Patra Lika

Inspirational

2  

Patra Lika

Inspirational

ঘর

ঘর

6 mins
50


অনুপ্রেরণা - যৌনকর্মীদের মনের কথা


বেশ কিছুদিন ধরেই অনির্বানকে এড়িয়ে চলছে নীলা।

আজকাল অনির্বান ঘরে এসে ঢুকলেই নীলা রাগের চোটে দুমদাম গালাগালিও দু একটা দিয়ে দেয়। সেদিন রাতে অনির্বান এসে দরজায় টোকা দিতেই, দরজাটা খুলেই নীলা বলতে শুরু করে, যে কাজে এসছো, তাড়াতাড়ি করে বিদায় হও। মাথাটা ধরেছে।

অনির্বান - আমি যে অন্যদের মত একই কাজে আসিনা নীলা এটা তুমি খুব ভালোই জানো। আমি শুধুমাত্র তোমার সাথে কথা বলার জন্য, তোমায় দেখার জন্য আসি।এটা কি তুমি বোঝনা? 


আচ্ছা নীলা, আমি তোমায় বিয়ে করতে চেয়েছি, তাই তোমার এত রাগ। আমায় বলতে তো পারো কিসে তোমার এত ঘেন্না আমার ওপর, আমায় দেখলেই এমন রেগে যাও। আমরা কি বন্ধু হতে পারিনা নীলা?


নীলা - বন্ধু? তুমি তো দেখছি হাসালে আমায়। বেশ্যার আবার বন্ধু?


বন্ধু তো আমাদের হয়না, আমাদের জীবনে শুধু বাবু থাকে। এই যেমন তুমি, আমার বাঁধা ধরা বাবু। তুমি কিচ্ছু না করলেও আমার এই কয়েক ঘণ্টা সময়টা কিনে নিয়েছ টাকা দিয়ে। আর ঘেন্না আমি তোমাকে কি করবো? ঘেন্না তো আমাদের সবাই করে বাবু। তবে ওই সংসার করার স্বপ্ন আমায় দেখিও না, ওসব কথা আমার শুনলেই গা পিত্তি জ্বলে ওঠে। 


অনির্বান - তোমায় কতবার বলেছি নীলা আমায় বাবু বলে ডাকবে না। আচ্ছা আমি তো ওই একই কাজে আসিনা তোমার কাছে, তাহলে ঐ একই দাঁড়িপাল্লায় আমায় নাইবা মাপলে। 


আর আমিতো কমদিন আসছি না তোমার কাছে, প্রথম যেদিন এসেছিলাম তোমার কাছে সেদিনও তুমি এমন দুরদুর করে তাড়িয়ে ছিলে মনে আছে। আমি তোমাদের সবাইকে বলেছিলাম আমি এখানে আসি তোমাদের অন্ধকার জীবনের শুরু, তারপর পথ চলা, অত্যাচারের কথা নিয়ে লিখতে চাই আমি, আমার এন জি ও র লোকেরা মিলে তোমাদের জন্য কিছু করতে চাই, তুমি সেদিনও বলনি নীলা তুমি কেমন করে এলে এখানে। আর তারপর কতদিন কেটে গেছে, আমি কত কথা ভাগ করেনি তোমার সাথে,এই দুটো ঘণ্টা সারাদিনের ক্লান্তি তোমার কাছে উজাড় করে আবার ফিরে যাই কাজে, তাও কি তোমার বন্ধু হয়ে উঠতে পারিনি নীলা?


নীলা - বন্ধু শব্দে আমার বিশ্বাস হয়না বাবু, যেমন ভালোবাসা, সংসার এসব কোন শব্দই আমাদের জন্য নয়। তারপর খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে, 

তুমি যখন শুনতে চাইছো তখন বলি, আমার বাড়ি মেদিনীপুরের এক গ্রামে। মেয়ে হয়ে জন্মেছিলাম বলে মাকে কত কথা শুনতে হতো। মা কিন্তু আমায় আগলে রাখতো বেশ। কিন্তু একটা ভাই হওয়ার পর মাও যেন কেমন বদলে গেলো, আমায় তখন বাড়িতে কেউ তেমন দেখতে পারেনা। পড়াশুনো করার বড় ইচ্ছে ছিলো, ভাইকে পড়াশুনো করিয়ে দাঁড় করাতে হবে, আর আমায় তো শশুর ঘরে হেঁশেল ঠেলতে হবে তাই আর স্কুলে যাওয়া, পড়াশুনো করা ভাগ্যে জুটলো না আমার। সকাল থেকে বাড়ির কাজকর্ম করা, ভাইকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা এসবই ছিলো আমার রোজকার রুটিন। ভাইকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার পথে ভাইয়ের স্কুলেই পড়তো, কাজলের সাথে বন্ধুত্ব হল আমার। তখন আমার বছর আটেক বয়স,কাজলের নয় কি দশ, থাকতো ও বাড়ির কাছেই, ওর সাথেই বিকেলবেলায় খেলা, একসাথে ঘুড়ি ওড়ানো, ক্ষেতের আল ধরে দুজনে ছোটাছুটি এসব করতে করতেই কখন যেন বয়স বেড়ে গেছে। যখন পনেরোতে পা দিলাম, বাবা এক সম্মন্ধ নিয়ে আসে, পাশের পাড়ার রবি কাকু, বয়স হয়েছে অনেক, বিয়ে হয়নি, কাঠের ব্যবসা। বাবা আর না করতে পারেনি তাকে, বিয়ের কথা দিয়ে ফেলে। 


সেদিন বেশ মেঘ করেছিল, বিকেলবেলা ছুটতে ছুটতে ধানক্ষেতের পাশের আমগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে কাজলকে বলেছিলাম সবটা।আমার এতদিনের একমাত্র বন্ধু কাজলকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি সেদিন, বলেছিলাম এই বিয়ে আমি করতে চাইনা। আমি একটা সুন্দর সংসারের স্বপ্ন দেখি। সেদিন কাজল বলেছিল, ও আমায় ভালোবাসে, বিয়েও করতে চায়। আমিও এক কথায় রাজি হয়েছিলাম সেদিন, বৃষ্টিভেজা বিকেলটা দুজনেই ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির জলে মেখে দুজনকে আপন করে নিয়েছিলাম। তারপর আর বেশি দেরি করিনি, এক সপ্তাহের মধ্যেই একদিন কাজলের কথায় কয়েকটা জামাকাপড় নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসি। সেদিন ভোরবেলা যখন ঘর ছেড়ে চলে আসছি, দূর থেকে একবার পেছন ফিরে দেখেছিলাম ঘরের দিকে, সেই আমার শেষ দেখা, আর কোনোদিন ফেরা হয়নি।


কাজলের হাত ধরে বেড়িয়ে এসে ট্রেনে করে কলকাতা শহরে আসা, চোখে তখন নতুন ঘর বাঁধার স্বপ্ন।কলকাতায় এসে একটা মন্দিরে নিয়ে গিয়ে আমায় সিঁদুর পরিয়ে দেয় কাজল, আর তারপর দুজনে মিলে একটা ভাড়াবাড়িতে থাকি দু সপ্তাহ। এই দুই সপ্তাহে আমার স্বপ্ন ডানা মেলতে শুরু করেছে সবে, তার মধ্যেই কাজল একদিন বললো, কাজের জন্য দূরে এক জায়গায় যাবে, সেদিন রাতে ফিরবেনা তাই আমায় রেখে আসবে ওর এক আত্মীয়ের বাড়িতে। 


সকালে একসাথেই দুজনে বেড়িয়ে আমায় নিয়ে রেখে এলো কাজলের এক মাসীর বাড়িতে, টের পাইনি তখনো এরপর কি অপেক্ষা করে আছে। তবে সেই মাসীর কাছেই সেদিন রাতে জানতে পেরেছিলাম মাত্র তিন হাজার টাকায় আমায় বিক্রি করে দিয়েছে কাজল।আমার সেই ছোটবেলার বন্ধু যে এই অন্ধকারের পথিক, আর আমায় ও টেনে নামালো কাদাজলেই, যখন বুঝেছি তখন আর ফেরার পথ নেই। তারপর থেকে প্রতিদিন, প্রতিরাত এই শরীরটা বারবার হাতবদল হতে হতে এখন সবটা সয়ে গেছে। কাজলকে ক্ষমা করে দিয়েছি কবেই, তবে মনে পড়েনা তেমন, শুধু মনে পড়ে মায়ের মুখটা, সেই ঘর। আর কোনোদিন ফেরা হবেনা আমার। বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে নীলা। 


অনির্বান - নীলা, আমরা কি ঘর বাঁধতে পারিনা, একটুও কি বিশ্বাস করতে পারোনি আমায় এতদিনে? 

