(Writer) Mr. SANDIPAN SAHA

Drama Fantasy Thriller

4.0  

(Writer) Mr. SANDIPAN SAHA

Drama Fantasy Thriller

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা অমরনাথ

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা অমরনাথ

11 mins
320



 প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা অমরনাথ ধাম হিন্দুদের কাছে তীর্থক্ষেত্র হলেও সব ধর্মের মানুষের কাছেই ভ্রমণের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে । অমরনাথ ধাম এমন একটি জায়গায় অবস্থিত যে ভারতবর্ষে তো বটেই পৃথিবীর বহু দেশ থেকেই বহুলোক এই ধামের তুষারলিঙ্গ দেখতে এবং সেইসঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে জড়ো হয় । ভারতবর্ষে আর কোথাও এমন ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা গুহা মন্দির আছে বলে আমার জানা নেই। যুগ-যুগ ধরে বহু মানুষের সমাগম হয়ে আসছে এই ধামে। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই গুহা-মন্দির দর্শনের সুযোগ পাওয়া যায়। বছরের বেশিরভাগ সময়েই মন্দির ধামের রাস্তা তুষারাবৃত থাকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যাত্রীদের কাছে অমরনাথ ধাম যাওয়ার রাস্তাটি খুবই বিপদসংকুল হয়ে ওঠে তথাপি প্রতিবছরই আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে শ্রাবণী পূর্ণিমা (জুলাই - আগস্ট) প্রায় এক মাস জুড়ে দলে দলে পুণ্যার্থীর দল অমরনাথ ধামে ভিড় করে। 


আমরা আট বন্ধু, স্বভাবে প্রকৃতিপ্রেমী, তাই ঠিক করলাম অমরনাথ ধাম দর্শনে যাব। কিন্তু যাব বললেই কি আর যাওয়া যায়,অনেক রকম আয়োজন করতে লাগে। সবথেকে আগে লাগে জম্মু-কাশ্মীর সরকারের অনুমতি পত্র,লাগে ডাক্তারি সার্টিফিকেট । সে সবই করা গেল,জম্মু-কাশ্মীর সরকারের অনুমতি মিলল এবং ডাক্তারবাবুও লিখে দিলেন যে অমরনাথ যাত্রার ধকল নেওয়ার মতো শারীরিক পটুতা আমাদের কাছে আছে । ট্রেনের আসন সংরক্ষণও বাদ পরল না।


২৬ শে জুলাই ২০১৭ তে বেরিয়ে পড়লাম অমরনাথ ভ্রমণে। অবশ্য ভ্রমণ বললে ভুল হবে। এ তো রীতিমতো অভিযান। আট বন্ধুতে কাঁধে আটটা রুক-স্যাক নিয়ে শিয়ালদহ স্টেশনে চেপে বসলাম জম্বুতাওয়াই এক্সপ্রেসে । বেলা বারোটা বেজে পনের মিনিটে ট্রেন ছাড়লো ।আমরা বন্ধুরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম- জয়বাবা অমরনাথ এর জয় ! আমাদের যাত্রা যাতে শুভ হয় এই কামনায় সকালে পুজো দিয়েছিলাম দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি গিয়ে । বন্ধুদের পূজোর প্রসাদ দিলাম । ট্রেন এগিয়ে চলল বিধাননগর স্টেশন,দমদম জংশন, দক্ষিণেশ্বর ছাড়িয়ে আরও সামনের দিকে । দুদিন দুরাত্রি ট্রেনেই কাটলো । তৃতীয় দিন সকালে যখন ট্রেন জম্মুতে গিয়ে পৌঁছলো তখন বাজে আটটা। 


