ভালো লাগে হাঁটতে তোর হাত ধরে
ভালো লাগে হাঁটতে তোর হাত ধরে
ছেলেটির নাম রাজা আর মেয়েটির নাম ছোটো । তারা দুজনেই একটা কো-এড স্কুলে পড়ে ।দুজনেই যখন ক্লাস সেভেন তখন তাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে । ধীরে ধীরে তারা খুব ভালো বন্ধু হয়ে যায় । ছোটো প্রথম থেকেই একটু শান্ত প্রকৃতির আর রাজা ঠিক তার উল্টো খুব চঞ্চল । ছোটোর একটা খারাপ অভ্যাস হল সে যখন রাজার দিকে তাকাই তখন সে তার দিকে তাকিয়েই থাকে । রাজা ওকে বার বারই বলে দ্যাখ্ ওরকমভাবে তাকিয়ে থাকিস না প্রেমে পড়ে যাবি কিন্তু । ছোটো তখনও সেভাবেই তাকিয়ে থাকত কোনো কথা শুনত না । হয়তো সে রাজার প্রেমেই পরতে চেয়েছিল বা প্রেমে পড়েছিল । ধীরে ধীরে তারা দুজন দুজনের আরও কাছাকাছি এল, তাদের বন্ধুত্ব আরও গভীর হল। দুজন দুজনকে খুব ভালবেসে ফেলল । দুজন দুজনের প্রতি বিশ্বাস ছিল অটুট । তাদের ঐ সম্পর্কের কথা তাদের বাড়ির কেউ জানত না । ভেবেছিল পরে জানাবে । তারা একে অপরকে এত ভালবাসলেও তারা কিন্তু তাদের পরিবার বা তাদের কেরিয়ার কোনটাকেই এঁড়িয়ে যায়নি । তারা নিজেদেরকে যেমন ভালবাসত তেমনি তাদের পরিবারকেও ভালবাসত । তাদের নিজেদের প্রতি যতটা দায়িত্বশীল যতটা কর্তব্যপরায়ণ ছিল ঠিক ততটাই বাকি সবার প্রতিও ছিল । উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে দুজনেই কলেজে ভর্তি হল । কিন্তু তখন আর তারা একই কলেজে ভর্তি হল না । ছোটো ভর্তি হল পুরুলিয়া রমাদেবী ওমেন’স কলেজে পলিটিক্যাল সায়েন্স অনার্স নিয়ে আর রাজা আসানসোল আই ডি বি কলেজে স্ট্যাটিসটিক্স নিয়ে ভর্তি হল । সুতরাং প্রতিদিন আর তাদের একসাথে দেখা হবে না আর কথাও হবে না কারন ছোটোর কাছে একটা ফোন থাকলেও রাজার কোনো ফোন ছিল না । তবে তারা ঠিক করল যে তারা মাঝে মাঝেই দেখা করবে একটা জায়গায় । প্রায়ই তারা দেখা করতো দুজনে , একসাথে বাইকে খুব ঘুরত । এভাবেই কেটে গেল দু’বছর । থার্ড ইয়ারের মাঝামাঝি সময়ে ছোটো ইনকাম ট্যাক্স অফিসে একটা চাকরি পেয়ে গেল । এই খবরটা শুনে রাজা ভীষণ খুশি । সে তো খুব আনন্দ করছে । তারা দুজনেই দেখা করল এমনকি ছোটোকে নিয়ে একদিন তো দুর্গাপুর শপিং কমপ্লেক্সে খেয়ে এল রাজা । তারপর গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে রাজাও বসল চাকরির পরীক্ষায় । পরীক্ষায় পাশ করে রাজাও চাকরি পেলএকটা বেসরকারি খবর চ্যানেলের মেইন জার্নালিস্ট-এর । সবার প্রথমে খবরটা জানালো ছোটোকে । খবরটা শুনে ছোটো খুব আনন্দিত হল । তারা আবারও তাদের সেই দেখা করার জায়গায় দেখা করলো দুজনে । কয়েকমাস পর থেকে রাজার মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখা গেল । ধীরে ধীরে ছোটোকে সে এঁড়িয়ে যেতে লাগল । এখন রাজা আবার মদও খেতে শুরু করেছে, যা ছিল ছোটোর একেবারেই অপছন্দের । এরপর তাদের মধ্যে একটা ঝামেলা দেখা গেল । একদিন ছোটো কাঁদতে কাঁদতে রাজাকে প্রশ্ন করেছিল কেন তার এই মদ খাওয়া, রাজা কোনো উত্তর দেয়নি । তারপর রাজা আরও বেশি করে মদ খেতে লাগল । একদিন তো রাজা ছোটোকে চর থাপ্পড়ও দিয়েছিল । ছোটো কিছু বলেনা কারন ছোটোও এখন রাজাকে ভয় পেতে শুরু করেছে, সেও রাজাকে এঁড়িয়ে