পেয়ে হারানো
পেয়ে হারানো


কয়েক দিন ধরে মনোরমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। প্রথম বার মা হতে চলেছে। তাই একটু ভয়ে আছে। এমনিতে ওর রক্তচাপ বেশি। যাইহোক দোনোমনো করে অফিস গেলাম। দুপুরের দিকে নীহারের ফোন।শীতেষ তারাতারি ফিরে আয়, বৌদির শরীরটা ভালো নেই। নীহার আমার বন্ধু। আমরা এক ই ফ্লাটে থাকি আবার চাকরি ও করি এক ই অফিসে।আজ ও ছুটিতে ছিল। মনোরমাকে হসপিটালে ভর্তি করলাম। বেঞ্চে বসে আছি দুজনে।নার্স এসে খবর টা দিল, মনোরমা একটা মৃত সন্তান প্রসব করেছে।ডাক্তারবাবুর সাথে কথা বলে জানতে পারলাম,ও আর কোনদিন ই মা হতে পারবে না। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। এই অনাগত সন্তানকে নিয়ে আমাদের কতো স্বপ্ন ই না ছিল।কি ভাবে যে ওকে সান্ত্বনা দেব! কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। হঠাৎ চোখে পড়লো শ্যামবর্ণ নিটোল চেহারার এক আদিবাসী নারী।কে ও? নিজেকে প্রশ্ন করলাম। মঞ্জু না? হ্যাঁ ও ই তো।বোধ করি ও ও আমাকে চিনতে পেরেছে। নীহার পাশে বসে আছে। ভরসা করে এগিয়ে গিয়ে কথা বলবো সে সাহস পাচ্ছি না। দেখলাম নীহার ই ওকে কাছে ডাকলো। ওদের কথা বার্তা শুনে মনে হলো নীহার মঞ্জুকে ঐ হসপিটালে আয়ার কাজটা পাইয়ে দিয়েছে।
ওর এটকু সমাজ সেবার বাতিক আছে। জানতে পারলাম মঞ্জুই মনোরমার দেখাশোনা করছে। রাতে একা ঘরে শুয়ে কত কথাই মনে পড়তে লাগলো। আমরা দুই বন্ধু একবার ঝাড়গ্ৰামের দিকে গেছিলাম অফিসেই কাজে। তখন অবশ্য আমার বিয়ে হয় নি। একদিন বিকেলে দুজনে একসাথে বেড়াতে বেড়িয়ে ছিলাম। দেখলাম একদল আদিবাসী কন্যা পরস্পর হাত ধরাধরি করে ধামসা মাদলের তালে তালে নাচছে। সেদিনের সেই পড়ন্ত বিকেলে মঞ্জুকে দেখেছিলাম। হাঁটুর নীচ অবধি লাল সাদা ঘর কাটা শাড়ি। ঘনকালো চুলের খোঁপায় বুনোফুল গোঁজা।সব থেকে দৃষ্টি কাড়া ওর মুক্তঝড়ানো হাসি। কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম। বৈশাখ মাসের বিকেল। একদিন হঠাৎ করে ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে।যেন রাত নেমে এলো বেলপাহাড়ির নীচে। দুজনে আশ্রয় নিলাম একটা পোড়ো মন্দিরে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি। সেদিন ওকে আশ্চর্য রকম সুন্দরী লাগছিল ওকে। পড়নে নীল হলুদ ডুরে কাটা শাড়ি। মাথায় পলাশ ফুল। গলায় পুঁথির মালা।
মনে হচ্ছিল যেন এক মৃ্ৎকন্যা।যে আমার জন্ম জন্মান্তরের চেনা। মন্দিরের সিঁদুর লেপন করা ঐ প্রস্তর খণ্ড যেন তার সাক্ষী। বৃষ্টিটা একটু ধরতেই ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম। সেদিনের ওর সেই চাহুনি আজ ও আমি ভুলতে পারি নি। বড়ো অপরাধি মনে হয় নিজেকে। সেদিন আস্তানায় ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল।নীহারের চোখে মনে অনেক প্রশ্ন ভিড় করে এসেছে। কিন্তু আমি একেবারে কাকভেজা। তাই শুধু বলল,তাড়াতাড়ি পোশাক পাল্টে নে। নাহলে জ্বরে পড়বি।সত্যিই তাই হলো। দু'দিন উঠতে পারলাম না। তারপর হঠাৎ করেই কোলকাতা ফিরে আসতে হল। মঞ্জুর সাথে আর দেখা করা হলো না। সেই অল্প পরিচয় ঘনিষ্ঠ প্রেমের খবর ও রাখি নি।
কিছু দিন পর এই কোলকাতার ই মেয়ে মনোরমাকে বিয়ে করলাম।পরের দিন সকালে আবার হসপিটালে গেলাম স্ত্রী মনোরমাকে দেখতে। আমাকে একা বসে থাকতে দেখে মঞ্জু গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে বলল,"বাবু তুই তো আমাকে কিচ্ছুটি না বলে চলে এলি। তার কিছু দিন পর জানতে পারলাম মোর ভেতরটাতে তু স্মৃতিটুকু ফেলে এসেছিস। গেরামের লোক টিকতে দিলো নাই। তাই মাকে সাথে করে ঈ শহরটাতে এসে পড়লাম। জানতে পারলাম তু সংসারটো পেতেছিস। নীহার বাবুর সাহায্যর কথাটো ভোলার লয়।মারাংগুরুং এর কাছে প্রার্থনা টো করি, ছেলেকে উয়ার বাপের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারলেই মোর শান্তি।উয়াকে মানুষ টো করার ক্ষমতা মোর নাই।কাল নীহার বাবুর সাথে গিয়ে উয়াকে নিয়ে আসিস। মেমসাহেবের শূন্য কোলটা জুড়োবে।"