গল্প হলেও সত্যি
গল্প হলেও সত্যি
ছোটবেলা থেকেই জন্তু-জানোয়ার-পশু-পক্ষী-কুকুর-বেড়াল বড়ো প্রিয় | যদি কখনো কোথাও এদেরকে দেখি, কি করে ওদের হাতের নাগালে পাওয়া যায় এবং কিছু খাওয়ানো যায় এই চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায় | আবার চায়ের দোকানে বসলে দেখেছি অনেক কুকুর খুব চালাকি করে পাশে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে থাকে | ওদের আবার টনটনে জ্ঞান, বুঝতে পারে মনিব চায়ের সাথে বিসকুট খেলে নিশ্চয় একটু-আধটু ভেঙে অন্তত দেবে | ওরা খুব অল্পতেই খুশি, যদি একটা বিস্কুটের আধখানাও দেওয়া হয় তাতেও লেজ নাড়িয়ে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলে না | মনে মনে ভাবি মানুষ তো স্বনির্ভর, কিন্তু ওরা তো সব সময় ওদের ক্ষুধা থাকলেও কাউকে বোঝাতে পারে না; তাই যদি ওদের জন্য কিছু করি তখন মনে মনে একটু আত্মপ্রসাদ লাভ হয় এই ভেবে যে যাক পৃথিবী থেকে চলে গেলে যমরাজ যদি তলব করে জিজ্ঞাসা করে তুই এতদিন পৃথিবীতে থেকে কি করলি? সারা জীবন শুধু নিজের জন্য খেলি-দেলি আর শেষে মরে আমার কাছে চলে এলি ? আমি তখন কি জবাব দেব ! যাক শুলে চড়বার আগে বলবো হ্যাঁ হ্যাঁ আমি দুটো চারটে বেড়াল-কুকুরকে খাইয়েছিলাম | ওই যে গাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনের পাশে ঘন্টের চায়ের দোকানটা আছে, ওখানে কতগুলো ল্যাংড়া-লেংড়ি কুকুর আছে, ওদের জিজ্ঞাসা করলে ওরা বলতে পারবে আমি খেতে দিতাম কি না | ওদেরকে আমি নামও দিয়েছিলাম, যেমন ডাকতাম ভেলু, মেলু আর তেলু বলে | যান, যান যমরাজবাবু, আপনি এক্ষুনি গিয়ে জিগ্গাসা করুন | ওরা ঠিক বলবে আমি খেতে দিতাম কি না | ওরা মিথ্যে বলবে না কারণ ওরা মানুষেদের মতো মিথ্যা বলতে বা বেইমানি করতে জানে না | আপনি গেলে ওরা আপনাকে মানুষের মতো সম্বর্ধনা করতে পারবে না কারণ ওদের তো কিছু নেই; তবে খুশি হয়ে লেজ নাড়িয়ে দু-চারবার জিভ দিয়ে চেটে দেবে
এতো গেলো কুকুর খাওয়ানোর কথা | এবার বেড়ালের কথায় আশা যাক | এরা এবার একটু সেন্টিমেন্টাল হয়, পছন্দ না হলে পাত্তা দেবে না | আমার ঘরের কিছু দূরে একটা বিল্লি চারটে বাচ্ছা দিয়েছিলো, কিন্তু অদৃষ্টের এমনি পরিহাস যে ওই বিল্লির চারটের মধ্যে তিনটে মারা যায় | অবশেষে আমি একটাকে তুলে এনে লালন-পালন শুরু করি | এবার চিন্তা করলাম আমি বেড়ালের ভাষায় কথা বলবো, তাই ওর আর নাম রাখলাম না, ও ম্যাও ডাকলে আমিও ম্যাও ডাকতাম | একদম ছোট থেকে লালন-পালন করাতে বেশ বাগে এনেছিলাম | ওর খিদে পেলে যখন ম্যাও করতো আমিও সাথে-সাথে ম্যাও করে খাবার দিতাম | ও ভাবতো আমি ওর ভাষা বুঝছি, আর আমি ভাবছি ও আমার ভাষা বুঝছে | কে কার ভাষা বুঝছে ভগবানই জানেন | যাই হোক এই ভাবেই ওই বাচ্ছাটিকে কোলে তুলে আমি আর ও দুজনেই ম্যাও-ম্যাও খেলতাম |
বাচ্ছা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকলো, আমিও ওর জন্য শুটকি মাছ কিনে এনে রাখতাম | ওর খিদে পেলে যেই ম্যাও-ম্যাও ডাকতো অমনি আমিও ওর সাথে ম্যাও-ম্যাও করে খাওয়াতে থাকতাম | এইভাবে মাস পেরিয়ে বছর আসে এবং একদিন দেখি আমার বিল্লি একটা বাচ্ছা দিয়েছে | ভাবলাম হলো বিপদ, একটা নিয়েই অস্থির, আবার দুটোকে কিভাবে পালন করবো ! যাই হোক, ভগবানের সৃষ্টি, ফেলে তো দেওয়া যায় না; তাই ঘরের বাইরে এককোনে ওদের দুজনের থাকবার জায়গা করে দিলাম | মা বিল্লিটা সব সময় আমার কাছে কাছে থাকতো, মাঝে-মধ্যে বাচ্ছাটাকে খাইয়ে আসতো | কিছুদিন পর ছোট বিল্লিটাও খাওয়া শিখলো | তখন শুটকি মাছকে হাতে ধরে থাকলে মা-বেটি দুজনেই বেশ লাফ দিয়ে আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে খেতো | আমারও সময়টা বেশ মন্দ কাটছিলো না |
হঠ
াৎ একদিন আমি অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লাম | দু-একদিন খাওয়ানোর পর ওদের শুটকি মাছ শেষ হয়ে যায়,শুটকি মাছ কিনবার কথা সবাইকে বলা যায় না | আমার তো বাপ্-চোদ্দপুরুষের ভিটেতে কখনো ঢোকেনি, কিন্তু ওদের জন্য আমাকে লুকিয়ে কিনে আনতে হয় যদি কেউ দেখে মুখ সিঁটকাই এই ভয়ে | আমার বিল্লি আমার সামনে এসে বসে শুধু ম্যাও-ম্যাও ডাকে, কিন্তু আমি আর ইচ্ছা করে ডাকিনা কারণ আমি একবার ডাকলে ও আবার দশবার ডাকবে
দু-একদিন পেরিয়ে গেলেও যখন আমি শয্যা ছেড়ে উঠছি না, তখন ও দেখি আমার বিছানার পাশে টেবিলের ওপর বসে লেজ নাড়িয়ে শুধু ম্যাও-ম্যাও ডাকছে | আমি একটু পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে ম্যাও করতে দেখি আমার বিছানাতে নেমে এসে ম্যাও-ম্যাও করছে | আমারও একটু মায়া হলো, দু-একবার মাথাটা হাত বুলিয়ে ম্যাও-ম্যাও করে বাংলাতে বলে উঠলাম, "আর কটাদিন অপেক্ষ্যা কর, আমি সুস্থ হলে আবার খাবার পাবি | এখন দেখছিস তো চাকরির সুবাদে বাইরে একা-একা থাকি | ওই মেস থেকে মেস-বয় মাঝে-মধ্যে যা এনে দেয় তাতে আমার চলে যায়, এ খাবার তো তুই খেতে পারবি না, আমি কোনো রখমে খেয়ে আছি " ও দেখি খানিক্ষন চোখ বুজে কি যেন ভাবলো তারপর আস্তে একটা লাফ দিয়ে দরজা দিয়ে বেড়িয়ে গেল,| আমিও চোখ বুজে শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়লাম
হঠাৎ একটা বেসুরো ম্যাও-ম্যাও শব্দ কানে আসতে ঘুমটা ধড়াস করে ভেঙে গেলো এবং আমিও ধড়পড়িয়ে উঠে টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার বিল্লি বসে আছে ; ওর মুখেতে রয়েছে একটা আস্ত ইঁদুর, আর মুখ থেকে একটু একটু রক্ত ঝরছে | আমি কিছু ভাববার বা করবার আগেই বিল্লি মুখ থেকে ইঁদুরটা বেড় করে টেবিলের ওপরে রাখলো | দেখে তো আমার চোখ কপালে, রেগে কাঁপতে কাঁপতে বল্লাম, "বেড়ো হতচ্ছাড়া এক্ষুনি আমার কাছ থেকে ; আজকের পর যেন কখনো এই ঘরে তোকে না দেখি |"ও মা, দেখি ওর কোনো তাপ-উত্তাপ নেই, আরামসে বসে দুটো পা জিভ দিয়ে চাটছে আর মাঝে মাঝে লেজটা একটু একটু করে নেড়ে ম্যাও-ম্যাও ডেকে আমার দিকে তাকাচ্ছে | আমার রাগ আরো বেড়ে গেলো এবং আত্মহারা হয়ে টেবিলটা দিলাম জোর্সে এক ধাক্কা | সঙ্গে সঙ্গে টেবিলটা উল্টে পড়লো আর ইঁদুরটা ছিটকে গিয়ে দরজার সামনে | বিল্লি আস্তে করে লাফ দিয়ে নিচে নেমে ম্যাও-ম্যাও ডাকতে লাগলো |
আবার বেড়ালটাকে মারবার জন্য একটা কিছু খোঁজার চেষ্টা করছি, তখন হঠাৎ চোখে পড়লো ওর ছোট বাচ্ছাটা ইঁদুরটা খাবে বলে সামনে এগিয়ে আসছে, কিন্তু ওর মা থাবা দিয়ে আগলাছে যাতে খেতে না পারে | আমার মাথাটা কেমন জানে ঘুরপাক খাচ্ছে, বুজে উঠতে পারছি না এ সব কি হচ্ছে | তবুও নিজের ক্রোধ সম্বরণ করে একবার ম্যাও বলে বিল্লির মাথায় হাত দিতেই ও দেখি বারবার ম্যাও-ম্যাও করে বলতে চাইছে, "খাও-খাও, খুব টেস্টি ফুড, আমি না খেয়ে, বাচ্ছাকে না খাইয়ে তোমার জন্য এনেছি |" একটুখানি শান্ত হয়ে একটা কাগজ হাতে নিয়ে ইঁদুরের লেজটা ধরে আস্তে আস্তে দরজার পাশে গিয়ে বারান্দায় ইঁদুরটা রেখে আমি ম্যাও-ম্যাও করতেই দেখি বিল্লি আর ওর বাচ্ছাটা ছুটে আসছে | আমি ইঁদুরটা রেখে যখন বসলাম, তখন মা ও বেটি দুজনে সামনে এসে ইঁদুরটাকে আস্তে আস্তে খেতে শুরু করলো |
আমি শান্ত হয়ে গিয়ে বল্লাম, "আমি তোমার ভাষা বুঝিনা, তুমিও আমার ভাষা বোঝোনা, কিন্তু তুমি আমার ভালোবাসা বোঝো, আমিও তোমার ভালোবাসা বুঝি | আমরা কি পারিনা মানুষের মধ্যে এই ভালোবাসা একে অপরকে বোঝাতে ? যদি আমরা সবাই সেটা বুঝতে পারি তবে পৃথিবীতে একটা মানুষও অনাহারে মরতে পারে না "