STORYMIRROR

শংকর হালদার শৈলবালা

Inspirational Others

5  

শংকর হালদার শৈলবালা

Inspirational Others

।। আদিবাসী বিদ্রোহী নারী।।

।। আদিবাসী বিদ্রোহী নারী।।

23 mins
768

।। আদিবাসী বিদ্রোহী নারী।। গল্প।

লেখক :- শংকর হালদার শৈলবালা।


     ।। আদিবাসী বিদ্রোহী নারী।।


 ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি বৃহৎ জেলা ছিল মেদিনীপুর।

পরবর্তী কালে জেলাটিকে ভেঙ্গে পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম, এই তিনটি জেলায় ভাগ করা হয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলার বেশকিছু অঞ্চল বর্তমানে ‘জঙ্গলমহল’ নামে পরিচিত। এখানে, বিশেষ করে জঙ্গলমহল এলাকায় বিভিন্ন ধরণের জাতি-উপজাতি বাস করে।তারা নানা ধরণের রীতি-নিয়ম,প্রথা ও ব্রততে বিশ্বাসী। ঝাড়গ্রাম জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যে শাল মহুল,আম,জাম,শিমূল ইত্যাদি গাছের সবুজ জঙ্গল রয়েছে, তার ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে রয়েছে আদিবাসীদের ছোট ছোট গ্রাম। এইসমস্ত গ্রামের সাঁওতাল, শবর, লোধা, মুণ্ডা ইত্যাদি জনজাতি আদিম যুগ থেকে একটা সময় পর্যন্ত জীবনধারণের জন্য সম্পূর্ণভাবে জঙ্গলের ওপর নির্ভরশীল ছিল। জঙ্গলের ফল-মুল, শাক-পাতা খেয়ে,পশুপাখি শিকার করে, জঙ্গলের কাঠ ও বনজ উপকরণ দিয়ে ঘর-গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় নানান জিনিস বানিয়ে বিক্রি করে দিব্যি দিন কাটাত। সারাদিন খাটুনির পর সন্ধ্যাবেলা মহুল-সিমুলের তলায় বসে হাঁড়িয়া খেত আর মাতাল হয়ে মেয়ে-মরদ একে অপরের কোমর জড়িয়ে নাচত গাইত।     


ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের পাতায় সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সান্তাল হুল অতিপরিচিত এই ঘটনা। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ও নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে একজোট হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল পুরুলিয়ার আদিবাসী জনগোষ্ঠী- সাঁওতাল। সিধু, কানু, চান্দ ও ভৈরবের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এক বছরের মাথায় বিদ্রোহ স্তিমিত হয় বটে। কিন্তু গোটা ভারতের মোহনিদ্রা ভেঙে দিয়ে গেল। জন্ম নেয় অধিকার সচেতনতা। তার দলিল ঠিক পরের বছর থেকেই এই মাটিতে একের পর এক বিদ্রোহ।


পুরনো ইতিহাস থেকে জানা যায়, উত্তর ভারত থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের ইস্টার আইল্যান্ড অব্দি বিস্তৃত ছিল অস্ট্রিক ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ। আনুমানিক ত্রিশ হাজার বছর আগেই তারা ভারত থেকে অস্ট্রেলিয়া যায়। সেই অস্ট্রিক গোষ্ঠীরই উত্তরাধিকারী বর্তমানের সাঁওতাল উপজাতি। সাঁওত বা সামন্তভূমিতে বাস করার কারণে সাঁওতাল নামে পরিচিত হয়।


পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার আদিবাসী জনগোষ্ঠী এলাকার জামবনির গ্রামের কুঁইরি পাড়ার শিবু কুঁইরির মেয়ে সাঁঝলি শীতের সকালে উঠানে বসে ঝলমলে মিষ্টি মিষ্টি রৌদ্রের তাপে পিঠ দিয়ে দুলে দুলে ক্লাস সেভেনের পাঠ্য বই থেকে সামন্ত রাজার ইতিহাস পড়ে মুখস্ত করতে বাস্ত।


কিশোরী সাঁঝলি কিছু সময় পড়াশোনা করার পর ভাবে মনে মনে :- 'মা, বাবুপাড়ার দে বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। কাজের বিনিময়ে ফেলে দেওয়া বাসি পান্তা খাদ্য ও মাসের শেষে কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দেয়। যে টাকা দেয় তা দিয়ে নুন আনতে পান্তা ভাত খাওয়া হয় না। ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হয়ে মায়ের শরীর টা একদম ভেঙে গিয়েছে। মায়ের শরীরে মাঝে মধ্যেই জ্বর আসে আর জ্বর আসলে মা তালপাতার ঘরের বারান্দায় খেজুরের পাটিতে একা একা চুপচাপ শুয়ে থাকে কিন্তু টাকার অভাবে মায়ের চিকিৎসা হচ্ছে না।এই এলাকার মধ্যে কোন সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই। আছে শুধু রাজনীতির বড় বড় বক্তৃতা আর প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে ভোট আদায় করা। ভোট চলে গেলে আমাদের মত হতদরিদ্র মানুষের কথা কোন রাজনৈতিক নেতাদের মনে থাকেনা।


 আজ মায়ের শরীরে জ্বর এসেছে ভীষণ ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই দাওয়াই শুয়ে আছে। কিন্তু আজ দে বাড়ির কাজে যেতে পারেননি।

বহুবার দে বাড়ির বড় গিন্নি লোক পাঠিয়েছে। মায়ের প্রচন্ড জ্বরে শরীর পুড়ে যায় তবুও বাবুর গিন্নি সে কথা শুনতে চায় না।


আমাদের দিদিমা বুড়ি রৌদ্রের তাপে বসে

ছেঁড়া কম্বল মুড়ি দিয়ে বিড়ি ফুকছিল।


দিদিমা বুড়ি, কিশোরী সাঁঝলি কাছে এসে বই বন্ধ করে দিয়ে বলে :- এখন পড়াশোনা করতে হবে না। যা বোন দে বাড়িতে গিয়ে মায়ের কাজ গুলো করে দিয়ে আয়।


কিশোরী সাঁঝলির অনিচ্ছাসত্বে বাড়ির দিদিমা একপ্রকার জোর করেই দে বাবুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়, মায়ের অনুপস্থিতিতে ঝিয়ের কাজের জন্য।

 

কিশোরী সাঁঝলি দে বাড়িতে গিয়ে পুরানো ফটক ঘেরা বড় উঠান ও উঠানোর চারিদিকে বড় বড় ঘরের ও বড় বড় বারান্দা সব জায়গায় ঝাঁটা দিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার পর বাড়ির উদ্দেশ্যে সবেমাত্র পা বাড়িয়ে দিয়েছে।


ঠিক সেই মুহূর্তে দে বাড়ির গিন্নি বলেন :- সাঁঝলি কোথায় যাচ্ছি? এখনো কাজ শেষ হয়নি।


কিশোরী সাঁঝলি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।


দে গিন্নি এক গাদা এঁটো বাসন নিয়ে এসে সাঁঝলির সামনে রেখে বলে :- এই বাসন গুলো পরিস্কার করার পর ভালো করে ধুয়ে রাখ।


কিশোরী সাঁঝলি প্রতিবাদী কন্ঠ বলে :- আমি আপনাদের এঁটো বাসন ধুয়ে দিতে পারবে না।


দে গিন্নি রাগে উত্তেজিত হয়ে বলেন :- কি বললি তুই? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা,

ছোট জাত হয়ে বড় বড় কথা বলা। তোর মা, তোর দিদিমা, তোর দিদিমার মা ও তোর চৌদ্দগুষ্টি সবাই এই দে বাড়িতে বহু কাল ধরে এঁটো বাসন ধুয়ে ধুয়ে মরে গেলে। এখন তোর মা মরতে চলছে। তাদের মেয়ে হয়ে আমাদের বাড়ির এঁটো বাসন ধুয়ে দিতে পারবে না। আমাদের এঁটো খাবার খেয়ে তোরা বেঁচে থাকিস।


কিশোরী সাঁঝলি বলে :- বললাম তো, আপনাদের এঁটো বাসন ধুয়ে দিতে পারবে না।

আপনারা কাজের লোক দেখে নিন আমি চললাম।

সাঁঝলি নিজেকে অপমানিত বোধ অনুভব করে, রাগে উত্তেজিত হয়ে দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়।


দে বাড়ির লোকজন অপমানিত বোধ করে, কিশোরী সাঁঝলির বাবা শিবু কুইরির কে রাস্তায় পেয়ে লোকজনের মধ্যে অপমান ও বিভিন্ন ভাবে ঝামেলা করতে শুরু করে এবং জাত পাত তুলে গালিগালাজ করতে থাকে।


সন্ধ্যার সময় মাহাতোদের ধান কাটার পর বাড়িতে ফিরে আসে শিবু কুইরি।


শিবুর মা ছেলের কাছে অভিযোগ করে বলেন :- তোর মেয়ে দুই পাতা পুঁথি পড়ে বড় পন্ডিত হয়ে গেছে, ছোট মুখে বড় বড় কথা বলে। আরে আমরা হলাম ছোট জাত বাবুদের সাথে ঝামেলা অশান্তি করে আমরা কি বাঁচতে পারি? কিশোরী সাঁঝলির লেখা পড়ার বিষয় সহ প্রতিবাদী কন্ঠের প্রতিবাদী ভাষার জন্য মা তার ছেলের কাছে মহাভারতের সাতকাহন বলতে শুরু করে।


সাঁঝলির মা হাড়ির মধ্যে ধানের কুড়া দিয়ে আগুন জ্বলে মাঘ মাসের সন্ধ্যায় সময় শীতের থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গা-হাত-পা সেঁক দিয়ে শরীরকে গরম রাখার চেষ্টা করছে।

 

কিশোরী সাঁঝলি ভাবে :- বাবার মাথার ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকুনি দিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বুকে হাত দিয়ে চাপরাছে কারণ বাবুদের কাছে থেকে অপমানিত হয়ে হৃদয়ের মাঝে আগুন জ্বলে উঠেছে। বাবা কখনো উত্তেজিত স্বভাবের মানুষ না কিন্তু আজ ভীষণ ভাবে দুঃখ পেয়েছেন। কিন্তু আমি তো সত্যি কথাই বলেছি কতদিন আর বাবুদের দ্বারস্থ হয়ে থাকতে হবে। আমাদের এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ গুলো কবে বুঝবে লেখাপড়া শেখার প্রয়োজনীয়তা।


শিবু কুইরি কিছু সময় ধরে চোখের জল ফেলে অপমানের দুঃখ জ্বালা ভুলে চোখ মুছতে মুছতে তার প্রতিবাদী মেয়ে কিশোরী সাঁঝলির

কাছে এসে বসে এবং মেয়ে কে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে উচ্চ কন্ঠে বলেন :- সাঁঝলি যা করেছিস ভীষণ ভাবে ভালো করেছিস। আমিও চাই আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষগুলো সবাই প্রতিবাদী হয়ে উঠুক।

শোন তোর মা, তোর মায়ের বংশপরম্পরায় সবাই বাবুদের বাড়িতে বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে আসছে। বাবুদের বাড়ীতে ঝিয়ের কাজ করেছে কিন্তু তাতে হয়েছে কি ? তাতে হয়েছে কি ?

তবে বাবুদের কাছে আমরা ছোট জাত কিন্তু তাই বলে আমাদের কি কোন মান সম্মান থাকতে নেই?


কিশোরী সাঁঝলি বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে :- ঠিকই তো আমাদের কি কোন মান সম্মান নেই। আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নারীদের বাবুরা কোনো মূল্যই দিতে চাই।


বাবা শিবু কুইরি উচ্চ কন্ঠে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন :- মা সাঁঝলি, মনে রাখিস তুই কিন্তু পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করার জন্য জন্ম হয়নি।যত বড় লাট সাহেব হোক না কেন; নিজের অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে কাহারোর কাছে মাথা নত করবে না। 

নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই তোকে লেখাপড়া শিখাচ্ছি , তোর থেকে সবাই শিখতে পারবে।

না হলে আমাদের মতো দিন দরিদ্র মানুষের ঘরে আছে কি ?


সাঁঝলি রাতে ঘরের শত ছিদ্র দিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভাবে :- মেয়েদের কি সমাজের বুকে কোন স্বাধীনতা নেই , না আছে অক্ষর জ্ঞান না আছে মান সম্মান।

ছোট থেকে শুনে আসছি মা, কাকিমা, দিদিমা ও বয়স্কদের মুখে মেয়ে মানেই মাটি। দুই দিন পর পরের ঘরে গিয়ে রান্নাঘরে জায়গা হবে তা লেখাপড়া শিখে কি লাভ হবে। একগাদা সন্তান লালন-পালন করতে করতে আর মাঠে-ঘাটে কাজ করতে করতেই দিন চলে যাবে। স্বামীকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া থাকে কাজ করে সংসার চালাবো। আমাদের জনগোষ্ঠীর সব দায়-দায়িত্ব নাকি মহিলাদের উপর।

গাঁয়ের কয়েকজন বাবুরা বলতো দ্যাখ সাঁঝলি, মন খারাপ করলেই তো তুমি হেরে গেলে এবং বহু দূর পর্যন্ত পিছিয়ে পড়বে। লোকে যে যা বলে বলুক না কিন্তু এক কান দিয়ে শুনবে আর অন্য কান দিয়ে বের করে দেবে। তোমার নির্দিষ্ট লক্ষ্য পথে এগিয়ে চলে।


সাঁঝলির বাবা এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় দীর্ঘ সময় ধরে অসুস্থতার জ্বালা যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে একদিন শরীরের মায়া ত্যাগ করে মৃত্যুর কোলে শুয়ে পড়লেন চিরনিদ্রায়।

মা ও মেয়ে কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়ে। তবুও সাঁঝলি বহু কষ্টের মধ্যে দিয়ে দারিদ্রতার সাথে লড়াই করে লেখাপড়া চালিয়ে একসময় মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পায়।


 মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কয়েক মাস পর হঠাৎ একদিন ভোর বেলায় জামবনি ইস্কুলের হেডমাস্টার সাঁঝলির বাড়িতে এসে ডাকাডাকি করতে শুরু করেন। 

অনেক ডাকাডাকি করার পর সাঁঝলির মা দরজা খুলে মাস্টারমশাই সহ পাড়া প্রতিবেশী লোকজন দেখে হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞাসা করে :- বাবুরা, আমরা কি কোন অন্যায় করে ফেলেছি ?


 মাস্টার মশাই আনন্দিত মনে মাথা নিচু করে কুঁড়ে ঘরে ঢুকে বলেন :- 'মা সাঁঝলি, তুমি আমাদের ইস্কুলের মুখ উজ্জ্বল করেছে কারণ পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফলাফলে তুমি সর্ব প্রথম স্থান অধিকার করেছে।


হেড মাষ্টারের কথা শুনে সাঁঝলি বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে ও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে :- 'মাস্টারমশাই,আমি কি স্বপ্ন দেখছি। আমার মত অভিভাবকহীন আদিবাসী কালো মেয়ে শুধুমাত্র স্কুলের ক্লাসের মাস্টারের কাছে পড়াশোনা করে প্রথম হতে পারে না হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে।


মাস্টার মশাই সাঁঝলির মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন :- 'মা, সত্যই তুমি প্রথম হয়েছে। এই সংবাদ দেওয়ার জন্য ভোরবেলা এসেছি। মা আমি আসছি বলে ঘরের বাইরে এসে চলতে শুরু করেন।


পরীক্ষা পাসের খবর শুনে আনন্দের অশ্রুধারা ঝরতে থাকে মা ও মেয়ের। সকাল বেলায় চাঁদের হাট বসেছে ভাঙ্গা কুঁড়ে ঘরের উঠানের মাঝে। 


সাঁঝলি তার অসুস্থ মাকে জড়িয়ে ধরে বলে :- আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতে ভীষণ খুশি হতো কারণ বাবার উদ্যোগের কারণে লেখাপড়া শিখতে পেরেছি। বলে দুই হাত তুলে কপালে ঠেকিয়ে স্বর্গীয় বাবার উদ্দেশ্যে কয়েক বার প্রণাম করে। 


দিনের আলো উদিত হওয়ার পর দিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথেই সাঁঝলিদের মাটির কুড়ে ঘরের উঠানোর মাঝে গ্রামের প্রতিবেশী সহ, অঞ্চল প্রধান, উপ প্রধান, মেম্বার ও রাজনৈতিক দলের নেতারা হাতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে দলে দলে আসতে শুরু করে।


সাঁঝলির মা এত লোকের আনাগোনা খাবারের প্যাকেট দেখে ভাবে মনে মনে :- কতদিন যে থেকেছি অনাহারে কিন্তু তখন কেউ তো খোঁজ করেনি। মেয়ে ফার্স্ট হয়েছে তাই নেতারা বাড়ির উঠানে এসেছে হয়তো রাজনৈতিক কোনো ফায়দা লোটার জন্য। পড়াশোনার জন্য একটা বই খাতা কেউ দিয়েছে।


সাঁঝলির ছবি তোলার জন্য টিভি চ্যানেলের ও দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকগণ ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে তৎকালীন শাসকদলের এক রাজনৈতিক নেতা বলেন :- তোমাদের মতো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মেয়েরা যদি উঠে আসে, তবেই ভারতবর্ষ উঠে আসবে।


সাঁঝলি ক্যামরার সামনে দাঁড়িয়ে বলে :- কথাটা ভীষণ সত্যি বলেছেন কিন্তু বাস্তবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মেয়েদের উঠে আসার রাস্তা যে এখনো আপনারা তৈরি করে দেননি। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষদের নিজেদের স্বার্থ বজায় রাখার জন্য রাজনৈতিক ভাবে নিচু জাত বানিয়ে রেখেছেন এবং নিচু জাত বলে আমাদেরকে সবসময় অবহেলিত করে নিচের দিকে ফেলে দিয়েছেন। কিন্তু কেন? 

খাড়া পাহাড়ে ওঠা সহজ নয় উঠতে হলে ভীষণ পরিশ্রম করতে হয় শরীর ও মনের জোর আর বিশ্বাস চাই।


একটি দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক বলে :- আপনার জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলুন।

সাঁঝলি ভাবে সেই ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়ের ঘটনা ছাড়া আমার আর কিছু মনে আসে না । সাঁঝলি দে বাড়ির ঘটনা উল্লেখ করে বলতে শুরু করে। ঘটনা শেষ হওয়ার পরে চারিদিকে হাততালি পড়তে থাকে।


টিভি সাংবাদিক ক্যামেরা নিয়ে বলে :- তুমি যে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সর্বপ্রথম হয়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষায় তোমার পড়াশোনার জন্য উদ্যোক্তা সবচাইতে বেশি কে ?


সাঁঝলি বলে :- আমার বাবা আমার পড়াশোনা করার জ্ঞানের আলোর বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে ছিলেন কিন্তু আমার লেখাপড়ার জন্য বাবা কে বাবুদের কাছে বহু অপমানজনক কথা বার্তা শুনতে হয়েছে। 

প্রথম যেদিন দে বাবুদের বাড়িতে ঝিয়ের কাজের এঁটো বাসন ধোয়ার প্রতিবাদ করেছিলাম কিন্তু সেই দিন আমার বাবা মাথায় হাত রেখে বলেছিল :- সাঁঝলি তুই ঠিক করেছিস আর কতকাল বাবুদের এঁটে বাসন ধুয়ে বেড়াবে আমাদের জাতির মানুষেরা, তোকে লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হতে হবে। আজ বাবা বেঁচে থাকলে ভীষণ খুশি হতেন, আমাদের কুড়ে ঘরে অপ্রত্যাশিত সূর্যের আলো দেখে।


যখন আমি প্রথম লেখাপড়া শিখতে চেয়েছিলাম কিন্তু ছোট জাত বলে সমাজের উচ্চ জাত নামধারী বাবুরা আমাকে সহযোগিতার বদলে করেছিল অবহেলা ও অপমানজনক কথা বার্তা। আজ মাধ্যমিকে প্রথম হয়েছি বলে ছোট জাতের তালপাতার কুঁড়েঘরে লোকে-লোকারণ্য হয়েছে কিন্তু কেন ? আমাকে দেখিয়ে রাজ্যের মান বাড়ানো আর উন্নয়নের নামে নেতাদের বাড়বাড়ন্ত।

আমাদের সুখ দুঃখের খবর রাখে কয়জনে রাখে। আজ বড় বড় ক্যামেরা নিয়ে বলছেন অনেক বড় বড় কথা, দুদিন পরে হারিয়ে যাবে আমাদের কঁইরি সমাজের মানুষেরা সব কথা। স্মৃতির পাতায় শুধু স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকবে কঁইরি পাড়ার মানুষগুলো।


সাঁঝলি ভাবছে :- আমাদের তালপাতা দিয়ে ঘেরা কুড়ে ঘরে আসছে কত মানুষ। মন্ত্রী আসবে বলে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় আবার অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে।


শীতের দুপুরে রৌদ্রের তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের পাহারায় মন্ত্রীর গাড়ি বাঁশি বাজাতে বাজাতে চলে আসে সাঁঝলির মাটির কুড়ে ঘরের সামনে।

শিক্ষামন্ত্রী সহ আরো রাজনৈতিক নেতাগণ গাড়ি থেকে নেমে মন্ত্রী বলেন :- সাঁঝলি কুঁইরি কোথায় ?

সাঁঝলি তার অসুস্থ মায়ের হাত ধরে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে এবং হেড মাষ্টারের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।

হেডমাস্টার মশাই বলেন :- প্রণাম কর সাঁঝলি প্রণাম কর।


সাঁঝলির পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে মন্ত্রীমহোদয় বলেন :- তুমি, দিন মজুরের কাজ কর্ম করে সংসার চালিয়ে বহু কষ্টে মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে। শুনি ভীষণভাবে আনন্দিত হলাম তাই তোমাকে দেখতে চলে এলাম কিন্তু তোমাদের সত্যিই ভীষণ দারিদ্র্য অবস্থা কিন্তু দারিদ্র্য দূরীকরণের চেষ্টা আমাদের সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।


তোমাদের মতো মেয়েরা যাতে উঠে আসে, তার জন্যই তো আমাদের পার্টি ও তোমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য আমাদের সরকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।


মন্ত্রী মহোদয় 10,000 টাকার চেক সাঁঝলির হাতে দিয়ে বলে :- সাঁঝলি, তোমাকে আমরা আরও ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধনা জানাবো মঞ্চ করে। আরো অনেক টাকা তুলে দেবো।

এই টিভির লোক গুলো ক্যামেরা এদিকে নিয়ে এসে ভিডিও করুন।


মন্ত্রী চেক প্রদান করছেন উন্নয়নের জন্য চারিদিক থেকে ছোট-বড় নানা ধরনের ক্যামেরা ঝলসে ওঠে আলোয়।


সাঁঝলি ভাবে :- বাপের সেই গাম্ভীর্য মুখ খানা অন্তর থেকে বাবা বলেন না, না সাঁঝলি টাকা নিবি না।


সাঁঝলি চিৎকার করে উঠে বলে :- না, না এই টাকা আমি নিতে পারবো না আর আপনারা আমাকে যে ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধনা দেবেন তাও আমার লাগবে না।


হঠাৎ বিস্ফোরণের মতো সাঁঝলি মুখে কথা শুনে মন্ত্রী ঢোক গিলতে শুরু করে, নিস্তব্ধ হয়ে যায় পরিবেশ।


সাঁঝলি ভাবে মনে :- মা, যে বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতেন, সেই দে বাড়ির গিন্নির বড় ছেলে এখন পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের বড় নেতা। এঁটো বাসন ধুতে পারবো না বলে প্রতিবাদ করেছিলাম কিন্তু বাবা কে করেছিল মানুষের মাঝে অপমান সেই দিনের কথা গুলো এখনো ভুলিতে পারি নাই।


দে বাড়ির দে গিন্নির বড় ছেলে স্থায়ী এলাকার বড় নেতা ভিড় ঠেলে সাঁঝলির কাছে এসে বলে :- কেন রে কি হয়েছে! সাঁঝলি টাকা নিবি না? তুই তো একদিন আমাদের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতিস?

বল তোর আর কি কি লাগবে ? ভালোভাবে খুলে বল সব দেবে আমাদের পার্টি।


সাঁঝলি বলে :- এই রাজ্যে আমার মতো হাজার হাজার অনেক কঁইরি মেয়ে সাঁঝলি আছে। আমি শিবু কুইরির মেয়ে বসবাস করি অজপাড়াগাঁয়ের মধ্যে। এই পাড়ার কঁইরি ছেলে মেয়েরা যতদিন অন্ধকারে পড়ে থাকবে, যতদিন লেখাপড়ার জন্য কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাবে ততদিন কোন বাবুর ও মন্ত্রীর দয়া আমার লাগবে না। শুনেছেন আপনারা আমার কোন দয়া লাগবে না।


মন্ত্রী বলে :- কেন মা তুমি রাগ করছো ?


সাঁঝলি বলে :- আমার বাবা বিনাচিকিৎসায় ধুকে ধুকে মরে গিয়েছে। আমার মায়ের মতো শত শত মা এই গ্রামে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে কিন্তু নিম্নতম প্রাথমিক ভাবে তাদের কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। এই গ্রামে কোন স্কুল নেই অন্য কোন গ্রামে গিয়ে বাবুদের হাতে পায়ে ধরে তাদের ইচ্ছা মত পড়াশোনা করতে হয়। কিন্তু কেন আমাদের জনগোষ্ঠীকে লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে?

আর লোকদেখানো চেক দিয়ে আমি কি করব? না আছে আমাদের ব্যাংকের একাউন্ট। হনুমানের মত রুটি ভাগ করতে করতে আমার ভাগে আর কিছু থাকবে না।

আপনারা রাজ্য পার্টির বড় নেতা ও মন্ত্রী। কেমন রাজ্য পরিচালনা করেন ?


আমি মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম হয়েছি বলেই ভোট পাওয়ার আশায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের নাম করে আমাদের কে সান্তনা দিতে এসেছেন?

এতদিন কোথায় ছিলেন যখন বই খাতার জন্য পড়াশোনা করতে পার ছিলাম না এবং বিদ্যালয়ে গিয়ে বার বার অপমানিত হতে হয়েছে।


দে বাড়ির দে গিন্নির বড় ছেলে এলাকার বড় নেতা হয়ে জনসমুদ্রের মাঝে শিবু কুইরির মেয়ে সাঁঝলি কে ঝিয়ের কাজের অপবাদ দিয়ে করলো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অপমান।

আমাদের কঁইরি সমাজের মানুষেরা চিরকাল হতদরিদ্র অশিক্ষিত কিন্তু আপনারা শিক্ষিত সমাজের মানুষ হয়ে আমাদের উন্নয়নের জন্য কি করেছেন ?

না করেছেন একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র, না করেছেন গ্রামের কোন উন্নয়ন, না কোন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। সরকারের দেওয়া উন্নয়নমূলক কাজের টাকা গুলো করেছেন আত্মসাৎ। প্রতিবাদ করতে গেলে তার কন্ঠ করেছেন রোধ।


যে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গৌরব করছেন কিন্তু এখনো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমাজের ছেলেমেয়েদের স্কুলে গেলে কোন মূল্যায়ন করা হয় না। শিশু কালে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছি স্কুলের বারান্দায় বসে বসে আমাদের ছোঁয়া নাকি স্নান করতে হয়।


যদি কিছু করার সৎ ইচ্ছা থাকে তাহলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমাজের উন্নয়নের জন্য কিছু করুন। শিক্ষা,স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান।

মন্ত্রী মহোদয় আমার জন্য আপনার কিছুই করতে হবে না। আমি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার হলে আরো লড়াই চালিয়ে যাবো।


 নেতা মন্ত্রীদের মুখে আর কোনো আর কথা নেই। মন্ত্রীমহোদয় গভীর চিন্তায় মুখ কালো করে ভাবতে থাকে। বাস্তবে উন্নয়ন না করে উন্নয়নের কথা বলে বেশিদিন রাজনীতি চলে না।


সাঁঝলি মায়ের হাত ধরে ভাঙ্গা কুড়ে ঘরের দিকে চলতে থাকে।


একদিন স্কুল চলাকালীন অপ্রত্যাশিতভাবে বিদ্যালয়ের বয়স্ক ইতিহাস শিক্ষক অশোক মহাশয় সাঁঝলি কে কাছে ডেকে নিয়ে "আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ইতিহাস" মূলক প্রবন্ধের বই হাতে দিয়ে বলেন :- এই বইটি মন দিয়ে পড়বে আরো বই সংগ্রহ করে দেবো। তোমাকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে হবে এবং পড়াশোনা করার মাধ্যমে তোমার সমাজের মানুষদের শিক্ষিত করতে হবে।

সাঁঝলি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা ও কিছু বিশিষ্ট মানুষের সান্নিধ্যে গবেষণা শুরু করে।

 

প্রাচীনকাল থেকে সর্বপ্রথম এই 

ভারত ভূখণ্ডে যে জনগোষ্ঠী বসবাস করত, তাদেরই “আদিবাসী” জনগোষ্ঠী বলা হয়ে থাকে। আদিবাসী শব্দ কথাটিরই অর্থ হল আদি বাসিন্দা বা সর্বপ্রথম বাসিন্দা। বর্তমানে প্রায় সমস্ত আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ভারতীয় সংবিধান অনুসারে Scheduled Tribe বা তপশীলি উপজাতি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। কিছু কিছু আদিবাসী জনগোষ্ঠী হয়ত Scheduled Tribe বা তপশীলি উপজাতি তালিকাভুক্ত হননি, এবং তাঁরা অন্তর্ভুক্তর জন্য আন্দোলন চালিয়ে আসছেন।

আদিবাসী জনগণ কে প্রাথমিক দিকে 

প্রথম জাতি, পাহাড়ি জনগোষ্ঠী, আদিম মানুষ, উপজাতি প্রভৃতি নামে চিহ্নিত করা হয়।

 যাদের নিজস্ব আলাদা সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও মূল্যবোধ রয়েছে; যারা নিজেদের আলাদা সামষ্টিক সমাজ-সংস্কৃতির অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে, তারাই আদিবাসী।

নিজেরাই এক একটি আলাদা জাতি।


পৃথিবীর পাঁচটি মহাদেশের ৪০টির 

বেশি দেশে বসবাসরত প্রায় ৫,০০০ আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩২ থেকে ৩৫ কোটি। 

নীতি-নির্ধারণী প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়ায় যুগে যুগে এদের অনেকে প্রান্তিকায়িত, শোষিত, বাধ্যতামূলকভাবে একীভূত হয়েছে এবং যখন এসব অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে নিজেদের অধিকারের স্বপক্ষে তারা কথা বলেছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা দমন নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। 


এক সময়ে উত্তর ভারত থেকে প্রশান্ত 

মহাসাগরের ইস্টার আইল্যান্ড অব্দি বিস্তৃত ছিল অস্ট্রিক ভাষা গোষ্ঠীর মানুষ। নাক চওড়া ও চেপ্টা, গায়ের রং কালো এবং মাথার চুল ঢেউ খেলানো। আনুমানিক ত্রিশ হাজার বছর আগেই তারা ভারত থেকে অস্ট্রোলিয়া যায়। সেই অস্ট্রিক গোষ্ঠীরই উত্তরাধিকারী বর্তমানের সাঁওতাল। খুব সম্ভবত সাঁওত বা সামন্তভূমিতে বাস করার কারণে সাঁওতাল নামে পরিচিত হয়ে পড়েছে।  


যুগের ব্যবধানে ভারতের ভূমিতে 

এসেছে আর্য, গ্রীক, আরব এবং ‍মোঙ্গলদের মতো অজস্র জাতি। সেই অর্থে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বিভিন্ন দেশের বহিরাগত। এদের কেউ কেউ নিজেদেরকে মহাভারতে বর্ণিত বীর একলব্যের বংশধর মনে করে। তবে তাদের উৎস এবং আদি নিবাসভূমি সম্পর্কে বলতে বহুল প্রচলিত এক লোককথাকে ‍গুরুত্ব দেয়া হয়।


আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস 

অনুসারে। "সাঁওতাল পুরাণ" নামক গ্রন্থে হাঁস ও হাঁসিল গল্প থেকে জন্মের ইতিহাস জানা যায়।

সেই মুহূর্তে পৃথিবী নামক গ্রহের জন্ম 

হয়নি কিন্তু শুধু জল আর জল। বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুসারে প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগে কাহিনী।

একদিন চন্দ্রের কন্যা স্নান করতে এসে শরীরের ময়লা থেকে সৃষ্টি করলেন হাঁস এবং হাঁসিল নামে দুটি পাখি। বহু বছর জলের উপর ভেসে থাকার পর একদিন তাদের সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের (ঠাকুর জিউ) নিকট প্রার্থনা জানাই খাবারের জন্য। তাদের প্রার্থনা শুনে ঈশ্বর অর্থাৎ ঠাকুর জিউ পৃথিবী সৃষ্টির মনস্থ করলেন। ভাবলেন সৃষ্টির জন্য মাটির দরকার কিন্তু মাটি রয়েছে সমুদ্রের তলদেশে।

জলচর প্রাণী বোয়াল কে ডাকা হল। সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর নির্দেশ দিলেন সমুদ্রের তলা থেকে মাটি নিয়ে আসার কিন্তু প্রথমে বোয়াল এবং তারপর কাকড়া মাটি আনতে ব্যর্থ হলে।

কেঁচো নামক এক প্রাণী এগিয়ে এলো। কচ্ছপ কে জলের উপর ভাসতে বলে কেঁচো নিজে লেজ রাখল তার পিঠে। তারপর কেঁচো মাটি খেয়ে তা লেজ দিয়ে বের করে কচ্ছপের পিঠে রাখতে শুরু করে। এইভাবে দীর্ঘ বছর ধরে চেষ্টার ফলে জন্ম নিল পৃথিবী।

সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর অর্থাৎ ঠাকুর জিউ নরম মাটিকে শুকনো করার জন্য পৃথিবীতে ঘাস শাল ও মহুয়া সহ নানা প্রজাতির বৃক্ষ রোপন শুরু করলেন।


আরো কিছুদিন পর মেয়ে পাখিটা দুটি ডিম দিল এবং নয় মাস দশ দিন পর ডিম পরিপুষ্ট হয়ে উঠে। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে ডিম ফেটে যায়। জন্ম হয় একজন পুরুষ পিলচু হাড়াম ও একজন নারী পিলচু বুড়ি। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে পিলচু হাড়াম ও পিলচু বুড়ি পৃথিবীর প্রথম নর নারী।

হিহিড়ি-পিহিড়ি নামক স্থানে তারা বসবাস করলে লাগলো।

 

ঈশ্বরের ইচ্ছায় তাদের দৈহিক সম্পর্ক তৈরি হয় এবং মিলনের মাধ্যমে জন্ম নেয় সাতটি পুত্র ও আটটি কন্যা।

ঈশ্বর (ঠাকুরজিউ) এবার পিলচু হাড়ামকে পুত্রদের নিয়ে সিংবীরে এবং পিলচু বুড়িকে কন্যাদের নিয়ে মানবিরে যাবার নির্দেশ দিলেন। আদেশ পালিত হলো দ্রুতই।


দীর্ঘ কয়েক বছর পর শিকার করতে করতে ভুলক্রমে সাত পুত্র এক বিলের ধারে চলে আসে। সেখানে শাক তুলছে আট কন্যা। পরস্পরকে দেখে আকর্ষিত হলো। ধীরে ধীরে সেই আকর্ষণ গড়ালো দৈহিক মিলনের পর্যায়ে। ছোট কন্যাকে বাদ রেখে দেয়। ভাইদের মধ্যে যে বড় সে বড় বোনকে এইভাবে সাত জন পুরুষ সাত জন নারীকে গ্রহণ করে।  

 সেই সাত পুত্র থেকে জন্ম নিলো সাতটি বংশ- হাঁসদা, মূর্মূ, কিস্কু, হেমব্রোম, মারাণ্ডি, সোরেন এবং টুডু। তখন থেকেই মূলত গোত্রপ্রথা এবং বিয়ে প্রথার শুরু হয়।


তারপর তারা খোজা-কামান দেশে গিয়ে বসবাস করতে লাগলো। নৈতিক অবক্ষয়, অন্যায় ও অত্যাচারে লিপ্ত হবার কারণে ঈশ্বর (ঠাকুরজিউ) তাদের উপর রুষ্ট হয়ে পড়ে। সাতদিন সাতরাত টানা অগ্নি বৃষ্টির মাধ্যমে পিলচু হাড়াম ও পিলচু বুড়ির বংশধরদের ধ্বংস করে। হারাতা পর্বতে আশ্রয় নিয়ে বেঁচে গেলো পিলচু হাড়াম এবং পিলচু বুড়ি। ধ্বংসলীলার শেষে প্রথমে সাসাংবেদা এবং পরে চায়চাম্পাতে গিয়ে বসবাস শুরু করেন এবং ঈশ্বর (ঠাকুরজিউ) আবার সন্তানাদি দান করলেন।

 

বর্তমান আদিবাসী জনগোষ্ঠীর 

সামাজিক অবস্থান। সমাজ ও বিচারের কাঠামো।বহু যুগ যুগ ধরে হিন্দু এবং মুসলিমদের সাথে বসবাস করার পরেও সাঁওতালরা তাদের সামাজিক স্বাতন্ত্র্য হারায়নি। বস্তুত রাষ্ট্রীয় বিধানাবলির চেয়ে সামাজিক প্রথার প্রতি তাদের আনুগত্য অধিক। তার অন্যতম প্রমাণ বিচারব্যবস্থা। 


সাঁওতাল গ্রামের বিশেষ পাঁচজনকে নিয়ে গঠিত হয় গ্রাম পঞ্চায়েত।

 তারা হলেন- মাঝি হাড়াম বা গ্রামপ্রধান, পরাণিক, জগমাঝি, গোডেৎ এবং নায়েকে। আবার কয়েকটি গ্রামের প্রধানদের নিয়ে গঠিত হয় পরগণা পঞ্চায়েত। এর প্রধানকে বলা হয় পারগাণা। এর থেকেও বৃহত্তর ব্যবস্থা দেশ পঞ্চায়েত। সাঁওতাল সমাজে দেশ বলতে নির্দিষ্ট এলাকাকে বোঝানো হয়। সাধারণত দেশপ্রধানের অধীনে পাঁচ-ছয় জন পারগণা ও মাঝি হাড়াম থাকতে পারে। এই তিন স্তরের বিচারব্যবস্থার বাইরে আছে ল’বীর বা সুপ্রিম কোর্ট। জটিল বিষয়াদি নিয়ে বছরে মাত্র একবার এই আদলত বসে।   


সাঁওতালদের একটি বৈঠক। মাঝি হাড়াম বলতে গ্রামপ্রধানকেই বোঝানো হয়। শুধু বিচারিকভাবে না, সার্বিকভাবে গ্রামের সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু তিনি। তার সহায়ক হিসেবে বাকি পদগুলো সৃষ্ট। পরাণিক পালন করে সহকারি গ্রাম প্রধানের দায়িত্ব। মাঝি হাড়াম অসুস্থ কিংবা অনুপস্থিত থাকলে তার দায়িত্ব বর্তায় পরাণিকের উপর। জগমাঝি পালন করে উৎসব তদারকির ভার। সেই সাথে উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরা তার মাধ্যমেই নিজেদের ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করে। সে হিসেবে তিনি যুব প্রতিনিধি। গোডেৎ এর কার্যাবলী অনেকটা চৌকিদারের অনুরূপ। আর নায়েকে বিশেষ করে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও পূজা উপলক্ষে বলি দেওয়ার মতো বিষয়ের দায়িত্ব পালন করে।


স্থানীয় সমস্যাগুলো মীমাংসা করা হয় গ্রাম পঞ্চায়েতে। গ্রাম পঞ্চায়েতে অমীমাংসিত বিষয়গুলো পরগণা পঞ্চায়েতে উত্থাপিত হয়। দেশ পঞ্চায়েতে উঠে পরগণা পঞ্চায়েতে অমীমাংসিত সমস্যা। সবার শেষে স্থিত ল’বীরের মুঠোতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা।


গোত্র বিন্যাস।

বাংলার আবহাওয়াই গোত্রব্যবস্থার অনুকূল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রে বিভক্ত হিন্দু সমাজের দেখাদেখি এখানকার মুসলমান সমাজও বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল সৈয়দ, শেখ, পাঠান ও দেশি মুসলিম হিসেবে। তবে তাদের কারোরই প্রভাব সাঁওতাল সমাজে পড়েনি। বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের মধ্যে বসবাসকারী সাঁওতাল সমাজ মূলত ১২টি ভাগে বিভক্ত। তারা হলো- কিস্কু, হাঁসদা, মূর্মূ, হেমব্রম, মারণ্ডি, সোরেন, টুডু, বাস্কি, গুয়াসোরেন, বেসরা, পাউরিয়া এবং চোঁড়ে। পৃথিবীতে

প্রায় ৫,০০০ আদিবাসী গোষ্ঠী আছে।

ভারতে প্রায় ৭০০ এরও অধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে। পশ্চিমবাংলায় মোট ৪০ টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে Scheduled Tribe বা তপশীলি উপজাতি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।


দৈনন্দিন জীবনাচার।

সাঁওতালদের খাদ্যতালিকা বাঙালি হিন্দু কিংবা মুসলমানের খাদ্যতালিকার মতোই। ভাত, মাছ, মাংস নিরামিষ কিংবা বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক পিঠা তাদের খাবার হিসেবে বিদ্যমান। নেশা জাতীয় খাদ্যের মধ্যে হাড়িয়া বা ভাত পচানো মদ প্রধান। এছাড়া আছে ভাঙ, তাড়ি, হুকা এবং গাঁজা। অনেক মেয়ে হাড়িয়া ও ধূমপানে অভ্যস্ত থাকলেও সব সাঁওতাল ধূমপান করে না। অতি ‍উৎসাহী অনেকেই তাদের খাদ্যাভ্যাসে কাঠবিড়ালী, গুইসাপ এবং কাঁকড়ার নাম উল্লেখ করেন।

 

গরীব পুরুষদের প্রধান পরিধেয় নেংটি। পোশাকটি একসময় বাংলার অধিকাংশ মানুষই পরিধান করতো বলে এখনো পরিচিত। তবে স্বচ্ছলদের মধ্যে সাধারণ পোশাক হিসাবে ধুতি এবং পাগড়ি বেশ জনপ্রিয়। আধুনিক শিক্ষিতরা বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের অনুরূপ প্যান্ট, শার্ট, পাঞ্জাবি ও পাজামা প্রভৃতি পরিধান করে। মেয়েদের পোশাক মোটা শাড়ি বা ফতা কাপড়। তবে স্বচ্ছল পরিবারের মেয়েরা বাঙালি মেয়েদের মতোই শাড়ি, ব্লাউজ এবং পেটিকোট পরে। 


ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সাঁওতাল নারী 

ও পুরুষ। সাঁওতাল রমণীরা সৌন্দর্য সচেতন। স্বর্ণালঙ্কারের প্রচলন না থাকলেও গলায় হাঁসুলি, মালা ও তাবিজের ব্যবহার দেখা যায়। এছাড়া কানে দুল, নাকে নথ ও মাকড়ী, সিঁথিতে সিঁথিপাটি, হাতে বালা, চুড়ি এবং বটফল, বাহুতে বাজু, কোমরে বিছা, হাতের আঙুলে অঙ্গুরী, পায়ের আঙুলে বটরী প্রভৃতি অলঙ্কার বেশ জনপ্রিয়। কখনো খোঁপায় ফুল গুঁজে, কখনো কাঁটা ও রঙিন ফিতা দিয়ে চুল বাঁধা হয়। দরিদ্র মেয়েরা বিশেষ প্রকার মাটি ব্যবহার করে শরীর মাজতে, যা নাড়কা হাসা নামে পরিচিত।


ক্ষুদ্রাকার ঘরগুলো বেশ পরিচ্ছন্ন। নিম্নাংশ রঙিন করা ছাড়াও দেয়ালে আঁকা হয় নানা রঙের ছবি। বাসায় আসবাবপত্রের আধিক্য নেই। কাঠ, বাঁশ ও পাট ব্যবহারের প্রাচুর্য দেখা যায়। তীর ধনুক ও টোটা প্রায় সব সাঁওতাল বাড়িতেই আছে।


উৎসব-অনুষ্ঠান সাঁওতাল সমাজ 

উৎসবপ্রধান। সাধারণত দুই ধরনের উৎসব দেখা যায়। জন্ম-বিবাহ ও মৃত্যুকেন্দ্রিক উৎসব এবং পার্বণিক উৎসব। সব অনুষ্ঠান ঝাঁকঝমকপূর্ণ না হলেও বিয়ে ও পার্বণিক অনুষ্ঠানগুলো ঘটা করে পালিত হয়। বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানদের মতো সাঁওতাল শিশু জন্মের পাঁচ কিংবা পনেরো দিনে অনুষ্ঠিত হয় অন্নপ্রাশন। এছাড়া নামকরণ, কানে ছিদ্র করা এবং সিকা দেওয়াকে কেন্দ্র করে পালিত হয় উৎসব। সিকার বদলে মেয়েরা ব্যবহার করে ঈশ্বরের চিহ্ন। 


সাওতাল সমাজের বিয়ের নিয়ম। 

সাঁওতাল সমাজে চার ধরনের বিয়ে প্রচলিত আছে। অভিভাবকের পছন্দ মাফিক বিয়ে হলে তাকে বলা হয় ডাঙ্গুয়া বাপ্লা বা আনুষ্ঠানিক বিয়ে। আগে থেকে বিদ্যমান প্রেম বিয়ে পর্যন্ত গড়ালে সেই বিয়েকে বলা হয় আঙ্গির বা প্রেমঘটিত বিয়ে। এছাড়া আর দুই প্রকারের বিয়ে হলো অ-র বা বলপূর্বক বিয়ে এবং ইতুত বা কৌশলে বিয়ে। অ-র বিয়েতে কোন তরুণ তার পছন্দের তরুণীকে সিঁদুর পরিয়ে দেয় জোর করে। পরবর্তীতে বৈঠক ডেকে তরুণীর মতামত নেওয়া হয়। তরুণী হ্যাঁ বললে কিছু করার থাকে না কিন্তু না বললে তরুণকে দণ্ডিত করা হয়। ইতুত বিয়েটাও প্রায় কাছাকাছি। শুধু এক্ষেত্রে তরুণ সিঁদুর পরিয়ে দিয়ে সিঁদুর পাতা গ্রামপ্রধানের কাছে জমা দেয়। গ্রামপ্রধান যুবতীর মত জানতে চান। হ্যাঁ হলে বিয়ে হয়ে গেছে বলে ধরা হয়।

সাঁওতাল সমাজে পণপ্রথা প্রচলিত

 আছে। তবে তা খুবই নগণ্য। সর্বনিম্ন ১২টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪৫টাকা। বরপক্ষ কন্যাপক্ষকে তিনটা কাপড় প্রদান করে। কনের দিদিমা কে দেয়া শাড়িকে বলা হয় বোঙ্গা শাড়ি। বাকি দুটি পায় কনের পিসিমা এবং মা। বিধবা বিবাহ প্রচলিত আছে। বিধবাকে সেই সমাজে বলা হয় ‘রাণ্ডি’। অন্যদিকে তালাক প্রাপ্তা মেয়েদের বলা হয় ছাডউই।


সাঁওতাল সমাজের অনুষ্ঠানাদি।  


 মৃত ব্যক্তির আত্মার জন্য পালিত হয় শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান। সাঁওতালর মৃতকে কবর দেওয়ার রীতি প্রচলিত আছে।

‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’ কথাটা সাঁওতাল সমাজের জন্য আরো বেশি করে সত্য। বাংলা ফাল্গুন মাসে উদযাপিত হয় নববর্ষ। চৈত্রমাসে বোঙ্গাবুঙ্গি, বৈশাখে হোম, জ্যৈষ্ঠ মাসে এরোয়া, আষাঢ়ে হাড়িয়া, ভাদ্র মাসে ছাতা, আশ্বিনে দিবি, কার্তিকে নওয়াই এবং পৌষ মাসে সোহরাই উৎসব পালিত হয়। ধর্ম-কর্ম, উৎসব-অনুষ্ঠান সবকিছু কে ঘিরে থাকে নৃত্য আর গান।


ধর্ম-কর্ম।

সাঁওতালদের নিজস্ব ভাষা আছে, বর্ণ নেই; ধর্ম আছে, ধর্মগ্রন্থ নেই। ধর্মের আদি দেবতা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ আছে। সিং বোঙ্গা হলো সূর্যদেবতা। সূর্যের এমন প্রকাশ অনেক ধর্মেই দেখা যায়। চান্দো শব্দের অর্থও সূর্য। অন্যদিকে মারাংবুরু আদিতে একটি পাহাড়ের নাম ছিল। ধীরে ধীরে তা পরিণত হয় মহাজাগ্রত দেবতায়। বস্তুতপক্ষে সিং বোঙ্গা, চান্দো এবং মারাংবুরুর সাথে ঈশ্বরের মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। শ্রেষ্ঠদেবতা অর্থে ঠাকুরজিউ ব্যবহৃত হয়। খুব সম্ভবত তা পরবর্তীকালে সংযোজিত। অনুরূপ কথা ধর্মদেবতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। 


সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষের বিশ্বাস মতে, আদি দেবতা নিরাকার। স্বর্গ-নরক কিংবা জন্মান্তরবাদের তেমন কোন ধারণা তাদের মধ্যে নেই। ধর্ম-কর্ম আবর্তিত হয় পার্থিব জীবনের মঙ্গল অমঙ্গলকে কেন্দ্র করে। বোঙ্গা মানে নৈসর্গিক আত্মা। তাদের মতে, আত্মা কখনো মরে না; সর্বদা পৃথিবীতেই বিচরণ করে। বোঙ্গারাই সুখ-দুঃখের নিয়ন্তা। সাঁওতাল ধর্মীয় জীবনের অধিকাংশ স্থান জুড়ে বোঙ্গাদের অবস্থান। এমনকি প্রত্যেক বাড়ির জন্য গৃহদেবতা হিসেবে আবে বোঙ্গা থাকে। আদিতে মূর্তিপূজা না থাকলেও ইদানিং দূর্গা ও শ্যামা পূজার মতো দাঁসাই উৎসব এবং মাই বোঙ্গার পূজা চালু হয়েছে। 


লোক-সংস্কৃতি সাঁওতাল সমাজ 

একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। জীবনের নানান সত্যকে বোধগম্যভাবে উপস্থাপন করার জন্য গড়ে উঠে লোকজ গল্প ও কাহিনী এবং শ্লোক। যেমন-

দারে সাকাম সাগে নেনা

ঞুরুঃলাগিৎ চান্দো পালোঃ লাগিৎ

নিংমাঞ জানা মাকান নোয়া ধারতিরে

বাংদঞ টুণ্ডোং চান্দো বাং দঞ বাং আ।।


ভাবার্থঃ গাছের পাতা আসে ঝরে যাবার জন্য। আর আমি জন্মগ্রহণ করলাম পৃথিবী থেকে সরে যাবার জন্য। 

এরকম অজস্র গল্প রয়েছে। আবার যাপিত জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের ভেতর জন্ম নিয়েছে নানান বিশ্বাস ও সংস্কার। অমাবস্যা বা পূর্ণিমায় ফসল লাগালে অমঙ্গল হয়, চুল ছেড়ে গোশালায় গেলে গৃহপালিত পশুর অকল্যাণ ঘটে, রাতে এঁটো থালা বাইরে ফেললে দারিদ্রতা আসে- প্রভৃতি কালের ব্যবধানে বিশ্বাসে রূপান্তরিত হয়েছে। এছাড়া সুলক্ষণা ও কুলক্ষণা নারীর বৈশিষ্ট্য, যাত্রা শুভ কিংবা অশুভ হবার কারণ, বৈবাহিক সম্পর্কের ঠিক-ভুলের প্রতীক প্রভৃতি তাদের বিশ্বাস ও সংস্কারে দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে লোক-সংস্কৃতির অফুরন্ত উপাদানে সমৃদ্ধ সাঁওতাল সমাজ। 

এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতির লালন করছে হাজার হাজার বছর ধরে। কিন্তু হাজার বছর ধরে হিন্দু ও মুসলমান সমাজের সাথে বসবাস করেও সাঁওতাল সমাজ তাদের স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হতে দেয়নি। ক্ষুন্ন হতে দেয়নি দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারা। প্রতিদিনের প্রকৃতি, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিশ্বাস এবং নৈতিক মূল্যবোধের আদর্শকেও দেয়নি কালিমালিপ্ত হতে। আদিবাসী সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্য এখানেই।


সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষেরা অনেকটা বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করছিল। ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ সরকার তাদের দামিনিকোতে বসবাস নির্দিষ্ট করে। স্থানটির পরবর্তী নাম হয় সাঁওতাল পরগণা।


সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর বিদ্রোহ।

ভারতীয় ইতিহাসের সাঁওতাল বিদ্রোহ ঘটে ১৮৫৫-৫৬ সালে। ১৯৪৫ সালে ঠাকুরগাঁওয়ে তেভাগা আন্দোলনে শহিদ ৩৫ জনের অনেকেই ছিলেন সাঁওতাল কৃষক। ১৯৫০ সালে নাচোলে কৃষক বিদ্রোহের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে তারা।

 ১৮৫৫ সালের ৩০শে জুন। ইংরেজ শাসন, জমিদার এবং নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠে বীরভূমের মাটিতে। নেহায়েত দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আধুনিক বন্দুক কামানের মুখোমুখি হয়েও কাঁপিয়ে দিল ব্রিটিশ মসনদ। সিধু, কানু, চান্দ ও ভৈরবের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এক বছরের মাথায় বিদ্রোহ স্তিমিত হলো বটে। কিন্তু গোটা ভারতের মোহনিদ্রা ভেঙে দিয়ে গেলো। জন্ম নিলো অধিকার সচেতনতা। তার দলিল ঠিক পরের বছর থেকেই এই মাটিতে একের পর এক বিদ্রোহ। বিপ্লব ছোঁয়াচে রোগের মতো কী না! ইতিহাসের পাতায় ঘটনাটি সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সান্তাল হুল নামে স্বীকৃত। আর এর মধ্যে দিয়ে আলোচনায় আসে একটা আদিবাসী জনগোষ্ঠী- সাঁওতাল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও সাঁওতাল যুবকদের সক্রিয় সহযোগিতা ছিল।

 

বিদ্রোহের পর ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের পরাজয়ের ফলে আবার বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে তারা। ছড়িয়ে পড়ে বাংলা, ত্রিপুরা ও উড়িষ্যায়। দীর্ঘদিন বন জঙ্গলে কেটেছে।


জমি হারানোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। 

ভারতের অন্তত ১৭টি রাজ্য থেকে ১০ লাখেরও বেশি বনবাসী উপজাতি ও অন্যান্য জনজাতি পরিবারগুলিকে উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট৷ ২০০৬ সালের অরণ্য অধিকার আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কিছু অরণ্যপ্রেমী সংগঠনের দায়ের করা জনস্বার্থ মামলার প্রেক্ষিতে এই নির্দেশ৷

এদের উচ্ছেদ করার পেছনে আপাত কারণ হলো, খনি ও কলকারখানার জন্য আরো জমি চাই৷ জীববৈচিত্র্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শিল্পোদ্যোগীদের হাতে জমি তুলে দেওয়া চাই৷ ঝাড়খন্ডে কয়েক হাজার বনভূমি এলাকা দখল করে নিয়েছে আদানি কোম্পানি৷ 


আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ।

 ভারতে প্রায় চার কোটি হেক্টর বনভূমিতে বসবাস করে প্রায় ১০ কোটির বেশি আদিবাসী ও অন্যান্য জনজাতি৷

আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে প্রায় ৩২ থেকে ৩৫ কোটি। 

এদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ইন্ডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ার ইনুইট বা এস্কিমোস, উত্তর ইউরোপের সামি, নিউজিল্যান্ডের মাওরি অন্যতম। মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ আদিবাসী আছে বলিভিয়ায়। পেরু ও গুয়াতেমালায় অর্ধেক লোকই আদিবাসী। চীন, মায়ানমারেও বহু আদিবাসী রয়েছে। ভারতে প্রায় ১০.৪ কোটি আদিবাসী জনগণ বসবাস করেন যা ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮.৬ %। পশ্চিমবাংলায় প্রায় ৬০ লক্ষ আদিবাসীর বাস যা পশ্চিমবাংলার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬ %। মূলধারার জনগোষ্ঠীর থেকে আদিবাসীদের পৃথক জীবন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস আছে। পশ্চিমবাংলায় মোট ৪০ টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ‘Schedule Tribe (ST) বা তফশিলি উপজাতি’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে সরকারী সুযোগ সুবিধা প্রদান করার জন্য।


সংযুক্ত রাষ্ট্র সংঘের (United Nations Organization – UNO) 

আলোচনায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এ বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে নেওয়া হয়েছে এবং ১৯৯৩ সালকে “আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী জনগোষ্ঠী বর্ষ“ ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৫ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত “আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী জনগোষ্ঠী দশক“ ঘোষণা করা হয় যার উদ্দেশ্য ছিল আদিবাসীদের উদ্বেগের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া। এছাড়া ১৯৯৫ সালের ৯ আগস্ট কে “বিশ্ব আদিবাসী দিবস“ ঘোষণা করা হয়। সংযুক্ত রাষ্ট্রসংঘ (United Nations Organization – UNO) ১৯৮২ সালে সর্বপ্রথম আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেয়।


সাঁঝলির মা ঘুম থেকে উঠে তার মেয়ে কে বলে:- ভোর হয়ে গেছে বই রেখে একটু ঘুমিয়ে নে। বলে বিছানার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বইগুলো গোছগাছ করে হারিকেনের আলো নিভিয়ে দেয়।

    -----------------------------------------------------

রচনাকাল :- ৬ মার্চ ২০২২

শ্রী শ্রী মা সেবাশ্রম,খাটুয়া,দোলন ঘাটা,মাঝদিয়া, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ,ভারত।

    ----------------------------------------------------

তথ্য সূত্র :- 

দেবব্রত সিংহ রচিত কবিতা 'তেজ' ।

 মু জামবনির কুঁইরি পাড়ার শিবু 

 কঁইরির বিটি সাঁঝলি বটে। এই বিখ্যাত কবিতা অবলম্বনে।। আদিবাসী বিদ্রোহী নারী।।

 গল্প ।

(০১) বাংলাদেশের সাঁওতাল: সমাজ ও সংস্কৃতি, মুহম্মদ আবদুল জলিল, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, নভেম্বর ১৯৯১

(০২) বাংলাদেশের আদিবাসী সংস্কৃতি, ড. মাযহারুল ইসলাম তরু, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০০৭, পৃষ্ঠা- ৩১-৪২ এবং ১০৭-১১৭

(০৩) বাংলাদেশের আদিবাসীদের কথা, খুরশীদ আলম সাগর, শোভা প্রকাশ, ঢাকা

(০৪) আদিবাসী সমাজ ও সংস্কৃতি: সাঁওতাল


     <><>< সমাপ্ত ><><>






Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational