উঠে বসে । মা ও টের পেয়ে উঠে দেখে মেয়ে কেমন যেন করছে , ঘেমে- নেয়ে একাকার অবস্থা ।
মেয়ের এই কান্ড দেখে বলেন,''- কি রে কোন দুঃস্বপ্ন দেখেছিস? এমন করছিস কেন জুঁই? দাঁড়া আগে একটু জল খা ।''
জুঁই মায়ের হাত দুটো ধরে বলে,'' - মা , মা গো আমায় কাল তোমরা কলকাতায় নিয়ে যাবে একটু ।''
শুনে মা অবাক হয়ে বলেন,'' - কেন রে কালই কেন ? বাবা তো তোকে বলেছে পরে নিয়ে যাবে একদিন ।''
''মা আমার যে আজ সব মনে পড়ে গেছে ।''
''ওখানে যে আমার মা, বাবা এখনও আমার জন্যে কাঁদে , মানস ও যে আমার জন্যে পথ চেয়ে বসে আছে ।''
''কিসব বলছিস তুই জুঁই!''
''তুই কি পাগল হয়ে গেলি মা? তোর মা, বাবা তো আমরা । তাহলে কলকাতায় কি করে মা, বাবা থাকতে পারে ! আর তাছাড়া মানস , সেই বা কে?''
জুঁইয়ের মা ছুটে যায় জুঁইয়ের বাবাকে ডেকে আনতে - বলে,'' হ্যাঁগো দেখো জুঁই কিসব বলছে?''
''কি বলছে?'' মা সব খুলে বলেন ।
সব শোনার পর আতঁকে ওঠেন উনি - বলেন,'' সে কি কথা !''
''হ্যাঁগো আর বলছি কেন তোমায় । ওগো ও মেয়ে নয় পাগল হয়ে গেছে, নয়তো ওকে নির্ঘাত ভুতে ধরেছে । তুমি ওকে কালই ওঝা নয়তো ডাক্তারের কাছে নিয়ে চল।''
''আচ্ছা ঠিক আছে দাঁড়াও তুমি অত উতলা হয়োনা। আমি নিজে ওর সাথে একবার কথা বলে দেখি ।''
বলে ওর বাবা মেয়ের কাছে যান ও মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,'' - কি হয়েছে মা, আমায় খুলে বল একবার ।''
বাবাকে দেখামাত্রই আহ্লাদী জুঁই বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল ,আর বলতে লাগল 'আমাকে একবারটি নিয়ে যাবে বাবা কলকাতায়? ওরা যে আমার জন্যে কেঁদে কেঁদে মরছে। আমি একবার ওদের কাছে যেতে চাই ।''
সব শুনে ওর বাবা বলল,''- এখন তো মাঝরাত তুই ঘুমিয়ে পড় লক্ষ্মী মা আমার , এই দেখ আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি । কাল সকালটা হতে দে'',বলে মেয়েকে কোনরকমে শান্ত করে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করেন , একসময় জুঁই ঘুমিয়ে ও পড়ে ।
এবারে ওর মা বলে,'' হ্যাঁগো , শুনলে তো মেয়ের মুখে , কি করবে তাহলে ?''
''আমি কাল সকালে গিয়েই একজন ওঝাকে ডেকে আনি।''
''না,না আগে আমি ওকে একজন মানসিক ডাক্তার দেখাই তারপর না হয় ওঝা ডাকবে। কাল সকাল টা হতে দাও । ও তো ঘুমিয়ে পড়েছে , এবারে আমরাও একটু ঘুমিয়ে নিই।'' বলে উনিও শুতে চলে গেলেন ।
কিন্তু মা, বাবার চোখের ঘুমটাই যেন কোথায় হারিয়ে গেল । তারা ভাবতে লাগল তাদের নয়নের মনি জুঁইয়ের একি হল!!
যথারীতি পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতেই জুইঁয়ের সেই একই বায়না , ''আমায় তোমরা কলকাতায় কখন নিয়ে যাবে ?''
''আরে নিয়ে যাব তো, দাঁড়া আগে অফিসে বলে ছুটি নিই। না হলে তোকে নিয়ে যাব কি করে মা? আচ্ছা তাছাড়া কলকাতা তো কত বড়ো শহর , তোকে তো আমরা কোনদিন ও কলকাতায় নিয়ে যাই নি, তাহলে চিনবি কি করে ?''
জুঁই বলে,'' - এখান থেকে ট্রেনে করে হাওড়া যাব প্রথমে, তারপর ওখান থেকে গড়িয়াগামী কোনও বাসে উঠে সোজা বৈষ্ণবঘাটায় গিয়ে নামব আমরা । আর যেখানেই আমাদের নামতে হবে , সেই রাস্তা ধরে সোজা পাঁচ মিনিট হেঁটে গেলেই আম
াদের বাড়ী । আমার আগের জন্মের বাবার নাম মৃনাল মুখার্জী, মায়ের নাম নন্দা মুখার্জী, আর আমার নাম ছিল মোহিনী মুখার্জী। আমাদের একতলা সাদা রঙের বাড়ী । বাবার খুব প্রিয় রঙ সাদা তাই কখনও পাল্টাতো না বাড়ীর রঙ। বাড়ীর পাশেই ছিল এক চিলতে বাগান । আমাদের পাড়াটা ফেলে আরও এগিয়ে গিয়ে ঠিক পরের পাড়াতেই থাকত মানসরা। ও ছিল আমার ছোট্টবেলাকার বন্ধু । ওর সাথেই আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল কিন্তু কপালের ফের খারাপ হলে যা হয়। বিয়ের ঠিক তিনদিন আগেই আমার মৃত্যু হয়। তখন ডেঙ্গুর এত ভালো চিকিৎসা ছিল না। তাই আমায় অকালেই চলে যেতে হয়েছিল । জানো বাবা , আমি ওকে তখন কথা দিয়েছিলাম ,তোর কাছে আমি আবার ফিরে আসব। তাই হয়তো বাবা আমি শুধুমাত্র ওই মানসের জন্যেই আবার ফিরে আসতে পেরেছি ভগবানের পরম আশির্বাদে।''
এতক্ষণ ধরে জুঁইয়ের মা,বাবা মেয়ের সব কথাই স্তম্ভিত হয়ে শুনছিলেন। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। এ কি সম্ভব! ওনারা পুনর্জন্ম নিয়ে শুনেছেন ঠিকই কিন্তু তাদেরই ঘরে হবে ভাবতে পারছেন না। একবার ভাবছেন জুঁই কোন কল্পনা করে এসব মনগড়া কথা বলছে না তো।
জুঁইয়ের ডাকে দুজনে সম্বিৎ ফিরে পান-'' কি হলো ও বাবা , ও মা, তোমরা কি অত ভাবছ?''
ওর মা বলে ওঠে,'' না না, কই কিছু না তো, তুই কলেজ যাবি না? বেলা হতে চলল রেডি হয়ে নে।''
জুঁইয়ের বাবা বললেন,'' - না না ওকে আজ আর কলেজে যেতে হবে না, ও বাড়ীতেই বিশ্রাম করুক । বলে উনি এরপর অফিসে চলে যান এবং বিকেল বিকেল বাড়ী চলে আসেন ও ওনারা জুঁইকে একজন মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।
ডাক্তারবাবু জুঁইয়ের সব কথা শুনে বললেন,'' - হ্যাঁ আপনাদের মেয়ে যা বলেছেন তা সবই সত্যি । ও জাতিস্মর, আপনারা ও যেখানে যেতে চাইছে নিয়ে যান।''
শুনেই ওর মা কেঁদে উঠে বলে,'' - ডাক্তারবাবু তা কি করে হয়, এই যে আমরা ওকে এত বড় করলাম , ও ছাড়া যে আমাদের আর কেউই নেই , ও যদি ওনাদের পেয়ে আমাদের ভুলে যায় ।''
ডাক্তারবাবু বলে ওঠেন,'' - আকাশের সব মেঘই কি ঘন কালো হয়? অত চিন্তা করবেন না, বরং ওকে যদি আপনারা না নিয়ে যান, বাড়ীতে আটকে রাখেন , তাহলে দেখবেন ও একদিন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে । সেটা নিশ্চয়ই আপনারা কখনোই চাইবেন না আশাকরি।''
শুনে দুজনেই বলে ওঠেন একত্রে -'' না না, তা কি কেউ চায় । আর তাছাড়া সব বাবা , মা সন্তানের মঙ্গলই চায় ।আমরা তাহলে আসি।আপনার কথানুযায়ী আমরা কালই ওকে কলকাতায় নিয়ে যাব।''
ডাক্তারবাবু বলেন,'' অবশ্যই, তবে ও বর্তমানে কোথায় থাকে , কোথায় পড়াশোনা করে সবকিছুরই একটা প্রমানপ্রত্র আপনারা নিয়ে রাখবেন, এমনকি আমাকে যে আজ দেখালেন প্রেসক্রিপশনটাও সঙ্গে রাখবেন । বলা তো যায় না যদি ওদের দেখাতে লাগে ।''
''বেশ ডাক্তারবাবু , অনেক ধন্যবাদ আপনাকে'' বলেই ওরা জুঁইকে নিয়ে বাড়ী ফিরে যায় । ফেরার পর জুঁই খুব উতলা হয়ে পড়ে। বারংবার ওদের কাছে জানতে চায় , ''কলকাতায় কখন যাব তাহলে আমরা ।''
ওর বাবা বলেন ,''হ্যাঁ যাব তো, কাল সকাল সকাল স্নান করে কিছু খেয়েই আমরা বেরিয়ে যাব। তুই বরং আজ আর বেশি দেরী করিস না , খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড় মা।''
জুঁইকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। কিন্তু মা, বাবার চোখে ঘুম আসেনা । অজানা এক চিন্তায় , কি হবে কাল , সত্যিই কি খুঁজে বার করতে পারবে ,জুঁই আগের জন্মের ঠিকানা ?
তারাও কি জুঁইকে বিশ্বাস করবে যে সেই তাদের আগের জন্মের মেয়ে মোহিনী। আর মানস, সে কি সত্যিই কখনও বসে থাকে এই আঠারোটা বছর !'বলো দেখি , মেয়ের কি পাগলামি।'
''হ্যাঁগো , কিছু বলছ না কেন ? যদি গিয়ে দেখে ও মানস বিয়ে -থা করে দিব্যি সংসার করছে , তাহলে আমাদের জুঁইয়ের কি হবে ? পারব ওকে সামলাতে আমরা ?''
এসব শুনে জুঁইয়ের বাবা বলে ওঠেন,'' - আঃ, তুমি এত বিচলিত হচ্ছো কেন ? চিন্তা আমার ও হচ্ছে কিন্তু কিছুই তো আমাদের করার নেই , ওই ওপরওয়ালার হাতেই ছেড়ে দাও । এ জগতে সবই তো হচ্ছে তার লীলা খেলা , হয়তো উনি ওদের ভালোবাসার পরীক্ষা নিচ্ছেন । শুধু এটুকু বিশ্বাস আছে তার প্রতি, তিনি যা করেন মঙ্গলের জন্যেই করেন।''
''যাও অনেক রাত হল একটু চোখ বুজে নাও। কাল কিছু মুখে দিয়েই তো আবার যেতে হবে আমাদের ।'' ওনারা ও শুয়ে পড়লেন।
পরেরদিন সকাল হতেই মা,বাবা ওঠার আগেই জুঁই উঠে পড়ে এবং স্নান করে সুন্দর হলুদ রঙের একটা চুড়িদার পড়ে নেয় , এই রঙটা যে খুব প্রিয় ওর মানসের। তারপরে রান্নাঘরে ঢুকে নিজের হাতে মানসের জন্যে পায়েস রান্না করে। ও যে পায়েস খেতে খুব ভালবাসে, আগে কতবার পায়েস রান্না করে খাইয়েছিল মানসকে।
জুঁইয়ের মা রান্নাঘরে ঢুকে মেয়েকে দেখে চমকে ওঠে , 'একি পাগলামী করছে জুঁই !''
মাকে দেখেই জুঁই বলে ওঠে,'' - দেখো মা , আমি ওর জন্যে পায়েস বানালাম। আজ গিয়ে আমি নিজের হাতে ওকে খাওয়াবো, দেখো ও কি খুশি হবে ।''
''আর যদি দেখিস মানস বিয়ে করে সুখে সংসার করছে , তখন তুই কি করবি মা?''
''ধুর্, তা হতেই পারে না, তুমি জানো না তাই বলছ। ও যে আমাকে ওর প্রাণের চেয়েও বেশী ভালবাসত। আমি যে ওকে কথা দিয়েছিলাম - ওর কাছে আবার ফিরে আসব। আমি ঠিক জানি, ও এখনও আমার জন্যে পথ চেয়ে বসে আছে । দোহাই মা তুমি কোনো অলুক্ষনে কথা মুখে এনো না।''
শুনে মা চুপ করে গেলেন , আর কিছুই বললেন না।
এরপর ওরা হাওড়ায় পৌঁছায় ,ওখান থেকে বৈষ্ণবঘাটা মিনিবাসে ওঠে,রাস্তাঘাট সবই জুঁইয়ের চেনা , অবাক হয়ে দেখছিল ওরা মেয়েকে । বাসে যেতে যেতে ওর সব চেনা জায়গা গুলো ওদের দেখাচ্ছিল জানলা দিয়ে ।এরপর যখন বৈষ্ণবঘাটায় পৌঁছায় ওরা , তখন তো জুঁইয়ের খুশিতে চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে । ওদের নিয়ে সোজা আগের বাড়িতে ওঠে।(চলবে)