সঞ্চারী চ্যাটার্জী

Romance Tragedy Classics

4.8  

সঞ্চারী চ্যাটার্জী

Romance Tragedy Classics

জিজীবিষা

জিজীবিষা

61 mins
1.8K


আজ জানে কি জিদ না কারো

আজ জানে কি জিদ না কারো

আজ জানে কি জিদ না কারো


ইঁউ হি পেহ্‌লু ম্যা ব্যাইঠে রাহো

ইঁউ হি পেহ্‌লু ম্যা ব্যাইঠে রাহো


আজ জানে কি জিদ না কারো


হায়ে মার জায়েঙ্গে, হাম তো লুট জায়েঙ্গে

অ্যাইসি বাতে কিয়া না কারো


আজ জানে কি জিদ না কারো

আজ জানে কি জিদ না কারো...


হায়ে মার জায়েঙ্গে, হাম তো লুট জায়েঙ্গে

অ্যাইসি বাতে কিয়া না কারো

আজ জানে কি জিদ না কারো...


তুম হি সোচো যারা কিঁউ না রোকে তুমহে

জান জাতি হ্যা যাব উঠকে যাতি হো তুম

জান জাতি হ্যা যাব উঠকে যাতি হো তুম

তুমকো আপনি কাসাম জানে-ই-জাঁ

বাত ইতনি মেরি মান লো


মধ্য রাত।মায়া নগরী মুম্বাইতে রাত ১টা কিছুই নয়।ওরলির সমুদ্রের ধারে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের ৪৫ তলায় কাঁচের জানালার ধারে বেতের দোলনায় হাতে ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফরিদা খানমের এই মায়াবী গজলে ডুবে আছে বছর চল্লিশের মালিনীর।লম্বা ছিপছিপে চেহারা মালিনীর।উজ্জ্বল শ্যমবর্ণ রঙের নির্লোম ত্বক নিয়মিত মাজা ঘষার ফলে চক চক করছে।স্ট্রেটেনিং করা চুল কাঁধ ছাড়িয়ে কোমর ছুঁয়েছে।অনায়াসে ২৫বছরের তন্বী বলে চালানো যায়।মোহময়ী নীল ফিনফিনে রাত পোশাকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে তাকে।ধীরে ধীরে উঠে সে খোলা বারান্দার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।আচ্ছা এখান থেকে লাফ দিলে কেমন হয়?নিচে ঝুঁকে দেখলো এত রাতেও প্রচুর গাড়ি যাচ্ছে মুম্বাইয়ের রাস্তা দিয়ে।ঝাঁপিয়ে পড়বে সে?৪৫ তলা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লে তার এত যত্নে তিল তিল করে গড়ে তোলা শরীরটা নিমেষে শুধু বডি হয়ে রয়ে যাবে।ডানদিকে তাকালে ঝিলমিল করছে মুম্বাইয়ের বিখ্যাত নেকলেস রোড।সমুদ্রের ঢেউ গুলোর আছড়ে পড়ছে পাড়ে।তার জীবনটাও একদিন আছড়ে পড়েছিল এই মায়া নগরীতে।কিন্তু ঢেউ যেমন আবার ফিরে যায় তার মূল উৎসে তেমন করে আর শান্তিনিকেতনে ফেরা হয়নি লাবণ্যর।সে মুম্বইয়ের মিস মালিনী হয়েই রয়ে গেছে।

আজ কি নেই তার কাছে?১৮ কোটি টাকার বিলাসবহুল ফ্ল্যাট,২-৩ টে ফাইভ স্টার ক্লাস গাড়ি।তার শুধু মুখ থেকে পড়ার অপেক্ষা,বছর ৬৫ এর মিস্টার আগারওয়াল পারলে আকাশের চাঁদটাও মালিনীর পায়ে রেখে দেন।তবু শান্তি নিকেতনের মায়ের হাতে সযত্নে গড়ে তোলা বাগান ঘেরা এক তলা বাড়িটাকে ভুলতে পারেনা মায়ের আদরের লাবু।মিস্টার আগারওয়াল এতকিছুর বদলে শুধু মাসে চার পাঁচদিন তাকে বিছনায় টেনে নেন।মালিনী ঘরের আবছা আলোয় তার রূপের মায়া জাল বিস্তার করে।কিন্তু মাত্র কয়েক মিনিট মালিনীর শরীরটাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়েন মালিনীর বুকে।আরেকটু ঝুঁকল মালিনী।পেট অব্দি শরীরটা রেলিংয়ের বাইরে।কি জোরে হাওয়া দিচ্ছে।দুইহাত দুইদিকে ছড়িয়ে দিল রাগিনী।মনে হচ্ছে এখুনি উড়ে যাবে।এমন সময় দরজার বেলটা বেজে উঠলো,ডিং ডং।

এই অসময়ে আবার কে?মিস্টার আগারওয়াল তো আজ রাতের ফ্লাইটেই সিঙ্গাপুর গেলেন।ফ্লাইট কি তবে ক্যানসেল হলো?উফফ একটু শান্তিতে মৃত্যু উপভোগ করবে মালিনী তার ও উপায় নেই।এইসব ভাবতে ভাবতে সে দরজার দিকে গেল।পা টা সামান্য টলছে।আইহোল দিয়ে না দেখেই দরজাটা খুলে দিল মালিনী।সামনে একটা বছর ২০র মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।পরনে একটা হাটু অব্দি গেঞ্জির ক্যাপরি,গায়ে লাল কালো স্ট্রাইপ দেওয়া স্যান্ডো গেঞ্জি।ভুরুর কাছে একটা রিং।একটা হাত দরজার পাশের দেওয়ালে আরেকটা হাত কোমরে।পা দুটো আরাআড়ি ভাবে রেখে চুইংগাম চিবচ্ছে।মালিনী ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসু ভাবে তাকালো।

মেয়েটি বুঝতে পেরে বলে উঠলো,"হাই!আমি তিতাস।তোমার পাশের ফ্ল্যাটে থাকি।আজ রাতটা তোমার ফ্ল্যাটে থাকবো।"এই বলে হন হন করে ভেতরে ঢুকে এলো।

মালিনী হতবাক।একি চেনা নেই জানা নেই একটা মেয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে এলো।এ আবার কি?অবশ্য একেবারে মালিনী একে চেনে না তা নয়।কমপ্লেক্সের লনে অনেকবার দেখেছে মেয়েটাকে কানে হেডফোন গুঁজে,পনিটেল দুলিয়ে দৌড়াতে।ওর পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে।ওর বাবা মার সাথে দেখা হলে একটা সৌহার্দ্য জনক হাসি হেসে পাশ কাটিয়ে যেত।ব্যাস এইটুকুই।তাও হয়তো দুই পক্ষই বাঙালি বলে এইটুকু ভদ্রতা দেখাতেন একে অপরের প্রতি।ফ্ল্যাটের অন্যান্য বাসিন্দারা তো এমন ভাব করে যেন কোনোদিন একে অপরকে দেখেই নি।অবশ্য মুম্বাইয়ের ইঁদুর দৌড়ে একজন অপরিচিতের পেছনে এর থেকে বেশি সময় নষ্ট করলে লোকসান উভয় পক্ষেরই।

ঘরে ঢুকেই তিতাস ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা জলের বোতল বের করে টেবিলে উপুড় করা একটা গ্লাস নিয়ে তার মধ্যে জল ঢেলে ঢক ঢক করে খেয়ে নিল।তারপর বলল,"সরি টু বদার ইউ এট দিস টাইম।আসলে আমার আর কোনো উপায় ছিল না জানো।"

মালিনী কোনো কথা বললো না।তার তখনো অবাক হওয়ার ঘোর কাটেনি।এদিকে তিতাস বলতেই থাকলো,"আমি তোমার পাশের ফ্ল্যাটেই থাকি বাবা মায়ের সাথে।সকালে দুজনেই যে যার কাজে চলে যান।আমি সকালে কলেজ,রাতে একটা কল সেন্টারে কাজ করি।আজ জাস্ট ব্রেক আপ হয়েছে আমার।১বছর বিছানা রগড়ে আজ তার মনে হয়েছে i am not a marriage material.Son of a beach.

বাড়িতে এসেও দেখি সেই অবস্থা।মা বাবা তুমুল ঝগড়া করছে।জানো শুধু এই ঝগড়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য আমি রাতের প্রজেক্টটা নিয়েছি।atleast এই ঝামেলা থেকে তো শান্তি।আজ এমনিতেই মাথাটা গরম হয়ে রয়েছে বাস্টার্ডটার জন্য তাই অফিস ডুব দিয়েছি।কিন্তু বাড়ি ঢুকেই দেখি অনিতা আন্টি,আমার বাবার সেক্রেটারি,তাকে নিয়ে ঝামেলা চলছে।ঘরে ঢুকতেই ইচ্ছে করলোনা সালা।বন্ধু গুলোও সব কোথায় দারু খেয়ে উল্টে পরে আছে কে জানে?ফোনই ওঠাচ্ছেনা।তাই ভাবলাম তোমায় একবার নক করে দেখি।আজ রাতটা তোমার ড্রইং রুমের সোফাতেই কাটিয়ে দেবো।প্লিজ আন্টি ডোন্ট মাইন্ড।"

মালিনী এবার একটু গম্ভীর হয়ে বললো,"আন্টি নয়।হয় মিস মিত্র বলো অথবা মালিনী,শুধু মালিনী।"

তিতাস-"সরি আন্টি,আ আ আই মিন মিস মিত্র।"

মালিনী নিজের আরাম কেদারায় বসে ডেভিল ডোফের প্যাকেটটা তিতাসের দিকে বাড়িয়ে দিল।

তিতাস একটা দেঁতো হাসি হেসে প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে বললো,"ওরে বাবা,এত ইম্পোর্টেড।আমি অবশ্য গোল্ডফ্লেক লাইট দিয়েই কাজ চালাই।কল সেন্টারের ওই টুকু মাইনেতে এর থেকে বেশি afford করতে পারিনা।হি হি।"

মালিনী সিগারেটটা ধরিয়ে আরাম কেদারায় নিজের শরীরটাকে হেলান দিয়ে একটা গোল ধোঁয়া ছেড়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,"পারমিশন না নিয়ে ঘরে যখন ঢুকেই পড়েছ তখন সোফায় শোওয়ার দরকার নেই।সোজা ঘরটা গেস্ট রুম।ওখানে রাতে শুয়ে পড়ো।কাল সকাল হলে চলে যেও।আমায় ডাকার প্রয়োজন নেই।দরজাটা টেনে দিয়ে চলে যেও।"

তিতাস "ওকে,গুডনাইট"বলে গেস্ট রুমে চলে গেল।

মালিনীর মুডটাই নষ্ট করে দিল মেয়েটা।মিউজিক সিস্টেমটা আপনা আপনি চলতে চলতে বন্ধ হয়ে গেছে।হাতের গ্লাসটার মদ ও শেষ হয়ে গেছে।মালিনী চোখ বন্ধ করে আপন মনে গুন গুন করতে লাগলো,"চ্যান সে হামকো কাভি আপনে জিনে না দিয়া,জেহের ভি চাহা আগর পিনা তো পিনে না দিয়া।"


সকালবেলার প্রথম রোদ এসে মালিনীর মুখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেলো।আস্তে ধীরে উঠে মুখে চোখে জল দিল।রান্নাঘর থেকে খুট খাট আওয়াজ আসছে।রিতা এত সকাল সকাল এসে গেছে নাকি আজ।রিতার কাছে মালিনীর ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি থাকে।রিতা ঘরের সব কাজ করে।বাসন মাজা,ঝার দেওয়া,জামাকাপড় কাচা,রান্না করা,ঘর পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখা অব্দি।

মালিনী সোফায় বসতে যাচ্ছিল।তারপর আবার হটাৎ মনে পড়লো আজ তো রবিবার।আজ তো রিতার ছুটি থাকে।তাহলে রান্না ঘরে কে?উঠে এগিয়ে গেলো মালিনী রান্নাঘরের দিকে।দেখল কানে হেডফোন গুঁজে ইংলিশ গান গাইতে গাইতে তিতাস অমলেট ভাজছে।মালিনীকে দেখেই একগাল হেসে বললো,"ওহ উঠে পড়েছ?গুডমর্নিং।আমি তোমার জন্যেই ব্রেড অমলেট বানাচ্ছিলাম।ভাবলাম তুমি কাল রাতে আমার এত বড় একটা হেল্প করলে,আমারও তোমার জন্য কিছু একটা করা উচিত।ঘরে গিয়েও ব্রেকফাস্ট বানাতাম ই তাহলে এখানেই বানিয়ে দুজনে খাওয়া যাক।"প্লেটে অমলেটটা ঢেলে তিতাস মালিনীর মুখের সামনে ধরে বলল,"ট্যান ট্যানা।তিতাসের ইসপেশাল ব্রেড অমলেট রেডি।"

 মালিনী এতক্ষন চুপ চাপ দাঁড়িয়ে দেখছিল।এখন রাগে লাল হয়ে গিয়ে প্লেট টা ছুড়ে ফেলে বললো,"how dare you?what do u think of yourself.একটা রাত থাকতে দিয়েছি বলে কি নিজেকে এই বাড়ির বাসিন্দা ভাবছো।তোমায় তো সকালের উঠেই চলে যেতে বলেছিলাম।যাওনি কেন? leave."তারপর চেঁচিয়ে বললো,"i said leave now."

তিতাস ভ্যাবাচ্যাকা মুখ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।মালিনী নিজের কপালটা ধরে বসে পড়লো।মাথাটা ধরিয়ে দিল মেয়েটা।কাল রাতে পেগটাও একটু বেশি হয়ে গেছিল।কড়া করে এক কাপ কফি বানিয়ে খেতে হবে।মালিনী উঠে রান্নাঘরের দিকে গেল।এমন সময় শুনলো দরজায় দুম দাম করে যেন কে ঘুষি মারছে।বিরক্ত হয়ে মালিনী দরজার কাছে গেল।শুনতে পেল হালকা একটা আওয়াজ।যেন কেউ চিৎকার করছে।দরজাটা খুলতেই মালিনীর গায়ের ওপর হুড়মুড়িয়ে পড়লো তিতাস।যেন কিছু দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছে।ঢোক গিলে 


তিতাস হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,"মাহ মাহ।আমার মা।"

মালিনী এবার ভয়ানক রেগে বললো,"কি হয়েছেটা কি?তোমার কি চাই বলতো?কাল থেকে অতিষ্ঠ করে দিচ্ছো।"

তিতাস বললো,"মাহ ডাইনিং এ মুখ উল্টে পরে আছে।রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারদিক।বাবা কোথাও নেই।আমি কি করবো এখন?কোথায় যাবো?আমার তো এই দুজন ছাড়া আর কেউ নেই।"

মালিনী ভাবলো এতো মহাজ্বালায় পরা গেলো।সে কপাল কুঁচকে বিরক্ত হয়ে বললো,"কৈ চলো দেখি।"ঘরে ঢুকতেই ড্রইং কাম ডাইনিং রুম।ডাইনিংয়ের সামনেই উপুড় হয়ে পরে আছে তিতাসের মায়ের মৃতদেহ।মাথার নিচ থেকে রক্ত বেরিয়ে ফ্লোর ভিজে আছে।মালিনী তিতাসকে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে প্রথম ফোন করলো ফ্ল্যাটের সিকিউরিটিকে আর ফ্ল্যাটের কমিউনিটির প্রেসিডেন্টকে তারপর লোকাল থানায়।সবাই এসে জড়ো হলো তিতাসদের ফ্ল্যাটে।তিতাস মালিনীর গেস্ট রুমে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে।মালিনী দেখলো কালকের ড্যাশিং মেয়েটার বদলে আজ তার সামনে রয়েছে ভীত সন্ত্রস্ত চড়ুই পাখির ছানা।পুলিশ এসে মৃতদেহ পাঠিয়ে দিল পোস্টমর্টেমের জন্য।মেইন দরজা থেকে বেডরুম অব্দি সিল করে দিয়ে গেছে।তিতাসকে নিয়ে মালিনী থানায় গেছিল FIR করতে।থানাতে তিতাসের বয়ান নেওয়া হয়েছে।তিতাস কিছুই বলতে পারেনি।কেঁদে কেঁদে হিক্কা তুলে তুলে মালিনীর কাঁধে মাথা রেখেছে।সব মিটতে মিটতে বেশ রাত হলো।থানা থেকে ফেরার পথে তিতাসকে নিয়ে একটা কফিশপে ঢুকলো মালিনী।একটা স্যান্ডউইচ আর এক কাপ কফি এগিয়ে দিল তিতাসের দিকে।সকাল থেকে ওদের দুজনেরই কিছু খাওয়া হয়নি।তিতাস স্যান্ডউইচ টা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বললো,"জানি কাল থেকে তোমার কাছ থেকে প্রচুর হেল্প নিচ্ছি।আমার বলার মত মুখ নেই তবু বলছি কিছু টাকা ধার দিতে পারবে আমায়?কাল থেকে এই এক জামা কাপড়ে রয়েছি।ঘরও এমনভাবে সিল করে দিয়ে গেছে যে নিজের জিনিষ পত্র আনতেও যেতে পারছিনা।আজ কিছু পরার মত জামা কিনতাম।"

মালিনী-"অনেক রাত হয়ে গেছে।সারাদিন প্রচুর ধকল গেছে।আজ আর কিছু কিনতে হবে না।আমার বাড়ি গিয়ে স্নান খাওয়া করে আমার নাইট গাউন পরে নিও।i hope size will be same."

তিতাস-না না।তোমার বাড়ি থাকবো না।আজ রাতটা সিঁড়ির নীচে কাটিয়ে কাল সকালেই বন্ধুদের ফোন করবো।যদি কেউ কটাদিন রুম শেয়ার করে।"

মালিনী হালকা হেসে বললো,"মুম্বাইয়ে একা একটা মানুষের মাথার ছাদ জোগাড় করাই difficult আর তোমায় কি করে তারা জায়গা দেবে।এমনিতেই তোমার সাথে সকাল থেকে আছি।এই কেস টাতে আমিও জড়িয়ে পড়েছি।এরপর তোমার কিছু হয়ে গেলে আমায় পুলিশ ছেড়ে কথা বলবে না।এখন স্যান্ডউইচ টা খেয়ে বাড়ি চলো,ফ্রেশ হয়ে নাও।আমি কিছু অর্ডার করে নেব for dinner।"

তিতাস-"আমি কিছু খাবোনা।খিদে নেই।"

মালিনী-" সকাল থেকে কিছু খাওয়া নেই তাই ওরকম মনে হচ্ছে।স্যান্ডউইচটা খেয়ে নাও।নাহলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।আমার আর বিপদ বাড়িও না প্লিজ।"

তিতাস চুপচাপ স্যান্ডউইচটা খেয়ে নিল।তারপর মালিনী গাড়ি স্টার্ট দিতেই তিতাস বলে উঠলো,"গাড়িটা একটু মেরিন ড্রাইভের দিকে নেবে প্লিজ।"মালিনী অবাক হয়ে বলল,"সে তো আধঘন্টার রাস্তা।"

তিতাস-"ওহ!তাহলে ছেড়ে দাও।"

মালিনী-"আমি ভীষণ টায়ার্ড।আমার মনে হয় তুমিও।আমাদের দুজনেরই এখন বাড়ি গিয়ে রেস্ট নেওয়া উচিত।"

তিতাস কোনো উত্তর দিলোনা।ওর এখন ভীষণভাবে একা থাকতে ইচ্ছে করছে।গাড়িতে তখন বাজছে জগজিৎ সিংয়ের গলায় "চিটঠি না কই সনদেশ জানে ওকৌন সা দেশ যাহা তুম চলে গায়ে।'গাড়ির জানালার দিকে ফিরে তিতাস চোখ মুছতে থাকে।মালিনী গানটা বন্ধ করে দেয়।


বাড়ি ফিরে ওরা আর কিছু খেলোনা।স্নান করে শুয়ে পড়লো।তিতাস গেস্ট রুমে আর মালিনী নিজের বেডরুমে।

রাত্রিবেলা মালিনী জল খাওয়ার জন্য উঠলো।ডাইনিংয়ের দিকে যেতে গিয়ে পায়ে হোঁচট খেল।তাড়াতাড়ি লাইট অন করে দেখল তার বেডরুমের মাটিতে কার্পেটের ওপর তিতাস শুয়ে আছে।প্রথমে রাগ হলেও তিতাসের ঘুমন্ত মুখ দেখে মালিনীর খুব মায়া হলো।নিজের বিছানা থেকে চাদর এনে তিতাসের গায়ে দিয়ে দিলো।

তারপর নিজে জল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।পরদিন সকালে মালিনীর ঘুম ভাঙলো একটা মিষ্টি গানে।বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল তিতাস জানালা দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে এক মনে গাইছে,"তুমি রবে নীরবে,হৃদয়ে মম।"

মালিনী পেছন থেকে এসে তিতাসের পিঠে হাত রাখলো।জিজ্ঞেস করলো,"মাকে মিস করছো?"তিতাস চোখ বুজল আর দু ফোঁটা জল ওর গাল বেয়ে নেমে এলো।মালিনীর দিকে ফিরে তিতাস জানালো ওর গেস্টরুমে একা শুতে ভীষণ ভয় করছিল।তাই ও মালিনীর বেডরুমের ফ্লোরে শুয়েছিল।মালিনী কিছু বললো না।

কয়েকটা জরুরী ফোন করে নিলো।মিস্টার আগারওয়ালের দৌলতে বেশ কিছু উচ্চ পদস্থ অফিসারদের সাথে জানা শোনা আছে মালিনীর।বড় বড় পার্টিগুলোতে মালিনীর একটু সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য এরা নিঃস্ব হয়ে যেতেও দ্বিধা করেনা।মালিনী ফোন করার জন্য হোক বা সাধারণ নিয়মেই হোক তিতাসের মায়ের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তৈরি হয়ে বডি রিলিজ হতে বেশি সময় লাগলনা।দুপুরের মধ্যে তিতাসকে বলা হলো তার মায়ের মৃতদেহটি নিয়ে যেতে সৎকারের জন্য।তিতাস ও তার কয়েকটি বন্ধু গেল। J J Hospital থেকে মৃতদেহ এনে ওরলি মুসলিম কবর স্থানে কবর দিলো তিতাস ও তার বন্ধুরা।কবরে মাটি দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো তিতাস।এবার সে কোথায় যাবে?কতোদিন ই বা এইভাবে অন্যের বাড়ি থাকা যায়।সে বন্ধুদের জিজ্ঞেস করে কারোর বাড়িতে থাকা যাবে কিনা?ওর বেশিরভাগ বন্ধুই পেয়িং গেস্ট বা হোস্টেলে থাকে।কারোর পক্ষেই ওকে রাখা সম্ভব নয়।তিতাস মাথা নিচু করে কবরস্থান থেকে বেরিয়ে এলো।তখনই থানা থেকে ফোন এলো,"মিস মজুমদার আমরা আপনার ফ্ল্যাটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।আপনি একটু তাড়াতাড়ি আসুন।"

তিতাস একটা অটো ধরে ফ্ল্যাটের দিকে রওনা দিল।ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেখলো পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে।তিতাসকে দেখে পুলিশ অফিসার বললেন,"আসুন মিস মজুমদার,আমরা আপনার জন্যই wait করছিলাম।আমাদের প্রাথমিক তদন্ত শেষ।এবার আপনি আপনার ফ্ল্যাটে থাকতে পারেন।আমরা সিল তুলে নিয়েছি।তারপর একটু সরে গলা নিচে নামিয়ে আস্তে আস্তে তিতাসকে বললো,"আগে বলবেন তো আপনি মিস মালিনীর close friend।কোনো সমস্যা হলে জানাতে দুবার ভাববেন না। মুম্বাই পুলিস সব সময় আপনার সাথে আছে।"অফিসারটি নিজের কার্ড ওর দিকে বাড়িয়ে দিলো।

তিতাস অবাক হয়ে ভাবলো ও আবার কবে মালিনীর ফ্রেন্ড হলো।মালিনী তো ভালো করে ওর সাথে কথাই বলেনা।আবার ক্লোজ ফ্রেন্ড।তিতাস একটু হাসলো।বুঝতে পারলো ওকে নিজের ঘাড় থেকে নামাতেই মালিনীর এই উদ্যোগ।তিতাস ঘরে ঢুকলো।


পরদিন সকালে মালিনীর ঘুম ভাঙল তার কাজের লোক রিতার ডাকে।রিতা মালিনীকে ডেকে বললো,"মাইডাম আজ সকালে আপনার ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি পাশের ঘরের দিদিমণি আপনার দরজার সামনে গুটি সুটি মেরে শুয়ে আছে।"

মালিনী অবাক হয়ে হাউজকোট চাপিয়ে বাইরে এলো।তিতাসের মাথার কাছে উবু হয়ে বসে হাত বুলিয়ে ডাকল।তিতাস উঠে বসতেই জিজ্ঞেস করলো,"তুমি এইভাবে এখানে কেন শুয়ে আছো।"তিতাস চোখ কচলে বললো তার রাতে নিজের ফ্ল্যাটে শুতে ভীষণ ভয় করছিল।মালিনী হেসে বললো আজ থেকে রাতে তিতাস তার কাছে শুতে পারে।তিতাস মাথা নিচু করলো।

এরপর প্রায় একসপ্তাহ কেটে গেছে।তিতাস সকালে কলেজ যায়।ওর কলসেন্টার ডিউটি এখন দুপুরে হয়ে গেছে।রাত্রি ৮টার মধ্যে বাড়ি চলে আসে।আগে তিতাস নিজের ফ্ল্যাটে রান্না করে খেত এখন রান্না নিয়ে মালিনীর ফ্ল্যাটে চলে আসে।দুজনে এক সাথে ডিনার করে ঘুমায়।

তিতাস সারাদিন কি হয়েছে সব খুঁটিনাটি গল্প করে মালিনীকে।মাঝে মাঝে ওদের আড্ডায় রিতা ও যোগ দেয়।বেশ ভালো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে দুইজনের মধ্যে।দুইটি একলা,নিঃসঙ্গ নারী কিছুটা সময় এক সাথে কাটায়।সময়টাও ভালোই কাটে।মালিনী এখন অন্ধকারে একা বসে রাত জাগেনা।মরবার ইচ্ছেটাও একটু কমেছে।দুজনে হাসি ঠাট্টায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে নিজেরাই জানেনা।সকালে অনেক সময় রিতাকে সরিয়ে নিজে হাতে তিতাসের জন্য টিফিন বানায়।একদিন তো মায়ের রেসিপি অনুযায়ী বানালো শান্তিনিকেতনের বিখ্যাত আনন্দ নাড়ু।তিতাস তো খেয়ে মুগ্ধ।বেশ কয়েকটা অফিস কলিগদের ও খাওয়ালো।এইভাবেই বেশ চলছিল।

এরমধ্যে একদিন তিতাসের অফিসে একটা প্রজেক্ট নিয়ে খুব ঝামেলা হয়।তিতাসের মুড সেদিন এমনিতেই অফ ছিল তার ওপর সিড, ওর পুরোনো বয়ফ্রেন্ড আবার ওর কাছে ফিরে আসতে চাইছে।এই কটাদিন ওর থেকে দূরে থেকে সিডের ভীষণ কষ্ট হয়েছে।ও এখন তিতাসের পাশে থাকতে চায়।তিতাস পুরোপুরি ঘেঁটে আছে।রাতে তার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।তবু মালিনীর ডাকে ডিনারে ওর ফ্ল্যাটে যেতে হলো।

ডিনার টেবিলে মালিনী তিতাসকে বলে,"তিতাস কয়েকটা দিন একটু কোথাও ম্যানেজ করতে পারবি প্লিজ?তুই যদি কারোর বাড়িতে নাও থাকতে পারিস তোর কোনও ফ্রেন্ডকে তোর বাড়িতে ডেকে নে।আসলে কাল রাতে মিস্টার আগারওয়াল আসবেন।কদিন থাকবেন জানিনা কিন্তু উনি চলে গেলেই আবার আমরা একসাথে ডিনার করবো,তুই এখানে শুবি।প্লিজ একটু ম্যানেজ কর।"

তিতাসের হটাৎ করে মাথা গরম হয়ে গেল।সে তির্যক একটা হাসি হেসে বললো,"চিন্তা নেই তোমার মালকে আমি হাতিয়ে নেবোনা।"

মুহূর্তে মুখের রং বদলে গেল মালিনীর।চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,"তিতাস!কি বলতে চাস তুই?"

তিতাস উঠে মালিনীর চেয়ারের হাতলে হাত রেখে মালিনীর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,"বয়স হচ্ছে তো তোমার।যা কামানোর তো কামিয়ে নিয়েছো।এখনো এত ভয়?আমার রুচি এখনো এতটা নীচে নামেনি যে এই নোংরা রাস্তায় হাঁটবো।"

রাগে মালিনীর কপালের রগ দপ দপ করতে লাগলো।এক ঝটকায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,"কি মনে করিস কি নিজেকে?তুই আমার নখের যোগ্যও হতে পারবি কোনোদিন?দয়া দেখানোর এই ফল হবে জানলে তোকে আমার ঘরেই allow করতামনা।বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে।get out.get out.

তিতাস খাবার ফেলেই নিজের ফ্ল্যাটে চলে গেল।

টেবিলে খাওয়ার ছড়িয়েই মালিনী বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরালো।কিছুক্ষণ পর দেখলো তিতাস ফ্ল্যাটের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফোনে কার সাথে কথা বলছে।বেশ অনেক্ষন পর একটা বাইক এসে তিতাসের সামনে দাঁড়ালো।তিতাস সেই বাইকের পেছনে বসে বেরিয়ে গেল।

মালিনীর ঘরে তখন বাজছে "দো নায়না এক কাহানি,থোড়া সা বাদল থোড়া সা পানি।"


পরেরদিন রাত্রে মিস্টার আগারওয়াল এলেন।সকাল সকাল মালিনী গিয়ে পার্লার থেকে নিজেকে চক চকে করে এসেছে।এই চল্লিশেও মালিনী যেন ২০ বছরের তন্বী।মিস্টার আগারওয়াল ঘরে ঢুকেই কোটটা সোফায় ছুড়ে ফেলে দিলেন।তারপর আরাম কেদারায় নিজের বিশাল বপু ছড়িয়ে দিয়ে পা দুটো তুলে দিল সেন্টার টেবিলে।একটা কালো ফিন ফিনে শিফনের শাড়ি আর স্লিভলেস ব্লাউজে মালিনী যেন কোনো স্বপ্নলোকের অপ্সরা।সুন্দর করে একটা পেগ বানিয়ে এনে মিস্টার আগারওয়ালের সামনে ঝুঁকে পড়ে হালকা ক্লিভেজ বের করে হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা দিল।মিস্টার আগারওয়াল যেন শুধু চোখ দিয়েই সেই দৃশ্য চেটে পুটে নিলো।তারপর আস্তে আস্তে হালকা হাতে মিস্টার আগারওয়ালের কাঁধ থেকে মাথা অব্দি চেপে চেপে ম্যাসাজ করে দিতে লাগলো মালিনী।আরামে আবেশে মিস্টার আগারওয়াল বলল,"ওহ! মালিনী,you are a magician।just 1 minite সব স্ট্রেস হাওয়া।এস এস আমার কাছে বসো।"এই বলে মালিনীর হাত ধরে পেছন থেকে টেনে এনে সামনে নিজের কোলে বসিয়ে নিল এক ঝটকায়।মালিনী তার কোলে বসে গালে হাত বুলিয়ে ,কানে একটা ছোট্ট কামড় দিয়ে বললো,"অনেকটা জার্নি করে এসেছো বেবি।ডিনার করবে চলো।আজ তোমার ফেভারিট পালং পনির আর নবরত্ন পুলাও বানিয়েছি,তার সাথে বুন্দি রায়তা।তারপর তো শুতেও হবে নাকি?"এই বলে চোখ টিপে রহস্যময়ী হাসি হাসলো।তারপর নিজের চুল আগারওয়ালের মুখে বুলিয়ে উঠে গেল।

ডিনার করতে বসে আগারওয়াল বললো মালিনীকে,"শুনো ডার্লিং কাল একটা পার্টি আছে।পুলিশ কমিশনার আসবে,মিনিস্টাররা আসবে আর আমার ছেলে আহান আসবে।ওকে এবার আস্তে আস্তে বিজনেস বোঝাতে হবে।শুদু ফ্রেন্ডদের নিয়ে মস্তি লুটে বেড়াচ্ছে।এইসব বরা বরা লোকদের সাথে জান পেহেচান থাকলে পরে ওরই সুবিধা হবে।কাল বিকেলে আমার সাথে আমার লোনাভালার গেস্ট হাউজে যাবে।শহরের

সব থেকে বরা পার্টি প্ল্যানারকে হায়ার করেছি।তারাই সব arrangement করে দেবে ,তুমি শুধু একটু তোমার ইসপেশাল ম্যাজিক টাচ দিয়ে দেবে।"

মালিনী একটা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসলো।


রাত্রে নীল আলোয় নরম গদির বিছানায় নিজের রূপের মোহজাল বিস্তার করলো মালিনী।লোভে মিস্টার আগারওয়ালের চোখ দুটো ধূর্ত শেয়ালের মত হয়ে গেল। মালিনীকে সে তার মোটা থামের মতো হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো।মালিনীর দম বন্ধ লাগতে শুরু করে।তারপর বেশ কিছুক্ষণ নিজের প্রায় ফুরিয়ে আসা পুরুষত্ব জাহির করে মালিনীর বুকে ঘুমে ঢলে পড়ে।মালিনী সযত্নে তাকে বিছানায় শুইয়ে দেয়।মিস্টার আগারওয়ালের ৯৫কেজির বিশাল দেহটা থেবরে পরে বিছানায়।নাক ডাকার আওয়াজ সমুদ্রের গর্জনকে ছাপিয়ে যায়।ধব ধবে ফর্সা মোটা পেট টা ওঠা নামা করে।মালিনী বাথরুমে ঢুকে সাউন্ডসিস্টেমে চালিয়ে দিল

"খালি হাত সাম আই হে,খালি হাতে জায়েগি,খালি হাতে সাম আই হে।

ফিরভি না আয়া কই,

ফির ভি না আয়া কই।

খালি লৌট জায়েগি।"

নিজেকে উষ্ণ গরম জলের বারিধারায় ভাসিয়ে দিল মালিনী।


তিতাসকে সেদিন মালিনী বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর সে সিডকে ফোন করে।সিড গত দু তিন ধরে বিভিন্ন সময়ে তাকে ফোন করে ক্ষমা চাইছিল।তিতাস পাত্তা দেয়নি।সেইদিন মালিনীর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে তার প্রথম সিড এর কথাই মনে পড়ে।সিড বাইক নিয়ে এলে তিতাস তার সাথে ডিস্কে যায়।তারপর দুজনে সারারাত উন্মত্ত অবস্থায় নাচানাচি করে, প্রায় ভোর রাতে তিতাসের ফ্ল্যাটে ফিরে আসে।সিড এর নাকি দেশের বাইরে থেকে দুটো অফার আছে।একটু সেটল হলেই তিতাসকে নিয়ে লাইফে সেটল করবে বলে সিড জানিয়েছে।তিতাস রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে যায়।সকালে উঠে সিডের জন্য ব্রেকফাস্ট বানানো,লাঞ্চ প্যাক করার মধ্যেই তিতাস এখন আনন্দ খুঁজে পায়।সিড ও তাকে ভরিয়ে দিচ্ছে বন্য আদরে।

তিতাস আজকাল কলেজে প্রায় যায়না বললেই চলে।কল সেন্টার এর চাকরীটা অবশ্য এখনো চালিয়ে যাচ্ছে।এখনই সে সিডের কাছে হাত পাততে চায়না।


মালিনী পরেরদিন সকালে মিস্টার আগারওয়ালের সাথে তার লোনাভালার গেস্ট হাউসে রওনা দেয়।কথা হয় লোনাভালা পৌঁছে গেস্ট হাউসের পার্টির arrangment দেখে সে লাঞ্চ করে পাওয়ার ন্যাপ নেবে।তারপর শহরের সব থেকে বড় সেলিব্রিটি মেকআপ ম্যান আসবে তাকে সাজাতে।আজ নিজের সবটুকু লাস্য ঢেলে দিতে হবে মালিনীকে।আজ একটা বড় ডিল ক্র্যাক করার ব্যাপার আছে মিস্টার আগারওয়ালের।

সন্ধ্যেবেলা লোনাভালার গেস্ট হাউজ ঝলমল করছে।পুরো লন জুড়ে বিরাট বুফে।কি নেই সেখানে?দেশি বিদেশি সব রকমের খাওয়ার।বার কাউন্টারে মদের ফোয়ারা ছুটছে।শহরে ফেমাস বার টেন্ডার নিয়ে আসা হয়েছে।জ্বলন্ত মদের বোতল জাগলিং করে সে নানা রকম কেরামতি দেখাচ্ছে।বাড়ির পেছনের দিকে সুইমিং পুল এ চলছে অহন ও তার বন্ধু বান্ধবীদের উদ্দাম রেইন ডান্স "আজ দিন হে সানি সানি"। সুইমিং পুলের জায়গাটি এমন ভাবে কাঁচ দিয়ে ঘেরা যে তার আওয়াজ লন অব্দি পৌঁছয়না।লনের একদিকে চলছে পঙ্কজ উধাস লাইভ।

"মায়খানে সে,

শরাব সে,

সাকি সি জাম সে।"

জমিয়ে দিয়েছেন আসর নিজের সুরের জাদুতে।সেখানে শহরের গণ্য মান্য ব্যক্তিরা হাতে দামি স্কচ নিয়ে বসে আছে।হটাৎ মিস্টার আগারওয়ালের পিঠে হাত দিয়ে পুলিশ কমিশনার বললেন,"পার্টিটা কিন্তু জমছে না আগারওয়াল।আজ কি তোমার তিতলি রানী আসবে না?"

আগারওয়াল বললো,"আরে সার, রাত কি পরী তো রাত হলেই জন্নত থেকে আসবে।একটু wait তো করতে হবে।"

ঠিক তখনই লন আলো করে রঙিন প্রজাপতির মত নামলো মালিনী।আজ সে পড়েছে লাল টুকটুকে শিফন তার সাথে মুক্তোর ছড়া গলায়।ব্লাড রেড লিপস্টিক যেন তার ঠোঁটকে সত্যিকারের রক্ত মাখা করে তুলেছে।মিস্টার আগারওয়াল এগিয়ে গিয়ে কোমর ধরে নিয়ে এলো মালিনীকে।কোমরের নিটোল,নির্মেদ খাজ যেন হাত রাখার জন্যই বাঁকানো রয়েছে।দুধসাদা মখমলের মতো গায়ের ওপর পূর্ণিমার চাঁদের আলো যেন পিছলে পড়ছে।মিস্টার আগারওয়াল বললেন,"কাম ডার্লিং,হেলো লেডিস এন্ড জেন্টলমান হেয়ার ইস মাই জান মালিনী।"

ঝিমিয়ে পড়া বুড়ো গুলো যেন কোনো জাদু বলে সতেজ হয়ে উঠল।মালিনী নিজ স্বভাবসিদ্ধ দৃপ্ত ভঙ্গিতে হেঁটে আসছে।তার গ্রীবা উন্নত।নিটোল নিতম্ব দুলছে এক অদ্ভুত ছন্দে।মুখে রহস্যময়ী বাঁকা হাসিটি লেগে আছে।সে গিয়ে বসলো পুলিশ কমিশনার মিস্টার চিটগোপকার ও টেন্ডার পাস করানোর হর্তা কর্তা মিস্টার ঝুনঝুনওলার মাঝখানে।বসেই মিস্টার চিটগোপকারের কানে কানে বললো,"many thanks for that day's help."

গদগদ হয়ে চিটগোপকার বলে,"ক্যা মালিনী ডার্লিং ইতনা নেহি কর সকতা।ইয়ে তো মেরে লিয়ে কুছ ভি নেহি।আপকে লিয়ে তো জান ভি হাজির হায়।"বলে মালিনীর হাতের পাতায় একটা আলতো চুমু খেল।মালিনী হাসতে হাসতে সন্তর্পনে নিজের হাত সরিয়ে ঝুনঝুনওলার কোলে রাখলো।ঝুনঝুনওলা মালিনীর হাতটা নিয়ে নিজের বুকে বোলাতে লাগলো।মালিনী তার রোমশ বুকে বিলি কাটতে কাটতে বললো,"কাল কা রেসাল্ট থোড়া দেখ লেঙ্গে না আপ?"

আগারওয়ালের মালিনীর ওপর অন্ধ বিশ্বাস।জানে মালিনী ঠিক ডিল ক্র্যাক করিয়ে দেবে।

ঝুনঝুনওলা মালিনীকে নিজের বুকে টেনে নেয়।মালিনী সুন্দর করে ছাড়িয়ে উঠে পরে নিজের শাড়ি আর চুল ঠিক করে নেয়।তারপর ঝুনঝুনওলার নাকটা টিপে বলে,"এনজয় ইওর ড্রিংক বেবি।"হাসতে হাসতে গেস্ট হাউসের দিকে চলে যায়।এইটুকু মালিনী জানে যে আর যাই হোক আগারওয়াল কাউকে ওর বেডে allow করবেনা।বিছানায় মালিনী শুধু তার।

দোতলায় উঠে মালিনী নিজের বেডরুমে যায়।আরেকটু মেকআপ টা টাচ আপ করতে হবে।মালিনী ঝুকে পরে বিছানায় নিজের মেকআপ গুলো দেখতে থাকে।হটাৎ পেছন থেকে দুটো হাত মালিনীকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে নিজের মুখ ঘষতে থাকে।মালিনীর নাক ঝলসে যায় মদের কড়া গন্ধে।মালিনী হাত দুটো ছাড়ানোর প্রবল চেষ্টা করে।শেষে আর না পেরে দেয় এক ধাক্কা।আগন্তুক টাল সামলাতে না পেরে পরে যায় পেছন দিকে।মালিনী স্বচকিতে পেছন ফিরে অবাক হয়ে যায়।অস্ফুটে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে "আহান"!

মালিনী ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত।

আহান তখনো মদের নেশায় চুর হয়ে যেখানে পড়েছিল সেখানেই পরে আছে।উঠতে 

পারছেনা।চোখ কচলে জড়িয়ে জড়িয়ে বললো,"you bitch.

নৌটঙ্কি কর রাহি হে? তু মেরে পাপা কি রাখেল হে রাখেল।পাপা কা প্রপার্টি হায় তু।ঔর পাপাকা হর প্রপার্টি কি তরহা তুঝ মে ভি মেরা হক হায়।"

মালিনী রাগে থর থর করে কাঁপতে লাগলো,"shut up.just shut up.how dare you touch me?ম্যা তুমহারি মা কি উমর কি হু।তুমনে ইতনা গন্দা সোচা ভি ক্যাইসে?নিকল যাও।"

আহান অতিকষ্টে টলতে টলতে উঠে গিয়ে মালিনীর চুল শক্ত করে চেপে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো,"চুপ সালি একদম চুপ।রা***ডি কাহিকী।মেরি মা বননে চলি।তেরি অঔকাত আজ দিখাতা হু।তু রুক।"

মালিনী নিজের চুল ধরে তারস্বরে সিকিউরিটিকে ডাকতে থাকে।কিন্তু নীচে পার্টির আওয়াজে কেউ শুনতে পায়না।মেকআপ ম্যান তখন আসছিল মালিনীকে টাচ আপ দিতে।সে দরজার কাছে এসে থমকে যায়।পরমুহূর্তে সম্বিৎ ফিরে পেতেই এই বিশ্রী পরিস্থিতি দেখে দৌড়ে নীচে লনে গিয়ে মিস্টার আগারওয়ালকে খবর দেয়।মিস্টার আগারওয়াল সিকিউরিটিকে নিয়ে কোনোরকমে দৌড়ে দৌড়ে দোতলায় মালিনীর রুমে এসে থমকে যান।সিকিউরিটি কোনো রকমে আহানকে সরায় মালিনীর থেকে।মিস্টার আগারওয়াল সিকিউরিটিকে বলে আহানকে নিয়ে যেতে।তারপর দরজা আটকে মালিনীকে বলে,"হুয়া ক্যা হায়।"

মালিনী কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় বসে পড়ে।তারপর পুরো ঘটনার বিবরণ দেয় মিস্টার আগারওয়ালকে।

আগারওয়াল কোমরে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বাইরে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকেন সব শুনে।তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে মালিনীকে বলেন,"তুম কব সে সতী সাবিত্রী বন গায়ি হো মালিনী?বাচ্চা হ্যায়।অভি তো উসকা উমর হায় মস্তি কারনেকা।থোড়া ছের খানি করনে মে তুমহারা ক্যা বিগর যাতা।কাল ডবল আমউন্ট তুমহারে একাউন্ট মে চলা যাতা।"

মালিনীর কান্না থেমে গেছে আগারওয়ালএর কথা শুনে।নিজের হাত দিয়ে চোখ মুছে মালিনী বললো,"আপ হোশ ম্যায় তো হে মিস্টার আগারওয়াল।বো মেরা ব্যাটা যাইসা হায়।"

আগারওয়াল এবার জ্বলন্ত চোখে মালিনীর দিকে ঝুঁকে আঙ্গুল তুলে বলে,"what do you think of yourself.you are just a slut.just.... a....... slut.তুমহারা আজ জো ইয়ে শান ও শওকত হায়না বো মেরে বদৌলত হায়।ম্যায় আগর নেহি হোতা না তুম সিগন্যাল পে খড়ি মিলতি।সমঝি?মেরা দিয়া হুয়া ভিক সে তুমহারি ইতনি luxary,ওরলি মে সি সাইড ফ্ল্যাট,বি এম ডাবলু কার,কড়র রূপে ব্যাংক ব্যলান্স, প্লাটিনাম, ডায়মন্ড জুয়েলারি কাঁহা সে মিলতা তুমহে? মেরে সাথ রেহেনা হায় তো আপনে ঔকাত মে রহো।জাইসে রাখেনগে ঐসে রাহো।"এই বলে আগারওয়াল নিজের পাইপ ধরানোর জন্য লাইটার জ্বালালো।

মালিনী চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ালো।রাগে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে দাঁতে দাঁত চিপে বললো,"Mind your language Mr. Agarwal.I am not your slave.আমি আপনাকে আমার টাইম দিয়েছি,আপনার ওই কদাকার শরীরকে আরাম দিয়েছি এবং সেটা স্ব ইচ্ছায় দিয়েছি।তার পরিবর্তে আপনি আমায় টাকা-পয়সা, গাড়ি,বাড়ি,গয়না দিয়েছেন অর্থাৎ আপনি আমার মূল্য চুকিয়েছেন।ব্যাস হিসেব বরাবর।আমি আমার শরীর আর সময় কাকে দেব আর না দেব সেটা আমার ডিসিশন সেটা আমি একজন বাজারু ঔরত হি হই না কেন।এবার আপনি লক্ষ কোটি টাকা দিলেও আপনার ছেলের সাথে আমি শোব না।কারণ সেটা আমার ইচ্ছে নয়।ও যতই নোংরামি করুক না কেন আমি ওকে আমার ছেলের মতোই দেখি।আপনার আজ অব্দি অগুনতি ডিল ক্র্যাক করিয়েছি।প্রত্যেকটা ডিল ক্র্যাক করার পর আপনি আমায় দামি গয়না দিয়েছেন।সেটা কিন্তু ভালোবেসে নয়।সেটা আমার ফিস হিসেবে দিয়েছেন।তাই ওই সব সম্পত্তিতে আপনার আর কোনো অধিকার নেই।ওগুলো আমার পারিশ্রমিক।তাই ভাববেন না আপনি আমায় ওগুলো ভিক্ষে দিয়েছেন।ওই গুলো আমার উপার্জন।ফ্ল্যাট টাও কিন্তু আমার নামে সুতরাং আমি যতক্ষন না আপনাকে ওটা দান করছি ততক্ষণ ওই ফ্ল্যাটে কোনো অধিকার আপনার নেই।আমি অন্তত আপনাকে আর্য্যর থেকে আলাদা ভেবেছিলাম।যে নিজের স্বার্থে অন্তত আমাকে অন্য কারোর সাথে শুতে বলবেনা।এখন তো দেখছি আপনি আরো ঘৃণ্য একজন নরকের কীট।যে নিজের শয্যা সঙ্গিনীকে নিজের ছেলের সাথে শুতে বলেন।ছিঃ!আসলে আপনারা সব পুরুষ মানুষ ই একরকম মানসিকতার।এই যে আপনারা নিজেদের ঘরে

সুন্দরী বউ রেখে আমাদের মতো slut এর কাছে আসেন।টাকা পয়সা,গয়না কিন্তু নিজের বউকেও কম দেন না।কিন্তু যেটা দেন না সেটা হলো সময়।আপনারা না বাড়ির বউদের taken for granted করে নেন।কারণ আপনারা ভাবেন এই শান্ত শিষ্ট অবলা প্রাণীগুলো যাবে কোথায়? যাদের দুটো পয়সা রোজগার করারও মুরোদ নেই।কিন্তু এটা ভুলে যান যে এই বাড়তি মানুষ গুলো না থাকলে আপনারা এই জায়গায় পৌঁছাতেই পারতেন না।পুরো বাড়ি তারা সামলে রাখে তাই ব্যবসা ছাড়া অন্য কোনো দিকে আপনাদের মাথা গলাতে হয়না।আপনারা ব্যবসায়ী মানুষ প্রত্যেকটা পাই পয়সার হিসেব রাখেন শুধু মাত্র বাড়ির ব্যাপারে এসেই ভুলে যান যে এই পৃথিবীতে কোনো কিছু ফ্রি তে হয়না।As if ওরা আপনার দাস আর আপনার সেবা করতে তারা বাধ্য।ভুলে যান যে দাসকেও মাস মাইনে দিয়ে রাখতে হয়।আপনারা তাদের বাড়ি গাড়ি গয়না দিয়ে ভাবেন তাদের করুনা করছেন।চিন্তা ভাবনা পাল্টান মিস্টার আগারওয়াল নয়তো শেষ বয়সে এসে দেখবেন আপনি বিছানায় পড়ে কাতরাচ্ছেন আর পাশে বসে দুটো কথা বলার লোকও নেই।(আগারওয়ালের মুখের সামনে আঙ্গুল তুলে)আর কোনোদিন যেন আপনাকে আমার ফ্ল্যাটের ত্রি সীমানায় না দেখতে পাই।আজ থেকে আমাদের সব সম্পর্ক শেষ।গুডনাইট মিস্টার আগারওয়াল।আশা করবো এই জীবনে যেন আপনার সাথে আর দেখা না হয়।"এই বলে মালিনী দৃপ্ত ভঙ্গিতে,দামি পেন্সিল হিলে গট গট শব্দ তুলে বেরিয়ে গেল।মিস্টার আগারওয়ালের পাইপ ঠোঁটেই ধরা রইলো,বিস্ফারিত চোখে তিনি মালিনীর চলে যাওয়া দেখলেন।তিনি ভাবতেই পারেননি মালিনী,তার হাতের কাঠ পুতলী, কবে এত জোর দিয়ে নিজের স্বপক্ষে কথা বলতে শিখলো।নিশ্চয় কোনো নতুন চিড়িয়া পেয়েছে।ফুহ!আগারওয়াল এর এক তুড়িতে হাজার একটা মেয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।শুধু ডাকার অপেক্ষা।ডাকলেই সুর সুর করে চলে আসবে।শুধু মালিনী যতই ঢলতা হুয়া সুরজ হোক না কেন?দিমাগ আর খুবসূর্তির এত ভালো মিলাপ খুঁজে পাওয়া মুশকিল।তবে আগারওয়ালের বিশ্বাস আছে কোনো না কোনো ঝিনুকে সে মতি খুঁজে পাবেই।ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয়না।

মালিনী কোনদিকে না তাকিয়ে লনের ওপর দিয়ে এগিয়ে গেল নিজের বি এম ডাব্লুর দিকে।ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো তার খাওয়া হয়েছে কিনা।ড্রাইভার হ্যাঁ সূচক অর্থে মাথা নাড়লো।মালিনী বললো ,"তাহলে চলো।"

গাড়ির নরম সিটে মালিনী নিজেকে এলিয়ে দিল।বাড়ি পৌঁছাতে রাত ২টো বাজবে।আকাশে চাঁদের আলো ঢেকে গেছে কালো মেঘে।


মালিনী চলে যাবার কিছুক্ষনের মধ্যেই আগারওয়াল নামলো লনে।হটাৎ করেই যেন পার্টিটা থমকে গেছে।আগারওয়াল হটাৎ হাতে তালি দিয়ে বললো,"মুম্বাইয়ালো কব সে রাত ১২ বাজে কো রাত সমঝে নে লাগে।অভি তো পার্টি শুরু হুই হে।লেটস স্টার্ট বেবি।"বলে তিনি একজন বেলী ডান্সারকে ডাকলেন।সুদূর আরব দেশ থেকে আসা লাস্যময়ী নারীর কোমরের খাঁজে ডুবে গেলেন শহরের রথী মহারথীরা।যারা কিছুক্ষণ আগেই মালিনীর একটু উষ্ণতা পাওয়ার জন্য তার পায়ে লুটিয়ে দিচ্ছিলেন নিজেদেরকে তারাই এখন আগারওয়ালকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন,"ছোরিয়ে আগারওয়াল সাহাব ঔরত জাত হতি হি এইসি হায়।ইন লোগো কি জাগাহ প্যার কে নীচে হি হায়।সর পে উঠাইয়া কি খুদ কো রাজা ভোজ সমঝে না লাগতে হে।"কেউ কেউ বললো,"ইয়ে সব বাজারু ঔরত হতি হি এইসি হে।এক জায়েগি দশ আয়গি।"

অলক্ষ্যে নিয়তি হাসে হায় রে তথাকথিত ভদ্র সমাজ এই তোদের আসল রূপ।তোরাই দিনের আলোয় নারী শক্তির আরাধনা করবি।নারী স্বাধীনতা নিয়ে বড় বড় বক্তৃতা দিবি।আর রাতের অন্ধকারে তাদের ছিঁড়ে খাবি।


ঐদিকে তিতাস আর সিড জমিয়ে লিভ টুগেদার করছে।সেদিন রাতে যখন মায়াবী নীল আলোয় দুজনেই শরীরী খেলায় উন্মত্ত।তখনই তিতাস বলে,"আমার মনে হয় বিয়ের আগে কয়েকদিন আমাদের প্রোটেকশন নেওয়া উচিৎ।"

সিড বিরক্ত হয়ে বলে,"কামঅন জান।dont spoil the mood.you know i cant enjoy with protection.u dont have faith on me?hu?"

তিতাস থতমত খেয়ে বললো,"no jaan,its not that.still...

তিতাসের কথা শেষ হওয়ার আগেই সিড তার ঠোঁট দিয়ে তিতাসের ঠোঁট চেপে ধরে তাকে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে ফেললো।


মালিনীর বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে প্রায় রাত ২.৩০টে বাজল।নিজের সাউন্ড সিস্টেমে তার অতি প্রিয় ঠাকুরের গান চালিয়ে ফ্রেঞ্চ ওয়াইনের গ্লাসে ডুব দিল।

"যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,

আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,


চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,


 মিটিয়ে দেব গো,  মিটিয়ে দেব লেনা দেনা,


 বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে--


 তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,


 তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।




পরেরদিন সকালে উঠে তিতাস একটা স্পোর্টস ব্রায়ের ওপর শার্ট চাপিয়ে আর নিচে হট প্যান্ট পরে চুল ছেড়ে ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছিলো।পেছন থেকে সিড এসে ওকে জড়িয়ে ধরে আলতো করে ঘারের কাছে মুখ ঘষলো।তখনই কলিং বেল বেজে উঠলো।সিড বিরক্ত হয়ে বলল,"what the f....k.এই সাত সকালে কে এল?"তিতাস সিডের নাকটা টিপে দিয়ে বললো,"সকাল কোথায় মশাই ১০টা বেজে গেছে।বোধহয় দুধওয়ালা এলো।আমি দেখছি দাঁড়াও।"এই বলে চুলটা পেঁচিয়ে ক্লাচর লাগিয়ে শার্টের বোতাম লাগিয়ে দরজা খুলল।সামনে রিতাদি দাঁড়িয়ে।কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল করে ফেলেছে।তিতাস তাড়াতাড়ি তাকে ঘরে ঢুকিয়ে এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,"কি হয়েছে রিতাদি?কাঁদছো কেন?মালিনী কিছু বলেছে?"


রীতা কাঁদতে কাঁদতে বললো,"তিতাস দিদি,মালিনী মেমসাব আর নেই গো।মালিনী মেমসাব আর নেই।"


তিতাস দৌড়ে মালিনীর ফ্ল্যাটে গেল।গিয়ে দেখল ইজি চেয়ারে মালিনী একদিকে হেলে ঘুমাচ্ছেন।একটা হাত পেটের ওপর কাগজ ধরা,আরেকটা হাত মাটিতে লটাচ্ছে,মাটিতে আধ খাওয়া গ্লাস পরে আছে।হাত তুলে দেখল পালস আছে কিন্তু বড্ড ক্ষীণ।পেছনে সিড এসে ভয়ার্ত গলায় বললো,"leave her.পুলিশ কেসে ফেঁসে যাবি কিন্তু।"

তিতাস চেঁচিয়ে বললো,"এখনো বেঁচে আছে রে।জলদি একটা ট্যাক্সি ডাক, এখুনি হসপিটালে নিয়ে যাবো।"

সিড-"are you mad?আমার ভিসা প্রসেস হচ্ছে।ফালতু কেসে ফেঁসে যাবো।আমি যেতে পারবোনা।"

তিতাস অবাক হয়ে বললো,"একটা মানুষের প্রানের থেকে তোর কাছে ভিসা প্রসেসিং বড় হলো?ছাড় তুই।রিতাদি চলো তো দুজনে ধরে ধরে মালিনীকে নিয়ে যাই।কাউকে না কাউকে ঠিক পেয়ে যাবো।"

দুজনে মালিনীকে ধরাধরি করে লিফটে উঠলো।লিফটম্যান নিজের চেয়ারে বসতে দিল মালিনীকে।দারোয়ান ট্যাক্সি ডেকে ওদের তুলে দিল।নার্সিংহোমে প্রথমে মালিনীকে ভর্তি নিতে না চাইলে তিতাস পুলিশ অফিসারকে ফোন লাগলো।যিনি তার মায়ের মৃত্যুর সময় নিজের কার্ড দিয়ে বলেছিলেন দরকার লাগলে ফোন করতে।পুলিশ অফিসারের ফোনে কাজ হলো।মালিনীকে তড়িঘড়ি অপেরাশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো।সেখানে পাম্প করে পুরো বিষ বের করে নেওয়া হলো।এরপর মালিনীকে ICU তে নিয়ে যাওয়া হলো।ডাক্তার বললেন ২৪ঘন্টা না কাটলে কিছু বলা যাচ্ছেনা।একসাথে অনেক গুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিয়েছিল মালিনী।তাই জ্ঞান এখনো ফেরেনি।শুধু সুখবর একটাই যে stomach full clean করা গেছে।তিতাস এই ২৪ ঘন্টা হাসপাতালেই থাকবে ঠিক করলো।রিতাদি মাঝখানে একবার বাড়ি গিয়েছিল কিছুক্ষনের জন্য।টিফিন কৌটো করে তিতাসের জন্য খাওয়ার নিয়ে এসেছে।তিতাস প্রথমে খেতে না চাইলেও জোর করে তিতাসকে দুটো রুটি অল্প সবজি দিয়ে খাইয়ে দিয়েছে।অনেক বার তিতাসকে বললো এত রাত অব্দি জেগে থাকার দরকার নেই।বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিয়ে পরেরদিন সকালে আসতে।কিন্তু তিতাস রাজি হলোনা।কখন কি দরকার লাগে।

ভোরের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে তিতাস দেখে সে রিতাদির কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে।রিতাদি ও ঢুলছিল।জর্দা খাওয়া দাঁত বের করে হেসে বললো ,"কি গা দিদিমণি ঘুম ভাঙ্গলো?যাও চোখে মুখে জল দিয়ে এসো গা।কাল রাতে দুটো কেক আর কলা কিনিছি।সেগুলো খেতি হবে তো?যাও আর দেরী কোরোনি কো।"

তিতাস মুখ চোখে জল দিয়ে এসে কেক খেতে খেতে বললো,"জানো রিতাদি তুমি একদম আমার মায়ের মত।মাও সবসময় এইভাবেই আমার খেয়াল রাখতো।শেষের দিকে অবশ্য একদম পাল্টে গেছিল।"

রিতাদি হেসে বললো,"সব মায়েরাই একরকম হয় গো।সবাইকে নিজের সন্তান ভেবি ফেলে।এই যে মালিনী মেমসাহেব তার বাড়ি আমি আজ থেকি নাকি?১০বচ্চর যাবৎ আছি ।সেই কোন ছোটবেলা কৃষ্ণনগরের কাছে তাহেরপুর থেকে বিয়ে করে বরের হাত ধরি চলি এসেছিলাম।বর এখানে সোনার দোকানে কাজ করত।এখানে যে বস্তি আছে না?ধারাভি।সেখানে থাকতাম।তারপর হলো এক খান ছেলে।সেও ভারী ভালো ছিলো গো।সাত চরে রা কারত নি।কোনো বায়না নাই,দুস্টুমি নাই।একটু বড় হতি সেও যেতি লাগলো তার বাপের সাথে সোনার দোকানে।আমার বরটাও খুব ভালো মানুষ ছেল জানো?বস্তির অন্যান্য লোকেদের মত মদ খেয়ে এসে বউ পেটাতো নি।ছেলেটাও পাশের ঘরের একটা মারাঠি মেয়ের সাথে ভাব ভালোবাসা করি বিয়ে করলো।বেশ ভালোই চলতিছিল জানো দিদি?অভাব থাকলেও দুঃখ ছিলোনি আমার কোনো।কিন্তু তারপর এলো সেই ভয়ানক রাত।২০০৮ সালের ২৬শে নভেম্বর রাত ১০টা নাগাদ বাপ ব্যাটা কাজ সেরি CST স্টেশনে আসতেছিলো ট্রেন ধরবে করি।সেইদিন সন্ধ্যেবেলা আমি পেরথম বার জানতি পেরিছিলাম বৌমা মা হতি চলিছে।ছেলেকে ফোন করি জানাতে যাবো।মন্টু ফোন ধরে বলল হ্যাঁ মা বলো।আমি আনন্দে বললাম মন্টু তুই বাপ হবি রে । হটাৎ দুম দাম আওয়াজ শুনতি পেলাম ফোনের ভেতর থেকে।মন্টু মন্টু করি কত ডাক দিলাম ছেলের গলা শুনতি পেলাম না।শুদু মনে হল একবার যেন মা গো বলিছিলো।কি জানি মনের ভুল ও হতি পারে।চারিদিকে সুদ্দু কান ফাটানো আওয়াজ আর লোকের চেঁচামেচি।পরে শুনলাম সব শেষ হৈ গেছে।পরেরদিন বাপ ছেলে মিলি একটা সাদা কাপড়ে জড়িয়ে বাড়ি এলো।আমার মন্টু।আমার সন্তান।আমার বর যাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝিনি কোনোদিন।বৌমা মুচ্চা যাচ্ছে ঘন ঘন।ছেলেকে দেখবো না বরকে দেখবো নাকি বৌমাকে।মাথা ঘুরতিছে তখন আমার।তারপর বুঝলাম আমাকেই শক্ত হাতে সব সামলাতি হবে সবদিক।নিজে হাতে ছেলে আর বরটাকে পুড়িয়ে ফিরলাম।তখন শুধু চিন্তা কি খাবো।কোথায় যাবো।আমি হাল না ধরলি সংসার ভেসি যাবে।সব কাজ মিটি গেলে হিসেব করে দেখলাম জমানো যা ছিল শেষের পথে।তখন আমার বৌমার মাই খপর দিলো।ওড়লীর দিকে বড়নোকদের ফালাটে কাজের নোক লাগবে।আমি আর এই সুযোগ হাত ছাড়া করলামনি।ঢুকি গেলাম।তারপর থেকে এই মালিনী মেমসাবের কাছেই আচি গো।"

তিতাস রিতাদির চোখের জল মুছিয়ে নিজের কেকটা রিতাদির সামনে ধরে জিজ্ঞেস করলো ,"এখন কেমন আছে তোমার বউ?"রিতা আঁচলের খুট দিয়ে চোখ মুছে বললো,"ভালোই আছে।নীচের ঘরের একটা মারাঠি ছেলেরে বিয়ে করিছে।দুটিতে আছে বেশ।মাঝে মাঝে আমার খোঁজ খবর নেয়।অনেক সময় খাওয়ার ও দি যায়।একটা পেট তো চলি যায় কোনোরকমে।মেমসাব ও খুব ভালো।আমায় কতোকিচু দেয়।এছাড়া এখানে এলি সময়টাও কাটে।ছুটি এতদিন নিতিম না।এখন নিই একটা দিন নাতি টাকে কাছে পাই বলি।নাতিটার মুখটা যেন পুরো আমার মন্টুর মুখ বসানো।বুকটা ফেটি যায় গো।"

তিতাস মাথা নিচু করে বসে শুনছিল।তখনই একজন নার্স এসে জিজ্ঞেস করলো,"ICU bed no 104 কে ঘর কে লগ কৌন হায়?পেশেন্ট কো হোস আ গিয়া।মিলনা হে তো মিল লিজিয়ে।কুছ দের বাদ ফির সে নিন্দ কা ইনজেকশন দে দিয়া যায়গা।"তিতাস চোখ মুছে রিতাকে বললো,"চলো রিতাদি তোমার মালিনী মেমসাবের সাথে দেখা করে আসি।"

তিতাস ধীরে ধীরে icu র দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো।আস্তে করে মালিনীর পাশে গিয়ে বসলো।মালিনীর anasthesiaর ঘোর তখনো কাটেনি।পাশে ডক্টর এসে বললেন,"উনি এখন out of danger.সব ঠিক থাকলে কালকেই ওনাকে জেনারেল বেডে দিয়ে দেবো।"

তিতাস শুনে একটু আশ্বস্ত হলো।মালিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে নিচে নেমে এলো।নিচে এসে রিতাদিকে বললো, "চলো রিতাদি বাড়ি যাই।মালিনী ভালো আছে।কাল সকালে আবার আসবো।বড্ড ঘুম পেয়েছে,শরীর আর দিচ্ছেনা।"

রিতা,"হ্যাঁ সেই ভালো।চলি চলো।"

বাড়ি ফিরে ক্লান্ত তিতাস ঘুমিয়ে পড়েছিল।ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যেবেলা।সিডের দরজা খোলার আওয়াজে।ঘরে ঢুকেই সিড দুম দাম আওয়াজ করে দরজা বন্ধ করতে লাগলো।সেই আওয়াজে তিতাসের ঘুম গেল ভেঙ্গে।চোখ কচলে ডাইনিংয়ে এসে বললো,"হাই সিড কখন এলি?"

সিড কোনো উত্তর না দিয়ে শার্টের বোতাম খুলে, টাইএর নট আলগা করে সোফায় গা এলিয়ে দিল,পা তুলে দিল সেন্টার টেবিলে।

একটু হেসে তিতাস পেছন থেকে গলা জড়িয়ে বললো,"কি হয়েছে জান?অফিসে প্রবলেম?"

সিড-"তোর কোনো আইডিয়া আছে? কাল সেই সকালে বেরিয়ে গেলি আর এখন ফিরছিস।একটা খবর নেই।কোথায় আছিস,কি করছিস কিছুই জানতে পারছিনা।কোথাকার একজন কে তার জন্য পাগলের মত করছিস।এরপর নিজে তো মরবিই আমাকেও মরবি।"

তিতাস-"এইরকম ভাবে বলছিস কেন বাবু?তুই তো ফোন করতে পারতিস।"

সিড-"কি করে করবো?ফোনটা তো সুইচ অফ করে রেখেছিস।"

তিতাস-"ওহ!সরি রে।ফোনটা ব্যাগে ছিল।ভালো কথা মনে করেছিস।চার্জ দিতে হবে।নার্সিং হোম থেকে ফোন এলে আবার পাবেনা আমায়।"

সিড-"তুই কিন্তু আমার কথার উত্তর দিলি না তিতাস।উনি কে হয় তোর?"

তিতাস-"তুই বুঝবিনা রে।সম্পর্কে হয়তো কেউ নয় কিন্তু অন্যান্য অনেক সম্পর্ক থেকে অনেক উর্দ্ধে।মালিনী কতটা আমায় হেল্প করেছিল মায়ের মৃত্যর সময় তুই জানিসনা।সেই দুঃসময়ে কেউ এইভাবে পাশে এসে দাঁড়ায়নি,যেমন মালিনী দাঁড়িয়ে ছিল।তুই তো তখন হাওয়া।মালিনী কিন্তু নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রেখেছিল আমায়।মাথার ছাদ,খাওয়ার আর সব থেকে বড় ব্যাপার,সঙ্গে ছিল ও আমার।ছাড়,তুই বুঝবিনা। খাবার অর্ডার কর।কাল আবার সকাল সকাল নার্সিংহোমে যেতে হবে।"

সিড-"তোর মনে হয়না তিতাস তুই একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছিস একটা neighbourকে নিয়ে?"

তিতাস কোনো উত্তর না দিয়ে ঘরে চলে যায়।জানালায় বসে ভাবতে থাকে সত্যি তো মালিনী ওর কে?স্রেফ প্রতিবেশী।অথচ ওর মায়ের মৃত্যর পরের দিনগুলো তিতাস আর মালিনী যেন একে ওপরের অবলম্বন হয়ে উঠেছিল।তারপর কোথা থেকে কি যে হয়ে গেল।


পরেরদিন সকালে তিতাস নার্সিংহোমে গিয়ে দেখল আজ মালিনী অনেক সুস্থ।তাকে জেনারেল বেডে দেওয়া হয়েছে।ওকে দেখেই মালিনী মুখ ঘুরিয়ে নিল।রিতা আগেই পৌঁছে গেছিল।রিতার দিকে মালিনী তাকিয়ে বলল,"ও কি করছে এখানে?ওকে চলে যেতে বল রিতা।"

রিতা,"এরম বলোনি গো মেমসাব।তিতাস দিদি না থাকলি আজ তুমি বেচি ফিরতি না।"

মালিনী,"কে বলেছিল আমায় বাঁচাতে?আমি তো মরতেই চেয়েছিলাম।"

তিতাস কপট রাগ দেখিয়ে বললো,"তুমি মরতে চাইলেই হলো?মরতে চাইলেই দিচ্ছে কে?"

মালিনী তিতাসের দিকে ফিরে বললো,"কেন আবার আমি কেন?সেই কানে দুল পড়া ছেলেটা পালিয়েছে বুঝি?"

তিতাস হেসে বলে," না না তা কেন?সে আছে তার মত।তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে দেখি।বাড়ি যেতে হবে তো নাকি?তোমার দারুর বোতল গুলো কাঁদছে।আপাতত সুপ খাও।"

এই বলে সুপের বাটিটা সামনে ধরলো।

মালিনীকে রিতা ধরে উঠিয়ে বসিয়ে দিলো।মালিনী কাঁদতে কাঁদতে বললো,"আমায় কেন বাঁচালি তিতাস?আমার বাঁচতে ভালো লাগেনা।"

তিতাস,"ধুর!তোমায় দেখে বেশ শক্ত পোক্ত মহিলা লেগেছিল আমার, এখন তো দেখছি তুমি একটা নারকেল।বাইরে শক্ত ভেতরে নরম।দেখো মরে গেলে তো হয়েই গেল কিন্তু বেঁচে থাকার মজাই আলাদা।প্রত্যেকদিন ভালো মন্দ মিশিয়ে নতুন নতুন দিন উপহার পাবে।এক একটা দিন এক একটা গল্প।এসব ফেলে কেউ মরে?"

মালিনী,"তোকে এতবার তারালাম তাও বার বার ফিরে ফিরে কেন আসিস তিতাস আমার কাছে?"

তিতাস হেসে মালিনীর হাত নিজের হাতে নিয়ে গাইলো,"তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো,ছেড়ে দেবোনা।হা হা"

দুজনেই হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে ঢলে পড়লো।

আজ মনটা বেশ খুশি খুশি তিতাসের।মালিনী এখন অনেক সুস্থ।কালকেই ছুটি পেয়ে যাবে।

বাড়ি ঢুকে ফ্রেশ হয়ে এক মগ কফি নিয়ে ল্যাপটপ খুলে বসলো।কিছুক্ষনের মধ্যেই একটা মেল ঢুকলো সিডের মেলবক্সে।সিড বোধহয় লগ আউট করতে ভুলে গেছে।কৌতূহলবশত মেলটা খুলে দেখতে পেল এলিজা নামে একজন মেল করেছে।মেয়েটিকে সে চেনে।সিডদের অফিসে মেয়েটি এসেছিল কয়েকদিনের জন্য ক্রস এক্সপোসারে।তখন সিড অনেকদিন মেয়েটার পেছনে ঘুর ঘুর করছিল।তিতাস জিজ্ঞেস করলেই বলতো,"আরে এক্সপাটদের একটু তেল দিলে বাইরে যাওয়ার চান্স অনেক বেড়ে যায় বস।সারাজীবন কি এদেশে পঁচে মরবো নাকি?"তিতাস এটা মানেনা।সে বিশ্বাস করে ভালো কাজের দাম সবসময় আছে সে দেশেই হোক কি বিদেশে। চিঠিটা পরে সে জানতে পারলো যে সিড আর এলিজার ভালো রকম সম্পর্ক আছে।সেই রেফার করে সিডকে ওখানে জবটা পাইয়েছে।দুজনে একই ফ্ল্যাটে থাকবে।এলিজা আবার বেশ কয়েকটা অন্যরকম কথাও লিখেছে।তিতাসের আর পড়তে ইচ্ছে করলোনা।সে নিজের মেল বক্স চেক করে কয়েকটা জরুরি মেলের উত্তর দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো সিড এর।


সন্ধ্যেবেলা সিড এলো।বেশ হাসি হাসি মুখ।দুই হাত ভর্তি শপিং।ঘরে ঢুকেই তিতাসের দিকে একগাল হেসে বললো,"পরশু ফ্লাইট বুঝলি?টিকিট টা আজ মেল করে দিল।সবই তো ওখানে পাওয়া যায় তবুও প্রথম কয়েকটাদিন চালানোর জন্য একটু শপিং করলাম।পুরোনো জিনিস কিছু নিচ্ছিনা।সব ফেলে দিয়ে যাবো।"

তিতাস-"পুরোনো এই আমিটাকেও ফেলে যাচ্ছিস সিড?"

সিডের মুখটা হটাৎ অন্ধকার হয়ে গেল।তারপর খুব তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে তিতাসের কাছে এসে নিজের হাত দিয়ে তিতাসের মুখটা তুলে বললো,"ধুর পাগলী!বলেছিনা কয়েকমাস পর তোকে নিয়ে যাবো।চিন্তা করছিস কেন?কনফার্মেশনটা হতে দে।আপাতত হোটেলে থাকবো।এরপর অফিস একমোডশন পেয়ে গেলেই তোকে নিয়ে যাবো।"

তিতাস জ্বলন্ত চোখ তুলে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,"কেন বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলছিস সিড?হোটেলটা কি এলিজার?"

সিড যেন একটা ঝটকা খেল।তিতাসকে ছেড়ে দিয়ে বললো,"কি বলছিস তুই?"

তিতাস-"তোর মেল দেখলাম সিড।তুই বোধহয় লগ আউট করতে ভুলে গেছিলিস।এলিজার সাথে যে তুই এতদূর এগিয়ে গেছিস আমি ভাবতেই পারছিনা।তুই আমায় এভাবে ঠকালি সিড।আমার কি দোষ ছিল বল?আমি তো তোকে ভালোবেসেছিলাম।খুব ভালোবেসেছিলাম বিশ্বাস কর।নিজের সব টুকু দিয়ে ভালোবেসেছিলাম।কেন করলি আমার সাথে এইরকম।"হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়ল তিতাস।

সিড নিজের শার্টের হাতা আর টাইএর নট ঢিলে করে একটা সিগারেট ধরালো।তারপর বলতে শুরু করলো,"ভালোই হয়েছে তুই সব জেনে গেছিস তিতাস নাহলে স্কটল্যান্ড যাওয়ার পর আই এস ডি,মেসেজ,মেল করে আমায় অতিষ্ঠ করে তুলতিস।আজ তোকে সবটা বলে আমিও হালকা হতে পারবো।কলকাতা থেকে যখন এখানে এসেছিলাম তখন আমার হাতে কোনো চাকরি ছিলোনা।শুধু মাত্র নিজের লুকের ওপর ভরসা করে মুম্বাই চলে এসেছিলাম।সিদ্ধার্থ থেকে ততদিনে সিড হয়ে গেছি।সারা জীবন স্কুল মাস্টার বাবার কষ্ট দেখে বড় হয়েছি।বিরক্ত লাগত।কি করব জানতাম না কিন্তু ছাপোষা কেরানী হবোনা সেটা ঠিক করে নিয়েছিলাম।স্টুডিও পাড়ায় কয়েকদিন ঘোরা ঘুরি করার পর বুঝে গেছিলাম রেফারেন্স ছাড়া এখানে কিচ্ছু হবেনা।তার ওপর অভিনয় করার অভিজ্ঞতাও আমার নেই।এর কয়েকদিন পর এক বন্ধুর মারফত তোর সাথে পরিচয় হলো।বুঝতে পেরেছিলাম প্রথম দেখাতেই লাট খেয়েছিস আমার ওপর।তোর কাছে একটু কাঁদুনে গাইতেই তুই গলে জল হয়ে গেলি।নিজের যত কনেকসন সব লাগিয়ে দিয়েছিলি আমার চাকরির জন্য।অবশেষে নিজের বসকে হাতে পায়ে ধরে আমায় তোর কোম্পানিতে ঢোকালি।

আমার বাবা নিজে বাংলা প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার হলেও মায়ের জেদের কাছে হার মেনে আমায় পড়িয়েছেন ইংলিশ মিডিয়ামে।তাই ইংরেজিটা খুব ভালো বলতে পারতাম।তার ওপর তোর রেফারেন্স তো ছিলই।সব মিলিয়ে আমার কল সেন্টারের কাজটা হয়ে গেল।রাতে কল সেন্টার আর দিনে টুকটাক কয়েকটা ad shootএ modeling করে ভালোই টাকা আসতে লাগলো হাতে।বাড়িতে তো কোনদিনই টাকা পাঠাতাম না।তারফলে ব্যাংক ব্যালান্স ভালোই হলো।৭ জনের গাদাগাদি পিজি ছেড়ে একটা এক কামরার ফ্ল্যাট নিলাম বদলাপুরের দিকে। ভালোই চলছিল জানিস।তারপর একদিন অফিসে আমাদের টিমে ক্রস এক্সপোসারে এলিজা এলো স্কটল্যান্ড থেকে।আমার স্মার্টনেস,আমার জিম করা বডি , আমার রূপ সব দেখে প্রেমে পড়ে গেল মেয়েটা।আমায় ওর সাথে নিয়ে যেতে চাইলো নিজের দেশে।আমি দেখলাম ভাগ্য নিজে আমার কাছে এসেছে।লুফে নিতে হবে।একসাথে এলিজা আর তোর সাথে প্রেম চালাতে লাগলাম।খেলা বেশ জমে উঠেছিল।কিন্তু এলিজাকে নিয়ে তোর সন্দেহবাতিকতা চরমে উঠেছিল।বিয়ে বিয়ে করে মাথা খেয়ে নিয়েছিলি তুই।বিরক্ত লাগছিল।এছাড়া তোর প্রয়োজনও ফুরিয়ে ছিল আমার কাছে।তাই তোর সাথে ব্রেকআপ করে নিলাম।এরপর এলিজা দেশে ফিরে গেল।কয়েকদিন ওর দিক থেকে কোনো খবর নেই।ভাবলাম সোনার ডিম পাড়ে হাঁস হাতছাড়া হয়ে গেল।কিন্তু তার কয়েকদিন পরেই ও ফোন করে বলে ও নিজের একটা আইটি সেটআপ করছে স্কটল্যান্ডে।আমি যেন ওর মার্কেটিং দিকটা দেখি।আমিও লুফে নিলাম অফারটা।ফ্ল্যাটটা নিয়ে চিন্তায় ছিলাম।আমারই এক অফিস কলিগ বললো সে আর্জেন্ট ফ্ল্যাট খুঁজছে।আগামী দুইদিনের মধ্যেই তার ফ্ল্যাট চাই।তার মা ক্যানসার পেশেন্ট।চিকিৎসা করাতে আসছেন।আমি ভাবলাম সুবর্ন সুযোগ।তাকে ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে দিলাম।কিন্তু ভিসা প্রসেসিং,ওয়ার্ক পারমিট জোগাড় করতে তো বেশ কিছুদিন লেগে যাবে।ততদিন থাকবো কোথায়?হটাৎ তোর কথা মনে পড়লো।জানতাম তোর ফ্ল্যাট এখন ফাঁকা।তোকে একদিন একটু ইমোশনাল কথা বলতেই দেখি তুই রাতে আমায় ডেকে নিলি।আর কি?তখন শুধু টিকিটের অপেক্ষা।আজ সেটাও হাতে পেয়ে গেলাম।পরশু চলে যাব সব ফেলে নতুন জীবনের দিকে।"

তারপর তিতাসের চেয়ারের হ্যান্ডলে ভর দিয়ে কিছুটা ঝুঁকে তিতাসের মুখের কাছে মুখ এনে বললো,"তুই প্রথম থেকেই আমার কাছে শুধু একটা সিঁড়ি ছিলি।সিঁড়ি।থ্যাংকস ফর এভরিথিং জান।"বলে তিতাসের গালে একটা চুমু খায়।তারপর নতুন কেনা স্যুটকেসে নিজের জিনিস পত্র গুছিয়ে তিতাসের সামনে এসে বলে,"চলি রে।পারলে আমার ঘটনাটা থেকে কিছু শিক্ষা নিস।সবসময় মন দিয়ে নয় মাথা দিয়েও কিছু ডিসিশন নিস আর বিনা পরীক্ষায় অন্ধের মত মানুষকে বিশ্বাস করিসনা।ভালো থাকিস।আসলাম।"তারপর দরজাটা খোলা রেখেই বেরিয়ে যায় সিড।তিতাস স্থানুবৎ বসে থেকে চুপচাপ সিডের চলে যাওয়া দেখতে থাকে।মন ভাঙার বোধহয় সত্যি কোনো শব্দ হয়না।


পরেরদিন সকালে মালিনীর ছুটি।তিতাস ও রিতা নার্সিংহোমে যায়।রিতা মালিনীর জামাকাপড় আর ক্রেডিট,ডেবিট কার্ড গুছিয়ে নিয়ে নেয়।কোনটা যে লাগবে সে জানেনা।তাই সবকটাই নিয়ে নেয়। সমস্ত নিয়মাবলী ও বিল মিটিয়ে মালিনী,রিতা ও তিতাস গাড়িতে উঠে বসে।ফ্ল্যাটে পৌঁছে লিফট থেকে নামার সময় মালিনী দেখে তিতাসের ফ্ল্যাট বন্ধ।আজ তো রবিবার।ছেলেটা কোথাও বেরিয়েছে বোধহয়।আপন মনে ভেবেই মালিনী ঘরে গিয়ে বসে।রিতা একটু লেবু চিনির শরবত করে আনে সবার জন্য।তারপর তিতাসকে বলে,"তিতাস দিদি আজ দুপুরে এখানে খেও।মালিনী মেমসাবকে না জিজ্ঞেস করেই বলে দিলাম গো।সকালবেলা মনে হয় কিছু খেয়েও বেরোওনি।মুখটা এক্কেরে শুকায় গেছে গো।যাও সিনান টা সেরি এস।"

তারপর মালিনীর দিকে তাকিয়ে বলল,"মেমসাব তুমি রাগ করোনি গো।এই কদিন মেয়েটা যা করলো তাই তোমায় না জিজ্ঞেস করেই বলে দিলাম।তুমিও সিনান সেরি নাও।আজ তোমার পছন্দের তেঁতোর ডাল,ঝুড়ি আলু ভাজা,আলু পোস্ত আর সুরময়ী মাছের গা মাখা ঝাল করিচি গো।যাও যাও তাড়াতাড়ি যাও।"

মালিনী হেসে বললো,"রাগ করবো কেন?আমার সংসার তো আমার থেকে বেশি তুমি সামলাও রিতাদি।যাচ্ছি।"

তিতাস অবাক হয়ে বলল,"তুমি কি ম্যাজিক জানো রিতাদি।কখন করলে এসব।আমার সাথেই তো সকাল ৯টায় বেরোলে।"

রিতা,"সব সক্কাল সক্কাল সেরে নিছি গো।তুমি এখন যাও দিকি।"

দুপুরে খেয়ে উঠে তিতাস রিতাকে বললো,"আহ রিতাদি আজ তো ফাটিয়ে রান্না করেছো।মন আর পেট দুটোই ভরে গেল।"

রিতা লজ্জা পেয়ে বললো,"যাই একটু গড়িয়ে নিই গা।তোমরাও একটু শুয়ে নাও।"

মালিনী বললো,"সারাদিন নার্সিংহোমে শুয়ে শুয়ে বিরক্ত লেগে গেছে।আজ একটু আমার সাধের বারান্দায় বসি।তিতাস তোর ঘুম পেলে একটু ঘুমিয়ে নে।কটাদিন যা দৌড় ঝাঁপ করলি।"

তিতাস,"নাহ ঘুম আসছেনা।তোমার পাশে একটু বসি।"

দুজনে চেয়ার নিয়ে বারান্দায় বসে শান্ত সমুদ্রের ঢেউ দেখতে লাগল।কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর মালিনী তিতাসের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,"তুই যে সারাদিন আমায় নিয়ে পড়ে রইলি তোর বয়ফ্রেন্ড রাগ করবে না?"

অনেক্ষন চুপ থেকে তিতাস সমুদ্রের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,"ও নেই।চলে গেছে।"

মালিনী একটু অবাক হয়ে নিজের কপালে এসে পরা চুল সরিয়ে জিজ্ঞেস করলো,"ওমা!সেকি কেন।"তারপর একটু থেমে স্বাভাবিক হয়ে বলল,"আমি বোধহয় একটু বেশি পার্সোনাল কথা জিজ্ঞেস করে ফেললাম।সরি রে।কিছু মনে করিসনা।"

দুজনেই অনেক্ষন চুপ থাকার পর তিতাস মালিনীর হাত নিজের হাতের উপর নিয়ে প্রথম কথা বললো,"সেদিনকার আমার বলা কথাগুলো পারলে ভুলে যেও।খুব বিশ্রী কথা বলেছিলাম তোমায়।আসলে আমার মায়ের জীবনটা শেষ হয়ে গেছিল শুধুমাত্র তৃতীয় একজন মহিলার জন্য।তাই হয়ত সেই রাগটা সেদিন তোমার ওপর বের করেছিলাম।"

মালিনী নিজের হাত দিয়ে তিতাসের হাতে আলতো চাপ দিয়ে বললো,"অল্প কয়েকদিনেই তোকে বড্ড বেশি আপন করে নিয়েছিলাম তাই মনটা ভেঙে গেছিলো তোর বলা কথাগুলোতে।তারপর যখন দেখলাম তুই আমায় বাঁচানোর জন্য এত কিছু করলি তখন বুঝলাম ওটা ক্ষনিকের ভুল ছিল।শোন যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে।আমি ভুলে গেছি তুইও ভুলে যা।বুঝলি?"

তিতাস-"জানো আমি না ভালোবাসায় আত্মহারা দুটো মানুষকে প্রতিহিংসায় জ্বলতে দেখেছি।তারপরেও আমি সিডকে নিজের সব টুকু উজাড় করে ভালোবাসার ভুল করে ফেললাম।"

মালিনী,"জীবনে আমরা বারবার ভুল করি।কখনো তার থেকে শিক্ষা নিই কখনো নিইনা।কিন্তু জীবন আমাদের অনেক কিছু শেখায়।"

তিতাস উঠে গেল মালিনীর পাশ থেকে।ড্রেসিংটেবিল থেকে চিরুনি নিয়ে এসে মালিনিকে বললো ,"কখন থেকে চুলগুলো মুখের সামনে পরছে তোমার এসে বেঁধে দিই।"

তিতাসের চুল বাঁধা হয়ে গেলে মালিনী তার হাত দুটো নিজের সামনে টেনে নেয়।তিতাস ঝুকে নিজের গালটা মালিনীর গালে লাগায়।মালিনী গেয়ে ওঠে,

"ওলো সই,ওলো সই,

আমার ইচ্ছে করে তোদের মতন মনের কথা কই।

ওলো সই।"

তিতাস মালিনীর গলা জাপটে ধরে গায়,

"ছড়িয়ে দিয়ে পা দুখানি

কোনে বসে কানাকানি,

কভু হেসে কভু কেঁদে চেয়ে বসে রই।"


তিতাসকে হাত ঘুরিয়ে সামনে এনে দুজনে একসাথে গায়,"ওলো সই,ওলো সই।"

তারপর দুজনে হেসে গড়িয়ে পড়ে একে অপরের গায়ে।

তিতাস হাটু গেড়ে মাটিতে বসে মালিনীর কোলে মুখ গুঁজে বসে থাকে।মালিনী তিতাসের চুলে বিলি কেটে দেয়।হটাৎ মালিনী লক্ষ্য করে তিতাসের পিঠটা ফুলে ফুলে উঠছে।তিতাস কাঁদছে।সে দুই হাত দিয়ে তিতাসের মুখটা নিজের দিকে তুলে বলে,"এই তিতাস কি হয়েছে?কাঁদছিস কেন?"

তিতাস চোখের জল মুছে বললো,"এই গানটা আমার মা খুব গাইত জানো?"

মালিনী-"হ্যাঁ তোর মাকে সোসাইটির দুর্গা পূজার অনুষ্ঠানে গাইতে শুনেছিলাম।দারুন গলা ছিল ওনার।"

তিতাস-"আমার মা বাংলাদেশের ময়মনসিংহের মেয়ে ছিল।অসম্ভব ভালো গান গাইত।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় MA করে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথঠাকুরের ওপর phd করতে আসেন।আমার মার ধর্ম জন্মগত ভাবে ইসলাম হলেও মা ঈশ্বর অথবা আল্লাহর বদলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেই মানতেন নিজের ঈশ্বর রূপে।গান মায়ের সাধনা ছিল।মায়ের খুব শখ ছিল শান্তিনিকেতনে পড়ার।কিন্তু সুযোগ হয়ে ওঠেনি।"

শান্তিনিকেতন নামটা শুনেই একটা দীর্ঘশ্বাস পরে মালিনীর।তিতাসকে তুলে চেয়ারে বসায়।কিছুক্ষণ থেমে তিতাস আবার শুরু করে,"প্রত্যেক শনি রবিবার করে আমার মা দেশপ্রিয় পার্কের দক্ষিণীতে গান শেখাতে যেতেন।দক্ষিণীর পাশেই আমার বাবার বাড়ি ছিল।বাবা ছুটিতে বাড়ি এলেই বারান্দায় বসে মুগ্ধ হয়ে দক্ষিণী থেকে ভেসে আসা গান শুনতেন।বাবা তখন মুম্বাইতে একটা অফিসে সেলসের কাজ করতেন।খুব বেশি মায়না ছিলোনা।তিন চার জন বন্ধু মিলে একজন পার্সি মহিলার বাড়ি থাকতেন।বছরে দুবার বাড়ি আসতেন বাবা।সেবার দুর্গা পূজায় বাবা এলেন।বাবার ক্লাবের পুজোর সেবার সিলভার জুবিলী।দক্ষিণীর মেয়েরা সেবার গাইবে।বাবা ছিলেন ক্লাব অন্ত প্রাণ।পুজোর একসপ্তাহ আগে আসতেন একাদশীর দিন ফিরে যেতেন।পুজোর কটাদিন পাগলের মত খাটতেন বাবা।সেবার উদ্বোধনী সংগীত দক্ষিণীর তৎকালীন অধ্যক্ষ শ্রীমতি ঋতু গুহঠাকুরতা গাইবেন ঠিক হলো।তারপর সমবেত সংগীত গাইবে দক্ষিণীর মেয়েরা।কোনো একটি কারণে শ্রীমতি ঋতু গুহঠাকুরতা আসতে পারলেন না।ক্লাব প্রেসিডেন্ট সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে বললেন অনিবার্য কারণ বশত ঋতুদি আজ আসতে পারেন নি কিন্তু তার বদলে উনি তার সুযোগ্যা সহকর্মীকে পাঠিয়েছেন।আজ আপনাদের সামনে উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করবেন প্রতিবেশি দেশের নিলফার চন্দনা আহমেদ।চারিদিকে মৃদু গুঞ্জন উঠলো।দুর্গা পূজার উদ্বোধনী সংগীত গাইবে কিনা এক মুসলমান।এতো ঘোর অনাচার।অনাউন্সমেন্ট শেষ হয়ে মা স্টেজে পৌঁছানো পর্যন্ত চাপা গুঞ্জন রোষে পরিণত হয়েছে।মাইকের সামনে যাওয়ার আগে মা ভয় পাচ্ছিলেন।বাবা মাকে পেছন থেকে বললেন যান আর নিজের গলা দিয়ে এই ধর্মান্ধ মূর্খ দের মুখ বন্ধ করে দিন।মা বললেন কিন্তু আমার যে ভীষণ ভয় করছে।বাবা বললেন ভয় লাগলে চোখ বুজে আপনার আরাধ্যর মুখ মনে করে গান।অচেনা একজনের থেকে মনে সাহস পেয়ে মা মাইকের দিকে হেটে গেলেন।ততক্ষনে চিৎকার চেঁচামেচি তুঙ্গে।মা সভয়ে মাইক দুটো হাতে ধরে চোখ বুজে একবার রবি ঠাকুরের মুখ মনে করে নিলেন।তারপর গাইলেন রবি ঠাকুরের পূজা পর্যায়ের গান, 

প্রাণও ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে

 মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।

প্রথম লাইনেই সবাই চুপ।মা চোখ বুজে গেয়ে চলেছেন মগ্ন হয়ে যেন তিনি আর এই লোকের বাসিন্দা নন ।গান শেষ হলে শ্রোতারা হাত তালি দিতেও ভুলে গেল।মা চোখ খুললেন।তার চোখ থেকে নেমে গাল দিয়ে জল গড়াচ্ছে তখনো।সম্বিৎ ফিরে পেয়ে নমস্কার জানিয়ে মা যখন স্টেজ ছাড়ছেন তখন হাত তালির বন্যা।বাবা ব্যাক স্টেজে হাসি মুখে বললেন দেখলেন আমার ঠাকুর ঠিক বাঁচিয়ে নিলো তো।মা লাজুক হেসে চলে গেলেন।স্টেজে তখন দক্ষিণীর মেয়েরা সমবেত সুরে গাইছে, আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও। 


সেই শুরু।পুরো পুজোটাই বাবা মায়ের সাথে কাটিয়েছিলেন।দশমীর দিন বিসর্জন ঘাটে দাঁড়িয়ে বাবা মাকে বলেছিলেন জানি পাঁচটা দিন একটা মানুষের সাথে কাটিয়ে সারাজীবন তার সাথে কাটানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যথেষ্ট কম সময়।তবু যদি মনে হয় আমার সাথে বাকি জীবনটা কাটানো যায় তবে এই নাম্বারটা রাখো।এটা আমার ল্যান্ড লেডির বাড়ির টেলিফোন নাম্বার।এখানে মেসেজ দিয়ে রাখলেই আমি কল ব্যাক করবো তোমায়,যে নাম্বার বলবে সেই নাম্বারে।মা সেদিন কোনো উত্তর দেননি।মাথা নিচু করে কাগজটা আঁচলের ভাঁজে রেখেছিলেন।বাবার কাছে ফোন গেল প্রায় দুই সপ্তাহ পর।দিওয়ালির দিন।আতসবাজির শব্দে মুম্বাই মুখরিত।বাবা সেদিন বাড়ি ছিলেন।মা বাবাকে ফোন করে জানালেন তার পার্কসার্কাসের মামারবাড়িতে যেখানে উনি বর্তমানে থাকেন,সেখানে তার মামাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ের কথা চলছে।অথচ মায়ের মামাতো ভাই রহিমকে বিয়ে করার ইচ্ছে নেই।বাবা যদি কিছু করতে পারেন।বাবা ও মায়ের সম্পর্কে বাড়ির কেউ কিছু না জানলেও আমার পিসি অর্থাৎ বাবার বোন পম্পা জানতেন।বাবা বললেন আর এক সপ্তাহ পর ঈদ।সেদিন সেমাই দেওয়ার নাম করে যেন মা পিসির সাথে দেখা করে।পিসি মাকে মুম্বাইগামী ট্রেনে তুলে দেবেন।বাবা পিসিকে টিকিট পাঠিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করে দেবেন তার এক বন্ধুর মাধ্যমে।মাকে কিছু আনবার দরকার নেই শুধু সার্টিফিকেট গুলো আনলেই হবে।কথামত কাজ হলো।নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময় মা মুম্বাই আসলেন।বাবা মাকে নিতে স্টেশন গেছিলেন।মা চলে তো এলেন।কিন্তু থাকবেন কোথায়।বাবার ল্যান্ড লেডি পার্সি মহিলাটি এক থাকেন।মা কয়েকদিন তার বাড়িতেই থাকবেন।তারপর রেজিস্ট্রির ডেট পেলেই বাবা মা বিয়ে করে অন্যত্র বন্দোবস্ত করবেন।বাবা যেদিন মাকে আনলো সেদিন বাবা একটা নতুন চাকরির appoinment letter পেলো।যার স্যালারি শুধু ভালোই নয় তারা স্টাফ accomodation ও দেবে।বাবা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন।তারপর থেকেই বাবা মাকে তার লাকি চার্ম মানতেন।যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে বেরোনোর আগে মাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বেরোতেন।এরপর বাবা মায়ের বিয়ে হলো।দুই বছর পর আমি হলাম।মায়ের মুখে শুনেছি একদিন বাবা আর মা রাতে শুয়ে শুয়ে ঋত্বিক ঘটকের "তিতাস একটি নদীর নাম" সিনেমাটি দেখছিলেন।তখনই দুজনে মিলে ঠিক করেন ছেলে হোক বা মেয়ে নাম তার তিতাস ই হবে।এরপর বাবা লন্ডনে ট্রান্সফার হলেন।তারপর অনেক এদিক সেদিক ঘুরে মুম্বাইতে যখন থিতু হলেন তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি।মা আমাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতেন।বলতেন তুই মিউজিক নিয়ে বিশ্বভারতীতে পড়বি।আমার অপূর্ন স্বপ্ন তুই পূরণ করবি।কিন্তু ভাগ্য দেখো আমার কলেজটাও শেষ করতে পারলাম না।


যাইহোক যা বলছিলাম এরপর মা মুম্বাইতে এসে একটা NGO খোলেন।যেখানে মুম্বাইয়ের বড় বড় ব্রোথেলের বাচ্চাদের নিয়ে এসে লেখাপড়া ও নানা রকম হাতের কাজ শেখানো হয়।মায়ের এই NGOটি প্রচুর বিদেশি অনুদান ও পায়।আমিও মাকে নিজের সময় সুযোগ মত ngoর কাজে সাহায্য করতাম।আমি যখন ক্লাস 12 এ পড়ি তখন একটা নামি বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধি মায়ের সাথে দেখা করতে শহরের এক নামজাদা পাঁচ তারা হোটেলে আসে।বাবা তখন শহরের বাইরে।মা সেদিন সেই মিটিংয়ে সেরে ফেরার পথে সেই পাঁচতারা হোটেলের সুইমিং পুলে বাবা ও তার সেক্রেটারিকে দেখতে পান মদ খেয়ে উন্মত্ত অবস্থায় নোংরামো করতে।মা সেই মুহূর্তে সেখানে কিছু বলেননি।দুইদিন পর বাবা বাড়ি ফেরার পর অশান্তি শুরু হয়েছিল।রোজ ঝামেলা লেগেই থাকতো।হাতাহাতি অব্দি হতো দুজনের।গত দুই বছর ধরে সেই অশান্তির জেরেই আজ আমার মাকে মরতে হলো।নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয় জানো?সেদিন যদি ঝামেলা এড়াতে তোমার ঘরে না এসে মায়ের কাছে থাকতাম তো আজ বোধহয় মা বেঁচে থাকতেন।"এত অব্দি বলে তিতাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে থামল।

বেশ কিছুক্ষণ পর মালিনী বললো সব তৃতীয় ব্যক্তি বোধহয় স্বেচ্ছায় তৃতীয় ব্যক্তি হতে চায়না রে তিতাস।আমিও অনেকটা সেইরকমই।

তিতাস বললো,"হয়তো।বলতে পারবোনা।কিন্তু মায়ের এত সাধের NGO ভেসে যেতে বসেছে।আমিও রোজ যেতে পারিনা।কি যে হচ্ছে ওখানে ভগবান ই জানেন।আর বাদ দাও।কথা বলতে বলতে সন্ধ্যে হতে চললো।তুমি বসো আমি কফি করে আনি।তিতাস উঠে রান্নাঘরে যায়।গিয়ে দেখে রিতাদি কফি আর বিস্কুট ট্রেতে সাজাচ্ছে।তিতাসকে দেখে বলে,"এই নাও কফি আমি বাজারে বেরোই দেখি ভালো দেশি মুরগি যদি পাই তো রাতে ইস্টু আর পাউরুটি খাওয়াবো।"বলে জর্দা ছোপ পড়া দাঁত বের করে হাসলো।তিতাস কফি নিয়ে যেতে যেতে শুনলো মালিনী গাইছে,

"বালি উমর মে নায়না লড়ে,

শাওন কে ঝুলে পরে,

তুম চলে আও,

তুম চলে আও।"

তিতাস কফির মাগটা মালিনীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,"বেশ তো গাইছিলে থামলে কেন?"

মালিনী হেসে গরম কফিতে চুমুক দিলো।কিছুক্ষন পর মালিনী বললো,"জানিস তিতাস,আগে না খুব মরে যেতে ইচ্ছে করতো।খালি মনে হতো কি হবে বেঁচে থেকে।কিন্তু সেদিন যখন দেখলাম একটা আমার সন্তানের বয়সী ছেলেও আমার দেহ লেহন করতে চাইছে তখন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলামনা।বারবার মনে হচ্ছিল আমি কে?আমি কি শুধুই একটা শরীর।যাকে যে কেউ ভোগ করতে পারে?এমনকি নিজের সন্তান সম পুরুষও?

তবে সেদিন যখন চরম ডিপ্রেশনে ঘুমের বড়ি গুলো খেয়ে আস্তে আস্তে ঢলে পড়ছিলাম মৃত্যুর কোলে তখন পুরোনো দিনের স্মৃতি গুলো একের পর এক চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো।মনে পড়ছিল ছোটবেলায় আমার বেশ কিছু স্বপ্ন ছিল।সেগুলো বড় হয়ে সব পূরণ করবো ভাবতাম।সেগুলো তো কিছুই করা হলো না।নিজের স্বপ্ন পূরণ করা বাকি,নিজের জন্য, নিজের মতো করে বাঁচা বাকি।জীবন তো একটাই।সেটাও শেষ হয়ে যাচ্ছে আর ফিরে পাওয়া যাবেনা একে।তখন খুব বাঁচতে ইচ্ছে করছিল জানিস?কিন্তু আমি আস্তে আস্তে একটা অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিলাম।কিছু একটা আঁকড়ে ভেসে উঠতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু না কিচ্ছু নেই।অন্ধকার চারিদিকে অন্ধকারে আমি ডুবে যাচ্ছি।নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।উফ কি কষ্ট।কিন্তু নার্সিংহোমে যখন প্রথম চোখ খুললাম,আলো দেখতে পেলাম তখন বুঝতে একটু সময় লাগছিলো যে আমি কোথায়?মরে গেছি নাকি বেঁচে আছি।কিছুক্ষন পর বুঝলাম নাহ আমি মরিনি।ভগবান আমায় দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছেন।এবার আমি তার পূর্ণ ব্যবহার করবো।

তিতাস বললো,"বাহ খুব ভালো।কিছু ভাবলে?"

মালিনী,"তুই আমায় একটা সুযোগ দিবি তিতাস।তোর মায়ের NGO সামলানোর।দেখ আমার টাকা পয়সার অভাব নেই কিন্তু সময় কাটানোর কোনো রাস্তা নেই।নতুন কিছু করতে গেলে সমাজ আমায় জায়গা দেবে না।তোকে কোনো মায়না দিতে হবে না আমায়।আমার অনেক যোগাযোগ আছে।ডোনেশন ও প্রচুর জোগাড় হবে।আমাদের নিজেদের টাকায় হাত ও পড়বেনা।NGO পুরোটাই চলবে তার নিজস্ব টাকায়।আমার হাতে এখন অঢেল সময়।ঘর রিতা সামলে নেবে।আমি পুরো সময়টাই ওখানে দিতে পারবো।আমায় এই সুযোগটা দিবি তিতাস প্লিজ।"

তিতাস যেন হাতে চাঁদ পেলো,"তুমি সত্যি এই দায়িত্ব নেবে?উফ কি শান্তি।"

মালিনী-"তবে কালকেই চল"

তিতাস-"এই না না।তুমি আগে পুরোপুরি সুস্থ হও তারপর।"

মালিনী-"আমি সুস্থই আছি তিতাস।ঘরে চুপ চাপ বসে থাকলে আবার আমি depression এ চলে যাবো।প্লিজ তিতাস কালকেই চল।"

তিতাস-"উফফ তুমি না পুরো বাচ্চাদের মত ,বড্ড বায়না করো।একদম কথা শোনোনা।ঠিক আছে কালকেই যাবো আমরা।"

মালিনী,"আমার একটা কথা রাখবি তিতাস?"

তিতাস,"বলো।"

মালিনী,"তুই কল সেন্টারের কাজ টা ছেড়ে graduation টা শেষ করনা বাবু।তারপর মাস্টারস।"

তিতাস,"ক্ষেপেছ?কল সেন্টার ছাড়লে খাবো কি?সেভিংস যা ছিল সব তো বাবার নামে।পুলিশ সব সিল করে রেখেছে।বাবা বেপাত্তা।কোনোদিন ফিরবে নাকি জানিনা।এর মধ্যে একদিন বাবার অফিসে গিয়ে শুনি বাবাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে।gratuity,last month salary সব hold করিয়ে দেওয়া হয়েছে।বাবার সেক্রেটারি কাজ ছেড়ে দিয়েছে।কোনো ক্লু ই নেই।মার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থেকে জানা যায় বাবা মায়ের মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করেছিল।কি দিয়ে আঘাত করেছিল কেউ জানেনা।এই অবস্থায় আমার পক্ষে চাকরি ছেড়ে পড়াশোনা চালানো সম্ভব নয় গো।"

মালিনী,"আমি তোর পড়াশোনার সব খরচ দেব।চিন্তা নেই দয়া করছিনা।একটা ভালো চাকরি পেলেই সব সুদ সমেত ফেরত দিবি।আমি হিসেব রাখবো।কিন্তু সারাজীবন কল সেন্টারে কাজ করে কি পাবি তুই?এর ভবিষ্যৎ কি?তুই প্লিজ আমার কথা শোন।"

তিতাস,"একটু সময় দাও।ভেবে জানাচ্ছি।"


পরের দিন সকালে তিতাস আর মালিনী বেরোয়।NGO তে সবার সাথে পরিচয় করায় তিতাস।সবাই খুব খুশি।এতদিন NGO টা অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছিল।মালিনী সারাটাদিন বাচ্চাদের সাথে সময় কাটায়।বয়স্ক মহিলাদের ঘর গুলো পেছন দিকে।বাগানে ঘেরা।সারাজীবন যেইসব রূপোপজিবিনীরা নিজেদের নিংড়ে ব্যবসা করেছে বয়স্কালে আমাদের সমাজ তাদের ছিবরে করে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে আস্তাকুঁড়ে মৃত্যুর দিন গোনার জন্য।হয়তো কোন স্টেশনে বা রাস্তায় গু মুতে মাখামাখি হয়ে তারা মরে পরে থাকে।কেউ ফিরেও তাকায়না তাদের দিকে।নিলফার তাদের কথা ভেবেছিল।তাদের আলাদা ঘর দিয়েছিল,বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য আর উপার্জনের রাস্তা দিয়েছিল।হাতের কাজ করে উপার্জন করে তারা।তারা নিজেদের মত কেউ প্রদীপ বানায়,কেউ পাঁপড় বানায়,কেউ বা ধুপকাঠি।NGO সেগুলো কে দেশে বিদেশে কুটির শিল্পের TAG লাগিয়ে ভালো দামে বিক্রি করে।সেই টাকায় চলে এদের থাকা,খাওয়া,চিকিৎসা আর পড়াশোনা।এরা কাজ করতে করতে নিজেদের মধ্যে রঙ্গ রসিকতায় একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ে।বেশ চলছে এদের জীবন।মালিনী এদের মধ্যে একটা অদ্ভুত জীবনীশক্তি খুঁজে পায়।NGO থেকে বেরিয়ে তিতাস আর মালিনী গাড়ি ছেড়ে দিয়ে হাটতে থাকে।দুজনে হাত ধরাধরি করে মার্কেটে যায়।সেখানে পানিপুরী খায়।চাট খায়।আর গল্প করতে করতে মনের আনন্দে হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে লুটিয়ে পড়ে।রাস্তা পেরোনোর সময় হঠাৎ একটা দোতলা BEST দেখে উঠে পড়ে।মালিনী বাচ্চাদের মত লাফাতে লাফাতে দোতলায় উঠে একদম সামনে কাঁচের জানালার সামনে বসে।বাস মেরিন ড্রাইভ এলে দুজনে নেমে যায়।হাত ধরা ধরি করে মেরিন ড্রাইভের রাস্তা ধরে দুজনে হাতে হাত ধরে হাঁটতে থাকে।পড়ন্ত বিকেলের লাল আভা সমুদ্রে পড়ছে।মালিনী হটাৎ গেয়ে ওঠে,

"কাতরা কাতরা মিলতি হে

কাতরা কাতরা জিনে দো।"

তিতাস যোগ দেয়,

"জিন্দেগী হে,জিন্দেগী হে

বেহেনে দো,বেহেনে দো।

তারপর দুজনে একসাথে গলা মিলিয়ে গায়,"প্যায়াসি হু মে প্যায়াসি রেহেনে দো,

রেহেনে দো না।"

একটা ফাঁকা জায়গা দেখে দুজনে বসে পড়ে সমুদ্র তীরের পাঁচিলের ওপর।

মালিনী আজ একটা মিষ্টি গোলাপি রঙের তাঁতের শাড়ি পড়েছে।কি স্নিগ্ধ লাগছে আজ তাকে।তিতাস পড়েছে আগুন লাল রঙের কুর্তি।একজন সদ্য টিনএজ পেরোনো মেয়ে ও আরেকজন মধ্য বয়সী মহিলার মধ্যে এক অসামান্য বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে।

দুজনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে শান্ত সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে।আরব সাগর এখানে বেশ শান্ত।মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটা খাঁজে ঢুকে এসেছে।বড় বড় বোল্ডার দিয়ে সমানে চেষ্টা চলছে তাকে আটকানোর।কিন্তু হার না মানা সাগর বার বার তার তীব্র আস্ফালন করে চলেছে শক্ত কঠিন বোল্ডার নামক বাঁধার ওপর।তা ফলশ্রুতি হিসেবে প্রতিনিয়ত একটু একটু করে ক্ষয়ে চলেছে বোল্ডার গুলো।সমুদ্রের তীব্র বিশ্বাস একদিন সে বোল্ডার গুলোকে ধুলিস্মাৎ করে এগিয়ে চলবে মালিনী ও তিতাসের মতোই।

অনেক ক্ষণ চুপ থাকার পর মালিনী বলে ওঠে,"তিতাস তুই কখনো শান্তি নিকেতন গেছিস?"

তিতাস-"মায়ের সাথে একবার গেছিলাম পৌষ মেলায়।তখন অনেক ছোট।ভালো করে মনে নেই।"

মালিনী-"জানিস তিতাস,আমি শান্তিনিকেতনের মেয়ে।ওখানেই জন্ম,ওখানেই পড়াশোনা, ওখানেই আমার বেড়ে ওঠা।শান্ত সবুজে বন আর লাল মাটি মিশে আছে আমার সারাটা বয়ঃসন্ধি জুড়ে।এখনো মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস নিলে ভরা বর্ষায় কোপাইয়ের সোঁদা গন্ধটা পাই নিজের শরীরে।"

তিতাস-"তুমি মুম্বাই এলে কেমন করে?"

মালিনী-"সে এক তিক্ত অধ্যায়।স্মৃতির এক ভয়ানক কালো অংশ।অন্য কোনো একদিন বলবো না হয়।"

তিতাস-"আমার মতে বলে তিক্ত অধ্যায় এই সমুদ্রে আবর্জনার মত ভাসিয়ে দেওয়া উচিত।আজ সব উগরে ফেলো।তারপর এক বুক বিশুদ্ধ বাতাস নিয়ে নতুন করে বাঁচো।নিজেকে ভালোবেসে বাঁচো।আমিও ভাবতাম সিড কে ছাড়া বাঁচবোনা।পরে ভেবে দেখলাম অন্যকে ভালোবাসলে সে আঘাত দেবেই।একবার হলেও দেবে,জেনে বা না জেনে হলেও দেবে।তার থেকে নিজেকে ভালোবাসলে কেউ আঘাত দেওয়ার নেই।খুব ভালো থাকবে।"

মালিনী হেসে বললো,"বাবাঃ!তিতু তুই তো কুড়িতেই পাকা বুড়ি হয়ে গেছিস রে।"

তিতাস হেসে বললো,"বুড়ি না হলে তোমার মতো বুড়ির সাথে বন্ধুত্ত কি করে হতো বলো?"

মালিনী কপট রাগ দেখিয়ে চোখ বড় বড় করে বললো,"এই আমাকে বুড়ি বলবিনা।অভি তো মে জবান হু।"

তিতাস-"কথা না ঘুরিয়ে বলে ফেলো এবার।"

কিছুক্ষণ চুপ থেকে মালিনী শুরু করলো,"বেশ কাটছিল দিনগুলো জানিস।বিশ্বভারতীতে পড়ে,সোনাঝুড়ির বনে আড্ডা মেরে,গান গেয়ে,নাচ করে স্বপ্নের মত দিনগুলো কাটছিল।মা ছিলেন সংগীত ভবনের শিক্ষিকা, বাবা ছিলেন কলাভবনের অধ্যাপক।মায়ের হাতে সযত্নে গড়ে তোলা বাগান ঘেরা ছোট্ট একতলা সুখনীর বাড়িতে কি ভীষণ শান্তি ছিল ভাবতে পারবিনা।আর ছিল বিপ্লব।আমার বাবার প্রিয় ছাত্র।ওর চোখে নিজের জন্য মুগ্ধতা দেখতে পেতাম আমি।কিন্তু তুমি যদি কোনো মূল্যবান জিনিস পেয়ে যাও অতি সহজে তবে তা মূল্যহীন হয়ে পড়ে তোমার কাছে হেলায়।আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল।ওকে পাত্তাই দিতামনা।ভাবতাম এরা আমার মতো সুন্দরীদের জন্য নয়।আমার জন্য আসবে রাজপুত্তুর ঘোড়ায় চড়ে।হীরে মনি মুক্তায় আমায় ভরিয়ে রাখবে।পড়াশোনা শেষে বাবার আর এক ছাত্র তার মামাতো ভাইয়ের জন্য আমার সম্বন্ধ আনলেন।ছেলেটি ব্যাংকার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।কুয়েতে চাকরি করে।অঢেল পয়সা,বাড়ি,গাড়ি।মেয়ে রাজরানী হয়ে থাকবে।আমি তো স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি।বাবা মা কেন জানিনা কিন্তু কিন্তু করেও রাজি হয়ে গেলেন। এক দেখাতেই ওদের আমাকে পছন্দ হয়ে গেল।ফাল্গুন মাসের এক সন্ধ্যায় আর্য্যর সাথে আমার বিয়েটা হয়ে গেল।বিয়ের কয়েকদিন পরেই আমি আর্য্যর সাথে কুয়েতে চলে গেলাম।সবুজ ঘাস আর লাল রঙের পলাশ-শিমুল-কৃষ্ণচূড়া ঘেরা জগতে বেড়ে ওঠা মেয়েটি ছিন্নমূল হয়ে এসে পৌছালো এক ধূসর মরুর দেশে।

আর্য্য প্রথম থেকেই ভীষণ ambitious ছিল।সে শুধু চাইত আরো আরো।অতি অল্প বয়সেই সে অনেক উন্নতি করেছিল।আমাকে ভালোবাসতো খুব।

অন্তত আমি তাই ভাবতাম।আর্য্য আমার প্রথম ভালোবাসা ছিল।ওর প্রতি দুর্বলতা ছিল আমার চূড়ান্ত।ওর জন্য আমি হাসতে হাসতে আগুনেও ঝাঁপ দিতে পারতাম।একদিন অফিস থেকে আর্য্য খুব মুখ কালো করে এলো।রাতে ভালো করে খেলোই না কিছু।ওর পছন্দের দম মুর্গ পোলাও করেছিলাম।ছুঁয়েও দেখলনা।আমি খুব চিন্তায় পড়ে গেছিলাম।বার বার জিজ্ঞেস করাতে ও বললো সামনেই ওর প্রমোশন হওয়ার কথা ছিল।কিন্তু অন্য এক কলিগ সেটা হাতাবার চেষ্টা করছে অসৎ উপায়ে।তাকে নিরস্ত করবার একটি উপায় হলো সামনের একটা ১০০০ কোটির ডিল ক্র্যাক করা।কালকে একটা পাঁচ তারা হোটেলে পার্টি আছে।আমি যদি একটু সেজে গুঁজে হেসে হেসে সেই ব্যবসায়ী শেখকে হাত করতে পারি তাহলে ডিলটা ফাইনাল হয়ে যায় আর ওর প্রমোশনটাও হয়ে যায়।মন থেকে মেনে না নিলেও প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান ও করতে পারলামনা শুধুমাত্র আমার ভালোবাসার মুখ চেয়ে।ওর জন্যে আমি সব কিছু করতে প্রস্তুত ছিলাম।পরেরদিন সেজে গুঁজে পার্টিতে গেলাম।আমি মদ খেতাম না।তবু পার্টিতে মদের গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে রইলাম।আর্য্য সবার সাথে আমার পরিচয় করালো মালিনী বলে।আমি ওকে আড়ালে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমার নাম তো লাবণ্য,মালিনী কে?আর্য্য হেসে বললো আরে এইসব high socityতে লাবণ্যর মত trash নাম চলেনা।তাই এদের কাছে তুমি মালিনী।এরপর ও আমায় শেখের সাথে পরিচয় করালো।শেখ প্রথমে হেসে হেসে কথা বলছিল।তারপর আস্তে আস্তে আমার পিঠে হাত বোলাতে লাগল।অদ্ভুত ব্যাপার আর্য্য সবকিছু লক্ষ্য করেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে গেল,কোনো কিছুই বললোনা।উল্টে আমাকে শেখের কাছে একা রেখে চলে গেল।শেখ আমাকে নিয়ে একটা ফাঁকা ঘরে ঢুকলো।আমি বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম অনেকবার।কিন্তু প্রত্যেকবারই বুঝেছিলাম এদের বন্য ক্ষুধার হাত থেকে আমার মুক্তি নেই।চিৎকার করতে গিয়েও পারলামনা।চোখের সামনে আর্য্যর অসহায় মায়া মাখানো মুখটা ভেসে উঠেছিল।দাঁতে দাঁত চিপে সব সহ্য করেছিলাম সেদিন।শেখ নিজের লালসা চরিতার্থ করে চলে যাওয়ার পর গায়ে আঁচল চাপা দিয়ে গুটি সুটি মেরে বিছানার এক কোনে চুপ করে বসে কাঁপছিলাম।চোখে কাজল ঢেবরে মাখামাখি,লিপস্টিকের লাল রং ঠোঁট ছাড়িয়ে গাল অব্দি এসে পৌঁছেছে,সিঁথিতে আর সিঁদুরের অস্তিত্ব আর নেই বললেই চলে,শাখা পলা টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছে।

কিছুক্ষন পর আর্য্য এসে আমায় জড়িয়ে ধরলো।আমি ওকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললাম।ও আমার কান্নাকে পাত্তা না দিয়েই বললো ওহ সোনা you have done a splendid job.শেখ খুব খুশি।কন্ট্রাক্টটা আমরাই পাচ্ছি।এবার ওই হারামজাদা আইয়ার কিছু করতে পারবেনা।প্রোমোশন টা আমিই পাচ্ছি।আমি অবাক চোখে আর্য্যকে দেখলাম।ও কি আমার কষ্টটা বুঝতে পারছে না?তবু ওর হাসিমুখ দেখে আমি সব ভুলে গেছিলাম।

এরপর থেকে প্রত্যেকবার বার বার একইভাবে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করে আমায় নিজের ওপরে ওঠার সিঁড়ি বানায়।আমি শুধুমাত্র আর্য্যর খুশির জন্য নিজের সবকিছু বলিদান দিতে প্রস্তুত ছিলাম।কিন্তু আর্য্য দেখতাম নিজের succsessএর বাইরে কিছু ভাবতে পারতোনা।এইরকম ভাবে প্রায় ৬ মাস চললো।এরমধ্যে কুয়েতের চাকরি ছেড়ে আর্য্য বোম্বে চলে এসেছে।নিজের এক্সপোর্ট ইম্পোর্টের ব্যবসা শুরু করেছে।একদিন আমার শরীর খুব খারাপ লাগছিল।অনেকদিন ধরে গা বমি আর মাথা ঘোড়াচ্ছিল।সেদিন বিছানা থেকে মাথাই তুলতে পারছিলাম না।সন্ধ্যেবেলা এসে আর্য্য বললো লাবণ্য তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।আজ একটা পার্টি আছে।অনেক টাকার ডিলিং একবার ক্র্যাক হলে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবেনা।সারাজীবন পায়ের উপর পা তুলে খাবো।আমি কোনোরকমে কাতরাতে কাতরাতে বললাম আজ ছেড়ে দাও আর্য্য।আজ শরীর একদম চলছেনা।মুহূর্তের মধ্যে আর্য্যর চোখ মুখ পাল্টে গেল।আমার কাছে এসে হিংস্র মুখ করে হিস হিস করে বললো ন্যাকামি বন্ধ করো।ব্যবসাটা ডুবলে এত ফুটানি কোথায় যাবে?ছিলে তো একটা গন্ড গ্রামে।সেখান থেকে তুলে এনে এই lavish life দিয়েছি।কোনোদিন কল্পনাও করতে পেরেছিলে এত ঐশ্বর্যে থাকতে পাবে।সারাদিন খেটে খুটে আমি রোজগার করবো আর তুমি শুধু বসে বসে খাবে তা তো হয়না সোনা।চুপ চাপ রেডি হয়ে চলো আমার সাথে।এই আর্য্যকে আমি চিনতাম না।বিশ্বাস কর তিতাস।সেদিন অনেক কিছু বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি তাই সেদিনের না বলা কথাগুলো আগেরদিন আগারওয়ালের সামনে উগরে দিয়েছিলাম।অনেক অভিমান নিয়ে তৈরি হলাম।চরা মেকআপের তলায় নিজের ক্লিষ্ট মুখটা ঢাকার চেষ্টা করলাম।শরীরটা ভালো ছিলোনা।তাও পার্টিতে সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছিলাম।এমন সময় দেখি আর্য্য আসছে এক বিশালদেহী পুরুষকে নিয়ে।আমি তো দেখেই ভয় পেয়ে গেলাম।আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় থেকেই দেখছি লোকটা লোলুপ দৃষ্টি আমার সারাটা শরীর চেটে পুটে নিচ্ছে।যেন অনেকদিনের হিংস্র ক্ষুধার্ত বাঘ তার শিকারকে এক হাত দূর থেকে দেখছে।কিছুক্ষন পর লোকটা আমাকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো।আমি একবার বলার চেষ্টা করেছিলাম যে আমার শরীর ভালো নেই কিন্তু তার আগেই লোকটা তার বিশাল দেহ আমার শরীরের ওপর চাপিয়ে,পিষে,আঁচড়ে,কামড়ে ছিড়ে খুঁড়ে দিল।অমানুষিক কর্ষণের পর আমি হটাৎ অনুভব করলাম আমার তলপেট যন্ত্রনায় ছিড়ে যাচ্ছে।পায়ের তলার চাদরটা ভিজে।লোকটা দেখি আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে ঘেন্নায় ওয়াক তুলছে।কোনোরকমে জামা প্যান্টটা গায়ে গলিয়ে মুখে হাত দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।আমি বিছানায় উঠে দেখি আমার যোনীদ্বার থেকে গল গল করে রক্ত বেরোচ্ছে তার সাথে অসহ্য যন্ত্রনা।আর্য্য দৌড়ে ঘরে এসে ঢুকেই চেঁচিয়ে উঠলো,"WTF!কি করলে মালিনী এটা?তোমার পিরিয়ড হয়েছে আগে বলতে পারলে না?ছিঃ।এত ভালো ডিলটার দিলে বারোটা বাজিয়ে।এরপর সেলিমভাই আর কন্ট্রাক্ট সাইন করবে আমার সাথে?আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম বিশ্বাস করো আমার আজ পিরিয়ড ছিলোনা।EVEN লাস্ট দুইমাস ধরে আমার পিরিয়ড বন্ধ।আমি বুঝতে পারছিনা কি হলো।বলতে বলতে আর্য্যর গায়ে অজ্ঞান হয়ে পরে গেলাম।চোখের সামনে অন্ধকার।যখন জ্ঞান হলো তখন হাসপাতালে।চোখ খুলে দেখি একজন নার্স আমার সামনে।আমি তাকেই জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছিল আমার।নার্স বললো আমার নাকি মিস ক্যারাজ হয়েছে।আমি দুইমাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম।সেদিন সেইমুহূর্তে আমি যেন হটাৎ করেই বজ্র কঠিন হয়ে উঠলাম।বুঝলাম আমার শক্ত হওয়ার সময় এসেছে।অনেক সহ্য করেছি আর নয় এবার থেকে নিজের জন্য বাঁচবো।

কথা শেষ করে মালিনী চুপ করলো।ওর চোখ দিয়ে আগুন ঝরছিল।তিতাস ওর কথা এতক্ষণ চুপ করে শুনে যাচ্ছিল।মালিনীর পিঠে হাত দিয়ে বললো,"মা বাবাকে কিছু জানাওনি?"

কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে কিছুক্ষণ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে মালিনী আবার বলতে শুরু করলো,"হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আমি আর আর্য্যর কাছে ফিরে যাইনি।আর্য্য অনেক করে বলেছিল।ক্ষমা চেয়েছিলো।হাতে পায়ে অব্দি ধরতে চেয়েছিল।আমি আর ওর মিষ্টি মিষ্টি কথায় ফাসিনি।শান্তিনিকেতনেও যাইনি কারণ আমার মা বাবার বোঝা আমি হতে চাইনি।সোজা চলে গেছিলাম আমার এক বান্ধবীর অফিসে।ওকে সব কথা খুলে বলেছিলাম।সব শুনে ও বলল,তুই একটা বোকা।সেই যখন নিজের শরীর নষ্ট করছিস ই তবে তা নিজের জন্য কর।নিজে আনন্দে থাক,নিজের ইনকাম উপভোগ কর।আমি নিজে পার্ট টাইম এসকর্ট সার্ভিস করি।ভালো ইনকাম।মুম্বাইতে ভালো ভাবে বাঁচতে হলে শুধু চাকরিতে চলে না রে।আমার অনেকদিন একসাথে দুটো কল আসে।attend করতে পারিনা।রেপুটেশন নষ্ট হয়।তোকে আমি লিড গুলো দিয়ে দেব।তোর যা রূপ কয়েকটা সিটিং দিলেই একটা ফ্লাট রেন্ট নিয়ে নিতে পারবি।ততদিন আমার সাথে থাক।কয়েকদিন ওর ফ্ল্যাটে রেস্ট নিয়ে ওর সাথেই কাজ শুরু করলাম।প্রথমদিকে খুব কান্না পেত।মন খারাপ লাগত।পরেরদিকে অভ্যাস হয়ে গেছিল।এই ভাবেই দেখা আগারওয়ালের সাথে।ও আমায় বললো তোমার এসকর্টের চাকরি করার কি দরকার?তোমায় আমি রানী করে রাখবো।তোমায় লাক্সারিয়াস লাইফ দেব তার বদলে তুমি শুধু মাঝে মাঝে আমায় আনন্দ দেবে।তাহলেই হবে।ব্যাস সেই শুরু।আর্য্যর সাথে থাকতে আমাকে আর্য্যর জন্য শরীর বেঁচতে হতো।এখন সেই শরীর দিয়েই নিজের বাড়ি,গাড়ি,সম্পত্তি করলাম।তাই সেদিন যখন তোর বাবার সেক্রেটারির কথা বললি তখন বলেছিলাম শুধুমাত্র তৃতীয় মানুষের জন্যই সংসার ভাঙে নারে।সংসার ভাঙে কারণ মানুষ তা ভাঙতে চায় বলে।"

তিতাস-"তুমি তো শিক্ষিত ছিলে।চাকরি কেন করলেনা।"

মালিনী-"এখানে প্রত্যেকটা কর্পোরেট হাউজের মাথারা আমায় চেনে।কে চাকরি দিত বল।পরে শুনেছি আর্য্য বাবা মাকে বলেছে আমি নাকি নোংরা মহিলা।কার হাত ধরে পালিয়ে গেছি।বয়স্ক মানুষ দুটো শোকে মুহ্যমান হয়ে কয়েক বছরের মধ্যেই মারা গেছিলো।"

তিতাস-"আর কোনোদিন আর্য্যর সাথে দেখা হয়েছিল?"

আর্য্য-"হ্যাঁ।বছর পাঁচেক আগে একবার একটা পার্টিতে মিস্টার আগারওয়ালের সাথে গেছিলাম।সেখানে দেখেছিলাম।লোকের মুখে শুনেছিলাম ওর নাকি খুব খারাপ অবস্থা।ব্যবসায় লোকসান আর ও নাকি ধার দেনায় ডুবে আছে।আমার সামনে এসে একবার ডেকেছিল লাবণ্য বলে।আমি নিজের মুখের ওপর কালো চশমা চাপিয়ে বলেছিলাম আপনি বোধহয় ভুল করছেন।আমার নাম মালিনী।মালিনী মিত্র।আমার হাত ধরে বলেছিল আমাকে কি আরেকবার ক্ষমা করা যায়না লাবণ্য।আমি মানছি আমি অনেক অন্যায় করেছি কিন্তু তুমি তো আমায় ভালোবাসতে মালিনী?আমি জানি তুমি এখনো আমায় ভালোবাসো।ফিরে এসো মালিনী।আমরা আবার নতুন করে সব শুরু করবো।আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম হ্যাঁ ভালোবাসতাম।শুধু আমিই তোমাকে ভালোবাসতাম,তুমি আমাকে শুধু ব্যবহার করেই গেছো।ভালো কখনো বাসনি।তাই তোমায় ছেড়ে আমি নিজেকে ভালোবাসছি।তাতে আর যাই হোক আমার মন কোনোদিন ভাঙবেনা।আর শুরু করার কথা বলছো?যদি একটুও জোড়া দেওয়ার ইচ্ছে থাকতো তবে দিনের পর দিন আমার মা বাবাকে আমার সম্পর্কে এক গাদা নোংরা মিথ্যে কথা বলে তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারতেনা।আর্য্য চুপ করে সরে গেল আমার সামনে থেকে।আমি সামনে এগিয়ে গেলাম।সেই শেষ।তারপর ওর আর কোনো খবর আমি জানিনা।"

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে থামল মালিনী।

কিছুক্ষন পর তিতাস বললো,"আমি কাল গিয়ে রেজিগনেসনটা দিয়ে দেব।অনেক ভেবে দেখলাম আবার পড়াশোনাটা শুরু করবো।

হ্যাঁ গো আমি ঠিক করেছি ভালোভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াবো আর নিজেকে খুব ভালোবাসবো।"

এর কয়েকদিন পর তিতাস চাকরি ছেড়ে একটা কলেজে ভর্তি হলো।মালিনী সই করলো ওর গার্জেনের জায়গায়।ভর্তি হয়ে ফেরার পথে তিতাসের কাছে একটা ফোন এলো থানা থেকে।ফোনে পুলিশ ওকে জানালো তিতাসের বাবা আত্মসমর্পণ করেছেন।যদি তিতাস চায় তার সাথে দেখা করতে পারে।তিতাস উত্তর দেয় সে দেখা করতে চায় না, বলে ফোনটা রেখে দেয়।কিন্তু মালিনী তিতাসের কাঁধে হাত রেখে বলে,"তিতাস যতই তুই লোকটাকে ঘৃণা করিস ভুলে যাসনা উনি তোর বাবা।আজ তুই যেটুকু যা হয়েছে তার পেছনে তোর বাবার হাত ও ছিল।চল।"মালিনীর গাড়ি থানার দিকে এগোয়।

পুলিশ স্টেশনে গিয়ে তিতাস দেখলো সেদিনের সেই পুলিশ অফিসারটি বসে আছেন।ওর মায়ের মৃত্যুর তদন্ত যিনি করছিলেন।ওদেরকে দেখেই পুলিশ অফিসারটি বসালেন।তারপর কিছু কাগজপত্রে তিতাসের সই নিয়ে ওকে হাজতের কাছে নিয়ে গেলেন।তিতাস দেখল জেলের শিকগুলোর গা ঘেষে মাটির মধ্যে ওর বাবা গুটি সুটি মেরে বসেছিল।তিতাস আলতো স্বরে ডাকলো বাবা।কোনো উত্তর এলোনা।তিতাস গারোদের এপারে হাটু গেড়ে বসে আবার ডাকলো,"বাবা"।গত দেড়মাসে অনিমেষ মজুমদার ৫০ বছরেই অশীতিপর বৃদ্ধ হয়ে গেছেন।ধীরে ধীরে মুখ তুলে এপাশে তাকালেন।কিছুক্ষণ চুপ করে জল ভরা চোখে জেলের শিক গুলো আকড়ে ধরে বলে উঠলেন,"তিতাস! "

তিতাসও ছল ছলে চোখে সেই হাতের উপর হাত রেখে বলে,"কেমন আছো বাবা?"

অনিমেষ-"মা রে আমি অনেক বড় অপরাধ করেছি মা।আমায় ক্ষমা করিস জানি অনেক বড় অপরাধ করেছি।এর কোনো ক্ষমা নেই।মা পারলে আমায় ক্ষমা করিস।"

তিতাস-"মা কি করে মারা গিয়েছিল বাবা?"

অনিমেষ গরাদ ছেড়ে কপালে হাত দিয়ে বসে পড়লো।কিছুক্ষন চুপ থেকে বলতে শুরু করলো,"কি করে যে কি হয়ে গেল মা।যবে থেকে আমাকে আর অনিতাকে তোর মা একসাথে সেদিন হোটেলের সুইমিংপুলে দেখেছিল সেদিন থেকেই আমায় আর অনিতাকে নিয়ে আজে বাজে ভাবনা ভাবতে শুরু করেছিল।সেদিন শুধু আমি একা ছিলাম না।আমার অফিসের অনেক HOD ও ছিল।কিন্তু মেয়ে বলতে শুধু আমার সেক্রেটারি অনিতাই ছিল।সেদিন সবাই আকন্ঠ হুইস্কি খেয়ে ছিলাম।কেউই স্বাভাবিক ছিলাম না।কিন্তু বিশ্বাস কর কিছু ছিলোনা আমার সাথে অনিতার।এটাই তোর মাকে বোঝাতে পারিনি।"

তিতাস অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলো,"মানে তোমার সাথে অনিতা আন্টির কোনো রিলেশন ছিলোনা?"

অনিমেষ মাথা নিচু করে বললো,"নাহ।"

তিতাস চিৎকার করে ওঠে-"তাহলে মা গত দুই বছর ধরে মিথ্যা সন্দেহ নিয়ে বেঁচেছিল?'

অনিমেষ এক গ্লাস জল চাইলো।একজন কনস্টেবল এক গ্লাস জল দিয়ে গেল।এক নিঃশ্বাসে জল শেষ করে অনিমেষ বলতে শুরু করল,"হ্যাঁ।তোর মা শুধুই মিথ্যে সন্দেহ করতো।পরিবার,দেশ,ধর্মের উর্দ্ধে গিয়ে মাত্র পাঁচ দিনের পরিচয়ে যার সাথে ঘর বেঁধেছিলাম সে আমায় সন্দেহ করত।কত বুঝিয়েছি।শুনতোই না।এক গোঁ।তুমি হয় নিজে চাকরি বদলাও নয়তো অনিতাকে sack করো।এটা সম্ভব তুই বল?এত ভালো একটা চাকরি শুধুমাত্র একটা মিথ্যে সন্দেহের জন্য ছেড়ে দিতাম।অনিতার ও সংসারের অবস্থা খুব খারাপ।ওকে বিনা দোষে তাড়ানো উচিত?তুই বল। 

সেদিন কি হয়েছিল জানিস মা?সেদিন আমার অফিসে মিটিং চলছিল।খুব ইম্পরট্যান্ট ডিসকাশন।আমার টেবিলের সামনে ঝুকে অনিতা ফাইল দেখাচ্ছিল।তখনই দরজা ঠেলে তোর মা ঢোকে মিটিং রুমে।ঢুকেই হাত তালি দিয়ে বলে বাহ দারুন চলছে।এরপর এক ঘর ভর্তি স্টাফের সামনে যাচ্ছেতাই ভাবে আমাকে আর অনিতাকে নিয়ে কুৎসিত কতগুলো কথা বলে গেল।আমি অনেক থামাতে চেষ্টা করেছিলাম।ও শুনলোনা।অনিতা কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল।সেদিনই রেজিগনেসন জমা দিল।আমার এতদিনের তিল তিল করে গড়ে তোলা সন্মান তোর মা ১৫ মিনিটে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল।তারপর বাড়ি ফিরে আবার শুরু করলো।আমি অনেকক্ষণ ধরে চুপ করতে বলেছিলাম।নীলু আমার কোনো কথা না শুনে যা মুখে আসছিল বলেই যাচ্ছিল আর এলোপাথাড়ি কিল চর ঘুষি চালাছিল আমার ওপর।হটাৎ আমার মাথা প্রচন্ড গরম হয়ে গেল।হাতের কাছে ফুলদানিটা ছিল টেবিলে,ওকে থামাতে না পেরে সেটাই তুলে সজোরে ওর মাথায় চাপিয়ে দিলাম।নীলু পরে গেল।ওর মাথা ফেটে রক্ত বেরোচ্ছিলো।আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম।কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।ওকে ওই অবস্থাতেই ফেলে রেখে আমি বেরিয়ে গেলাম।তারপর একটা অটো ধরে CST স্টেশন।

সেখান থেকে একটা সেকেন্ড ক্লাসের টিকিট কেটে কলকাতা।এত বছর পর কলকাতা পৌঁছে সব কিছু কেমন অচেনা লাগছিল।হাওড়া থেকে একটা বাস ধরে দেশপ্রিয় পার্ক পৌছালাম।সব বদলে গেছে।কত কিছু চিনতে পারছিনা।নতুন নতুন ব্রিজ,নতুন নতুন রাস্তা।আমাদের বাড়িটা দেখলাম বড় ফ্ল্যাট হয়ে গেছে।পম্পা বিয়ে করেছে।আশপাশ থেকে ওর ঠিকানা জোগাড় করে ওর শসুরবাড়ী পৌছালাম।বেশ কিছুদিন ছিলাম ওখানে।পম্পা অনেক বোঝালো আমায়।আমিও অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছিলাম।অনেক ভেবে ঠিক করলাম আত্মসমর্পণ করবো।তাই করলাম।"

তিতাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে থামল।

তিতাস-"তুমি কিছু চিন্তা কোরোনা বাবা।আমি খুব ভালো উকিল রাখবো তোমার জন্য।"

অনিমেষ-"শোন তিতাস তুই একবার কলকাতা যেতে পারবি প্লিজ।এই কদিনে আমার কলকাতার ভাগের ফ্ল্যাটটা বিক্রির বন্দ্যবস্ত করেছি।পম্পা সব কিছু করে ফেলেছে।তুই শুধু ওর সাথে দেখা করে সই দিয়ে টাকা গুলো নিয়ে আয়।আর আলমারির চাবি তোর মায়ের বিছানার নিচে আছে।লকারে বেশ কিছু fd আছে যার নমিনি তুই।কয়েকটির matchurity এই মাসেই।তুই সবগুলো ভাঙিয়ে যেমন যা লাগে খরচ করিস।বাবা হিসেবে সেরকম ভাবে কিছুই করতে পারলাম না তোর জন্য।সারাজীবন টাকার পেছনে দৌড়েই বেড়ালাম কিন্তু ভোগ করতে পারলাম না।ভালো থাকিস আর এই নে পম্পার নম্বর।ওকে ফোন করে নিস।"

তিতাস কিছুক্ষন চুপ করে থেকে উঠে পড়লো।

সারাটা রাস্তা চুপ করে ছিল তিতাস।অনেক না মেলা হিসেব মেলানোর চেষ্টা করছিল।বুঝতে পারছিলনা কোনটা ঠিক।দুই বছর ধরে মায়ের কাছে যা শুনেছে সেটা ঠিক নাকি অনিমেষের স্বীকারোক্তি।ও আর ভাবতে পারছিলনা।মাথাটা দপ দপ করছে।

এরমধ্যে মালিনী শুধু একবার বললো "আমার চেনা একজন ভালো উকিল বন্ধু আছে।আমি কি তার সাথে একবার যোগাযোগ করবো তোর বাবার ব্যাপারে?"

তিতাস আলতো করে মাথা নেড়ে বললো,"তোমার যেটা ঠিক মনে হয় করো।আমার মাথা কাজ করছেনা।উকিল তো লাগবেই।বাবাকে বাঁচানোর একটা চেষ্টা তো করতেই হবে।আমার তো তেমন চেনা জানা নেই।তোমার থাকলে তাকেই ঠিক করো।"তারপর সারাটা রাস্তা আর কোনো কথা হলোনা।

বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে দুজনে চা নিয়ে বসলো।তিতাস হটাৎ বলে উঠলো,"আমি কলকাতা যাবো।"

মালিনী-"যাবি?হ্যাঁ চল।কবেকার টিকিট কাটবো বল?আমিও যাবো তোর সাথে।তোর কলকাতার কাজ মিটলে দুটোদিন শান্তিনিকেতন থেকে ঘুরে আসবো।কত বছর হয়ে গেল যাইনি।"

রিতা পাশেই দাঁড়িয়ে শোকেসের কাঁচ মুচ্ছিলো।সে হটাৎ বলে উঠলো,"তাহলে একবার আমাদের কেষ্টনগরটাও ঘুরি এসো।"

মালিনী হেসে বললো"তবে আর কি তুমিও পুটুলি বাধো।তিনজনে মিলে বেরিয়ে আসা হবে।"

রিতা এই প্রস্তাবে আহ্লাদে আটখানা হয়ে উঠলো।

দুইদিন পরে মালিনী অনিমেষের জন্য নিজের বন্ধু লইয়ারকে ঠিক করে,তাকে সব দায়িত্ব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে রিতা আর তিতাসকে নিয়ে কলকাতা যায়।এয়ারপোর্ট থেকে সোজা তারা দেশপ্রিয় পার্ক যায়।পম্পাকে খুঁজে বের করে।পম্পা তো ওকে পেয়ে কিভাবে যত্ন করবে বুঝে পায়না।এক গাদা রান্না করে ওদের জন্য।ফ্ল্যাটের কাজ অনেকটা অনিমেষ এগিয়ে গেলেও সব ফর্মালিটিস মিটতে মিটতে দুইদিন লেগে যায়।পম্পার কাছে দুইদিন বাবার ছোটবেলার গল্প,দুষ্টমির গল্প আর প্রেমের কাহিনী শুনতে শুনতেই কেটে যায়। ফ্ল্যাটের কাজ মিটিয়ে তারা তিনজন কলকাতা ঘুরে দেখে।তিতাস জন্মের পর প্রথমবার এলেও কেমন যেন অন্তরের টান অনুভব করে এই শহরটার সাথে।সে দক্ষিণীর সামনে যায়।মনে করে এখানেই প্রথম বাবা মায়ের গান শোনে।তারপর অনুভব করে পুজোর কটাদিন বাগবাজার,শোভাবাজার,জোড়াসাঁকো চত্বরে তার বাবা মায়ের প্রেম।মায়ের মুখে শোনা রাস্তা গুলো ধরে হাটতে থাকে।মায়ের মুখে সোনা পারামউন্টের শরবত,রয়্যালের বিরিয়ানী চেখে দেখে।সবশেষে পড়ন্ত বিকেলে বাগবাজারের মায়ের ঘাটে গঙ্গার ধরে বসে তিতাস কান্নায় ভেঙে পড়ে।মালিনী স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পায়না।দুইদিন কলকাতায় কাটিয়ে পম্পার কাছ থেকে চোখের জলে বিদায় নেয় তারা।একটা গাড়ি ভাড়া করে তাহেরপুর এর উদ্দেশে রওনা দেয়।সেখানে গিয়ে প্রায় ৩৫ বছর আগের ফেলে আসা গ্রামকে খুঁজে পায়না রিতা।আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে তার গ্রামের।শহরের ইট কাঠ পাথরের ছোঁয়ায় গ্রামের সেই শীতলতা মাখানো মেঠো গন্ধটা আর নেই।অনেক কষ্টে একে তাকে জিজ্ঞেস করে নিজের বাড়ি খুঁজে পায় রিতা।নিজের দাদাকে দেখে।এখানেও সেই একই অবস্থা।ওনারা গরিব হলেও এতবছর পর বোনকে পেয়ে সাধ্যের বাইরে আয়োজন করার চেষ্টা করেন।মালিনী বুঝতে পেরে ওনাদের হাত জোড় করে বলে,"বোম্বেতে বেশিরভাগ সময় রিচ খাবার খাওয়া হয়েই যায় আর এই কদিন কলকাতায় তিতাসের পিসির বাড়িতেও ভীষণ ভারী খাওয়া দাওয়া হয়েছে।জিভে চড়া পরে গেছে।কতদিন গ্রামের টাটকা সবজি গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত খাইনি।আমার এই ইচ্ছেটা আপনারা পূরণ করলে আমি খুব খুশি হব।"রিতা সব বুঝতে পারে মালিনী যে তার দাদার আর্থিক পরিস্থিতি দেখে বলছে এসব কথা।আড়ালে আনন্দে চোখ মোছে।দাদা বউদি পরম যত্নে ওদের দুপুরে খাওয়ার খাওয়ায়।ওদের ভালোবাসায় সামান্য ডাল আলু সেদ্ধ ভাতও অমৃত লাগে মালিনী আর তিতাসের।মালিনী রিতার দাদা,বৌদি আর ভাইপো ভাইঝি দের জন্য আনা জামাকাপড় রিতার হাত দিয়ে বিতরণ করায়।ওদের বলে এগুলো রিতা কিনেছে।দাদা বৌদি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়।এরপরদিন ওদের সারাটাদিন ধরে রিিিআর দাদা টোটো করে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ী,মায়াপুর,নবদ্বীপ ঘোরায়।সারাটাদিন খুুুব আনন্দে কাটায় তারা।তার পরদিন সবার মন খারাপ করে দিয়ে ওরা রওনা দেয় শান্তিনিকেতন।শান্তিনিকেতনে মালিনীর বাড়ির সামনে এসে মালিনী থমকে যায়।তার বাবার বাড়ির বড় গেটে একটা বড় সাইন বোর্ড ঝুলছে।

"লাবণ্যে পূর্ন প্রাণ"

গেট খুলে বেশ কয়েকটা সাঁওতালি বাচ্চা বেরিয়ে এলো।তার পেছন পেছন এলো এক লম্বা,শান্ত ,সৌম্যদর্শন লোক।মালিনী এগিয়ে গিয়ে বললো ভালো আছো বিপ্লব।বিপ্লব অবাক হয়ে বলল,"লাবণ্য।কেমন আছো?কত বছর পর।এস ভেতরে।"

লাবণ্য,মালিনী,রিতা ভেতরে ঢুকলো।বিপ্লব ওদের ভেতরে বসতে দিয়ে শরবত বানিয়ে আনলো ওদের জন্য।

শরবতের গ্লাসে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,"ভালো আছো বিপ্লব?ওহ তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।ও হলো তিতাস।আমার বুড়ো বয়সের কচি বান্ধবী আর উনি হলেন রিতাদি।আমার নিজের দিদির থেকেও অনেক বেশি।আর ও হলো বিপ্লব আমার ক্লাসমেট ও আমার বাবার প্রিয় ছাত্র ছিল।"

বিপ্লব নমস্কার করে বললো,"যদু দাকে বলেছি পেছনের বাগানের দিকের ঘরগুলো পরিষ্কার করে তোমাদের ডাকতে।রাত ৮ টা বাজে।এখানকার হিসেবে অনেক রাত।আজ তেমন কিছু তো বাজার করা নেই।সামনের রেস্টুরেন্ট থেকে খাওয়ার আনিয়ে দিচ্ছি।অনেকটা জার্নি করে এসেছো।খেয়ে দেয়ে রেস্ট করো।কাল বাজার করে আনবো।"বিপ্লব হেসে উঠে যেতেই মালিনী ডেকে উঠলো তাকে।বিপ্লব পেছন ফিরে বললো,"জানি এক সমুদ্র কথা জমে আছে।কাল কথা বলি?আজ তোমাদের মত আমিও বড় ক্লান্ত।চলি।"

পরেরদিন বেশ ভোর ভোর ঘুম ভাঙল মালিনীর।তিতাস তখনো গভীর ঘুমে।মালিনী ওর কপালে হাত বুলিয়ে একটা চুমু খেলো।রিতা উঠে রান্নাঘরে গেছে কাজ কর্ম দেখতে।সত্যি ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে ভেবে অজান্তেই মালিনীর মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।বাড়ির বাগানে বসলো মালিনী।প্রাণ ভরে নিলো একবুক বিশুদ্ধ টাটকা ভোরের হাওয়া।ঘাসের ডগা থেকে শিশির নিয়ে নিজের গালে মাখলো।বাগানের সামনের দিকে চাটাই পেতে বিপ্লব অনেক গুলো আদিবাসী কাচ্চা বাচ্চা দের নিয়ে প্রার্থনা সংগীত গাইছে।

"সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে

শোনো শোনো পিতা।"

মন্ত্রমুগ্ধের মত মালিনী গান শুনছিল চোখ বন্ধ করে।বেশ কিছুক্ষণ পর গান থেমে গেলেও মালিনী একই ভাবে বসে ছিল।মালিনীর ঘোর ভাঙে বিপ্লবের ডাকে,"তুমি কি রোজ এত ভোরেই ওঠো লাবণ্য?"

মালিনী-"নাহ।আজ ঘুমটা ভেঙে গেল।"

বিপ্লব-"এতটা জার্নি করে এলে আরেকটু ঘুমালে পারতে।"

মালিনী-"এই বাড়ির তো নাম সুখনীর ছিলো বিপ্লব।লাবণ্যে পূর্ন প্রাণ কি করে হলো।"

বিপ্লব-"তুমি বিয়ে হয়ে কুয়েত চলে যাওয়ার পর থেকে আর শান্তিনিকেতনে আসোনি।তোমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার কয়েকমাস পরেই কাকিমার শরীর স্বাস্থ্য ভাঙতে থাকে।তারপর একদিন জানা যায় কাকিমার ক্যানসার।তুমি তখন মুম্বাইতে।চিন্তা করবে বলে তোমায় না জানিয়ে আর্য্যকে ফোন করেন মাস্টারমশাই।আর্য্য ফোনে ওনাদের আসতে বলে মুম্বাই।দুইজন বয়ষ্ক মানুষকে একা ছাড়তে মন চায়নি আমার।আমিও সাথে গেছিলাম।আর্য্য স্টেশনে এসেছিল আমাদের নিতে।আমরা আর্য্যর সাথে তোমাদের ফ্ল্যাটে গেছিলাম।অবাক লেগেছিল এতদিন পর তোমার বাবা মা আসছেন জেনেও তুমি বাড়ি নেই।আমরা তোমার কথা জিজ্ঞেস করতে ও এড়িয়ে গেছিল।এরপর সেদিনই কাকিমাকে বাড়িতে রেখে আমরা টাটা মেডিকেল এ appointment নিতে যাই।appointment নিয়ে ফেরার পথে আর্য্য একটি ফাইভস্টারের সামনে গাড়ি থামায় কফি খাওয়ার জন্য।মাস্টারমশাই আর আমি দুজনেই খুব অস্বস্তি বোধ করছিলাম এত দামি জায়গায় ঢুকতে।আমরা হোটেলের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ইতস্ততঃ করছি তখন আমি আর মাস্টারমশাই দেখলাম তুমি একটি স্বচ্ছ জামা পরে একটি অন্যলোকের বাহুলগ্না হয়ে হোটেল থেকে বেরোচ্ছ।সেই লোকটি তোমায় একটি বড় গাড়িতে তুলে দিল তুমি তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলে তারপর গাড়িতে উঠে চলে গেলে।মাস্টারমশাই সেই দেখে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন।বাড়ি ফিরে কাকিমাও সব শুনে আর একটা দিনও মুম্বাইতে থাকতে চাইলেননা।তোমার স্বামীও তোমার সম্পর্কে প্রচুর খারাপ খারাপ কথা বলে কান্নাকাটি করেছিলেন ওদের কাছে।সেইদিন দুইজন অসুস্থ মানুষকে নিয়ে কিভাবে যে আবার এই ভুবনডাঙ্গায় পৌছেছিলাম তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন।তারপর কাকিমা ও মাস্টারমশাই দুইজনেই আর বেশিদিন বাঁচেন নি।মারা যাওয়ার আগে মাস্টারমশাই তার সমস্ত সম্পত্তি আমায় দানপত্র করে দিয়েছিলেন।আমি একা মানুষ।তাই আদিবাসী বাচ্চাদের নিয়ে স্কুল খুলে বসেছি।কিন্তু তুমি এসে গেছ আমি এবার নিশ্চিন্ত।এই নাও তোমাদের ব্যাংকের লকারের চাবি,ব্যাংকের ও বাড়ির কাগজপত্র।এবার আমার মুক্তি।"

মালিনী-"বিয়ে করোনি?'

বিপ্লব-"নাহ"

মালিনী-"কেন?"

বিপ্লব-"যাকে বিয়ে করবো বলে কৈশোর থেকে ভেবে এসেছি যৌবন অব্দি সে আমার চোখের ভাষা বুঝতেই পারলো না।অবশ্য আদৌ বুঝতে চেয়েছিল কিনা তাই জানিনা।একদিন এক রাজপুত্র এসে তাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল তাই আমিও আমার প্রথম ভালোবাসা অর্থাৎ আঁকা আর গানের সাথে ঘর বাঁধলাম।নাও কাগজপত্র গুলো সব বুঝে নাও।"

মালিনী-"বাবার কাছে আমি মৃত ছিলাম তাই আমায় মৃতই থাকতে দাও বিপ্লব।ওগুলো তোমার।তুমি এক মহৎ কাজ করছ।এর থেকে ভালো ভবিষ্যৎ আমাদের সুখনীর এর হতে পারতোনা।তোমার লাবণ্য পূর্ন প্রাণ সবসময় যেন প্রাণে পূর্ণই থাকে।তুমি এগিয়ে চলো সেই কামনাই করি।ভালো থেকো।আর অমিত ও লাবণ্যর নিয়তিতে তো স্বয়ং রবি ঠাকুর বিচ্ছেদ এর সিলমোহর লাগিয়ে রেখে গেছেন ।সেই শাপমোচন করে কার সাধ্যি?কখনো কোনো সাহায্য লাগলে বলো আমি আছি।আজ তিতাসকে নিয়ে একটু বেরোবো।এখন উঠি।"

বিপ্লব নিজের মনে মনে বলে আজও তোমার জন্য এই অমিত অপেক্ষা করে বসে আছে।চাইলে আজো ফিরে আসতে পারো।তারপর নিজের মনেই গেয়ে উঠলো

"ভালো আছি,ভালো থেকো।

আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।"

মালিনী পেছন ফিরে আর না তাকিয়ে সামনে এগিয়ে চললো।

ব্রেকফাস্ট খেয়ে তিতাস আর মালিনী বিশ্বভারতী চত্বর ঘুরে বেরোলো।ছাতিম বনে লুকোচুরি খেললো।খোয়াইএর বাউল মেলায় কোমর দুলিয়ে নাচল দুজনে,

"ঈদক তুকে মানাইছেন লে।"

তারপর জোৎস্না ভরা সন্ধ্যেবেলা কোপাই নদীর তীরে বসে দুজনে গলা মিলিয়ে গাইলো,

"চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে,

উছলে পরে আলো।

ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধ সুধা ঢালো।"

পরেরদিন মালিনীরা মুম্বাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।যাওয়ার আগে শুধু বিপ্লবকে বলে গেল "পরের জন্মে লাবণ্যকে পেলেই সঙ্গে সঙ্গে সিঁথি রাঙিয়ে দিও।কে বলতে পারে কোথায় কোন রাক্ষস অপেক্ষা করছে লাবণ্যকে ছিড়ে খাওয়ার জন্য।"

বিপ্লব ছল ছল চোখে লাবণ্যের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।মালিনীদের গাড়ি স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।ধীরে ধীরে "লাবণ্যে পূর্ন প্রাণ "লেখাটা ছোট হতে হতে একসময় পথের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

মুম্বাই ফিরে আসার পর দেখতে দেখতে বেশ কেটে গেল তিনটে মাস।তিতাস নিজের কলেজ,টিউশন পড়া নিয়ে মেতে ছিল।মালিনী ডুবে ছিল NGOর কাজে।অনেক অনেক ডোনেশন জোগাড় করেছিল নিজের চেষ্টায়।রিতা বাড়ির সব দায়িত্ব সামলাচ্ছিল।ছুটির দিন তিনজনে একসাথে বেড়াতে বেরোত,মুভি দেখতে যেত,বাইরে খেত।বেশ আনন্দেই দিনগুলো কাটছিল।

একদিন সকালে মালিনী লক্ষ্য করলো তিতাস অনেকক্ষন হলো বাথরুমে ঢুকেছে।বেরোচ্ছেনা।ওদিকে বাথরুমে বসে তিতাস দেখছিল।তার হাতে ধরা প্রেগনেন্সি কিটটাতে দুটো সুস্পষ্ট লাল দাগ।



তিতাস অনেকক্ষণ ধরে দরজা না খোলায় মালিনী ভয় পেয়ে যায়।সে দুম দাম করে দরজা পেটাতে থাকে।তাকে দেখে রিতাও জোরে জোরে তিতাসকে ডাকতে থাকে।অনেকক্ষন পর তিতাস দরজা খোলে।মালিনী হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,"দরজা খুলতে এত দেরি করলি কেন?"

তিতাস হাত বাড়িয়ে কিটটা মালিনীর দিকে এগিয়ে দিল।মালিনী কিট টা হাতে নিয়ে ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো।রিতা তিতাসকে ধরে সোফায় বসিয়ে দিল।মালিনী গিয়ে তিতাসের কাঁধে হাত রেখে বললো,"কিছু ভাবলি?কি করবি?তোর সব রকম ডিসিশনের সাথে আমি আছি।"

তিতাস অনেক্ষন পর উত্তর দিলো"অনেকদিন হলো,প্রায় তিনমাস।পিরিয়ড বন্ধ।আর কোনো অসুবিধা নেই।আমি আজ ডাক্তার দেখাতেই উনি বললেন টেস্ট করাতে।আর এখন টেস্ট করে দেখছি এই।বুঝতে পারছিনা কি করবো।"

মালিনী-"তোকে আজ কলেজ যেতে হবে না।আমিও বেরোবনা।তুই সারাটাদিন ভাব।তারপর তুই যা বলবি তাই হবে।"

মালিনী আর তিতাস সারাটাদিন ঘরে রইলো।কেউ কোনো কথা বললোনা।রিতাও মুখ বুজে কাজ করে চলছিল।সন্ধ্যের দিকে তিতাস মালিনীর ঘরে এসে বসলো।তিতাস মালিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।তিতাস বললো,"আমি এখন কি করবো বলতো?যতোবার ভাবছি একে রাখবনা ততবারই দুর্বল হয়ে পড়ছি একটা কচি মুখ ভেসে উঠছে,যেন আমায় হাত বাড়িয়ে বলছে আমার কি দোষ বলো,আমি তো তোমার ভেতরে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে একটু একটু করে বড় হচ্ছি।আবার এটাও ভাবছি ওকে পৃথিবীতে আনলে আমার লেখাপড়া ,আমার ক্যারিয়ার,তার কি হবে।পুরো জীবন পরে আছে সামনে।তাছাড়া বাচ্চাটা সিডের সন্তান।যদি ওর মতোই প্রতারক আর স্বার্থপর হয়?"

মালিনী,"কে বললো ও শুধু তোর একার দায়িত্ব।ওর তো দুটো মা হবে।তুই জন্ম দিবি আর আমি ওকে মানুষ করবো,শুধু মানুষ।ছেলে মানুষ বা মেয়ে মানুষ নয়।সিডের কোনো চিহ্নই আমরা ওর গায়ে লাগতে দেবোনা।ও শুধু তোর মত মিষ্টি ফুলের সন্তান।শোন বাচ্চারা মাটির তালের মত হয়।ওদের যেমন ভাবে মানুষ করবি ওরা তেমন ভাবেই বেড়ে উঠবে।তুই তোর পড়াশোনা চালিয়ে যা।আমি আছি তোর পাশে। ।"

রিতা কখন যেন আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ওদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে,।সে হটাৎ বলে উঠলো"দুটো বলতেছো কেন গো দিদি।বলো তিনখান মা।তোমরা অত চিন্তা করোনি গো।আমি একটা ছেলেকে কত্ত বড় করে ফেললাম।আমার কাছে এগুলো কোনো ব্যাপারই না।তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।"


এরপর শুরু হলো নতুন প্রাণ আসার তোড়জোড়।গেস্টরুমটা একেবারে নতুন করে সাজাল রিতা আর মালিনী।পুরো ঘর রকমারি খেলনা,বেবিকট,দোলনায় ভরিয়ে তুললো।তিতাসকে যত্ন আত্তি করে একেবারে অতিষ্ঠ করে তুলল।

মালিনী এখন রোজ ভোর বেলা উঠে তিতাসকে বাদাম,আখরোট সহযোগে হেলথ ড্রিংক খাওয়ায়।তিতাস খেতে চায়না কাঁদে।বকে ঝোঁকে খাওয়ায় মালিনী।তারপর দুজনে সমুদ্রের পার ধরে হাঁটে।বাইরের খাওয়া তিতাসের একদম বন্ধ করিয়ে দিয়েছে মালিনী।তিতাস যা যা খেতে চায় রিতা বা মালিনী তা নিজে হাতে বানিয়ে খাওয়ায়।মর্নিং ওয়াক সেরে ফেরার পর স্নান সেরে দুজনে ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরিয়ে পড়ে।এই সময়টা রিতার অখণ্ড অবসর।সে এই সময়টা তিতাসের অনাগত সন্তানের জন্য কাপড় কেটে জামা বানায়,কাঁথা সেলাই করে আর নিজের মৃত ছেলের ছোটবেলার কথা ভেবে চোখের জল ফেলে।তারপর চোখের জ মুছে নিজেই ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে যে আসছে সে যেন সুস্থ হয়।

মালিনী তিতাসকে নামিয়ে NGO চলে যায়।ফেরার সময় তিতাসকে নিয়ে ফেরে।বাড়ি ফিরে শুরু হয় তিন মায়ের জল্পনা কল্পনা।মালিনী বলে ছেলে হলে নাম রাখবে তাতিন আর মেয়ে হলে তাথৈ।তিতাস হেসে বলে আমার বাচ্চাটাকে তোমরা নাচিয়েই ছাড়বে দেখছিই।মালিনী হাসতে হাসতে হটাৎই অন্যমনস্ক হয়ে বলে"না রে বিয়ের পর পর ভেবেছিলাম আমার যদি সন্তান হয় তাদের এই নামই রাখবো।"

রিতা গালে হাত দিয়ে মাটিতে বসে শুনছিল।হটাৎ বলে উঠলো,"তোমরা যা ডাকবে ডাকো আমি মেয়ে হলে ডাকবো মানতু আর ছেলে হলে মন্টু।আমি জানি যে আমার মন্টুই আসতিছে তোমরা যে যাই বলো।দাঁড়াও তোমাদের একটা জিনিষ দেখাই।"এই বলে উঠে গিয়ে সে ঘর থেকে বড় এক খানা পুটুলি বের করলো।তার থেকে বেরোলো মন্টুর ছোটবেলার পুতুল,বল,জামা আরো কত কি।সেগুলোর ওপর হাত বুলিয়ে রিতা বললো,"এগুলো আমার মন্টুর সব গুছিয়ে পরিষ্কার করে রেখে দিয়েছি।বৌমাকে দিতে গেলে সে নেয়নি।জানি তোমরা ওর জন্যি অনেক দামি দামি জিনিষ কিনবে তবু যদি মনে হয় এগুলো একটু সোনারে ছুঁইয়ে রেখে দিও।তাহলেই হবে।"

জিনিসগুলো হাতে নিয়ে রিতা কেঁদে ফেলেছিল।তিতাস আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে রিতাকে জড়িয়ে বললো,"যে আসছে সে তো সব থেকে বেশি তোমার গো।তুমি তো ওকে হাতে করে মানুষ করবে।ওকে কখন কি পড়াবে,কি খাওয়াবে সব তুমি জানবে।আমি তো শুধু জন্ম দেব তাকে।আমার সন্তানের কি ভাগ্য।সে একসাথে তিনজন মা পাবে।"

রিতা চোখের জল মুছে বলে,"তুমি কোনো চিন্তা করোনি গো।আমি তারে তেল মাখাবো,স্নান করাবো,খাওয়াবো,পার্কে ঘুরতে নিয়ে যাবো,ইস্কুলে দিয়ে আসবো।তার কাছে আমি নেকাপড়া শিখব।ভেবেই কি আনন্দ হতিছে আমার।"

এই ভাবেই আদর যত্নে পেরিয়ে যায় আরও ছয়টা মাস।তিতাস ভীষণ যত্নে থাকে।ডাক্তার তাকে এক্টিভ থাকতে বলেছে।সে সবসময় নানা কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে।শেষের দিকে ছোট খাটো সমস্যা শুরু হয়।যেমন পা ফুলে যায়,ক্রামপ ধরে।রিতা সারা রাত জেগে পায়ে তেল মালিশ করে দেয়।তিতাসের জন্য ভালো মন্দ রান্না করে।

অবশেষে ডেলিভারির দিন ভোরবেলা তিতাস যখন স্নান করে রেডি হচ্ছে তখন অনেকবার ফোন বেজে বেজে থেমে যায়।সে ধীরে ধীরে এসে চার্জ থেকে ফোনটা খুলে দেখে ১৫ টা মিসকল একটা আননোন নাম্বার থেকে।তিতাস রিং ব্যাক করতে গিয়ে দেখে ISD নাম্বার।তখনি ওপাশ থেকে একটা ভারী গলা ভেসে এলো,"ভালো আছিস তিতাস?"

তিতাসের বিস্ময়ে হাত থেকে চিরুনি পরে যায় সে অবাক গলায় বলে,"সিড!"

সিড-"হ্যাঁ রে ।ভাবলাম আমার পাগলিটা এখনো আমার ওপর রেগে আছে নাকি দেখি?"

তিতাস ধাতস্থ হয়ে বললো,"আমি তো তোর কোনদিনই ছিলাম না সিড।যেটা বলতে ফোন করেছিস সেটা বল।"

সিড-"আমি তোর কাছে ফিরে আসতে চাই তিতাস।সব ভুলে আমায় আবার কাছে টেনে নিবি তিতাস?"

তিতাস-"অনেক দেরি করে ফেলেছিস সিড।আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি অন্য কারোর হয়ে যাচ্ছি।ভবিষ্যতে আমায় আর ফোন করে ডিস্টার্ব করিসনা।"

পেছন থেকে রিতা বলে "আরে চলো দিদিমণি।আর দেরি করলি তো বাচ্চাটা এখানেই হই যাবে।"

তিতাস ঘুরে বলে,"তুমি যাও রিতাদি আমি আসছি।"

সিড ওপাশ থেকে চেঁচাচ্ছে,"এই তিতাস।তুই বিয়ে করছিস নাকি?কাকে করছিস?এত তাড়াতাড়ি আমায় ভুলে গেলি?আর বাচ্চা?কার বাচ্চা?কোথাকার বাচ্চা?তোর পাশ থেকে কে কি বলছে?এই তিতাস।তিতাস।হ্যালো।হ্যালো।হ্যালো।"

তিতাস ফোনটা কেটে সুইচ অফ করার দেয়।

মালিনী কাঁধে হাত দিয়ে বলে,"সিড ফোন করেছিল?"

তিতাস হেসে বলে,"কে সিড?আমি তো কোনো সিডকে চিনি না।চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।"


 সুন্দর সূর্য্য ঝলমলে দিনে তিন মা মিলে রওনা দেয় নার্সিংহোমে।যথা সময়ে তিতাসের একটি ফুটফুটে ছেলে হয়।আনন্দে রিতা আর মালিনী মালিক-ভৃত্য সম্পর্ক ভুলে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।রিতা উচ্ছসিত হয়ে বলে,"বলেছিলামনা আমার মন্টু আসতিছে।দেখলে?"মালিনী হেসে বলে,"আমার তাতিন।আমার তাতিন এসেছে রে।মায়ের ওপর অভিমান করে সে চলে গিয়েছিল।কত ডেকেছি সারা পাইনি।আজ সে তার মায়ের কাছে ফিরে এসেছে।"

তিনদিন পর তিন মা তাদের পুত্রকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়।ফেরার পথে ভারসভা বিচের কাছে গাড়ি দাড় করালো মালিনী।গাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনজনে বীচে সমুদ্রের কাছে এসে দাড়ালো।এখানে অটো ভীড় নেই।তিতাস দুই দিকে হাত বাড়িয়ে চোখ বুজে বুক ভরে নিশ্বাস নিলো।রিতা ছেলেকে কোলে নিয়ে বললো,"দেখ দিদি দেখ,মন্টু কেমন দেয়ালা করতিছে।"মালিনী ঝুকে পরে দেখলো তাতিন ঘুমের মধ্যেই হাসছে। মালিনী হাত দিয়ে ওর গালে একটা টোকা মেরে গেয়ে উঠলো,

" এয় জিন্দেগী গলে লাগালে"

তিতাস পেছন থেকে এসে মালিনীকে জড়িয়ে ধরে গাইলো,

"হামনে ভি তেরে হর এক গম কো গলে সে লাগায়া হে।"

তারপর দুজনেই ছেলের দিকে ঝুঁকে ভুরু নাচিয়ে গাইলো

 "হায় না?"

তিনজন মানুষের অদম্য জিজীবিষাকে কুর্নিশ জানিয়ে মাথা নত করলো জীবন।



Rate this content
Log in

More bengali story from সঞ্চারী চ্যাটার্জী

Similar bengali story from Romance