যে প্রিয় জিনিসটা হারাইনি, তবু আর পাইনি
যে প্রিয় জিনিসটা হারাইনি, তবু আর পাইনি
রাত শহরকে আলাদা করে দেয়। মানুষ ঘুমায়, কিন্তু কিছু স্মৃতি, কিছু কষ্ট, কিছু অপেক্ষা—নিশ্চল থাকে। আমি সেই নিশ্ছিদ্র রাতে দাঁড়িয়ে আছি, হাতে শুধু একটি নীল ডায়েরি। ওটা কোনো দামি জিনিস ছিল না, বাজারে গেলে হয়তো কেউ দরও জিজ্ঞেস করত না। তবু আমার কাছে ওটার ওজন ছিল স্মৃতির সমান। আমি একে বলতাম—“থাক।” কারণ ওটা থাকলেই আমার সবকিছু ঠিকঠাক মনে হতো।
ওটা ছিল একটি ছোট নীল ডায়েরি। কভারটা ফেটে গিয়েছিল। প্রথম পাতায় লেখা ছিল—“যদি কখনো সব শেষ হয়ে যায়, এইখানেই নিজেকে খুঁজে নিও।” আমি নিজেই লিখেছিলাম। ডায়েরিটা কোনো গল্পের ছিল না, কবিতারও না। ওটা ছিল আমার ভাঙা মনকে ধরে রাখার জায়গা। যেদিন কথা বলার মানুষ পাইনি, আমি ওটার ভেতর কথা বলেছি। যেদিন বাঁচতে ইচ্ছে করেনি, ওটার পাতায় নিজেকে আটকে রেখেছি।
ডায়েরিটা হারানোর দিনটা খুব সাধারণ ছিল। বৃষ্টি হচ্ছিল, বাস ভিড়, আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। নামার সময় খেয়ালই করিনি। রাতের বেলা ব্যাগ খুলে হঠাৎ বুকটা খালি হয়ে গেল। প্রথমে ভাবলাম, ভুল করে অন্য খোপে রেখেছি। এরপর ঘর উল্টালাম। নিজের মনও উল্টালাম। কোথাও নেই। সেই রাতেই বুঝলাম—মানুষ হারালে কাঁদা যায়, কিন্তু জিনিস হারালে নিজের ওপর রাগ হয়।
পরের দিন বাস ডিপোতে গেলাম। কেউ কিছু জানে না। এক সপ্তাহ পর কন্ডাক্টর বলল, “একটা ডায়েরি পাওয়া গিয়েছিল। নীল রঙের।” হৃৎপিণ্ড থেমে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, “এখন কোথায়?” সে বলল, “ভেতরে কিছু লেখা ছিল, পুলিশে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
সেই রাত আমি ঘুমাইনি। ডায়েরিতে শেষ পাতায় লেখা ছিল—“যেদিন সহ্য করতে পারব না, এই ডায়েরিটাই হবে আমার শেষ ঠিকানা।” পুলিশ সেটি পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার হাত বাড়ালাম, কিন্তু কিছুই নেই। শেষ পাতার কথা মনে পড়ে কেবল—ওটা পুড়ে গেছে, কিন্তু কষ্টটা এখনও আমার ভেতরে জ্বলছে।
আজও আমি টেবিলের দিকে তাকাই। ডায়েরিটা চলে গেছে, কিন্তু ওটার কাজ শেষ হয়নি। আমি এখন আর কিছু লিখি না। কারণ আমার প্রিয় জিনিসটা আমাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব শেষ করে দিয়ে গেছে।
