স্বপ্ন ভাঙার পরে
স্বপ্ন ভাঙার পরে
ম্যাল থেকে যে রাস্তাটা নীচের দিকে নেমে যায়, সেখান থেকে সোজা নেমে গেলে শুখিয়ার বাড়ি। আজ দাঁশাই সারা পাহাড়ে আজ সাজো সাজো রব। দাঁশাই হল নেপালীদের বিজয়া দশমী, এই দিন প্রত্যেক বাড়িতে চাল, সিদুর ও ঘী সহযোগে একটি মিশ্রণ বানানো হয়, আর তাই দিয়ে, বাড়ির গুরুজনেরা, অগ্রজদের তিলক পড়িয়ে দেয়। আজ শুখিয়ার খুব আনন্দের দিন, বহু দিন পরে সে আজ তার দাদুর বাড়ি যাবে, সেখানে সে তিলক পড়বে আর আশীর্বাদ নেবে, এই বছর বোর্ডের পরীক্ষা, বড়দের আশীর্বাদ খুব দরকার। তাই সকাল সকাল স্নান করে, তার প্রিয় লাল গেঞ্জী, খয়রী রঙের জ্যাকেট টা পরে বেড়িয়ে পোড়লো।
রাস্তায় তখন বেশ ভিড়, তাছাড়, শুখিয়ার বাড়ির রাস্তা টা বেশ শীর্ণ। বিভিন্ন বয়েস, বর্ণ ও ভাষাভাষির লোকজন রাস্তায়। এমনি তেই বাঙালীর দুগগা পুজো মানেই পাহাড়ে ভ্রমনের বাই চাপে, তাতে দাশাই, তীল এটে যাবে সেরকম জায়গা ছেড়ে ভিড়টা ছোড়িয়ে রয়েছে। দার্জিলিং অঞ্চলে রাস্তা গুলো একটু বেশিই খাড়াই এর দিকে, কিন্তু শুখিয়া অবস্থ, তাই নামতে তার বিশেষ বেগ পেতে হল না। দাদুর বাড়ি পৌছে দেখল, বাড়ি থমথমে, তার দুই মামা তার দাদু কে নিয়ে হাশপাতাল গেছে। হঠাৎ হ্রিদ যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ায়, তাড়াতাড়ি শুখিয়ার দাদু কে, হাস্পাতাল নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মনটা খারাব হয়ে গেল তার। তার ছোট মামি তাকে বস্তে বলে ভিতরে রান্না ঘরে গেল, জল নিয়ে আসতে। শুখিয়ার মামা বাড়িটা বেশ ছোট, ঢুকতেই একটা ছোট বসার জায়গা, সেখানে একটা পুরনো কাঠের খাট, সেটাই ছিল শুখিয়ার দাদুর বর্তমান পৃথিবী, তার পাশে একটা ছোট টেবিল, তাতে কিছু ওষুধ রাখা রয়েছে ও একটা খালি জলের গ্লাস, তার পাশের চেয়ারটা তে বশে আছে শুখিয়া আর এখানেই ঘরের শেষ, তারপর রান্না ঘর। পর্দার ফাক দিয়ে দেখল, তার ছোট মামী চাল ধুয়ে ওঘেনে ভাত বসাচ্ছে। দাদু প্রতিবার তাকে দাশাই উপলক্ষে কিছু টাকা দেয়, আর সেই টাকা দিয়ে, সে তার কীছু গুরুত্ব পূর্ণ জিনিশ কেনে। সে দেখেছে প্রত্যেক চার বছর অন্তর তার দাদু পঞ্চাশ টাকা করে বাড়িয়েছে। এ বছর তার পাওয়ার কথা, এবং এবারে সেই লীপ ইয়ার। কিন্তু এমতাবস্থায় কী হবে সেটা ভেবেই সে বেশ চিন্তিত। তার মামী একটা কাঁচের গ্লাসে জল ভোরে শুখিয়া কে দিল, আর ঘরের কোনে রাখা ট্রাঙ্ক টা খুলে সেখান থেকে কিছু একটা বের করলো। শুখিয়া জল খেতে লক্ষ্য করছে সবই। তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো যখন দেখল মামীর হাতে কড়কড়ে নতুন দুটো দুশো টাকা। দাদু দেবে বলে ঠিক ছিল, আর এটা শুখিয়ার প্রাপ্য।
