মনের মানুষ
মনের মানুষ
“কি বললেন ভালোবাসা!”
“না দাদাভাই ওই জিনিস টা আর মনে ধরে না।”
“কেন?”
”আর কেন।একবার দেখুনই না ট্রাই করে।হাড়ে হাড়ে টের পাবেন।”
কথা গুলো বলেই সুরেশ চলে গেল সামনের যে রাস্তা টা নিষিদ্ধপল্লীর দিকে গেছে।
তার কাছে এ রাস্তা নতুন নয়।
সেই যে রিয়া চলে গেল,
সে প্রায় এক বছর হয়ে গেল।
ঠিক একবছর আগে আজকের দিনেই।
কি যেন নাম ছেলেটার।
সুরেশের সবসময় মনেও থাকে না নাম টা
হ্যাঁ মনে পড়েছে সৌম্য
রিয়ার কথায়,যেমন নাম তেমন চেহারা।
সত্যি ছেলেটার নামের সাথে মুখের মিল ছিল বটে।
সুরেশ ও তা মানে।
কিন্তু,তাই বলে কি…..
যাক সে কথা।
সুরেশের আজ আর ভালো লাগছে না।
প্রথম থেকেই সে ভেবেছিল আজ আর যাবে না।কিন্তু এটা যে একটা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সে কি কখনো স্বপ্নেও ভেবেছিল।
সেই ছোট বেলায় স্কুল ফেরার সময় মায়ের বলা সেই খারাপ জায়গাটা যেখানে নাকি কাওকে যেতে নেই যারা যায় তারা ভালো মানুষ নয়।সময়ের কি পরিহাস সেই জায়গায় আজ সুরেশের একাকিত্বের একমাত্র ঠাঁই হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেই দিনটা সুরেশের এখনো মনে আছে।
বাজার করে ফিরছিল এক মাস হয়ে গেছে রিয়ার চলে যাওয়া।হঠাৎ চোখ চলে গেল সেই গায়ে শ্যাওলা জমা পুরোনো বাড়ি টার ভাঙা মরচে পরা দোতালার এক জানালার দিকে।
ছোট থেকেই সে দেখেছে বাড়িটা কিন্তু আজ কি
যেন চোখে পড়তেই থমকে দাঁড়ালো সুরেশ।
এ কি দেখছে সে!!
বাজারের ঝোলা ফেলে রেখে সুরেশ ছুটলো সেই দোতলায়।
ঘরের সামনে এসেই দেখলো বন্ধ।
জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলো সুরেশ।এখনই যেন ভেঙে ফেলবে।
দরজা খুলে ভিতর থেকে মুখ বাড়ালো এক বছর ৩০ এর যুবক।
সুরেশ তখন উদ্ভ্রান্ত।সে কোনো কিছু পরোয়া না করেই সেই ব্যক্তি কে পাস কাটিয়ে ঢুকে পরলো ঘরে।
সেখানে বসে আছে এক মহিলা পরনে শাড়ি থাকলেও তা তার শরীর কে ঢাকতে অসমর্থ।
কিন্তু সুরেশের তখন সে দিকে নজর দেওয়ার সময় নেই।সে তন্ন তন্ন করে যেন কাকে খুঁজছে।একবার জানালা দিয়ে বাইরেটাও দেখে নিলো সে ঠিক ঘরে ঢুকেছে কি না।
তারপর ঘরের মাঝে থাকা টুলটার ওপর কিছু না পাওয়ার হতাশায় বসে পরলো সুরেশ।
এত টা ভুল কি ভাবে হতে পারে তার!
সে যে স্পষ্ট দেখতে পেল।
কিন্তু নাহ,নেই সে।
ততক্ষনে ঘরের বাইরেও কিছু মুখ উঁকি মারছে।
আর সেই যুবক ও মেয়ে টাও অবাক তার এই কান্ড দেখে।
নিজের হুঁশ ফিরে পেতেই সুরেশ লজ্জায় কষ্টে ছুটে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে।
সেই রাতের কথা ভাবলে এখনো সুরেশের চোখ দুটো জলে ভিজে যায়।অফিস থেকে বাড়ি ফিরে যখন দেখলো বাড়ির বাইরে তালা ঝোলানো,সে বেশ অবাকই হলো।নিজের কাছে থাকা ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুললো সে।বসার ঘরের টেবিলে একটা ডাইরির ছেঁড়া পাতা।তাতে লেখা--
আমি রিয়া।মানে রিয়া সেনগুপ্ত।অবাক হলে নাকি?রিয়া রায় কি ভাবে সেনগুপ্ত হয়ে গেল?
আশা করি তোমার সৌম্যর পুরো নাম টা মনে আছে।তাহলে আর কিছু বলতে হবে না যা বোঝার বুঝে গেছ ইতিমধ্যে।
আর হ্যাঁ আমাকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা করো না।ও তোমাকে তো বলাই হয় নি।আসলে সৌম্য আমার পূর্ব প্রেমিক,কোনো কলিগ না।বাবা মায়ের জন্যই তোমাকে জোর করে বিয়ে করতে হয়ে ছিল।
থাক আর কিছু বলার নেই।অন্য কাওকে পারলে বিয়ে করে সুখে থেকো।
ইতি,
এক্স-সহধর্মিণী
কথা গুলো পরে বসে পরেছিল সুরেশ।সেদিন আর তার সেখানে থেকে ওঠার মতো অবস্থা ছিল না।
তার ১ মাস পর সেই ঘটনা।
দরজায় একটা নক করার শব্দ।
সুরেশ দরজা খুলে দেখে এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে।
“কি চাই?”
মহিলা একটা পার্স তার দিকে এগিয়ে দেয়।
এ কি!এ তো তারই পার্স।
“আপনি কাল আমার ঘরে ফেলে এসেছিলেন এটা”
সুরেশের মনে পরতেই কাল তার উদ্ভট ব্যবহারের জন্য সে বেশ লজ্জিত হলো।
“ও,এ কি বাইরে কেন ভেতরে আসুন”
“কি যে বলেন,আপনাদের মতো ভদ্দরলোকের ঘরে কি আর আমরা যেতে পারি।তাও এই দিন দুপুরে”
“আপনার কোনো দরকারি কিছু থাকতে পারে ভেবে আপনাকে দিতে এলাম,ঠিকানা এর ভিতরেই ছিল”
“আসছি”
বলেই সে চলে গেছিল।
সুরেশ তাকে ধন্যবাদ টুকুও জানাতে পারলো না।
পরের দিন অফিস থেকে ফেরার সময় সে আবার সেই ঘরে গেল,আসলে মেয়ে টার ধন্যবাদ টা পাওনা ছিল।সুরেশ এটা অন্তত করতেই পারে।আর তার নাম টাও তো জানা হয় নি তার।
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠেই সে দেখলো ঘরের সামনে আর একজনের সাথে গল্প করছে মেয়ে টা।
“আরে বাবু জি আপনি আবার এখানে?,সার্ভিস চাই নাকি?কাল পার্স টা ফ্রীতেই দিয়ে এসেছি কিন্তু আর কোনো কিসু ফ্রি না এই বলে দিলুম।”
“না না আমি শুধু আপনাকে ধন্যবাদ টা বলতে এসেছি,কাল হঠাৎ চলে গেলেন তাই বলা হয় নি”
“ঘরে আসুন”
ঘরে ঢোকে সুরেশ।
“আচ্ছা আপনার নাম টা কি?”
“কি যে বলেন বাবু,আপনার ধান্দা টা কি বলুনতো?”
“শরীর চাইলে বলুন”
“রেট ওই ঘন্টায় ৩০০ টাকা”
“এইরকম কেন বলছেন,বললাম তো ধন্যবাদ বলতে এলাম”
“তাহলে নাম কেন জিজ্ঞাসা করছেন?”
“কেন,সেটা কি অপরাধ”
“দেখুন বাবু সাহেব এই লাইনে ১৫ বছর হয়ে গেল,কখনো কাওকে নাম জিজ্ঞাসা করতে শুনি নি,সবাই আসে কাপড় খুলে নিজের সুখ মিটিয়ে কয়েকটা কাগজ মুখের ওপর ছুঁড়ে চলে যায়,কাজ হয়ে গেলেই সেই ভদ্র সমাজের মুখোশ টা মুখে এঁটে নেই।”
সুরেশ এবার বেশ বিরক্ত হয়েই বললো-
“আচ্ছা তো,নাম সুধালাম তাতেই এতোকথা শোনাচ্ছেন”
“আরে বাবু চটছেন কেন,এখানে সবাই তো চামেলী বলেই চেনে,তবে বাপ মা নাম রেখেছিল তিন্নি কিন্তু সে সব নাম এখানে খাটে না।”
“এই রাস্তায় কেন এলে?অনেক তো ভালো কাজ আছে”
“হাসালেন বাবুসাব,আপনার কি মনে হয়?সাধ করে এসেছি এই অন্ধকার রাজ্যে?”
