Patra Lika

Romance Inspirational

3  

Patra Lika

Romance Inspirational

দশভূজা

দশভূজা

5 mins
394



তুই তৈরী হয়ে নে, আমি গরম গরম ভাত বেড়ে দিচ্ছি বলেই থালা নিয়ে ভাত বাড়তে চলে যায় দুর্গার শাশুড়ি মলিনা দেবী। দুর্গা কোনরকমে কয়েক মগ জল ঢেলে স্নানটা সেরে একটা কুর্তি আর পাজামা পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সিঁথিতে সিঁদুরটা পড়তে পড়তে চোখ চলে যায় ঘড়ির দিকে। ইস খুব দেরী হয়ে গেলো আজকে , বলতে বলতেই দুর্গা ওরনাটা জড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসে। কিরে কোথায় চললি , কয়েক গাল ভাত খেয়ে যা মা, সেই সারাটা দিন রোদে জলে রাস্তায় রাস্তায় কাটে, ঠিকমতো খাওয়া না হলে যে তোর শরীর খারাপ করবে। আর তুই দুটো মুখে না দিলে আমরা কি মুখে তুলতে পারি মা। আয় আমি একটু মুখে দিয়ে দি বলেই ঝটপট কয়েক গ্রাস ভাত দুর্গার মুখে তুলে দেয় মলিনা দেবী ।আর সেইসময় পাশের ঘর থেকে রুমা হাঁক দেয় আজ কিন্তু একটু তাড়াতাড়ি আসিস , মেলায় যাবো। রুমা দুর্গার একমাত্র ননদ , ওর যত আবদার ওই দুর্গার কাছেই, দুজনের বয়েসের ফারাক ও খুব কম,তাই তুইতোকারিই চলে ওদের। খাওয়া হতেই কোনরকম চটিটা পায়ে গলিয়ে গলির মোড়ের থেকে ডানদিকটায় বেঁকে স্ট্যান্ডের দিকে রাস্তা ধরে। কে যেন পেছন থেকে বলে ওঠে, ওই চললো এখন বাস নিয়ে দুনিয়া ঘুরে বেড়াবে। বরটাও একটা ভেড়া আর শাশুড়ি ননদ সবকটাই ওর হাতের মুঠোয় কেউ কিচ্ছু বলেনা। সারাটা দিন বাড়ির বউ হাজারটা পরপুরুষ কে বাসে উঠিয়ে চষে বেড়াবে, ছি ছি এমন মেয়েছেলে আমার ঘরে এলে কবেই বের করে দিতাম। সবটা শুনেও একবারও পেছন ফিরে তাকায় না দুর্গা, এসব শুনতে শুনতে ওর গা সওয়া হয়ে গেছে, কত লোক তো বাড়ি বয়ে এসে ওর শাশুড়িকেও কত কথা শুনিয়ে যায়, কিন্তু উনিও এসব কানে নেন না, বরং দুচার কথা শুনিয়ে বিদায় করেন। কখনো হাতে সময় থাকলে এসব কথা নিয়ে শাশুড়ি বৌমা হাসাহাসি ও করে , মাঝখান থেকে রুমা ও টিপ্পনী কাটে তোরা আবার হাসছিস এসব কথা নিয়ে, তোদের কিন্তু পাড়ায় আর রাখবেনা বৌদি। এসব ভাবতে ভাবতে মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে স্ট্যান্ডের দিকে দৌড়ায় দুর্গা, এক কোণে রাখা বাসটার দিকে এগিয়ে গিয়ে সামনের দরজাটা খুলে প্রথমেই সামনের কাঁচের গায়ে লাগানো ঠাকুর দেবতাদের একটু ধুপ দেখিয়ে , কয়েকটা নকুলদানা দিয়ে , মা বাবার ছোট্ট একটা ছবিতে প্রনাম করে সিটে বসে পড়ে। আর তারপর স্টিয়ারিংটা ধরে একটু আগুপিছু করে স্ট্যান্ডটার সামনে এনে দাঁড় করায়।


এই স্টিয়ারিংটায় হাত পড়লেই নিজেকে রাজা মনে হয় দুর্গার। মনে হয় যেন ওই যে তার বাসের প্যাসেঞ্জাররা তাদের সব্বার জীবনের স্টিয়ারিং গন্তব্যে না পৌঁছনো পর্যন্ত ওরই হাতে। স্টিয়ারিংটায় হাত রেখে মনে মনে একটা প্রনাম সেরে নেয় দুর্গা, আর বলে সব্বাইকে যেন সুস্থ ভাবে তাদের পরিবারের হাতে তুলে দিতে পারি। বলতে বলতেই কিছুক্ষণের মধ্যে বাসে উঠে পড়ে রাজু। রাজু এই বাসেই কন্ডাক্টরের কাজ করে। দুর্গার পাড়াতেই মামারবাড়ি রাজুর। বাপ মা মরা ছেলেটার মামা মামীর কাছে আদর যত্নের বদলে রোজ জুটতো বেদম মার, প্রায় খাওয়াই জুটতো না রাজুর। একদিন বাসন মাজতে গিয়ে দুটো কাঁচের কাপ ভেঙেছিল বলে রাজুর হাতে গরম জল ঢেলে দিয়েছিল ওর মামী। সেসময় রাজুর চিৎকারে পাড়ার লোকজন জড়ো হলেও কেউ আর ওর মামীর গালাগালির ভয়ে এগোয় না। এই দুর্গাই সেদিন রাজুকে বের করে নিয়ে আসে , আর এই বাসের কন্ডাক্টরের কাজ দেয়। সেই থেকেই রাজু , দুর্গা আর ওর বাড়ির সবার কাছে নিজের লোকের মতই আছে। দুর্গা রাজুকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছে বেশি তাড়াহুড়ো করবিনা, কেউ যেন উঠতে গিয়ে পড়ে না যায়, বয়স্ক মানুষদের সাবধানে ওঠাবি। দ্যাখ শুধু পয়সা রোজগার করলেই হবেনা, এই মানুষগুলো নিত্যদিন যাতায়াত করে বলেই কিন্তু আমাদের পেট চলছে, এটা কিন্তু মাথায় রাখতে হবে। সেইমত রাজুও সবদিকে খেয়াল রাখে। দুর্গা শিয়ালদহ হাওড়া রুটের বাস চালায়।সারাদিন কত রকম লোক, তাদের কত্ত রকম গল্প । কেউ অফিস ছুটছে, কেউ বউকে নিয়ে বেড়াতে, কেউ বা দূরে কোথাও ঘুরতে যাচ্ছে হাওড়া থেকে ট্রেন ধরবে, কেউ বা বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে , বাচ্চারা মায়ের হাত ধরে স্কুলে, কেউ যাচ্ছে কলেজ কেটে প্রেমিকার সাথে দেখা করতে এরকম কত গল্প শুরু হয় আর শেষ হয় এই বাসে আর তার স্বাক্ষী থাকে দুর্গা আর রাজু। সারাদিনের শেষে ঘরে গিয়ে রাজু কে নিয়ে গুনতে বসে দিনের কামাই।


এই কাজটায় মেয়েরা তেমন আসেনা বলে দুর্গাকে লোকজন ভালোও বাসে। কেউ কেউ দুর্গা দি, কেউ আবার ম্যাডাম, কেউ আবার দুর্গা বলে ডাকে ওকে। দুর্গার ও তো আসার কোনো ঠিক ছিলনা, রমেনের সাথে বিয়ের ঠিক মাস সাতেক পরেই রমেন যে গেঞ্জির কারখানাতে কাজ করতো সেটা বন্ধ হয়ে যায়। আর তারপর থেকে রমেন ঘুগনি আর পাউরুটি , ডিম সেদ্ধ নিয়ে ওই বড়ো রাস্তার মোড়টায় বসতে শুরু করে। তখন তেমন বিক্রিবাটাও ছিলনা, তাই একদিন পাড়ার বাদলদার সাথে কাজ নিয়ে কথা বলতে বলতে দুর্গা মনস্থির করে নেয় সেও বাদলদার মত বাস চালাবে। প্রথম প্রথম রমেন আকাশ থেকে পড়ে, কি বলছিস কি তুই দুর্গা, তুই বাস চালাবি? মেয়েমানুষ কোনোদিন বাস চালাতে দেখেছিস? এসব ভূত তুই মাথার থেকে নামা বলে দিচ্ছি ওর থেকে যেমন ঘুগনি তৈরি করে দিচ্ছিস তেমনি কর। আচ্ছা তোর কাজ করতে ইচ্ছে হয় আমার সাথে ঠেলাগাড়িটা নিয়ে বসিস না হয়।দুজনে মিলে কথাও হবে কাজও হবে। সবটা চুপ করে শোনে দুর্গা তারপর বলে , মেয়েরা তো আগে চাকরিও করতোনা, ঘর সামলাতো, মেয়েরা তো আগে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ও হতো না, মহাকাশেও যেতনা। এখন তো সব পেশাতেই মেয়েরা আছে। আর মেয়েমানুষ বাস চালায় না বললেই হবে, কাউকে না কাউকে তো শুরু করতেই হবে। আমি শুরু করলেই দেখবে মেয়েরাও বাস চালাতে আসবে। দুর্গার জেদ দেখে আর দ্বিধা করেনা রমেন, শুধু বলে সাবধানে চালাবি, রাস্তায় কত গাড়ি , মনে রাখিস আমি কিন্তু তোকে হারাতে পারবো না। কথাটা শুনে দুর্গা হাতটা চেপে ধরে রমেনের। দেখো কেউ কাউকে হারাবনা আমরা , এতগুলো পেটের সংসার , তার ওপরে সবার শখ আহ্লাদও আছে একা তুমিই খেটে মরবে কেন ? দুজনেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংসারটাকে টেনে নিয়ে যাই।


দুর্গার মুখের দিকে হাঁ করে সেদিন তাকিয়ে ছিলো রমেন। একটা মানুষ এত নিখাদ ভাবে এতগুলো মানুষকে ভালোবাসতে পারে ভেবে দুর্গাকে নিয়ে বড়ো গর্ব হয় রমেনের। জানলা দিয়ে এক চিলতে রোদ এসে পড়ছিল তখন দুর্গার মুখে। মনে হচ্ছিল দুর্গার সাথে মিলেমিশে যাচ্ছে সামনের মন্দিরের দুর্গা প্রতিমার মুখখানা।





Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance