।।হ্যাপি ভ্যালেনটাইনস ডে।।
।।হ্যাপি ভ্যালেনটাইনস ডে।।
অনু সকাল থেকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন একটু ফ্রী হয়ে রনি ভিডিওকল করবে, রনি সচরাচর এরকম তো করে না, তার ওপর ফোনটাও বারবার নট রিচেবল বলছে।
আজকের দিনটা যে তাদের কাছে খুবই স্পেশাল কারণ আজ তাদের ভালোবাসার সপ্তমবার্ষিকী, তার সাথে আবার ভ্যালেন্টাইনস ডে।
রনি বরাবরই ওই ভ্যালেন্টাইনস ডে তে বিশ্বাসী নয়, তার কাছে প্রতিটা দিনই ভালোবাসার দিন তবে অনুর যেহেতু একটু স্পেশাল লাগে এই দিনটা তাতে রনির কোনো আপত্তি নেই কারণ সবার মতামত সবসময় সমান হবে এরকম তো কোনো মানে নেই, বরং অনুর সাথে খুব ভালোভাবেই কাটায় দিনটা।
হঠাৎ মনে পড়ল সেই পুরনো দিনগুলোর কথা।
স্কুলে এবং টিউশনে একসাথেই যাওয়া আসা ছিল তাদের, এই টিউশনেই তো তাদের প্রথম দেখা।
ক্লাস ইলেভেনে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিল অনু আর রনি ছিল কলা বিভাগে, সেভাবে স্কুলে যেত না রনি তবে ক্লাস টুয়েলভে রনি যেখানে ইংলিশ টিউশন পড়তো সেখানে যেদিন অনু প্রথমবার পড়তে এলো সেদিন অনু লক্ষ্য করেছিল রনি হা করে যেন দুঘন্টা ধরে শুধু তাকেই দেখে গেল, অনুর থেকে যখন জানতে পারলো তারা একই বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী কিন্তু রনির স্কুল না যাওয়াতে কখনও দেখা হয়নি ব্যাস রনি পরের দিন থেকেই রোজ স্কুলে যাওয়া শুরু করে দিলো, যে ছেলেকে স্কুলেই পাওয়া যেত না তার উপস্থিতির হার কিনা গিয়ে দাঁড়ালো একশো শতাংশয়।
তারপর উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে তাদের একই কলেজে ভর্তি হওয়া, ধীরে ধীরে যে কিভাবে তারা একে অপরের ওপর এতটা নির্ভরশীল হয়ে পড়ল সেটা তাদেরও অজানা, একটা সময় গিয়ে তারা বুঝতে পারতো না যে তারা শুধুই বন্ধু নাকি একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেছে।
যাইহোক বর্তমানে রনি ইন্ডিয়ান আর্মিতে কর্মরত একজন সেনা, হ্যাঁ খুব কষ্ট হয় এভাবে ওর থেকে দূরে থাকতে কিন্তু অনুর গর্ব হয় যে রনি একজন দেশসেবক।
এইতো সামনের মাসে ফাল্গুনের শেষেই তাদের চারহাত এক হবে, ব্যাস তখন আর সেই দূরত্ব থাকবে না, বিয়ের পরেই অনু চলে যাবে জম্মু, ওখানেই এখন রনির পোস্টিং।
রনি শুধু পুজোতে কিছুদিনের ছুটি নিয়ে এসেছিল বিয়ে উপলক্ষে কেনাকাটা করার জন্য, তবে বিশেষ কিছু লাভ হয়নি কারণ সময়ের অভাবে সে নিজের সাইজের জামাকাপড় আর টুকটাক বিয়ের কেনাকাটা করে, কার্ড, ইত্যাদি অর্ডার দিয়েই পাড়ি দিয়েছে নিজের দেশের কাজে।