“জানেন আমি লেখাপড়া করতাম,স্কুলেও যেতাম,মা লোকের বাড়ি কাজ করে আমাই পড়াতো,বাবা অনেক দিন হলো আমাদের ছেড়ে গেছে,মায়ের স্বপ্ন ছিলো ইস্কুলের মাস্টার হবো আমি,কিন্তু সে সব আজ অতীত।মার কষ্ট হলেও বলতো পড়াশোনা ছাড়িস না তোকে বড় হয়ে আমার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে,আমিও মন দিয়ে পড়তাম,কিন্তু তা হয়ত ভগবান সহ্য করতে পারলে নি।
মা একসময় খুবই অসুস্থ হয়ে পরলো,লোকের কাছে হাত পেতে যা টাকা পেলাম তাতে কিছু ওষুধ কিনলেও মায়ের অসুখ আর সারলো না।
কিছু দিনের মধ্যেই মারা গেল মা।
কয়েক দিনেই টের পেলাম মা ছাড়া সন্তান দের কি হয়।ঘরে চাল যা ছিল শেষ হয়ে গেছে।ক্ষিদের জ্বালা যে বড় জ্বালা বাবু।একদিন বাড়িতে সুজয় দা এল।মা সব সময় এর সাথে মিশতে মানা করতো কিন্ত সেদিন এসে যখন বললো আর কত দিন এই ভাবে লোকের কাছে চেয়ে চেয়ে কাটাবি একটা কোনো কাজের জোগাড় কর,সেদিন মায়ের নিষেধ অমান্য করে বলেই ফেললাম তুমি একটা কাজ দেখে দিতে পারোনা?বললো চল কাল আমার সাথে।গেলাম জানেন তার সাথে।আমার জন্য কত পেয়েছিল কে জানে।কিন্তু সেই থেকেই শুরু হলো আমার কলঙ্কিত জীবন।প্রথম দিকে কষ্ট হতো কাঁদতাম সারা রাত,কিন্তু আস্তে আস্তে সব সয়ে গেল।এখন আর কিছু মনে হয় না।”
সব শুনে সুরেশের বেশ খারাপ লাগলো চামেলি দুর্দশার কথা ভেবে।সেদিন সে আর কিছু না বলেই চলে এসেছিল।
কিন্তু তার পর থেকেই শুরু হয় তার চামেলির কাছে যাওয়া।সুরেশ তাকে তিন্নি নামেই ডাকে।প্রতিদিন সে তিন্নির সাথে গল্প করে তিন্নিও তার নিজের অনেক কথা বলে,আস্তে আস্তে সুরেশ রিয়ার কথা ভুলেই গেছিল।প্রতিদিন সকাল থেকে শুধু সন্ধ্যের জন্য অধীর ভাবে অপেক্ষা। সে বোঝে তিন্নি তাকে কিছু না বললেও সেও সুরেশের জন্য অপেক্ষা করে।সুরেশ অনেক বার তাকে বলেছে এই সব ছেড়ে নতুন ভাবে সব কিছু শুরু করো।কিন্তু শোনে নি।সে চাই না তার নামের সাথে লেগে থাকা কলঙ্ক যেন সুরেশের জীবনেও চলে আসে।
কিন্তু আজ আর ভালো লাগলো না সুরেশের। বাড়ি ফিরে এলো।কিছুক্ষন পরেই ফোন টা বেজে উঠলো,তিন্নির ফোন।
“কি হলো আজ এলে না?”
“তুমিও তো একদিন আসতে পারো”
“আমি?”
“হ্যাঁ,কেন আসা যাবে না?”
“কিন্তু লোক..”
“নিকুচি করেছে লোকের,তোমার কাছে সকাল থেকে যাদের লাইন লেগে থাকে তারা কি ভদ্র সমাজের নয়,তুমি যদি খারাপ কলঙ্কিনী হও তাহলে তোমার গায়ে যারা কলঙ্কের দাগ দিয়েছে তারাও তো সমান দোষী,তারা তো কখনও সমাজের ভয়ে কোথাও লুকিয়ে থাকে না তাহলে তুমি কেন?”
“বেশ আমি যাবো”
“শুধুই আসবে?এখনো কি আমরা এক হতে পারি না?সমাজ যদি নাই মানে আমরা অন্য কোথাও যাবো যেখানে কেও চিনবে না আমাদের।”
“কাল সকালে শহরের বাইরের মন্দিরে আমার জন্য অপেক্ষা করো আমরা ওখানে বিয়ে করে এখন থেকে অন্য কোথাও চলে যাবো।”
প্রায় ১০ টা বাজতে চললো এখনো আসেনি সুরেশ,প্রায় ৯ টা থেকেই তার জন্য অপেক্ষা করছে তিন্নি।
ততক্ষনে রাস্তার মধ্যে একটা ভিড় জমে উঠেছে।
সদ্য কেনা বেনারসি টা তখন রাস্তার ধারে পরে
আর সিঁদুরের কৌটো থেকে ছিটকে পরা সিঁদুর মিশে যেন জায়গা টা আরো রক্তিম বর্ন করে তুলেছে।