চলছে একটু । ছোটোও যেন এখন কেমন হয়ে গেছে । মুখে তার আর হাসি নেই, সারাক্ষণ সে গোমড়া মুখ করে বসে থাকে । রাজার কিন্তু ছোটো ছাড়া আর কোনো বন্ধু বান্ধবী নেই কিন্তু ছোটোর আরও বন্ধু বান্ধবী আছে । তাই তারা সবাই একদিন ছোটোকে প্রশ্ন করল, “ কিরে তোর কী হয়েছে বলত কেমন যেন হয়ে গেছিস সারাক্ষণ মুখ ভার করে বসে থাকিস আগের মতো আর কথাও বলিস না সেরকমভাবে, বিয়ে করবি নাকি ?” ছোটো তাদের জানাল রাজার এই পরিবর্তনের কথা , তার মদ খাওয়ার কথা । ছোটো আরও জানিয়েছিল রাজা তার জীবনের সব, রাজাকে ছাড়া সে বাঁচতে পারবে না কিন্তু রাজার এই মদ খাওয়াটাও সে মেনে নিতে পারছে না । আর এই কারনে সে রাজাকে কখনও ক্ষমা করতে পারবে না । তারা বুঝতে পারল যে ছোটোর মধ্যে অনেক অভিমান জমে আছে রাজার মদ খাওয়ার প্রতি যা সে একেবারেই পছন্দ করে না । তাই একদিন সব বন্ধুরা গিয়ে রাজাকে খুব মারধর করে, কারন তারা ছোটোর কস্ট সহ্য করতে পারেনি । রাজা তবুও ঠিক হয় না আরও বেশি বেশি করে মদ খেতে লাগল । শেষে একদিন রাজা ছোটোকে চিঠি লিখল, “ ভালো থাকিস রে আমি আসছি ।“ তারপর আর দুজনের সাথে দুজনের দেখা হয়নি , কথা হয়নি । ছোটো অনেক খোঁজ করেছিল রাজার কিন্তু রাজার খোঁজ মেলেনি কোথাও ।
আজ 14ই ফেব্রুয়ারি, 2020 কেটে গেল সাত বছর । প্রিয়তোষ বলে ছোটোর এক বন্ধু এখন চাকরি করে অন্ধ্রপ্রদেশের নেল্লোরে একটা বেসরকারি হাসপাতালে । ওখানে একদিন সে দেখতে পায় রাজাকে । দেখা মাত্রই দৌড়ে যায় রাজার কাছে । গিয়ে রাজাকে সে প্রশ্ন করে কেন সে ছোটোর সাথে এরকম করেছিল আর কেনই বা সে এখানে । রাজা তাঁকে তার সব প্রশ্নের উত্তর দেয় । পুজোর ছুটিতে প্রিয়তোষ বাড়ি এসে সবার প্রথমে ছোটোর সাথে দেখা করে । দুজনেই দুজনের ভালোমন্দের কথা জিজ্ঞাসা করে । ছোটোর অবশ্য এখন বিয়ে হয়ে গেছে । ছোটো বলে সমাজের কথা ভেবে বিয়েটা করতে হল বুঝলি । তাই প্রিয়তোষ ওকে আর কিছু না বলেই বেড়িয়ে আসছে ওর বাড়ি থেকে এমন সময় পেছন থেকে ছোটো জিজ্ঞাসা করে-“ হ্যাঁ রে রাজার কোনো খবর জানিস ও কোথায় থাকে এখন বলতে পারবি ?” প্রিয়তোষ উত্তর দেয়-“ হ্যাঁ রে ওর খবর জানাতেই তোর বাড়ি এসেছি । জানিস ও তোকে ঠকাইনি রে । ওর সাথে আমার দেখা হয়েছিল নেল্লোর হসপিটালে । ও মদ খেত না রে । আজ সাত বছর ধরে ও ক্যান্সারে ভুগছে । ও জানত তুই ওকে কতটা ভালবাসিস তাই ও তোকে বৈধব্য যন্ত্রণায় দেখতে চায়নি । তাই ও যখন জানতে পেরেছিল যে ওর ক্যান্সার হয়েছে , তোর সাথে দেখা করতে আসার ঠিক আগেই হোমিওপ্যাথি ওষুধে থাকা সেই স্পিরিট খানিকটা মুখে ঢেলে আসত যার গন্ধ মদেরই মতো । ও জানত তুই মদ অপছন্দ করিস তাই ও কোনোদিনই মদ ছুঁয়েনি । আসলে ও চেয়েছিল তোকে ভালো রাখতে তাই ওর জীবন থেকে তোকে সরিয়ে দিয়েছিল । ও জানত তুই ওর ক্যান্সারের খবর শুনলে মরে যাবি, তাই ও তোকে এঁড়িয়ে যাওয়ার নাটকটা করেছিল । আমার সাথে দেখা হওয়ার পর আমি ওকে সব জিজ্ঞাসা করেছিলাম ও সবটাই আমাকে বলেছে । এগুলোই জানাতে এসেছিলাম তোকে , আসি রে । “ প্রিয়তোষের হাত দিয়ে যেন ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র সেরা উপহারটা এই সাত বছর পর আবারও দিয়ে গেল রাজা ।