রনি যদিও ভিডিওকলে রাত বারোটা বাজার সাথে সাথেই অনুকে উইশ করেছে তাদের ভালোবাসার সপ্তম বার্ষিকীর উপলক্ষে এবং এই প্রথমবার সে হ্যাপি ভ্যালেনটাইনস ডে উইশ করেছে, অনু তো অবাক হয়ে গেছিল, রনি নিজেই বললো এই দিনটাতে প্রথমবার সে তার থেকে এতোটা দূরে, খুব মিস করছে সে অনুকে, রনির চোখের কোনে জল দেখে অনু কিছু বলতে যেত কিন্তু রনি বললো "একটু দাঁড়াও তো," এটা বলেই সে ফোন কেটে দিয়েছিল।
অনু যখন চোখ খোলে তখন ভোর চারটে, বুঝতে পারলো যে চোখটা লেগে গেছিল অপেক্ষা করতে করতে, ব্যাস ফোনে আর কিছুতেই তাকে পাওয়া যাচ্ছে না, অনুর মনটা খারাপ লাগছে যে সে রনিকে উইশ করতে পারলো না যেখানে কিনা জীবনে প্রথমবারের জন্য রনিকে এতো রোম্যান্টিক হয়ে দিনক্ষণ মনে রেখে এতো মিষ্টি করে উইশ করতে দেখলো।
অনু এটাও ভাবছে যে ঘুমিয়ে পড়বে কিনা কারণ তাকে আবার কাল রনির বোন এবং মায়ের সাথে কেনাকাটা করতে বেরোতে হবে, আবার এটাও ভাবছে যে যদি রনি ফোন করে আর সে যদি শুনতে না পায়!
অনুর মনে পড়ছে বাড়িতে সেই প্রথমবার তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে জানানোর কথা, সেই মুহূর্তে বাড়ির গুরুজনদের অমত থাকলেও ধীরে ধীরে সেটা কেটে গেল বেশ তাড়াতাড়ি, তারপর তো রনি চাকরি পেতেই দুইবাড়ির মধ্যে পাকাকথা হয়ে গেল, এখন তো শুধু কয়েকটা দিনেরই অপেক্ষা ব্যাস।
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো, ফোনটা ধরতে ধরতেই কেটে গেল, অনু ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো সকাল সাড়ে সাতটা বাজে।
রিমির এতো সকালে মিসডকল!!!
ফোন ঘুড়িয়ে হ্যালো বলাতে রিমি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,"অনু তুই ঠিক আছিস?"
অনু বললো,"আমার আবার কি হবে, মাথাটা খারাপ হয়ে গেল নাকি রে তোর? তোকে বললামই বা কখন যে আমার কিছু হয়েছে?"
_____একবার টিভিটা অন কর, আই অ্যাম সরি অনু।
রিমি ফোনটা কাটার পরেই যেন ঘুমটা কেটে গেল অনুর, তাড়াতাড়ি পাশের রুমে গিয়ে দেখলো বাবা মাকে বলছে,"টিভিটা অন করো তো, অমিত ফোন করে বললো খবরের চ্যানেলটা দেখতে।"
যে খবরটা ভেসে উঠলো টিভির পর্দায় সেটার জন্য কেউ উপস্থিত ছিল না।
"উধামপুর আর্মি বেসে জঙ্গিদের হামলা"
খবরের চ্যানেলের খবর অনুযায়ী,"গতরাতে বারোটা কুড়ি নাগাদ দশজন জঙ্গি উধামপুর আর্মি বেসে আচমকা হামলা করে, তারপর শুরু হয় গুলির লড়াই, একের পর এক বোমাবাজি করতে থাকে জঙ্গিরা, প্রায় দেড়ঘণ্টা ধরে লড়াই চলতে থাকে, শেষপর্যন্ত জঙ্গিরা মারা যায় কিন্তু সেই লড়াইয়ে আমাদের ৮জন জওয়ান শহীদ হয়েছেন এবং ৯জন জওয়ান সঙ্কটজনক অবস্থায় হসপিটালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন।"
অনু যেন পাথর হয়ে গেল, শহীদ জওয়ানদের তালিকায় ৪নম্বরে রনি মানে "রনজয় সিংহ রায়" নামটা জ্বলজ্বল করছে।
যেহেতু তারা একই স্কুল-কলেজে পড়েছে তাই বন্ধুবান্ধব বেশিরভাগই পরিচিত, একে একে সবাই এলো, পরিবেশটা এতোটাই থমথমে যে কে কি বলবে কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না।
অনুর মুখে কোনো আওয়াজ নেই, চোখে জল নেই, ওকে ঝাঁকুনি দিলে মনে হচ্ছে যেন জোর করে একটা বড়ো পাথরের চাই নাড়ানোর চেষ্টা চলছে, গালে হালকা করে দুটো তিনটে চড় মেরেও কোনো লাভ হয়নি, ওর চোখে মুখে জল দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছে বারবার রিমি।
ওদিকে রনির বাড়িতেও একই পরিস্থিতি, আত্মীয় স্বজনের ভিড়, কে কাকে সান্ত্বনা দেবে এইসময় কারণ রনি যে সবার চোখের মণি ছিল, কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না যে তাদের ছেলেটা আর নেই, সামনের মাসেই যার বিয়ে ছিল।
দুই বাড়ির মানুষগুলো আলাদা হলেও দুই বাড়ির চিত্রটা যেন একই, আত্মীয় স্বজন বা বন্ধুবান্ধবরা চেষ্টা করেও দুই বাড়ির কোনো মানুষের মুখেই একটু খাবার তুলে দিতে পারেনি, রনির মা বেশ কয়েকবার অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল আর এদিকে অনু এখনও কথা বলেনি, শুধু শক্ত হয়ে বসে আছে।
খবর এলো আগামীকাল সকালে রনির মৃতদেহ আনা হবে।
কখনও ভাবতে পারেনি তারা যে এই সকালটা তাদের জীবনে আসবে, ঐরকম ভিড় রনির পাড়ায় এর আগে কখনও হয়নি, ইন্ডিয়ান আর্মির ট্রাকটা এসে থামলো, তিরঙ্গা দিয়ে মোড়া কফিন বন্দী রনির মৃতদেহ জওয়ানরা কাঁধে করে নিয়ে আসছে, চারিদিকে শুধু রনির জয়ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে সাথে "বন্দে মাতরম" এবং "ভারত মাতা কি জয়।"
বোম বিস্ফোরণের কারণে রনির মৃতদেহ অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়নি তাই ওই বীর যোদ্ধার মুখটাও দেখার উপায় নেই, রনির বাবা, মা এবং বোনকে সামলানো খুব কঠিন হয়ে গেল, আর ওদিকে অনু প্রথমবার কাঁদলো।
অনুর জ্ঞান হারানোর আগে বাক্সটাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে বলল,"হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস ডে।"
××××××××××××××××××××××××××××××××××××××××
গল্পের চরিত্র এবং গল্পটি কাল্পনিক হলেও বাস্তবে আমরা ২০১৯ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি এইরকম একটি ঘটনার সাক্ষী থেকেছি, আমাদের কাছে এইদিনটা "কালো দিন" হয়েই থেকে যাবে, সেইদিনের ৪৪জন জওয়ান এবং আমাদের দেশরক্ষার ক্ষেত্রে শহীদ হওয়া সকল জওয়ানদের জানাই শ্রদ্ধা।
কিছু মানুষের কাছে আজ যেমন "ভ্যালেন্টাইনস ডে," ঠিক তেমনই কিছু মানুষের মনে হয় যে ভালোবাসার কোনও নির্দিষ্ট দিন হয় না, আমার কাছে সবটাই কাম্য কারণ দাবি তো একটাই "ভালোবাসার।"