নীলা - বিশ্বাস করবোনা বললেই যে মনকে বেঁধে রাখা যায়না বাবু, এই মন এমনই। ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে যায়, তবু আবার স্বপ্ন দেখে। 

আমায় বিয়ে করলে তোমার মান সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে বাবু। এই সমাজ তোমায় একঘরে করবে আমার মত। আমাদের যে সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখা মানা।

অনির্বান - আমি সব সামলে নেবো নীলা। সমাজ বদলাতে আমি পারবনা, সে চেষ্টাও করিনা। তবে কি জানো, এ সমাজের ঘরে ঘরে প্রতিটি মানুষ জানে তোমরা আছো বলেই কত ভদ্র ঘরের পুরুষ নিজের চাহিদা মিটিয়ে নিচ্ছে। তোমরা একঘরে ঠিকই কিন্তু, দুর্গা পুজোর প্রতিমা গড়ার প্রথম মাটি যে এই তোমাদের ঘরের। 

কোনোদিন ভেবে দেখেছো নীলা, যে নারী শক্তিকে আমরা মাতৃ জ্ঞানে পুজো করি, তিনিও তোমাদের স্থান দিয়েছেন নিজের শরীরে।ওই একটুকরো মাটি দিয়ে তার মৃন্ময়ী মূর্তিতেও তোমাদের ছোঁয়া লেগে থাকে। সমাজ যে এমনই, এমন অনেক চরম সত্যকে অগ্রাহ্য করে, দমিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু পারে কি? সত্য যে অমর, অবিনশ্বর।


নীলা - তুমি যাই বোলো বাবু, আমি স্বপ্ন দেখিনা আর। এই যেমন চলছে চলুক। বরং তুমি আর এসোনা আমার কাছে। নিজের জীবনটাকে গুছিয়ে নাও। 

কথাগুলো বলতে বলতে নীলা বেশ বুঝতে পারে, অনির্বানকে চলে যেতে বলতে কেমন যেন একটা কষ্ট হচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন সত্যি যদি আবার একটা ঘর বাঁধতে পারতো, আবার নতুন করে সংসার করতে পারতো। এই জীবন যে আর ভালো লাগেনা ওর। 

ভাবতে ভাবতেই আবার চোখটা জলে ভরে যাচ্ছে নীলার।


অনির্বান - কি এত ভাবছো নীলা? আমি কি একটুও বিশ্বাস অর্জন করতে পারিনি। সব ছেলেই একরকম হয়না নীলা। তোমার চোখের জল বলে দিচ্ছে নীলা তুমি জোর করে আমায় ফিরিয়ে দিতে চাইছো। আমি জানি নীলা এই অন্ধকার থেকে বেরোনোর পথ খুব একটা সহজ নয়, তবে দুজনে একসাথে চললে সবটা সহজ হয়ে যাবে। তুমি যদি চাও, আমি খুব তাড়াতাড়ি নিয়ে যাবো তোমায় এখান থেকে।


সেদিন অনির্বান যখন নীলার হাতটা ধরেছিল শক্ত করে, নীলা আর ফিরিয়ে দিতে পারেনি। নীলা আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল ঘর বাঁধার। 

এরপরের বেশ কিছুদিন খুব কঠিন ছিল ওদের কাছে। একবার এই অন্ধগলিতে এসে ঢুকলে ফেরা যে কতটা কঠিন সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিল সমাজ ওদের। তবে ভালোবাসা কিচ্ছু মানেনা, যেকোন লড়াই ভালোবাসা থাকলে যে কতটা সহজ হয় সেটা প্রমান করে দিয়েছে অনির্বান আর নীলা। অনেক দুর্যোগ কাটিয়ে কঠিন সংগ্রামের পর আজ ওরা দুজনেই বিয়ের পিড়িতে। বেশ কিছু কাছের বন্ধু আর বাবা মাকে নিয়ে আজ ওরা বিয়ের সই সাবুদ, রীতিনীতি পালন করে চলে এসছে এক অনাথ আশ্রমে। প্রায় পঞ্চাশজন অনাথ শিশুদের সাথে সারাদিন কাটিয়ে, এক অন্যরকম বিয়ের অনুভূতি সঙ্গে করে নিয়ে শুরু হয়েছে অনির্বান নীলার ভালোবাসার ঘর।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational