Debmalya Dutta

Drama

5.0  

Debmalya Dutta

Drama

হারানো সুর

হারানো সুর

3 mins
2.3K


বিপ্লবের বয়েস কত আর হবে এই এগারো বছর।এর মধ্যেই মা হারা সে।ছোট্ট একরত্তির বিপ্লবকে ঠকিয়ে বিধাতা যখন তার মা কে কেড়ে নেয় তখন থেকেই সে একা।পাশের রাঙাকাকিমার স্নেহ না পেলে বুঝি দুজনেই ভেসে যেত।

এমনটা নয় যে বিধান তার ছেলে কে ভালবাসে না। কিন্তু বি.এ ফার্স্টক্লাস পেয়েও যখন সরকারি চাকরি পেল না তখন রহিমগঞ্জ থেকে ক্রোশখানেক দুরে নবাবপুরে স্যাকরার দোকানে কাজ নিল নক্সা কারিগর হিসেবে।ভাল ছবি আঁকত বিধান কিন্তু প্রাইমারী স্কুল শিক্ষকতা করে ছেলের জন্য বিশেষ কিছুই করে যেতে পারেননি বিধানের বাবা।আর জমি জমা বিশেষ কিছু ছিল না যে বিক্রি করে ব্যবসা শুরু করবে। সম্পত্তি বলতে বিধানের মায়ের কয়েকভরি সোনা-রূপার গয়না। তাও মালতী বিধানকে ভালবেসেছিল। কিন্তু মারনরোগ তাকে আর বিধানের ছোট্ট সুখী পরিবারকে ছিন্নভিন্ন করে দিল হঠাৎ। একবছর হতেই বিপ্লব এসেছিল ওদের জীবনে কিন্তু জীবন এত তাড়াতাড়ি ছোট হয়ে যাবে কেউ- ই ভাবেনি। জলের মত পয়সা খরচ করেও বিধান মালতী কে আটকে রাখতে পারেনি। এক সন্ধেতে পাশের পাঁকুড়গাছে একটা লক্ষ্মীপ্যাঁচা ডেকে উঠেছিল!আর বিধান এর ঘরের লক্ষ্মী বিদায় নিল সেইদিনেই। বিধান কাঁদেনি বিপ্লবের মুখের দিকে তাকিয়ে পাথর হয়ে গেছিল।

তারপর আবার সেই দশটা পাঁচটার কাজে বেরিয়ে পরেছিল। বিপ্লব থাকত পাশের রাঙাকাকিমার কাছে।বাবা এলে ছুট্টে চলে আসে গল্প শোনে বাবার ঘাড়ে চড়ে। দামোদরের পাগলা মাঝীর গল্প। খেয়াপারাপারের গল্প নবাবপুর বাজারের গল্প।বিপ্লব পেয়েছিল মালতীর চোখ দুটো। তেমনিই ভাসা ভাসা উজ্জ্বল। বিধান সেই চোখের দিকে তাকিয়ে হারিয়ে যেত। ভুলে যেত মালতী নেই।বাপ-বেটার খুনসুটি চলতেই থাকত।চাট্টি ভাতে-মাড়ে খেয়ে বাপ বেটা ঘুমিয়ে পড়ত।বিপ্লব ওই ছোট্ট চোখ দিয়ে বাবার দূঃখ বুঝেছিল কিনা জানা নেই। তবে সে অন্যায় আব্দার কিছু করত না। সারাদিন আপনমনে বালি-ধুলি মেখে প্রকৃতির মাঝে তার দিন কেটে যেত। হারু আর কালু ছিল তার বন্ধু। হারু ছিল কালী কসাইএর ছেলে আর কালু বুড়িপিসির নাতি। সব এক বয়েসি। ঢিল ছুঁড়ে কুল পেয়ারা পাড়া থেকে গৌরাঙ্গীর ছাগলকে আমপাতা খাওয়ানো সব চলত। শর ঝোঁপে সেদিন শবর রা এসেছিল তিতির মারতে ওরা ঢিল ছুঁড়ে মেরেছিল বলেই তিতিরটা দৌড়ে পালিয়েছিল। খুব আনন্দ হয়েছিল সেদিন।আরেকদিন কালু মড়া আরশোলা এনে ছিল কোত্থেকে। বুড়ি পিসির বাড়ির পিছনে ছিল লাল পিঁপড়ের ডেরা। ওখানে আরশোলাটা ফেলে ওদের ভোজ খাওয়া দেখেছিল,আর রাত্রে শুয়ে শুয়ে বাবার বুকে মাথা রেখে ছোট্ট বিপ্লব তার সব অভিজ্ঞতা উজাড় করে দিত। বিধানের ওই চোখ দুটিতে চোখ রেখেই দিন কেটে যেত।

তখন বর্ষাকাল রাস্তায় জল যাচ্ছে ঢেউ তুলে তিন বন্ধু নাচত লাফিয়ে লাফিয়ে। রাঙাকাকিমার কথা শুনত না।

-দাঁড়া বিধু আসুক সব বলছি!

কিন্তু বিপ্লব খিল খিল করে হেসে উঠত।আর রাঙাকাকিমার রাগ সব পরে যেত।মাহারা বিপ্লব যে একলা রাঙাকাকিমার প্রান।

একদিন বিপ্লব দেখল বর্ষার জলে ভিজে মাটিতে একটা গাছ মাথা তুলেছে। ঠিক ওই পাঁকুড়গাছের নিচেই।আর সেটা বড় হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি। বাবা এলে বিপ্লব দেখায় গাছটাকে। কি সুন্দর আঁকাবাকা হয়ে উঠে যাচ্ছে পাঁকুড়ের গা বেয়ে বেয়ে।বিধানের তো চোখে পড়েনি। অবাক করে বিধান দেখে আরে এটাতো ‘মালতীলতা’!!

পরের দিন বিধান কাজে বের হয়। মালতীলতায় বাতাসে তরঙ্গ উঠে। যেন মালতী হাত নাড়ছে বিধানকে।এমনটাই মনে হয় বিধানের। আর সেইদিন কাজে গিয়ে শোনে তাকে কলকাতায় যেতে হবে। তার নক্সা কলকাতার এক নামী জুয়েলারি হাউসের খুব পছন্দ হয়েছে। তারা বিধানকে কলকাতায় নিয়ে যেতে চায়। মাইনেও অনেক।

বিপ্লব খুব খুশীতেই ছিল আজ সে মালতীলতা গাছটার পাশেএকটা কঞ্চি পুঁতে দিয়েছে। মালতীলতাগাছটা বাড়ছে। কুঁড়ি এসছে ফুলের।

বিধান এসে বিপ্লবকে কোলে তুলে নিয়ে নাচতে থাকে।

সে কলকাতা যাবে দুদিন পরে।বিপ্লবকে নিয়ে।কিন্তু বিপ্লব মনমরা হয়ে যায়। হারু কালু পরদিন শুনে বলে- ‘তোর ভালই হল বিলু।তুই শহরে গিয়ে ভুলে যাবি।

-কক্ষনো না।দেখে নিস। আমি আবার আসব।

রাঙাকাকিমার তিনকুলে কেউ নেই সেও যেতে চায় বিধানের সাথে। তারপর তিনজন একদিন ভোরের আলো না ফুটতে ফুটতে বেড়িয়ে পড়ে।৫.৩০টার বর্ধমান কর্ড ধরবে বলে।তখন শরৎকাল। শিশিরবিন্দু জমে মালতিলতার পাতায়।তার শরীর লালে লাল।ভোরের হাওয়া নাড়া দিয়ে যায় পাতায় পাতায়। দুইবিন্দু শিশির ঝড়ে পরে টপটপ করে। তিনজন মানুষের চোখের অগোচরে ঠিক কে যেন কেঁদে ওঠে অস্ফুটে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama