মাতৃ ঋণ
মাতৃ ঋণ
লালিমা - প্রতিমা তুমি এসে গেছো, এত দেরি করলে কেন গো?
কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি।এসো। এদিকে চলে এসো।
প্রতিমা - আমি তো আসবো বলেই ছিলাম দিদি, আমার জন্য অপেক্ষা কেন? আমি এখানেই ঠিক আছি দিদি।
লালিমা - কি বলছ প্রতিমা তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে? এদিকে এসো। তুমিই আগে খাওয়াবে চৈতিকে। এসো প্রতিমা আর দেরি করনা।
আজ আমার চৈতির আইবুড়ো ভাত। প্রথম ভাতটা চৈতি তোমার হাতেই খাবে।
প্রতিমা - এ হয়না দিদি। এটা তুমি করনা। চৈতির আমি ক্ষতি করতে পারবোনা সে তুমি যতই জোর করো।
এ আমি পারবোনা।
লালিমা - কে বললো তোমায় প্রতিমা তোমার হাতে খেলে চৈতির ক্ষতি হবে। আজ ওর জীবনের একটা বিশেষ দিন। চৈতির আজকে বড়ো হওয়ার পেছনে তোমার ও যে অবদান অনেকখানি সে আমি ভুলে যাই কি করে বলতো।
প্রতিমা - তুমি তো জানো দিদি আমার কোনো
লালিমা - কি কোনো সন্তান নেই তাইতো? চৈতি কি তোমারও মেয়ে নয়?
লালিমা প্রতিমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বলতে থাকে। তুমি না থাকলে যে চৈতির কি হতো? তুমি ছিলে বলেই আমার বিপদের দিনগুলোতে তুমিই আগলে রেখেছিলে মেয়েটাকে। তোমার দাদা আমাদের ছেড়ে ঘর বাঁধলেন অন্য কোথাও, তখন আমার যে কি দিন গেছে সে তোমার থেকে ভালো কেই বা জানে। তখন যদি আমার চৈতিকে তুমি রোজ অফিসের সময়টায় না রাখতে আমিতো চাকরিটাও করতে পারতাম না। আর চাকরিটা না করলে তো মা মেয়েতে না খেতে পেয়ে মরা ছাড়া আর কোনো রাস্তা ছিলনা। বাপের বাড়িতে ভাইদের সংসার, বাবা মা কোনকালেই উপরে চলে গেছে কোন মুখে যেতাম বলো তো? জানোই তো সমাজের কাছে বর খ্যাদানো মেয়েমানুষের আবার কোনো মান আছে নাকি। কেউ কেউ তো বলেই ফেলতো আমিই আটকে রাখতে পারিনি মানুষটাকে।
প্রতিমা - ও দিদি, কাল চৈতির বিয়ে, আজ আর তুমি এসব নিয়ে কষ্ট পেওনা। আমি রাখবো না কেন বলো চৈতিকে। আমারও তো শত চেষ্টা করেও ছেলেপুলে হলোনা, পাড়ার লোকে তো বাঁজা বলতে বলতে আমার নামটাই বোধহয় ভুলে গেছে। এই মেয়েটাকে বুকে আগলেই তো সারাটা দিন কাটিয়ে দিতাম। মেয়েটার গায়ের গন্ধ পেলে নিজের সন্তান না হওয়ার কষ্ট ভুলেই যেতাম। চৈতিকে তুমি সকালে দিয়ে যেতে আর তারপর স্নান করানো, খাওয়ানো, ওর স্কুল, ওর সাথে খেলা এসবেই দিব্যি সময় কেটে যেত। কতগুলো বছর হাওয়ার মত হুশ করে বয়ে গেলো, কিন্তু সেই হাওয়াতেই যে অনুভূতি ছিলো, তার রেশ টেনেই কাটিয়ে দেবো বাকি জীবন।
লালিমা - শুধু তুমি চৈতিকে আগলে রাখো নি, চৈতির মানুষ হওয়ার জন্য যেটুকু করার তার সবটাই করেছো তুমি। আমি আর সময় পেতাম কই। অফিস, বাজার
আবার বাড়ি এসেও একটু বেশি উপার্জনের জন্য স্কুলের বাচ্চাদের সেলাই, পুতুল বানানো এসবের মাঝে চৈতিকে তোমার হাতে দিয়ে আমিও তো নিশ্চিন্তে ছিলাম।
আজ আর আমায় আটকিও না প্রতিমা, আর নিজেকেও আটকে রেখোনা। আমার চৈতি তো তোমারও।চৈতি কিন্তু তোমাকে মায়ের থেকে কম কিছু ভাবেনি কখনো। আমি একদিন বুঝেছিলাম জানো, একবার তোমার জ্বর হয়েছিল, তুমি বিছানায় শুয়ে অচেতন, সেইদিন আমি অফিস থেকে ফিরতেই চৈতির সেকি কান্না। আমায় এসে বলছে মা, তুমি শিগগিরই চলো, মামনি উঠতে পারছেনা, জ্বর হয়েছে। মা, একটু কিছু খাবার নিয়ে চলো, মামনি মনে হয় কিছু খায়নি, আর কাকুও অফিসে।মা, ডাক্তার কাকুকে একটা ফোন করি? আমি সেদিন ওর চোখে মায়ের কষ্টে সন্তানের হাহাকার দেখেছিলাম জানো।
মিথ্যে বলবনা সেদিন এক মুহূর্তের জন্য তোমার ওপর একটু হিংসেও হচ্ছিলো, আমার মেয়ে অথচ তোমার প্রতি এতো টান, যতই হোক মায়ের মন তো।
তারপর ভেবে দেখলাম জানো, তোমার এই আদরটা পাওয়া সাজে, তুমি তো কম কিছু করনা মেয়েটার জন্য, সারাটাদিন মেয়েটাকে আগলে রাখো তুমি, এতো খুব স্বাভাবিক।
দেখতো মেয়ের আজকে আইবুড়ো ভাতের দিনে আমরা দুই বুড়িতে মিলে নিজেদের গল্প নিয়েই পড়ে আছি। চলো প্রতিমা আর দেরি করনা বেলা হয়ে গেলো। চৈতি খেয়ে উঠলেই আবার ওকে মেহেন্দি পরানোর লোক চলে আসবে।
চৈতি তখন পাটভাঙা লাল পেড়ে হলুদ রঙের জামদানি পড়ে রানীর সাজে বসে আছে আসনে। পাশে শঙ্খ বাজছে, প্রদীপ জ্বলছে।সামনে পিতলের থালায় রাখা আছে পাঁচ ভাজা, ভাত, ডাল, মাছ, পায়েস আরো কিছু চৈতির পছন্দের খাবার। কিছুটা ভাত মেখে মুখে দিয়ে দিচ্ছে প্রতিমা। প্রতিমার চোখে আনন্দে জল চলে আসছে বারবার, কিন্তু সন্তানের এমন আনন্দের দিনে চোখের জল ফেলা অকল্যাণের তাই গলার কাছটা দলা পাকিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। লালিমা চৈতির মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করছে, ওর চোখ ও ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে বারবার।
চৈতির মুখে চোখে আনন্দের আলোয় ঝলমল করছে, তাকিয়ে দেখছে প্রতিমা আর লালিমার দিকে আর ভাবছে আমি কত ভাগ্যবতী, দুই মায়ের ভালোবাসা পেলাম এক জীবনে।এই মানুষ দুটো সমাজের কত সমালোচনা, কটুক্তি সব উপেক্ষা করে শুধু আমায় নিয়ে ব্যস্ত ছিলো এতদিন। শুধু আমায় দিয়েই গেলো এরা, এই ঋণ যে কনকাঞ্জলি দিয়ে শোধ করার নয়। মনে মনেই বলে চৈতি, আমি কিছুতেই চলে যাওয়ার সময় চাল ছুঁড়ে দিয়ে বলবনা যে মায়ের ঋণ শোধ করে দিলাম।এই ঋণ কি এজন্মে শোধ করা যায়?
ওসব অমানবিক নিয়ম পালন আমার দ্বারা হবেনা।
ক্যামেরাম্যান ও এমনই একটা মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিল এতক্ষণ। আর দেরি না করে ঝটপট ক্যামেরাবন্দি করে নিলো দুই মা আর মেয়ের এমন এক আলো ঝলমল ছবি।