একটি আলাপ
একটি আলাপ


সন্ধ্যে নেমে আসা শহরে তখন ব্যস্ততা বাড়ি ফেরার, তারই মাঝে, শ্রীকান্ত পা রাখলো ফুতপাথে। ফুতপাথে তখন সদ্য অফিস ভাঙা শহরের ভিড়টা শুরু হয়েছে। শ্রীকান্ত কোন মতে ভিড় টা এড়িয়ে দু পা দূরে মুতষূদ্দীর দোকানে গিয়ে ঠাই নিলো। একে অফিস ভাঙা ভিড় তায়ে মহাপঞ্চমী, কাজেই শহরের রাস্তায় মানুষের ভিড় উত্তর উত্তর বাড়ছে। পুজো আর আগের মত নেই, ষষ্ঠী তে ঢাকের কাঠি পরবার আগেই, লোকে রাস্তায়ে ভিড় করতে শুরু করে। তা ছাড়া সরকার বাহাদুরে কৃপায় পুজো শুরু মহালয়া থেকেই। ব্যাপারটা মোটেই ভালো লাগে নি, শ্রীকান্তর। ভিড়, গাদা গাদি ব্যাপার টা কখনই ভাল লাগেনা তার, সে শান্তি প্রিয় মানুষ, পুজোর এই ডামাডোলে তার সময় কাটে নানান রকমের বই পড়ে। শ্রীকান্ত ক্যামাক স্ট্রীটে একটি ইন্সিওরেন্স কোম্পানী তে সামান্য ক্যারানীর পদে কাজ করে। অফিস থেকে ভুবার অফার করা সত্তেও সে কোন রকমের প্রোমোশান নিতে চায় নি। তার অবশ্য একটা কারন আছে। শ্রীকান্তের মতে, জীবনে অনেক অর্থ প্রতি পত্তির থেকে বেশি জরুরি হল, সুখ ও শান্তি। সে থাকেও একা একটি ফ্ল্যাটে, কলেজ স্ট্রীটের কাছে। মুতশুদ্দীর দোকান থেকে একটা এশো বিশ জড়দা দেওয়া পান ও এক প্যাকেট বিলাতি সিগারেট কিনে সে এগোতেই যাবে, এমন সময় পিছন থেকে কে যেন তার কাঁধে হাথ রাখলো। আচোমকা পা পিছলে গেলে যেমন একটা হ্যাচকা টান লাগে বুকে, তেমনি লাগল শ্রীকান্তর। সে দেখল, ছিপছিপে, সুদর্শনা একটি মেয়ে, তাকে ডাকছে। শ্রীকান্ত ভ্রু কুঞ্চিত করে মেয়েটির দিকে ফিরে তাকালো।
- আপনার মোবাইল ফোন টা একটু ব্যবহার করতে পারি?
- আমার মোবাইল?
এমনি তে চট করে কারো হাতে মোবাইল তুলে দেওয়ার পাত্র সে নয়। কিন্তু পুজো গন্ডার বাজার, তাই সে দিতে রাজি হল।
- হ্যা, নিশ্চই।
- থ্যাঙ্কস, আসলে আমার ফোন টার চার্জ শেষ হয়ে গেছে।
মেয়ে টা একটা নম্বর ডায়েল করে, ফোন তা কানে নিলো। শ্রীকান্ত সাবধানী লোক, সে মেয়ে টা কে চোখে চোখে রাখছে, কারন, দু মাস আগে ঠিক এই ভাবেই তার সাধের স্যামসাঙ্গের ফোন তা চুরি হয়ে গেছিল, তাই সে অনতী দূরে, একটি সিগারেট ধরিয়ে দাড়াল। নারী দের প্রতি দুর্বলতা হেতু, সে কোন আপত্তি করেনি। যদিও ব্যাপারটা কখনই সে প্রকাশ করে না, কিন্তু, তার যৌন বাসনা ভিষণ ভাবে প্রবল। হলে কি হবে, আজ অবদ্ধি, কোন মেয়ে বা মহিলার সাথে, সে ঠিক মত আলাপ জমাতে পারে নি, তাই বাসনা বাসনাই রয়ে গেছে। বাড়ির লোক জন ধোরে বেঁধে একবার বিয়ে দেবার কথা তুলেছিল, কিন্তু শ্রীকান্তই, ঝামেলা করে সেই বিয়ে ভেস্তে দেয়। তার বক্তব্য ছিল যে প্রেম না হলে বিবাহের কোন সাফল্য নেই।
মেয়েটির চেহারা চোখে পড়ার মত। পড়নে তার, টাইট লাল হাতা কাটা টিশার্ট আর টাইট ডেনিম জীন্স। মেয়েটি কে দেখতে কেমন একটা ঘোর মত লেগেছিল শ্রীকান্তর।
- এই নিন আপনার ফোন টা।
হঠাৎ ঘোর ভাঙলে যেমন হয়ে, সেই দশাই হল, শ্রীকান্তর।
- কথা হয়ে গেল?
- হ্যা, কিন্তু সমস্যা হল, আমার যে বন্ধুটির আসার কথা ছিল, সে কলেগ স্ট্রীটে দাঁড়াবে, তাই ভাবছি কী করি।
- সমস্যা না হলে আমি তোমাকে কলেজ স্ট্রিটে নামিয়ে দিতে পারি।
- আপনি? না না আপনি আবার কেন।
- আমার কোন অসুবিধে হবে না, আমি কলেজ স্ট্রীটেই থাকি, তা ছাড়া আমার গাড়িও আছে।
মেয়েটি রাজি না হয়ে পারলো না। আর সত্যিই তো কি সের অসুবিধে, এই একাকিত্তের জীবনে, হঠাৎ আচমকা চাঞ্চল্য কার না ভাল লাগে?
তখন রাস্তায় বেশ লম্বা একটা ট্রাফিক জ্যামে গাড়ি নিয়ে শ্রীকান্ত দাঁড়িয়ে, সাথে তার সেই আগুন্তুক। আগুন্তুকের নাম অনামিকা। জ্যামে দাড়িয়ে বেশ আড্ডা জমে উঠেছিল অনামিকা ও শ্রীকান্তর। অনামিকার বয়স একুশ বছর, থাকে দক্ষীন কলকাতার যাদবপুর অঞ্চলে, তার আসল বাড়ি শিলিগুরি তে। পুজোর সময়ে শহরের রং তা বোদলে যায়, নানা রঙের পান্ডেল, নানা রঙের জামা, নানান রঙের আলো। কিন্তু আজ শ্রীকান্তর মনের রং টা লাল। এরম একটা ঘটনা ও যে ঘটতে পারে এটা সে কষ্মীন কালেও ভাবে নি। বেশ স্বপ্নিল একটা পরিবেশ ছিল কিন্তু সেটা ভাঙল পিছনের গাড়ি গুলোর হর্নে।
- আচ্ছা, এরম অবলীলায় একটা মেয়ে কে যে গাড়িতে তুলে নিলেন, ভয় করলনা আপনার?
- ভয়? ভয় কি সের?
- না মানে আজ কাল যা দিন কাল, তাতে পান থেকে চুন খসলেই মেয়েরা যেমন মাতা মাতি করতে শুরু করেছে, তাতে পুরুষদের পক্ষে মেয়ে দের ওপর বিশ্বাস রাখাও ক্টহিন হয়ে যাচ্ছে।
- তা ঠিক। কিন্তু পুরুষদের ও তো দোষ আছে।
- তা আমরা আপনার বাড়িতে যাচ্ছি তো?
- বাড়ি? তুমি তো টমার বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলে।
- আপনি তো বড্ড সরল, এত টা ভাবিনি।
- তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছিনা আমি।
- পুজোর দিনে একটা মেয়ে আপনার গাড়িতে নির্দ্বিধায় উঠে বসল, এটা আপনার খুব নর্মাল লাগছে?
এই কথাটার জন্য মটেই প্রস্তুত ছিল না শ্রীকান্ত। গুলির মত ছিটকে বেরল কথা গুল অনামিকার মুখ থেকে। শ্রীকান্ত নিজের কান কেই বিশ্বাস করতে পারল না। ততক্ষনে টাইট জীন্সের পকেট থেকে আক্টা সিগারেট বার করে ধরাল অনামিকা। অনেক শাহস করে কথা বলল শ্রীকান্ত।
- তা তুমি এই প্রফেশনে এলে কি করে?
- কোন প্রফেশনে?
বাইরে প্রচুর আওয়াজ, তাই ঠিক মত কথা টা শুনতে পায় নি অনামিকা।
- এই মানে, আর কি
- বেশ্যা বৃত্তি করছি কবে থেকে?
- হ্যা ওই আর কি
- আরে না না, আমি সেরম বেশ্যা নই। আমি একটু অন্য ধনের। সেক্স ব্যাপারটা আমার বেশ অদ্ভুত লাগে, কিন্তু জীবনে শুধু এক জনের সাথেই সেক্স করবো ভাব্লে মনে হয়ে সেক্স ব্যাপারটার সাথে সঠিক জাস্টিস করা হল না। তাছাড়া বাড়িতে বসে বোড় হচ্ছিলাম, তাই ভাব্লাম বেড়িয়ে পড়ি, মজা ও হল চারটি টাকা ও আমদানী হল ক্ষতি কি।
পুর ব্যাপার টা শুনে মুষড়ে পড়ল শ্রীকান্ত। যদিও একবার তার মাথা তে এসেও ছিল এই কথা যে নিতান্তই এটা তার ভাগ্য না অন্য কিছু যে একটা যুবতী নির্দ্বিধায় তার গাড়ি চড়তে রাজি হয়ে গেল।
- তা টাকা পয়শার কথা টা হোক? না কি আমাকে কোথাও নামিয়ে দেবেন।
- না বরং আমার বারিতেই চল।
কেমন একটা মোহের মদ্ধ্যে বইতে লাগল সময় টা। শ্রীকান্তর কাছে এটা পুরো পুরি একটা নতুন অভিজ্ঞতা। এর আগে কখনই কোন লিবারাল মেয়ের সংস্পর্শে সে আসেনি। অত্যন্ত্য অর্থডক্স পরিবারে তার জন্ম। তাই এই অদ্ভুত কথোপকথনের পড়ে তার একটু, নিশ্বাসের প্রয়োজন ছিল। শ্রীকান্ত ও একটি সিগারেট ধরাল। তবে নানা রকমের প্রশ্ন এসে ভিড় করতে লাগল তার মনে। এত দিন সে আছে তার ফ্ল্যাটে কিন্তু কোন দিন, সে এরকম কিছু করেনি, এটাও ঠিক যে তার কাছে সুজোগ আসেনি। সাত কথা ভাবতে পুজোর ভিড় কাটিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে শ্রীকান্তর নীল আয়ম্বাস্যাডর।
- আচ্ছা আপনি সোনাগাছি গেছেন?
- না, কেন বল তো?
- আমারও যাওয়া হয়নি।
- ছাড়িয়ে এলাম তো।
- এখন কে যাবে, কখনো যাব। আচ্ছা আপনি বিবাহিত?
- না
- কেন? আপনার তো বয়স ভালই।
- কাউকে ভালোবেসে উঠতে পারিনি তাই।
অনামিকা হাস্তে লাগল।
- হাসছো যে?
- আপনার মত লোকজন ভাবনা চিন্তা করতে শুরু করলে এ দেশের অনেক কল্যান হবে।
- তোমার অদ্ভুত মনে হয়েনি কখনো?
- কেন?
