ওরা সুখে আছে
ওরা সুখে আছে
হ্যাঁ শুনলে সবাই অবাক হবে কিন্তু ওরা ভালো আছে। আগে স্টেশনে থাকত তিনফু, এখন খালপাড়ে প্ল্যাস্টিকের ছাদ আর দর্মার বেড়া দেওয়া ঘর বানিয়েছে। সত্যিকারের ঘর! স্টোভ আছে হাঁড়িকুড়ি, ছুরি, হাতাখুন্তি, প্ল্যাস্টিকের বালতি সব আছে। মায় কাঠের প্যাকিংবাক্সের একটা কাঁথা বিছানো বিছানা পর্যন্ত। আর এই ঘর হয়েছে যবে থেকে নিমুকে বিয়ে করেছে তিনফু, তার ঘরণী এসেছে। বিয়ে অবশ্য শনিঠাকুরের সামনে মালাবদল করে হয়েছে। ঠিক স্টেশনের বাইরে ওই মন্দিরটাই আছে কিনা। শনিবারে প্রচুর মালা ধূপ পূজো পড়ে।তাই দিয়েই চাওয়ালা বিনু, ঝাড়ুদারনি ফুলি,জুতো পালিশ ওয়ালা শাহজাহান দাঁড়িয়ে থেকে অপরাজিতার মালাবদল করিয়ে বিয়ে দিয়েছে। ফুলি আবার একটা কাপড় দিয়েছে। বিনু সবাইকে পাঁউরুটি আলুরদম খাইয়েছে। তিনফু আর নিমুর বিয়ে হয়েছে।
না না, এরা কোন চীনা জাপানি পরিবার নয়। বরং একদমই চেনা, স্টেশনে ভিক্ষে করা তিনফুটিয়া, যাকে তার পরিবার বছর পাঁচেক বয়সে স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল। ভালো কথা বলতে পারত না, নাকে নাকে কথা বলত। বাড়ির ঠিকানা জানত না। তিনফু শুধু জানত মা মরেছে পনেরো দিন হল। বাপ যাকে সবাই ভক্তদাস বলে ডাকত, সে দুচোক্ষে দেখতে পারত না তিনফুকে, খুব মারত, সে নামিয়ে দিয়ে গেছে তাকে। ট্রেনে অনেক দূর থেকে সে এসেছিল । তারপর থেকে আস্তে আস্তে কিন্তু নিজে নিজেই বড় হয়েছে। কিভাবে বড় হয়েছে তা বলা মুশকিল। স্টেশনে এক পাগলি থাকত সে খুব ভালবাসত। তিনফু তার কাছেই থাকতো বেশিক্ষণ। ভিক্ষা করতে করতে একদিন বড় হয়ে গেল। বড় হয়ে গেল বলতে বয়সেই বড় হল। চেহারার সর্বসাকুল্যে তিন ফুটের কাছাকাছি ছিল। একদিন তার পাগলি মা রেলে কাটা পড়ল। খুব কাঁদল তিনফু। যে সব যাত্রীরা খুব পিছনে লাগত তারাই প্রচুর ভিক্ষা দিয়ে সাহায্য করেছিল। পুলিশ শুনেছিল খুব বজ্জাত হয় কিন্তু তারাও সাহায্য করেছিল।চেরাইঘর থেকে মরা বার করতে ঝামেলা হয় নি, ডোমও আলাদা করে যে টাকা নেয় তা নেয় নি। ভ্যানওয়ালা এমনিই মরা বয়েছিল। এই বড় সাইজের ছোটলোকেরা তার খুব উপকার করেছিল। মুখাগ্নি করেছিল তিনফু। তারপর একার জীবন।
এমন সময় একদিন নিমুর সাথে দেখা। রেললাইনের ধারে ঘুরে বেড়ানোটা তার একটা নেশার মত ছিল। অনেক অনেক দূর চলে যেত সে, এই পথেই একদিন তার বাবা তাকে এনে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, এই লাইনেই তার যশোদা মা মরেছিল। পড়াশোনা না জানলেও ট্যাঁপাদার টিস্টলের ছোট টিভিতে সে রামায়ণ, মহাভারত আর সিরিয়াল দেখেছে সে অনেক। ট্যাঁপাদার ফাইফরমাশ খাটত। ট্যাঁপাদা লোক ভালো, ওই টিভি দেখার মস্ত সুখ।
সেই সময় একটা ঘটনা ঘটল। সে হাঁটছে আপন মনে। এমন সময় একটা মেয়ে হঠাৎ তার থেকে একটু দূরে লাইনের পাশের ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালো লাইনের উপর। তারপর লাইন ধরে হাঁটতে লাগল হনহন করে। অস্বাভাবিক হাঁটা। মেয়েটা বিশাল লম্বা, বেটাছেলেদের মতো। তার মতলব ভালো নয়। এটা সে বুঝল। এই লাইনে ট্রেন আসছে। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে হাঁটছে মাঝে মাঝেই সে হাতের তালু দিয়ে মুখ মুছে নিচ্ছে। তার মুখটা অবশ্য দেখতে পেল না। সে তাড়াতাড়ি হাঁটছে অদ্ভুত চলাফেরা কেমন ঘোড়ার মতো। ছুটতে লাগলো তার পিছনে তিনফু, তার
ছোট ছোট পা বেশি দ্রুত দৌড়াতে পারে না। সে বুঝলো ডাকলে মেয়েটা শুনবে না। একমাত্র উপায় ছুটে গিয়ে মেয়েটাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া। তা না হলে কাটা পড়বে। তার মার কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে গেল। ট্রেন এসে যাচ্ছে। ছুটে এসে মেয়েটার হাঁটুতে ধাক্কা মারল তিনফু। তার গায়ে তত জোর ছিল না। মেয়েটা অন্যমনস্ক না থাকলে আর তিনফু আচমকা জোরে ধাক্কা না দিলে, মেয়েটাকে সরানো সম্ভব হত না। দুজনেই মরত তেমন হলে। কিন্তু দুজনেই পড়ে গেল পাশের ঝোপে, তাদের পাশ দিয়ে ট্রেনটা বেরিয়ে গেল ঝড়ের মতো হুহু করে।
মেয়েটা খানিকক্ষণ পড়ে রইল মরার মত তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে।" কেন বাঁচালে আমাকে? তোমার কি দরকার ছিল আমাকে ধাক্কা দেবার? " তিনফুও সতেজে জবাব দিল " কেন মরতে যাচ্ছিলে? আমায় তাকিয়ে দেখো দেখ। আমার চেহারা দেখে হাসে সকলে, আমাকে ফেলে দিয়ে চলে গেছে কত ছোট বয়সে আমার বাবা, আমি তো মরতে যায় নি, আমি তো লড়ে যাচ্ছি। জীবনে তোমার কি কষ্ট তা আমি জানি না কিন্তু তাও একটা সুস্থ শরীর আছে সেটা তো চোখের সামনে দেখতেই পাচ্ছি। জীবন এত সস্তা নয়। "মেয়েটা থমকালো যেন, ছোট্ট চেহারার বড় মানুষটার দিকে তাকাল। তিনফু দেখল বাঁশের মতো লম্বা, রোগা কালো একটা চ্যাপ্টা গোছের মেয়ে। নারী বলে বোঝা যায় না তাকে দেখলে।
নমিতা অনাথ, জেঠির ঘরে আপদবালাই বেড়ে ওঠা অলক্ষ্মী একটা পুরুষালি চেহারার মেয়ে, যাকে নিমু বলে ডাকত সবাই। পাঁঁচবছর থেকেই জেঠীর সংসারের বিনি মাইনের ঝি। বড় হতে সবাই বলত, ওর নাম নমিতা নয় নিমাই, অর্থপূর্ণ কুৎসিত হাসত সবাই।অত্যাচার, খাটুনি সয়েই ছিল কিন্তু এবার জাঠতুতো দিদির বিয়ের সময় বেটাছেলেদের আড্ডায় চা দিয়ে আসতে গেলে জামাইবাবু, ভাই,একগাদা বেটাছেলেদের মাঝে সবার সামনে টান মেরে জামা খুলে দিয়েছে তার মাতাল দাদা আর সবাই উৎসাহ দিয়ে বলেছে সায়াটাও খুলে দেখতে মেয়ে না ছেলে! রাগে দুঃখে গরম চায়ের কেটলি তুলে দাদার মাথায় মেরে সে পালিয়েছে এই আপদ জীবন সে রাখবে না, এত অপমান, অবিচার,অত্যাচার সে আর সইবে না। তাই...
না ওরা কেউ মরে নি। একে অপরকে নিয়ে ঘর বেঁধেছে।স্টেশনের ধারে মস্ত হনুমানজীর মন্দির। সেখানে এখন তিনফু ভক্তদের জুতো জমা রাখে। শনি মঙ্গলবার ভালো পয়সা। নিমু মস্ত ফ্ল্যাট বাড়িতে কমন সিঁড়ি ঝাঁট দেওয়া মোছা করে। তারও ভালো ইনকাম। এখন ও অনেকেই তাদের বেখাপ্পা জোরী নিয়ে হাসে, অশ্লীল ইঙ্গিত করে কিন্তু তারা পরম সুখী । সারাদিনের কাজের ফাঁকে তারা ঠোঙা তৈরি করে, দোকানে দেয়। আর ট্রেনের আনাগোনা দেখে, গুজগুজ গল্প করে। ভবিষ্যৎ প্ল্যান করে। "প্ল্যাসটিক পলিথিন আর চলবে না, ঠোঙার দাম বাড়বে দেখবে। পয়সা ভালোই আসবে। কিছু জমাতে হবে তো । "নিমুকে বলে তিনফু "জীবন কত সুন্দর বল, মরে গেলে আর পেতে এমন সুন্দর জীবন? জীবন অনেক কষ্টে পাওয়া তাকে হেলায় হারাতে আছে? " নিমু তার মোটা পুরুষালি গলায় বলে " এমন কথা বলা তুমি কেমন করে শিখলে গো। আমার মতোই তো ইস্কুলে পড় নি। " নরম মিহি গলায় তিনফু বলে " ট্যাঁপাদার দোকানে টিভি দেখে দেখে। হিরোরা বলে যে। তবে বড় সুন্দর কথা।সত্য কথা। সুন্দর সত্যি।"