শুখিয়া মা হারা ছেলে, তাই মামা বাড়ি তের অনাদর না হলেও সমাদরের ও তেওম্ন ভাগ্য নেই, কিন্তু দাদু তাকে ভালবাসে। মা মারা যাবার পর তার বাবা আবার বিয়ে করে আর যথা রীতি, সৎ মা যেমন টি হওয়ার তেমনটি হয়। কিন্তু তাতে শুখিয়ার কিছু যায় আসেনা, সে তার বন্ধু বান্ধব আর নেশা নিয়ে মেতে থাকে। না নেশা বলতে অন্য কিছু বুঝবেন না। ছেলেটি ছবি আঁকতে ভালবাসে সেটাই তার নেশা, যখনই মন খারাব লাগে বা মায়ের কথা মনে পড়ে সে গির্জায় চলে যায়। ওখানে বসে ছবি আঁকলে মন টা ভালো হয়ে যায়। কিন্তু প্রায় এক মাস হল, সে যেতে পারেনি। বাবার কাছে টাকা চাইলে বাবা কুৎসিত ভাষায় তাকে বকে দেয় আর তার সৎ মা কে বলা না বলা সমান। তাই আজ টাকা টা পাওয়া তার খুব দরকার। শুখিয়ার বন্ধুরা আজ সবাই মিলে সিনেমা দেখতে যাচ্ছে, শুখিয়াও সিনেমা দেখতে ভালোবাসে, কিন্তু সে গুল অন্য ধরনের। তাই আজ সে যায়নি, বরং দাদুর আশীর্বাদ নিয়ে ম্যাল এ তার অতি পরিচিত দোকান থেকে আঁকার খাতাটা কিনে, সে চলে যাবে গির্জায়, সেখান থেকে গোটা শহর টাকে দেখা যায়। গির্জায় বসে একা চুপ চাপ নিরিবিলিতে ছবি আঁকতে তার বেশ লাগে। কিন্তু তার বন্ধুরা সেটা বোঝে না, তারা শুখিয়া কে নিয়ে ঠাট্টা করে, জেটা মোটেই ভাল লাগে না শুখিয়ার, সে জানে সে একটু অন্য ধরনের, তাতে কী হয়েছে, সে রবীন্দ্রনাথের কথা পড়েছে, গ্যালিলীওর কথা পড়েছে, বিজ্ঞানী হকিং এর ব্যাপারে পড়েছে তারাও তো অন্য ধরনের ছিল, আর তাই তারা আজ কত নাম করেছে, সেও একদিন বড় হবে।
ম্যালের রাস্তা ঘাট আর আগের মত নেই, প্রচুর, লোকের ভিড়, গাড়িদের ভিড় তীল ধারনের জায়গা নেই। তারই মদ্ধ্যে এগিয়ে চলল শুখিয়া। দাশাই বলে ভিড়টা বেশি। হাতে চারশো টাকা, কাজেই বুদ্ধিমানের মত খরচটা করতে হবে। ম্যালের চড়াই পেড়িয়ে, সে পৌছল, অক্সফোর্ড স্টোরে যেখান থেকে সে তার নেশার সামগ্রী কিনবে। দোকানের কাছাকাছি পৌছে শুখিয়া দেখলো দোকানে বিশাল কুলুপ ঝুলছে। দেখে মনটা ভেঙ্গে গেল। কিন্তু কী কারণ? হঠাত করে বন্ধ। দুখু ভিখারি, বসে তার বাজনা বাজাচ্ছিল, শুখিয়া গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই, সে মুখ তুলএ বলল, দোকানের মালিক, দেওয়ানজি কাল রাত্তিরে হ্রিদ যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়, তাই আজ দোকান বন্ধ। ব্যর্থ হল দিনটা খবর টা নিতে পারলে এরম টা হত না, কিন্তু কি ভাবেই বা সে জানত এমন টা হবে। তা জাই হোক এত দূর যখন এসে পড়েছে, তখন গির্জাটা একবার ঘুরেই যেতে হয়। সেখানে গিয়ে শান্ত গির্জার ভিতরে বসে থাকবে সে। গির্জায় পাদ্রি ফাদার জন শুখিয়া কে বেশ স্নেহ করেন, তার কাছে বসে বাইবেলের গল্প শুনতে বেশ ভাল লাগে। হাটতে শুরু করল শুখিয়া।
গির্জায় গিয়ে দেখল বেশ কিছু পর্যটক গির্জার বাইরে ঘোরা ফেরা করছে। প্রত্যেকের গলা থেকে ঝুলছে ক্যামেরা। শুখিয়া গেট খুলে ঢুকতেই তারা ফিরে তাকাল। পাঁচ জন ছিল, সবাই শ্বেতাঙ্গ। শুখিয়া সবাই কে অগ্রাঝ্য করে, এগিয়ে গেল। পোড়টিকোর ধার ঘেঁষে ছোট দরজাটা খুলে সে ঢুকে গেল ভিতরে। গির্জার ভিতরটা শান্ত ও শীতল। হেটে গিয়ে সে বেঞ্চে বসল। চুপ চাপ বসে থেকে মায়ের কথা মনে পড়ল। গলা টা ভার হয়ে এল। চুপচাপ বসে খ্রীশটের মূর্তির দিকে তাকিয়ে ছিল। আজ দিন টা ভাল না, এক জনের মৃত্যু সংবাদ, দাদু হাস্পাতালে, সব মিলিয়ে এবারের দাশাই টা খুব ম্লান। এমনি পাহাড় কিছু বছর ধরে অশান্ত, তার কারণ অবশ্য জানে, তার বাবা তার সাঙ্গপাঙ্গ। কিন্তু শুখিয়ার সেই সব অশান্তি একদ্ম ভালো লাগে না। ফাদার জন কেও এরা হেনস্থা করতে ছাড়েনি। সাত কথা ভাবতে, মন টা আরো মলীন হতে থাকল। শুখিয়া খালি ভাবে এত সমস্যা কেন সব জায়গায়। এই বিশ্বের আনাচে কানাচে নানান জায়গায় আজ যুদ্ধ, কত লোক মরছে সেই যুদ্ধে, শুখিয়া খ্রীশটের দিকে তাকিয়ে চোখ বুঝে খানিক প্রার্থনা করল, সকলের মঙ্গলের জন্য। কখন যে ফাদার জন তার পিছনে এসে দাড়িয়েছে সে জানতে পাড়েনি। তিনি শুখিয়ার মাথায় হাত বোলাতেই, সে চোখ তুলে চাইল। ফাদার জন প্রৌঢ়, অশিতি পর, তার শান্ত মুখটা দেখলে, মনটা বেশ শান্ত হয়ে। ফাদার জন শুখিয়ার পাশে বসল।
-তুমি চুপ চাপ আজ দাশাই এর দিনে এখানে?
-মন ভাল নেই।
-কেন?
-দাদুর শরীর ভালো না, আর-
-আর?-আঁকার খাতা কিনতে পার নি তাই তো?
-তুমি কী করে জানলে?
অক্সফোর্ডের ফাদার জন মৃদু হেসে বললেন, যখন যার যাবার সে তখন যাবে, কেউ আটকাতে পাড়বে না , তাই নিয়ে মন খারাব করে লাভ নেই। বলে উনি উঠলেন, তুমি এখানে বস আমি এখুনি আসছি। বলে ফারদার জন ভিতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষন পরে তিনি এলেন, তার হাতে একটা কী যেন, শুখিয়া ঠিক দেখতে পেল না, গির্জার ভিতরের আলো আঁধারিতে। যখন তিনি কাছাকাছি এলেন, শুখিয়া দেখল, তার হাতে একটা আঁকার খাতা।