- আমার মনে হয়ে প্রেম ছাড়া যৌনতা ক্লীব, অসম্পূর্ণ।
কথা টা নতুন নয় কিন্তু এই ভাবে কেউ অনামিকা কে বলেনি। গাড়িটা এবার একটা গলির মদ্ধ্যে ঢুকল। উওর কলকাতার গলি, এঁকে বেঁকে চলল, শ্রীকান্তর নীল আয়ম্বাসাডর। অবশেষে, একটা চার তলা উচু ফ্ল্যাতের সামনে এসে, গাড়ি টা থামাল শ্রীকান্ত। হর্ন দিতেই, চৌকিদার এসে গেট খুলে দিল আর শ্রীকান্ত গাড়ি টাকে পাড়কিং এ ঢুকিয়ে দিল। শ্রীকান্ত একবার চৌকিদারের দিকে তাকাল, দেখল সেও শ্রীকান্তকে নিরীক্ষণ করছে। একটু বিরক্তই হল সে। যাই হক, গাড়ি থেকে নামে ওপাশে অনামিকার দিকের দরজাটা স্বসম্মানে খুলে দিল সে।
ফ্ল্যাটের দরজা খুলতেই একটা অন্য জগৎ ধরা দিল অনামিকার চোখের সামনে। শ্রীকান্তর ফ্ল্যাটের বৈঠক খানা টা বেশ বড়, মেঝের ওপোরে একটা বড় জাজিম পাতা রয়েছে। চতুর্দিকে ছোট বড় নানান ধরনের বাতি দিয়ে ঘরটা সজ্জিত। ঘরটার অধিকাংশ জায়গা জুড়ে রয়েছে প্রচুর বই। অনামিকা সেখানেই কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে, পুর ঘরটা ভাল করে দেখছে। এতো বই একসাথে সে কোথাও দেখেনি সে, মনে পড়ে গেল তার স্কুলের লাইব্রেরি, সেখানে এতো বই সে দেখেছে, কিন্তু কারো বাড়িতে মনে পরে না।
- তুমি বসো আমি একটু পাশের ঘর থেকে আসছি।
শ্রীকান্ত পাশের ঘরে চলে গেল আর অনামিকা, বসে নিরীক্ষ্ণ করতে লাগল। প্রচুর পুরুষের সাথে তার সাক্ষাত ঘটেছে, তাদের মদ্ধ্যে অধিকানশই খারাব ছিল, কিন্তু শ্রিকান্ত্র মত পুরুষের সানিদ্ধ সে আগে কখনো পায়নি। অনামিকা দেখল নানান ধরনের বই সেখানে সাজানো, জীবণী থেকে শুরু করে খেলা ধুলো, কব্রেজি, বিভিন্ন ধরনের এন্সাইক্লোপেডিয়া প্রভৃতি রকমের বই এ ঠাসা। অনামিকা অবাক হয়ে ভাবতে থাকে, যে এতো বই পড়া একটা মানুষ এত সাধারণ জীবন যাপন করে কি করে। তবে সাধারন হলেও, একটা অসাধারনত্তের ছোঁয়া আছে সারা বাড়িতে।
- কেমন লাগছে?
পিছনে ফিরে অনামিকা দেখল, শ্রীকান্ত এসে দাড়িয়েছে। গালের খোচা খোচা দাড়ি গুল নেই তার মুখে। দাড়ি ছাড়া যে কোন পুরুষ মানুষ কেই অন্য রকম দেখতে লাগে।
- আপনি ফ্রেশ হয়ে এলেন?
- হ্যা।
- এতো বই সব আপনার?
- হ্যা।
- সব কেনা?
- কিছু কেনা, কিছু পাওয়া আর কিছু চুড়ি করা।
- চুড়ি?
- কেন?
মানে চুড়ির করার মত এতো কিছু থাকতে, বই।
- বই ব্যাপারটা নিয়ে আমি বেশ স্পড়শকাতর, তাই ভালো বই দেখলে ঝেপে দেই।
- না- ইন্টারেটিং। এতো ক্যানভাস, এ গুলো ও তোমার?
- হ্যা, আকাআকি করার অভ্যাসও আছে।
- তাও তুমি একা?
- এবার এ ফ্রেশ হয়ে এসো।
অনামিকা মন্ত্র মুগদ্ধের মত, শাবান আর তোয়ালে টা নিয়ে স্নান ঘরে চলে গেল। স্নান ঘরে ঢুকেও চমক লাগল অনামিকার। খুব সুন্দর ভাবে সাজানো, স্নান ঘরের শেষে একটা বাথটাব, তাতে জলের ওপর ছড়ানো গলাপের পাপড়ি। নিজেকে অনাবৃত করে শীতল সলিলে প্রবেশ করল, করতে করতে কেমন যেন তার শ্রীকান্ত কে খুব ভালো লেগে গেছে। মিনি্ট তিরিশ পরে স্নান ঘর থেকে তোয়ালে পড়ে বেড়িয়ে এলো, অনামিকা। অল্প হলুদ আলোয়ে, ভীষণ মিষ্টি দেখাচ্ছিল তাকে। তাকে দেখে উঠে দাঁড়াল শ্রীকান্ত, এবং তারা এঁকে অপরের প্রতি এগিয়ে আস্তে থাকল। এরপর টা ইতিহাস। সারা কলকাতা যখন ভিড় করছে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে, তখন সেই শহরেরই এক কোনে নতুন একটা সম্পর্ক গড়ে উঠলো নিভ্রিতে।
____________