প্রেম এসেছিল নীরবেই
প্রেম এসেছিল নীরবেই
বাইরে থেকে অনেকদিন হল তাপস ফিরেছে, কিন্তু আমরা বন্ধুরা এখন সবাই কর্মব্যস্ত জীবনে সময় পাই না। ওই ফোনেই কথা চলে মাঝে মধ্যে। এবারে সবাই মিলে একটা জটলা করব ঠিক হল। অনেকগুলো ছুটির দিন বাতিল হবার পর এই রবিবার ঠিক হল তাপসের বাড়ি আড্ডাটা হবে। ওর বাড়ি দুটো সুবিধে, বেচেলার আর বাড়িতে আর কেউ নেই, ওর বাড়িটা আমাদের সবার বাড়ির মিডিলে ফলে কারোরই বেশি দূর হবে না। আমাদের স্বল্পবাক শিল্পী বন্ধুটি সানন্দে রাজী হল। দুপুরে দোকান থেকে আনানো ফাটাফাটি চাইনিজ খেয়ে আরাম করে বসে আরম্ভ হল গল্পগাছা। বসন্তের অলস দুপুর, কৃষ্ণচূড়া লালে লাল অতএব শুরু হল বর্তমান অথবা ফেলে আসা প্রেমের গল্প।
সবার কথাই সবাই বলল, এখানে শুধু আমরা হরিহর আত্মা বন্ধুরা, নির্দ্বিধায় মনের কথা বলতে পারি কেউ আর জানবে না। কিছু কথা থাকে খারাপ না হলেও কাউকে জানাতে ভালো লাগে না। সবার শেষে আমরা তাপসকে বললাম, "এই যে ঋষি মহাশয় তাপস, আপনার জীবনে কি প্রেম-ট্রেম একবারও আসেনি? দেশে কিংবা বিদেশে। কোনদিন ও তো মনের কথা বলিসনি! তোর ব্য্যাপারখানা কি?" ফাজিল ঋদ্ধি বলল "মেশিনপত্রে গন্ডোগোল।" সবাই হেসে উঠল। তাপসও হেসে উঠল, ও একটা ছবি আঁকছিল। তুলিটা রেখে বলল "একবার নয় রে প্রেম বারবার আমায় ধাক্কিয়েছে|" আমরা সমস্বরে বললাম "বলিস কি রে!!" তাপস হেসে বলল " শুধু একবার প্রেম পথ ভুলে আসে নি। " "বল বল শুনি"। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল তাপস, তারপর বলল " দ্যাখ আমি তোদের সব্বাইকেই ভালোবাসি কিন্তু আমি ঠিক মন খুলে কাউকে সব কথা বলতে পারি না। মাত্র দুজনকে আমি মনের কথা বলতাম আমার পলাশ স্যার,যে ছোট থেকে আমায় পড়াচ্ছে, অথচ বন্ধুর মত আর আমাদের পাশের বাড়ির ডরোথি আন্টির মেয়ে লিজা।"
আমরা লিজাকে চিনতাম, তাপসের মা বেঁচেছিলেন যখন তখন প্রায়ই নিমন্ত্রণ করতেন আমাদের, খুব যেতাম ওদের বাড়ি। ওখানেই দেখেছি লিজাকে, সাদা হ্যাঁসহেঁসে ফরসা, কেমন নি:স্প্রাণ দৃষ্টি, খুব অমিশুক। গলায় একটা মোটা চেন তাতে ঢাউস একটা পানের মত বক্স লকেট, ওই যাতে ঠাকুর দেবতার ছবি টবি থাকে, বুড়িদের মত। সেবয়সে অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা পাশাপাশি এলেই একটা নিজেদের মধ্যে কৌতূহল বা আকর্ষণ বোধ করে। না আমরা, না লিজা কেউই এধরনের টাঁক অনুভব করিনি। ও আমাদের বয়সীই ছিল। তবে তাপস আর কাকিমাকে মেয়েটা খুব ভালোবাসত। কাকিমা খুব কোমল মনের মানুষ ছিলেন। তাপস বলল " হ্যাঁ, মা লিজাকে খুব ভালোবাসত, ওর যখন সাতবছর বয়স তখন ওর এক কাকা ওকে....... মেয়েটা ভয়ে আতঙ্কে পাথর হয়ে গিয়েছিল, ডরোথী আন্টি সব সম্পর্ক ত্যাগ করে বাপ মরা মেয়েটাকে নিয়ে এ পাড়ায় উঠে এসেছিলেন। এ সব কথা কেউ কোনদিন জানত না আন্টি শুধু মাকে বলছিলেন। যাইহোক আমি প্রথম প্রেমে পড়ি আমার দিদির বিয়ের সময়।" হাসি ফুটে উঠল তাপসের মুখে, "সে কি ভালোলাগা, দিদি তেরা দেবর দিওয়ানা রিং টোন ওর মোবাইলে, আমার তখন মোবাইল ছিল না। সারাক্ষণ ওর কথা ভাবা, ছবি এঁকে পাতা ভড়ল। তারপর মাস তিনেক খুব দিদির বাড়ি যেতে আসতে লাগলাম, কিন্তু তারপর দেওয়া নেওয়া তত্ত্বতাবাশ নিয়ে অশান্তি লাগল, জামাইবাবুর চেম্বার করে দেবার জন্য ওরা দিদিকে চাপ দিতে লাগল, শেষে অত্যাচার। বিয়ে ভেঙে গেল, সম্পর্ক ও।
পলাশদা আর লিজা বলছিল ওরকম যাদের মন তাদের সাথে আর কোন রিলেশান না থাকাই ভালো।
দ্বিতীয় বার প্রেমে পড়লাম সেঁজুতির। ওকে তো সব্বাই চিনিস, আমাদের কলেজে পড়ত, ফাটাফাটি দেখতে। মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি, ডজনখানেক উৎকৃষ্ট কবিতাও লিখেছিলাম। ও দেখা হলেই কি সুন্দর করে হাসত। বলব বলব ভাবছি এমন সময় একদিন ও নিজেই এগিয়ে এসে হাতে একটা চিঠি দিল। " আমরা বললাম "তাই"? ও হেসে বলল " হ্যাঁ, তবে নিমন্ত্রনের চিঠি, এক ইংরাজি প্রফেসরের সাথে ওর বিয়ে। তোদের দু একজনকেও তো বলেছিল কিন্তু আমায় কেন বলল কে জানে? আলাপ তো ছিল না!"
অন্যমনস্কের মত তাপস চুপ করে গেল। তারপরে নিশ্বাস ফেলে বলল "কি ভাবছিস এর পরে আর প্রেমে পড়া উচিৎ ছিল না? কিন্তু আবার পড়লাম। শ্রীলা সাথে একটা প্রদর্শনী করেছিলাম মনে আছে তোদের? এবার অবশ্য আমি এগিয়ে যাই নি, ওই নিজে এগিয়ে এসেছিল। ভিষণ স্বাধীনচেতা, স্মার্ট, হাসিখুশি, সংস্কারমুক্ত মনের মেয়ে ছিল। ওর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল,রোজ আমার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা চলত এরপর দিল্লীতে একটা আর চেন্নাইতে একটা একজিবিশন হবে সেখানে আমরা অংশ নেব। ব্যাপারটা একটু চাপের ছিল, বেশ ধরা কওয়ার ব্যাপার ছিল। আমরা দুজনেই খুব ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম। অনেক কাছাকাছি চলে এসেছিলাম তবুও আমি কিছু বলিনি, ওই প্রথম এগিয়ে এসেছিল, যেদিন চেন্নাইয়ের ব্যাপারটা ফাইনাল হল সেদিন ও আমায় প্রথম আচমকা চুমু খেয়েছিল। তারপর যা হয়.... আমি ভাসলাম...।পলাশ স্যার কে সব খোলাখুলি বলিনি, লিজাকে বলেছিলাম মন খুলে। জানতাম ও ঠাট্টা করবে না, ও খুব অনুভূতি প্রবণ ছিল। ও মাথা নিচু করে সবটা শুনেছিল, ওর রক্তশূন্য মুখটা খুশিতে গোলাপী হয়ে গিয়েছিল। তারপর বলছিল দেরী করো না, চেন্নাই থেকে ফিরে এসেই কাকীমাকে বলে সেট করে ফেল জীবনটা। রোগাভোগা মেয়েটা আমায় লেট লতিফ বলত। রোজই জ্বরে ভুগত। চেন্নাই থেকে ফিরে এসে আর ওকে কথাটা তখন জানাতে পারিনি, আন্টি তখন ওকে নিয়ে খুব ব্যস্ত, ওর এই রক্তহীনতা জ্বরটা ডাক্তাররা খারাপ কিছু বলে সন্দেহ করছেন। তাই ওকে বলা হয় নি শ্রীলা চেন্নাইতেই থেকে গিয়েছিল অভীকের সাথে, অভীক আর ও প্যারিস যাবে ওখানে একটা সুযোগ করে দিতে পারবে অভীক। যাবার আগে আমায় চুমু খেয়ে শ্রীলা বলেছিল আমি ওর সবচেয়ে লাকি ফ্রেন্ড। আমি কিছু বলতে পারিনি, লজ্জায় গুটিয়ে গিয়েছিলাম, আমার সংকীর্ণ মানসিকতায় আমি বন্ধুত্বটাই বুঝিনি, ভালোবাসা বলে ভুল করেছি। খুব একা আর বোকা লাগত তখন জানিস। কাউকে বলতেও পারতাম না।
আর বলব কাকেই বা,লিজার লিউকোমিয়া ধরা পরেছে, কবে যে এতটা বাড়াবাড়ি হল তা জানতেও পারিনি কেউ। ছোটাছুটি শুরু করলাম, ডরোথি আন্টির আমরা ছাড়া তো কেউ ছিল না। উনি হসপিটালের নার্স ছিলেন। একদম ভেঙে পড়েছিলেন। আমায় খুব ভালোবাসতেন, এবার পুরোপুরি নির্ভর করতে শুরু করলেন। বললেন " আর তো সময় নেই তপু, যে কটাদিন আছে তুমি ওর সঙ্গে থাক, তুমি ছাড়া ওর তো কোন আপনজন নেই, মনের কথা ও কোনদিনই কাউকে বলবে না তবে তুমি পাশে থাকলে ও শান্তি পাবে। ওকে শেষের দিকে বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম, ওর কাছেই বেশিক্ষণ থাকতাম। মাও থাকত। ও জিজ্ঞাসা করেছিল শ্রীলার কথা, আমি সত্যিটা বলতে পারিনি, ও হয়ত ব্যথা পাবে। " তাপস থেমে থাকল কিছুক্ষণ তারপর বলল "তোরা বস একটু চা আনি। " তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে গেল, আমরা চুপ করে বসে রইলাম, কখন কখন নিস্তব্ধতা ও অনেক কথা বলে। তাপস চা নিয়ে এল,বলল " ও খুব আগ্রহী চোখে তাকিয়েছিল আমার চোখের দিকে, চোখ নামিয়ে জানিয়েছিলাম ও প্যারিস থেকে এলে ফাইনাল করব। ও অনেকক্ষণ তাকিয়েছিল আমার দিকে, তারপর মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলেছিল ও একটা গিফট রেখেছে আমার বিয়ের জন্য। জানতাম এই নিয়ে ভাবার কিছু নেই, লিজা দুদিনের অতিথি। ডাক্তারির অত শক্ত কথার মানে না বুঝলেও মোদ্দা কথাটা এটাই বুঝেছিলাম। এক এমনি বসন্ত সন্ধ্যায় ও চলে গেল। "
আমাদের ঘরেও অন্ধকার নেমে এসেছিল। তাপস বলল " আলোটা আর জ্বালালাম না রে অন্ধকারটাই ভালো লাগছে। ডরোথি আন্টি চাকরী ছেড়ে চার্চের এক সেবা প্রতিষ্ঠানে চলে গেলেন। যাবার আগে আমায় দুটো জিনিস দিয়ে গেলেন, একটা সোনার আঙটি, আর সেই রূপোর লম্বা চেনটা ঢাউস লকেট দেওয়া। এমনই আধো অন্ধকার ঘরে আন্টি বলেছিলেন "এটা আমি বিয়ের সময় তোমার আঙ্কলকে পরিয়ে দিয়েছিলাম। সে চলে যাবার পর লিজাকে দিয়েছিলাম যদি কখন লিজার বিয়ে হয় তবে তার হাসব্যান্ডকে দেবে। দুর্ভাগা মেয়েটা আমার, বিয়ের কথা ভাবতেই পারে নি, আমায় বলে গেছে এটা তোমায় দিতে, তুমি বিয়ের সময় পরো। ওর আত্মা শান্তি পাবে। আমার একটাই সান্ত্বনা শেষ কটা মাস তুমি সবসময় ওর পাশে ছিল, মেয়েটার জীবনের এই চাওয়াটুকু অন্তত পূর্ণ হয়েছিল। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। " আন্টি চলে যাবার পর স্তব্দ হয়ে বসেছিলাম আমি কি সত্যিই লেট লতিফ, কিছু কি কথা ছিল যাআমার বোঝার ছিল বুঝিনি! আঙটিটা হাতে পরলাম, আলো জ্বেলে হারটা হাতে তুলে নাড়াচাড়া করতে লাগলাম, ভাবলাম হার তো আমি পরি না, যীশুর লকেটটা আমার মানিব্যাগে রাখব, বুকের কাছাকাছি থাকবে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী প্রিয় বান্ধবীর ব্যবহৃত জিনিষটা কিন্তু লকেটটা আমি রাখতে পারলাম না, শুধু চেনটা গলায় পরে নিলাম।
হৃষি বলল "কেন? " ধরা গলায় তাপস বলল " ছবিটা যে আমারই ছিল। তাই বলছি বারেবারে প্রেম এলেও শেষকালে পথ ভুল করেছিল।। "