জম্মুতে পৌঁছেই আমাদের প্রথম কাজ ছিল রাত্রিবাসের জন্য হোটেল ঠিক করা । হোটেল ঠিক করলাম জম্বু স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকায় । হোটেলে সবাই স্নান সেরে বেরিয়ে পড়লাম শহরে । জম্মুর রাস্তায় এদিক-ওদিক ঘুরলাম খানেক,তারপর দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলাম একটি পছন্দসই হোটেলে।টুকিটাকি দু একটা জিনিস কেনাকাটার ছিল সেসবও কেনা হলো । তারপর গেলাম রঘুনাথ মন্দির দর্শন করতে । রঘুনাথ মন্দির থেকে এবার ফেরা হোটেলে । ফেরার পথে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে যেতে হল । পরের দিন সকালে বালতাল বেস ক্যাম্পে পৌঁছানোর লক্ষ্যে বেরিয়ে পড়ার কথা, তাই সে পথে যাওয়ার জন্য আগে থেকেই একটা গাড়ি ঠিক করে রাখা খুবই দরকার কিন্তু এক এক জন গাড়ির চালক এক এক রকম ভাড়া চাইলেন। সেইসব রেট শুনে এতটাই বিচলিত হলাম যে কোনো গাড়ি ভাড়া না করেই হোটেলে ফিরতে হলো । পড়ে হোটেলের ম্যানেজার আমাদের সহায় হয়ে গাড়ির সমস্যা দূর করে দিলেন । তারই ব্যবস্থাপনায় আমরা একটা টাটা সুমো ভাড়া করলাম ভরসাযোগ্য ভাড়ায়।


২৯ শে জুলাই ভোর চারটে তখন, টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে যাত্রা শুরু হলো টাটা-সুমোয় করে। পাঠকদের এখানে বলে রাখা ভাল, তাঁরা যদি কখনো অমরনাথ ধাম যাওয়ার কথা ভাবেন তবে দেখে বুঝে অনুমোদিত অর্থাৎ যথা নির্দিষ্ট রাস্তা দিয়ে যাবেন। নিজেদের ইচ্ছেমতো রুটে অমরনাথ ধাম পৌঁছতে গেলে, অনর্থক হয়রানি হবে, যাত্রার ব্যয় ভারও বাড়বে। আমাদের অভিজ্ঞতা অন্তত সে কথাই বলে। পূর্ব নির্ধারিত ছিল যে আমরা পহেলগাঁও বেসক্যাম্পে ধরে যাত্রা শুরু করব কিন্তু আগের রাত্রে আমাদের সিদ্ধান্ত বদল হয়, ঠিক হয় বালতাল রুট ধরে যাওয়ার। গাড়ির চালক বিভিন্ন ঘোড়া পথ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে চললেন, উদ্দেশ্য বালতাল বেসক্যাম্পে পৌঁছানো। কিন্তু মাঝপথে সেনাবাহিনীর তল্লাশির সামনে পড়ে গেলাম। আমাদের গাড়ি আটকে গেল ভাবলাম শেষ রক্ষা  বুঝি হলো না। সেনাবাহিনীর অফিসাররা বললেন ও পথ দিয়ে বালতাল বেসক্যাম্প যাওয়ার অনুমোদন নেই। আমাদের পহেলগাঁও দিয়েই যেতে হবে। সেনা-অফিসারদের অনেক অনুনয় বিনয় করে তবে রক্ষা হল সে যাত্রায়। এক নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে তীব্র গতিতে ছুটে চললো আমাদের গাড়ি। রাস্তার দু'ধারে নয়নাভিরাম দৃশ্য। যতদূর চোখ যায় শুধুই বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। মাঝেমাঝেই রাস্তার দু'ধারে পড়েছে বড় বড় দোকানও দু-একটা। সেসব দোকান উইলো গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি। খুব অবাক হয়ে ভাবছিলাম সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এত উঁচুতে এই কাশ্মীর উপত্যকায় এমন শস্য-শ্যামলা ধানক্ষেতও থাকতে পারে। সেই ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে কখনো কখনো এমন মনে হচ্ছিল যে আমরা যেন বাংলাদেশে আছি। সারাদিন ধরে শুধু চলা আর চলা। দুপুরের আহার সেরে নিয়েছিলাম পথচলতি এক হোটেলে। সেটুকু সময় বাদ দিলে সারাটা সময় গাড়িতেই গেল। বালতাল ক্যাম্পে গাড়ি পৌঁছলো সন্ধ্যের মুখোমুখি। এখান থেকে আর গাড়ি নয় বাকি পথ চলতে হবে পায়ে হেঁটে।


বালতাল বেস ক্যাম্পে পৌঁছে আমাদের প্রথম কাজ হলো তাবুর খোঁজ করা। কারণ রাত্রিবাসের জন্য তাবু ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় নেই এখানে। দেখে শুনে একটা তাবু ঠিক করা হল পাঁচশত টাকার বিনিময়ে। ঠিক সেই সময়ের যা দৃশ্য তা প্রকাশ করার ভাষাই নেই। তাবুতে থাকার অভিজ্ঞতাই অন্যরকম যা আমায় অত্যন্ত অভিভূত করেছিল। তাঁবুর ভেতরটা খুবই সুদৃশ্য এবং গরমও। সারি সারি ক্যাম্প খাট পাতা ডানদিক থেকে বাঁদিকে করে। তারপর তাঁবুতে যে যার জায়গায় রুকস্যাক গুলি রেখে হাত মুখ ধুয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে তাবুর বাইরে বেরোলাম। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে বাইরে হিমেল হাওয়া পরিবেশটাই অন্যরকম। কাল এখান থেকেই যাত্রা শুরু হবে অমরনাথের উদ্দেশ্যে। বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিলাম আমাদের পৌঁছানোর সংবাদ,সবাই নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছেছি জেনে বাড়ির লোকেরা অত্যন্ত আশ্বস্ত হলেন।


 সবাই ঘুরে ফিরে আশপাশটা দেখলাম। শুধু আমারই নয় আমাদের মত আরো অনেকেই সেখানে হাজির একই উদ্দেশ্য নিয়ে। আমরা একটা লঙ্গরখানা খুঁজে বার করতে চাইছিলাম, কারণ দুপুরের পর পেটে পড়েনি কিছু। এতটা পথ জার্নি করে খিদেটাও চাগিয়ে উঠেছে কিছু, তাই কিছু খেয়ে নেওয়ার জন্যই লঙ্গরখানা খুঁজে চলা। এখানে লঙ্গরখানা ছাড়া বাইরে অন্য কোথাও বিশেষ খাবার পাওয়া যায় না। যেটুকু পাওয়া যায় তাও কিনতে হয় চড়া দামে। ফলে সে পথে বিশেষ কেউই পা বাড়ায় না। 


কিন্তু লঙ্গরখানা পৌঁছে অবাক হলাম। জায়গাটা দেখে মনে হলো আমরা যেন কোন খাদ্য উৎসবে এসে পড়েছি। চারিদিকে যেন মেলার পরিবেশ এবং মেলার চতুর্দিকে ঘিরে রয়েছে সামরিক বাহিনীর জওয়ানরা। পরপর অনেকগুলো লঙ্গরখান। প্রত্যেকটিতে সেনাবাহিনীর জওয়ানরা সারাক্ষণ পাহারা দিয়ে চলেছে। সেখানে ঢোকার আগেই তারা দেহ তল্লাশি করে তারপর অনুমতি দিচ্ছে ভেতরে প্রবেশ করার জন্য। লঙ্গরখানার চারিদিকে শুধু খাবার ও খাবার। দক্ষিণী, পাঞ্জাবি, বাঙালি সব ধরনের খাবারই সাজানো রয়েছে অনেক অনেক পরিমাণে, তবে সব খাবারই নিরামিষ। কেশর দেওয়া দুধ বড় বড় গ্লাসে সাজানো রয়েছে, ঠান্ডা জায়গা বলে চা-কফির টেবিলও কম নেই। মিষ্টির টেবিলে যেতেই রাজভোগের আকৃতি দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। একটা খেলেই আর একটা খাওয়া যাবে না এত বড় তার সাইজ। সেইসঙ্গে টেবিলে দেখা যাচ্ছে নানা রকমের সন্দেশ, চমচম,লাড্ডু, প্যাঁড়া ইত্যাদিও। সব থেকে চমকপ্রদ ব্যাপার হল যে যত খুশি খাক এইসব, সবই বিনামূল্যে। তবে লঙ্গরখানার এই খাবার কেবলমাত্র তীর্থযাত্রীদের জন্যই বরাদ্দ। আমরা যে যার ইচ্ছা মত খাবার খেয়ে নিলাম। প্রথমে মিষ্টি থেকে শুরু, তারপর অন্যান্য খাবার,তবে পরিমাণ বুঝে। পরের দিনই অনেকখানি রাস্তা হেঁটে যেতে হবে, তাই শারীরিকভাবে সুস্থ থাকাটাই জরুরি, সে কারণেই নিয়ন্ত্রিত আহার।


৩০শে জুলাই ভোর হওয়ার আগে আগেই আমরা সবাই পদব্রজে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিলাম। ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা ছোঁয়া মাত্র আমরা তাবু ত্যাগ করে রওনা দিলাম। অত ভোরেই দেখলাম কাতারে কাতারে মানুষ চলছে একই পথ ধরে, একই উদ্দেশ্যে, একই গন্তব্যে। রাস্তার দু'ধারে নানা দৃশ্য দেখতে দেখতে এবং উপভোগ করতে করতে আমরা এগিয়ে চললাম দেবাদিদেব অমরনাথের কাছে। গঙ্গার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়তে হল আমাদের, কারণ রাস্তা এখানে বড় সংকীর্ণ। উত্তরাই-এর রাস্তা খাড়া পাহাড়ের দিকে এঁকে বেঁকে উঠে গেছে। কাদামাটিতে খুবই পিছল রাস্তা। সব তীর্থযাত্রীই খুব সাবধানে ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। কেউ যদি একবার পা পিছলে পড়ে যায় তাহলে কোন গভীর অতল খাদে গিয়ে পড়বে কে জানে ? এত সরু রাস্তা যে পাশাপাশি দুজন হাঁটা যায় না। এই রাস্তা শেষ হলেই পার হতে হবে একটা খরস্রোতা দুরন্ত পাহাড়ি-নদী, তাও আবার একটা নড়বড়ে গাছের গুড়ির উপর দিয়ে। এখানেও মৃত্যু ওঁত পেতে আছে। নড়বড়ে সেতু পার হতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে কেউ যদি একবার পড়ে যায় তবে তাকে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। খরস্রোতা নদী যে তাকে কোথায় নিয়ে যাবে কে বলতে পারে?


যাইহোক আমরা সবাই একে একে সাবধানে সাঁকো পার হয়ে যেখানে উপস্থিত হলাম সেই জায়গাটিকে মোটামুটি সমতল বলা চলে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লাগছিল সেখানে। পরে বুঝলাম এত ঠান্ডা লাগার কারণ। হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্য করছিলাম কোথাও কোথাও আমাদের পা বসে যাচ্ছে, আর যেখানে যেখানে পা দিচ্ছি সেখানেই অল্প পরিমান জল দেখা যাচ্ছে, বুঝতে পারলাম যে আমরা গ্লেসিয়ারের উপর দিয়ে হাঁটছি। গ্লেসিয়ার বুঝতে পেরেই আমাদের সাবধানে হাঁটতে হচ্ছিল এবং লাঠি ঠুকে ঠুকে দেখে নিচ্ছিলাম কোথাও বরফের আস্তরণ হালকা হালকা আছে কিনা, কারণ বরফের ভেতর কোনো ফাঁপা জায়গা থাকলে বিপদ। তারপর চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ, চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার মতন বরফ। যত এগোচ্ছি ততো সাদা বরফে মোড়া এই প্রকৃতি।

 

সারাটা দিন ধরে অক্লান্ত হাঁটার পর আমরা মন্দিরের কাছে গিয়ে পড়লাম। অনেক হাঁটাহাঁটির কারণে প্রত্যেকেই ক্লান্ত-বিধ্বস্ত ছিলাম তখন। এদিকে বেলা গড়িয়ে বিকেলও আসন্ন প্রায়। সেদিনকার মত হাঁটাহাঁটির পালা সেখানেই শেষ। এখন বিশ্রামের পালা। রাত্রিবাসের জন্য একটি তাঁবু ঠিক করতে হলো। রফা হলো ৯০০ টাকায়। তাঁবুতে আমাদের মালপত্র রেখে মন্দিরের দিকে এগোনো হল। উদ্দেশ্য হল মন্দিরের আশপাশটা দেখে নেওয়া। মন্দিরের কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম দীর্ঘ লাইন পড়েছে পুজো দেওয়ার জন্য। ছোট ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কে নেই সেই লাইনে, সবাই সারিবদ্ধ ভাবে দণ্ডায়মান। মাঝেমধ্যেই আওয়াজ উঠছে —হর হর মহাদেব। মন্দির প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল এ যেন ভারত তীর্থ। সব প্রদেশের লোকই এক লাইনে সামিল।মন্দির প্রাঙ্গণে বিক্রি হচ্ছে পূজার উপাচার উপকরণ সামগ্রী। যারা বিক্রি করছে সে সব, তারা সবা-ই স্থানীয় কাশ্মীরি মুসলমান সম্প্রদায়ের লোক।

বিকেল থাকতে থাকতেই মন্দির থেকে তাঁবুতে ফিরে এলাম। এখন একটু অবসর, সারাদিনের ধকল নেওয়ার পর একটু বিশ্রাম, ক্লান্তি দূর করার জন্য। ওদিকে বিকেল গড়িয়ে নাম ছিল সন্ধ্যা। ইচ্ছে ছিল মন্দিরের সন্ধ্যারতি দেখব কিন্তু সন্ধ্যার সময় মন্দিরের আরতি দেখার জন্য যে মানুষের ঢল দেখলাম তাতে আরতির প্রায় কিছুই দেখা গেল না। বাইরে ঠান্ডার তীব্রতাও ভীষণরকম তাই দূর থেকে দেবাদিদেব মহাদেবকে প্রণাম করে এদিক ওদিক খানিক ঘুরে, রাতের খাওয়া সেরে ফিরে এলাম। 


তাবুতে করার কিছু নেই, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লেই হয়। কিন্তু শীতের তীব্রতা যেমন, তার ঠ্যালাতেই কাহিল,এখন ঘুম এলে হয়। চারিদিকে বরফের সাম্রাজ্য, তার উপরে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। মাথা থেকে পা পর্যন্ত যা যা পরে থাকা যায়, মাঙ্কি টুপি, গ্লাভস, সোয়েটার, পুল-ওভার ইত্যাদি সবকিছু পরে ফেলার পরেও কোনভাবে ঠান্ডা আটকানো যাচ্ছিল না। তার উপরে আমাদের শুয়ে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল মেঝেতে পেতে রাখা একটা প্লাস্টিকের চাদরের উপর। তার উপরেই পেতেছি সঙ্গে নিয়ে যাবা বিছানার চাদর, অর্ধেক কম্বল। তার উপর শয়ন আমাদের, আর বাকি অর্ধেক কম্বল চাপিয়েছি গায়ে। তাতেও যা ঠান্ডা তা বলার অবকাশ রাখে না। কেউ কেউ ঠান্ডার চটে জুতোটা পর্যন্ত খুলে রেখে ঘুমোবার কথা ভাবতে পারেনি। জুতো পরেই শুয়েছিল।

 পরেরদিন ৩১শে জুলাই ভোররাত্রে আমাদের দুই বন্ধু মন্দিরে গিয়ে লাইন দিল। অত ঠান্ডার মধ্যেই মাঝরাতের থেকে মন্দিরে পুজো দেওয়ার লাইন পড়ে গেছে। অথচ পুজো নেওয়া শুরু হতে তখনও বহু সময় বাকি। আমরা বাকি বন্ধুরাও আস্তে আস্তে যে যার মত পুজো দেবো বলে তৈরি হতে শুরু করলাম । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পুজো দিয়ে আমাদের উৎরাই-এর পথ ধরে নেমে যেতে হবে। পুজো দেওয়ার আগে আমি আমার দুই বন্ধু তাঁবুর কাছাকাছি এক পাহাড়ি ঝরনায় স্নান সেরে নিলাম। পাহাড়ের বরফ গলা জলের এই ঝরনা। ঝরনা জল যেমন পরিষ্কার তেমনি ঠান্ডা, তবু ওই জলেই স্নান করলাম কারণ স্নান না করে পূজো দেওয়ার কথা আমি ভাবতেই পারি না। এরপর জামা কাপড়ে পুজোর লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সাড়ে পাঁচ-ছটার সময় লাইনে দাঁড়িয়ে যখন পূজো দিলাম তখন প্রায় সকাল আটটা। গুহা মন্দিরের শিবলিঙ্গ দেখে মন ভরে গেল । এই জন্যই তো সুদূর কলকাতা থেকে এখানে এত পরিশ্রম করে আসা। এই পরিশ্রম সার্থক হল।


পুজোর শেষে প্রসাদ খাওয়া। তারপরে ফিরে আসা তাঁবুতে । এবার ফেরার পালা। যে যার মত রুকস্যাক গুছিয়ে নিয়ে তাবু ছাড়লাম। বাইরে সকালের জলখাবার খেয়ে নিয়ে ফেরার রাস্তা ধরে এবার অবতরণ‌। যেতে হবে পহেলগাঁও। অমরনাথ ধাম জয়ের আনন্দ নিয়ে ফিরতে লাগলাম আট বন্ধু। সারাটা পথ গল্পে গল্পে হেঁটে চলা, দিনের শেষে সন্ধ্যার মুখোমুখি পৌঁছে গেলাম পঞ্চন্ততরণী। সেদিনের রাত্রিবাস সেখানেই হবে। আবার তাবু ঠিক করতে হলো। এই রাতের তাঁবুটি খুব সাজানো-গোছানো। তাঁবুর ভেতরটা বেশ গরমও। খুব ভোরে উঠেছিলাম। শরীরে ক্লান্তি ছিল খুব। সাত তাড়াতাড়ি তাঁবুর বাইরে একটি লঙ্গরখানায় রাত্রের খাওয়া খেয়ে নিয়ে তাবুতে ফিরলাম। তাই ঘুমোতে হবে। শারীরিক ক্লান্তি দূর করার জন্য ঘুমের বিকল্প আর কিছু নেই।


১ আগস্ট, পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙলো দেরিতে। প্রাতঃকৃত্য সেরে সকালের জলখাবার খেয়ে আবার আমাদের পথচলা শুরু হল। কিছুক্ষণ চলার পরেই সামনে এসে পড়ল মহাগুনা পাশ। এই পাশ পার হতে গিয়ে কালঘাম ছুটে গেল আমাদের। তারপর এলো তুমুল বৃষ্টি যেন এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। বৃষ্টিতে খানিক ভেজার পর শরীর বাঁচাতে আশ্রয় নিলাম পথের ধারের একটি ছোট চা দোকানে। চায়ের দোকানে চা খাওয়ার মাঝে বৃষ্টি থেমে গেল। এবার আবার হাঁটা শুরু। এখানে দুজন কুলি ঠিক করা হলো। তাদের হাতেই আমাদের মালের বোঝা চাপিয়ে ভারমুক্ত শরীরে এগিয়ে চললাম আমরা।


পহেলগাঁও এর পথে প্রাকৃতিক দৃশ্য এক কথায় অপূর্ব। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা হল। মেঘ নেমে এলো আমাদের হাঁটুর কাছে। চারিদিকে অস্পষ্ট ধোঁয়াশা মনে হলো, পাশের জনকে দেখা যায় না এমন অবস্থা। অগত্যা হাটা না থামিয়ে উপায় রইল না। পাশেই গভীর গিরিখাত ভুল করে পা বাড়ালে কি বিপদ অপেক্ষা করে আছে তা কেউ জানে না। শুধু মেঘ আর মেঘ আমাদের চোখের সামনে। মজা পেয়েছিলাম আমরা প্রচুর। আমরা বন্ধুরা এর ওর নামে মজা করে উল্টোপাল্টা কথা বলছিলাম, মেঘের আড়ালে কে যে কার নামে কি বলছে বোঝা যাচ্ছে কিন্তু বক্তাকে দেখা যাচ্ছে না, এ এক রোমাঞ্চকর ব্যাপার।


মেঘ সরে গেল একটু সময় বাদে। চারিদিক দৃশ্যমান, আবার হাঁটা শুরু করলাম। একটু এগোতেই একটা মন্দির পেলাম, পাহাড়ের কোলে ছোট্ট এক মন্দির। কি কারনে জানি না মন্দির প্রাঙ্গণে তখন জলসা চলছিল। আমরা মনের আনন্দে উপস্থিত হলাম সেখানে। খানিকক্ষণ নাচানাচি করলাম আমরাও,তারপর নাচানাচি করে আমাদের আনন্দ প্রকাশ করলাম। তারপর আবার হাঁটা শুরু। পহেলগাঁও পৌছালাম যখন তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। সেখানে আমাদের জন্য মালপত্র নিয়ে কুলি দুটি অপেক্ষা করছিল। তাদের থেকে আমাদের মালপত্র বুঝে নিয়ে তাদের প্রাপ্য মিটিয়ে দিলাম।

সন্ধ্যার মুখে বৃষ্টি নামল আবার। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই একটি তাবু ঠিক করলাম আমরা, কিন্তু এখানে তাঁবুর জন্য কোনো ভাড়া লাগলো না আমাদের। সে রাতেও লঙ্গরখানায় খাওয়ার পর্ব মেটালাম। এরপর রাত্রিবাসের জন্য তাঁবুতে ফিরে আসা,তারপর গভীর রাতে আবার বৃষ্টি পরা শুরু হল। একেই ঠান্ডার জায়গা,তার উপর যত বৃষ্টি হয় ঠান্ডা যেন ততই বাড়তে থাকে। ফলে ঠাণ্ডার ঠেলায় সারা রাত ঘুম হল না কারোর।


পরের দিন সকাল সকাল সব গুছিয়ে নিয়ে চা পানের পর বাসস্ট্যান্ডে হাজির হলাম সেখানেও লোকে-লোকারণ্য সবারই ফেরার তাড়া ফিরতে হবে আমাদেরও কিন্তু মন চাইছিল না ফেরার কিন্তু ফিরতে তো হবেই তাই মনটা খারাপ হলেও সত্যি টাকে মানতেই হল আমাদের শেষ পর্যন্ত। যেমন পাহাড় তেমন নদী তেমনই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। অমরনাথ যাত্রার অপরূপ সৌন্দর্যের কথা আমরা অনেকেই শুনেছি কিন্তু এমন অত্যন্ত সুন্দর দৃশ্য এবং প্রকৃতির এমন মলিনতা আমরা পাব তা কখনোই বুঝতে পারিনি। ভয়ংকর সুন্দর প্রকৃতির রূপ দর্শন করে গেলাম আমরা এই ভ্রমণের মাধ্যমে, সত্যি প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য আমাদের মনকে মুগ্ধ করে তুলেছিল যেন এমন ভাবেই প্রতিবছর আমরা জীবনের ব্যস্ততার মধ্যে একটু সময় বের করে প্রকৃতির এই সৌন্দর্যতাকে গ্রহণ করতে পারি। সেই ফেরার মুহূর্তে মনে হচ্ছিল আবার কোনদিন পথ আমাদের ডাকবে, আর... আমরা পথে বেরিয়ে পরবো প্রকৃতির আরেক সৌন্দর্যতাকে উপলব্ধি করতে ।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama