আবাদি বানো
আবাদি বানো
স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে
মুজাফফরনগর এলাকাতেও সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখা গিয়েছিল হিন্দু-মুসলিম নারীদের। আশা দেবী, বখতাভারি, হাবিবা, ভগবতী দেবী ত্যাগী, ইন্দ্র কৌর, জামিলা খান, মন কৌর, রহিমী, রাজ কৌর, শোভা দেবী, উমদা- ধর্ম ও জাতি নির্বিশেষে তাঁরা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। পঁয়তাল্লিশ বছরের আসগরি বেগমকে বাদ দিলে, এই সমস্ত মহিলারই বয়স ছিল বিশের কোঠায়। তাঁদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল কাউকে কাউকে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নির্দেশে সার বেঁধে বারো জন মহিলা যোদ্ধাকে মুজফফরনগরে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল ১৮৫৮ সালে।
এই মেয়েরা পর্দানসিন অবলার স্টিরিওটাইপ ভেঙে দিয়েছিলেন। আর এই প্রেক্ষাপটেই উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদের আমরোহা গাঁয়ে বেড়ে উঠেছিলেন আবাদি বানো নামের বালিকা (১৮৫২-১৯২৪), যিনি পরে রামপুরের আবদুল আলি খানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর দুই ছেলে মৌলানা মোহাম্মদ আলি আর মৌলান শওকাত আলি, যাঁরা 'আলি ব্রাদার্স' নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন।
আবাদি বানো বেগম (বি আম্মান) (উর্দু: عبادی بانو بیگم) (জন্ম 1850 মৃত্যু: 13 নভেম্বর 1924) ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট কণ্ঠস্বর। তিনি বি আম্মান নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি প্রথম মুসলিম নারীদের মধ্যে একজন যিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশ নেন এবং ব্রিটিশ রাজ থেকে ভারতকে মুক্ত করার আন্দোলনের অংশ ছিলেন।
তিনি রামপুর রাজ্যের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আব্দুল আলী খানকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির এক কন্যা ও পাঁচ পুত্র ছিল। অল্প বয়সে তার স্বামীর মৃত্যুর পর, তার সন্তানদের দেখাশোনার দায়িত্ব তার উপর পড়ে। যদিও তার সীমিত সম্পদ ছিল, আবাদি বানো বেগম তার সন্তানদের শিক্ষিত করার জন্য তার ব্যক্তিগত গহনাগুলিকে বন্দক রেখেছিলেন। বানো বেগমের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না কিন্তু তারপরও তার সন্তানদের উত্তরপ্রদেশের বেরেলি শহরের একটি ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলে পাঠাতেন। তার ছেলেরা, মাওলানা মোহাম্মদ আলী জোহর এবং মাওলানা শওকত আলী খিলাফত আন্দোলন এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বাধীনতা আন্দোলনে এই নারী কিন্তু শুধু 'আলি ভায়েদের মা' হয়েই থাকেননি। তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু হয় হোমরুল আন্দোলনের মাধ্যমে, যে আন্দোলনে তিনি নৈতিক সমর্থন দিয়েছিলেন ও আর্থিক ভাবে সাহায্য করেছিলেন। যখন ব্রিটিশ সরকার ইন্ডিয়ান ডিফেন্স রেগুলেশন বলে চন্দনওয়াড় গ্রামে আলি ব্রাদার্সকে আটক করে, মাকে বোঝায় ছেলেদের আত্মসমর্পণের জন্য রাজি করাতে, তখন তিনি নির্দ্বিধায় বলেন, ‘যদি আমার ছেলেরা সরকারের প্রস্তাবে রাজি হয়, তাহলে আমি তাদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করব। আমি আশা করি ঈশ্বর এই বৃদ্ধ মহিলার দুহাতে তা করার পর্যাপ্ত শক্তি দেবেন।'
আবাদী বানো বেগম রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ নেন এবং খিলাফত কমিটির সদস্য ছিলেন। 1917 সালে, তিনি অ্যানি বেসান্ট এবং তার দুই ছেলেকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আন্দোলনে যোগ দেন। মহাত্মা গান্ধী তাকে কথা বলতে উৎসাহিত করেছিলেন, কারণ তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীদের সমর্থন পেতে পারেন।
১৯১৭ সালে আবাদি বানোর মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে দেখা হল। মহাত্মা গান্ধী ও গান্ধী-অনুগামীদের ‘আম্মিজান’ হয়ে উঠলেন তিনি। বি.আম্মা নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। তিনি গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন হেতু এবং খিলাফত নেতাদের খিলাফত আন্দোলনের জন্য সার্বিক ভারত সফর বাস্তবায়িত করতে খোলা হাতে অর্থ ঢেলেছিলেন।
১৯১৭ সালে, সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের অধিবেশন চলাকালীন, তিনি একটি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী এবং জোরালো ভাষণ দেন যা ব্রিটিশ ভারতের মুসলমানদের উপর একটি স্থায়ী ছাপ রেখে যায়।
খিলাফত আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জোগাড় করার জন্য তিনি ভারতজুড়ে ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছিলেন। আবাদী বানো বেগম খিলাফত আন্দোলন এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য তহবিল সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি, মাওলানা হাসরাত মোহানি, বাসন্তী দেবী, সরলা দেবী চৌধুরানী এবং সরোজিনী নাইডুর স্ত্রী বেগম হাসরাত মোহানির সাথে, প্রায়শই শুধুমাত্র মহিলাদের সমাবেশে ভাষণ দিতেন এবং বাল গঙ্গাধর তিলক দ্বারা প্রতিষ্ঠিত তিলক স্বরাজ তহবিলে অনুদান দেওয়ার জন্য মহিলাদের আহ্বান জানান। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য। 1924 সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।
আবাদী বানো বেগম 1924 সালের 13 নভেম্বর 73 বছর বয়সে মারা যান।
১৯১৭ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস এবং অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের যুগ্ম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হল কলকাতায়। আম্মিজান সেই সভায় বক্তৃতা দিলেন। সে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। বোরখা তাড়াল থেকে তেজস্বী ভাষণ রাখছেন বৃদ্ধা এক পুরুষ-অধ্যুষিত উপত্যকায়। বলছেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথা, বলছেন খিলাফত আর অসহযোগ আন্দোলনের কথা, ঘোষণা করছেন, 'দেশের কুকুর -বিড়ালও ব্রিটিশদের দাসত্বের অধীনে থাকা উচিত নয়।' ব্রিটিশ সরকারি রেকর্ড তাঁকে 'বিপজ্জনক ব্যক্তি' হিসেবে গণ্য করেছিল৷ বেশ কয়েকটি মহিলা সংগঠনেরও নির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি। তীব্র দেশপ্রেমিক এই বৃদ্ধা, অসুস্থতা ও পুলিশি অত্যাচারে ১৯২৪ সালের নভেম্বরে মারা গেলেন। গান্ধীজি বলেছিলেন, 'তিনি বৃদ্ধা হলেও তাঁর মধ্যে ছিল যুবদের ন্যায় অদম্য প্রাণ শক্তি।' তহবিল সংগ্রহ করতেন, মহিলাদের ব্রিটিশ পণ্য বর্জন এবং স্বদেশী পণ্য ব্যবহারের গুরুত্ব বোঝাতেন মৌ আম্মা মাওলানা হাসরাত মোহানী, সরলা দেবী চৌধুরানী, বাসন্তী দেবী, সরোজিনী নাইডু, বেগম হাসরাত মোহানিদের সঙ্গে। রাখহরি চ্যাটার্জির লেখা ''গান্ধি এবং দ্য আলি ব্রাদার্স: বায়োগ্রাফি অব ফ্রেন্ডশিপ'' বইতে দেখি, মাওলানা মোহাম্মদ জোহর আম্মিজান সম্পর্কে বলেছেন,
'যদিও তিনি কার্যত নিরক্ষর ছিলেন, আমার অভিজ্ঞতায় আমি তাঁর চেয়ে জ্ঞানী, ঐশ্বরিক এবং আধ্যাত্মিক কাউকে দেখিনি।'
বি.আম্মার পুত্রবধূও কম যেতেন না। আমজাদি বেগম ছিলেন মুহাম্মদ আলি জওহরের স্ত্রী। শাশুড়ির উৎসাহে আমজাদি বেগমও রাজনীতিতে যোগ দেন। কথিত আছে, তিনি লন্ডনে প্রথম গোলটেবিল সম্মেলনে আলি জওহরের পাশে ছিলেন। শাশুড়িকে অসহযোগ আন্দোলন এবং খিলাফত আন্দোলনে সাহায্য করার পাশাপাশি তিনি জিন্নাহর পরামর্শে মুসলিম লীগের প্রথম কার্যনির্বাহী কমিটিতে পঁচিশ জন সদস্যের মধ্যে একমাত্র মহিলা হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৩৭ সালে লখনৌতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে বেগম নারীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণে উৎসাহ দেন। মহাত্মা গান্ধি তাঁর উদ্দেশে ''আ ব্রেভ উওম্যান'' শিরোনামের একটি নিবন্ধ উৎসর্গ করেছিলেন।
তথ্য : আন্তর্জাল, বিভিন্ন পত্রিকা।
