সন্ধ্যা নিশীথ
সন্ধ্যা নিশীথ
বারো ক্লাসের পরীক্ষার পর নিশীথ তৈরি হচ্ছে জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে ডাক্তারিতে চান্স পাওয়ার জন্য । আজ ওর ঘরে ফিরতে দেরী হওয়ার কারণ, ওই যে সমস্তিপুর গ্রামের বিদ্যুত দা কোচিং ক্লাসে এসে বকরবকর করে কি যে সব আউড়ে গেলো, এবার ঘরে গিয়ে দাদুকে নানা কৈফিয়ত দাও । ঘরে তো দাদুই সব, বাবা পর্যন্ত ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে ; আর মা, সে তো যমের মতো ভয় পায় দাদুকে, দেখলে এমন করে যেন সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখেছে, এক্ষুনি ঘাড় মটকাবে । আমি তো একরত্তির খুদে পিঁপড়ে দাদুর কাছে । আমাকে দেখলেই সবসময়ে উকিলের জেরা, কোথায় গিসলি, কখন গিসলি, কেন গিসলি, তোর সাথে কারা কারা ছিলো ? এতক্ষন ধরে কি করছিলি ইত্যাদি । মরণদশা, আমি যেন জেলের কয়েদী, রাত দিন আমার চিন্তায় ঘুম হচ্ছে না কিভাবে প্রথম এটেম্পটেই সফল হবো এই চিন্তা করে । আজ যদি বেশি কিছু বলে যে যাই ভাবুক আমি বলে দেবো কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে রেস্টুরেন্টেতে বসে মজা করে খেয়েদেয়ে এসেছি ।
এখনও কিছু কিছু গ্রাম আছে যেখানে রাস্তা-ঘাট, গাড়ি, ইলেক্ট্রিক সব কিছুর সুবিধা ঠিকমতো নেই । নিশীথের গ্রাম গোবিন্দপুর যেখানে সবার থেকে শ্রেষ্ঠ ধনবান এবং প্রভাবশালী বেক্তি হচ্ছেন শ্যামসুন্দর চট্টোপাধ্যায় যিনি নিশীথের দাদু । গ্রামের শেষ প্রান্তে ওদের বিশাল পুরানো মহল আজও ওদের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে । নিশীথ প্রায় দশ কিলোমিটার দূরবর্তী এক ছোট মফস্বল শহরে কোচিং ক্লাস এটেন্ড করে রোজ বাস থেকে নেমে গ্রামের রাস্তাটা সাইকেলে যাতায়াত করে । গ্রামের এক কিনারায় রয়েছে এক বিশাল দীঘি যেখানে গ্রীষ্মের সময়ে বেশির ভাগ গ্রামের মানুষজন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্নান-ধ্যান সম্পন্ন করে । নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মা মেয়েরা সন্ধ্যার সময়ে স্নান করে যখন কোনো পুরুষ মানুষ সেখানে থাকে না । দীঘির পার্শবর্তী এলাকাতে বেশ কিছু বস্তি, দীন মজুরেরা বসবাস করে, তারা সবাই তফসিল জাতি এবং উপজাতি ।
কিয়ৎক্ষণ পূর্বে সূর্য্যি মামা তার রক্তিম রশ্মিচ্ছটা সোনাদীঘির ছোটছোট ঢেউগুলিকে বেশ কয়েকবার আলিঙ্গন করে গুড বাই জানিয়ে কোথায় অজানা সমুদ্রের তলদেশে তলিয়ে গেছে । এবার সন্ধ্যায় পূর্ণিমার রুপালি চাঁদ সোনালী ঢেউগুলিকে রুপালি ঢেউয়ে রূপান্তরিত করবার জন্য জোৎস্নাকে অপরূপ সাজে সাজিয়ে ঢেউগুলিকে কোমল স্পর্শে অভিভূত করতে উদ্যত হয়েছে । দীঘির চারিপাশের বস্তির মেয়েরা স্নান ও জলক্রীড়ায় আনন্দে মশগুল হয়ে হাসি মস্করায় উচ্ছলিতা । বয়স পনেরো-ষোলো হবে, শ্যামলা সুমুখশ্রী গোলগাল চেহেরা সন্ধ্যার শাড়ির আঁচলটা ধীরে ধীরে ধেয়ে যায় ঢেউয়ের মৃদু-মন্থর গতির ওপর ভর করে । পূর্ণিমার চাঁদ ঠিক এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করছিলো, কালবিলম্ব না করে সন্ধ্যার আলুথালু শরীরে এবং মুখশ্রীর ওপর জোৎস্না রুপোলি আভা ছড়িয়ে ওর মনকে উড়িয়ে নিয়ে যায় এক স্বপ্নময় জগতে । সহসা নিশীথের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় সোনাদীঘিতে স্নানরতা সন্ধ্যার আলুথালু শরীর এবং মুখমন্ডলের ওপর । যৌবনের প্রারম্ভে প্রথম প্রেম ওকে আমন্ত্রণ জানায় সন্ধ্যার রূপ ধরে, সম্মোহিত হয়ে সাইকেলের প্যাটেলকে বল প্রয়োগ করতে অক্ষম হয়ে যায় । অকস্মাৎ সন্ধ্যার দৃষ্টি নিশীথের ওপর পরে, বুঝতে পারে না কেন ওই উচ্চ বংশের নামজাদা পরিবারের ছেলেটি হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে । হঠাৎ দেখে মৃদুমন্দ ঢেউয়ের তালে তালে ওর শাড়ির আঁচলখানি নাচতে নাচতে এগিয়ে চলেছে শরীরের উর্ধাংশ পরিত্যাগ করে । তবে কি নিশীথ সেইজন্য দাঁড়িয়ে পড়েছে ! লজ্জা ও সংকোচে তাড়াতাড়ি ডুব দেয় জলের মধ্যে, কিছুক্ষন পরে মুখ তুলে তাকাতেই দেখে নিশীথ সেই জায়গাতে দাঁড়িয়ে স্ট্যাচুর মতো । ওর শরীরে এক প্রেমের শিহরণ বয়ে যায়, মনে মনে নিশীথের প্রতি টান বা আকর্ষণ অনুভব করে । ভেজা মাথার চুল থেকে গাল বেয়ে সমানে জল গড়িয়ে পড়ছে শরীরে, ভেজা কাপড় শরীরে জড়ানো যেন কোনো পাথরের মূর্তি বৃষ্টিতে ভিজে গেছে । নিশীথের কি হয়েছে, কেন দাঁড়িয়ে সে নিজেই জানে না । ভয় ও লজ্জা এড়িয়ে সন্ধ্যা গৌরবর্ণ নিশীথের মুখের পানে তাকিয়ে একটু হকচকিয়ে যায়, পরে খিল খিল করে প্রাণখোলা হাসি হেসে ওঠে, বোঝাতে চায় তোমার এ কি হলো ! নিশীথ লক্ষ্য করে ওর শ্যামবর্ণ পবিত্র মুখমন্ডল এবং শুভ্রবর্ণ দন্তপাটি চন্দ্রালোকিত হয়ে ওকে আহ্বান করছে প্রেমাঙ্গনে প্রবেশের জন্য । উভয়ের শরীরে এক অজানা প্রেমতরঙ্গ বয়ে যায় যৌবনের উদ্দীপনা জাগিয়ে ।
নিশীথ ঘরে ফিরে কিছুতেই সন্ধ্যার ভিজে কাপড়ে জলে দাঁড়িয়ে ফিক ফিক করে হাসার মুহূর্ত ভুলতে পারে না । যতবার চেষ্টা করে ভুলতে কিন্তু অগোচরে মেয়েটার নিষ্পাপ হাসি উদয় হয় মনে, যৌবনের উন্মাদনা না কি ভালোবাসার প্রথম কলি মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে বুঝতে পারে না । সন্ধ্যার ওই রূপটাই ওর কাছে শ্রেষ্ঠ রূপ বা সৌন্দর্য হয়ে বার বার উঁকি দেয় ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে মিলনের আকাঙ্খায় । নিশীথের মনে বাসা বাঁধে প্রেমের নীড়, সংকল্প করে কাল থেকে রোজ ওই সময়েই ফিরবে ওই রূপ দর্শনের জন্য ।
বস্তির মেয়ে সন্ধ্যা বাবা-মার্ একমাত্র কন্যা ; না খাওয়ার, না শোয়ার বা থাকার ভালো ব্যবস্থা । মাত্র নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় অভাবের তাড়নায় । সকালবেলায় উঠে যেতে হয় বংশীবাবুর বাড়ি ; ঘর মোছা, বাসন মাজা সেরে খেতে-খামাড়ে কাজ করতে হয় দিনের বেলা । সারা দিনের ক্লান্তি দূর করা, দেহ-মনের শুচিতা ও পবিত্রতার জন্য সোনাদীঘিতে তাই কিছুক্ষন সাঁতার কাটা ও স্নান করা, তারপর দুমুঠো সিদ্ধ ভাত খেয়ে মা-বাবার সঙ্গে একখানা ছোট্ট মাটির ঘরের মেজেতে চেটাই পেতে শুয়ে পড়া । প্রেমের বিশেষত্ব এই যে সে কখনো ঘড়ি, দৌলত আর বনেদিয়ানা দেখে হৃদয়ে উদয় হয় না, তাই মা-বাবার সাথে চেটাইযে শুয়ে মনে মনে আঁকড়ে ধরে নিশীথের মধুর স্মৃতিকে । আস্তে আস্তে নিদ্রাদেবীর শরণাগত হয়ে গভীর রাতে নিজেকে মায়াপুরীর রাজকন্যা এবং নিশীথকে সপ্নরাজ্যের রাজপূত্র সাজিয়ে কল্পনার জগতে প্রবেশ করে এবং অজানালোকে মিলিত হয় উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে । এক সময়ে হেসে উঠায় মা শৈলবালা ঠেলা দিয়ে বলে উঠে, "কি রে সন্ধ্যা, তোর আবার কি হলো ?" বাবা নিমাই দলুই পাস ফিরে বলে ওঠে, "তোমার মেয়ে স্বপ্ন-টপ্ন দেখেছে আর কি ।"
ত্রস্তব্যাস্ত হয়ে মাঠের কাজকর্ম সেরে সন্ধ্যা সোনাদীঘির উচ্ছল জলতরঙ্গে ঝাঁপিয়ে পরে যৌবনের উন্মাদনা নিয়ে ! দীঘির কাছে এসে জলের দিকে তাকানো মাত্র নিশীথের বুকটা ধড়াস করে ওঠে, আজও এক কোমর জলে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যা অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। কিছুক্ষন একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকে ; হাজার প্রশ্ন মেঘের মতো উড়ে চলে ওদের কল্পিত গগনে কিন্তু মুখ ফুটে কেউ কিছু বলতে পারে না । এক অজানা কামোদ্দীপনার রোমাঞ্চ ও আনন্দে উভয়ের মনকে আন্দোলিত করে ; সোনাদীঘিতে স্নানরতা সব মেয়েরা অবাক বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ওদের হালচাল নিরীক্ষণ করতে থাকে। হঠাৎ একটা মোটরসাইকেলের হর্ণের আওয়াজে সকলেই চমকে ওঠে, নিশীথ দেখে রাস্তা দেবার জন্য এক মোটরসাইকেল আরোহী হর্ন বাজিয়ে চলেছে । একটু ইতস্তত করে তাড়াতাড়ি সাইকেল চালিয়ে ঘরে ফিরে আসে ।
নিশীথ ও সন্ধ্যার অন্তত একবার একে অপরকে দেখা চাইই ; একদিন সাহস করে নিশীথ সন্ধ্যাকে জিজ্ঞাসা করে, "তুই কোন ক্লাসে পড়িস, তোর নাম কি ?" সন্ধ্যা ভাবতেই পারেনি যে ওকে এ রখম প্রশ্ন করে বসবে নিশীথ । লজ্জায় ও ভয়ে কিছু বলতে পারে না । নিশীথ আবার জিজ্ঞাসা করে, "কিরে, তুই যে কিছু বল্লি না ?" সন্ধ্যা নিজেকে ভাবে ও একটা ছোট জাতের অত্যন্ত গরিব ঘরের মেয়ে এবং সমাজের চোখে নিকৃষ্ট ; অন্যদিকে নিশীথ অতি সম্ভ্রান্ত ও ধনী ঘরের ছেলে যার একটা চুলের যোগ্য ও নয় । সমাজের চোখে ওরা হচ্ছে বড়োলোক আর আমরা হোলাম ছোটোলোক, ওর মুখ দিয়ে কোনও কথাই বের হয় না ।
এবার নিশীথ একটু অনুনয়ের শুরে বলে, “তোর কি নাম, কোথায় থাকিস আর কোন ক্লাসে পড়িস ? তোকে আমার খুব ভালো লাগে, তাইতো তোর জন্য এই সময়ে রোজ সাইকেলে করে তোদের এই পাড়া দিয়ে যাই তোকে দেখতে দেখতে । জানিস, তোকে একবার না দেখলে থাকতে পারি না ।” চোখ কপালে তুলে লজ্জায় হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে দু মিনিট দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলে ওঠে, "এ কি বল্লে তুমি ! বাবু তোমরা তো কত বড়ো লোক, আর আমরা লোকের বাড়ি কাজ করে, মাঠে-খেতে-খামাড়ে খেটে দুটো পয়সা রোজগার করে কোনরখমে দুমুঠো খেয়ে বেঁচে থাকি । আমি তো কোনো পড়াশোনা করিনি, থাকি ওই তো, ওই যে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা ছোট্ট মাটির ঘরটা, ওটাতে । আমার নাম সন্ধ্যা, সন্ধ্যা দলুই, সন্ধ্যাবেলায় রোজ এই সোনাদিঘিতে সন্ধ্যে-স্নান করি ।"
নিশীথ : অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে, কি বলবে ভেবে পায় না । একটা ঢোঁক গিলে বলে ওঠে,"তুই কিন্তু রোজ এই সময়টা দীঘিতে স্নান করিস । আমি রোজ তোকে একবার করে দেখে যাবো ।"
সন্ধ্যা : বাবু, আমি দাঁড়িয়ে থাকলে যদি তুমি খুশি হও, তবে আমি তোমার জন্য এই জলে রোজ দাঁড়িয়ে থাকবো ।
সেদিন থেকে রোজ শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সন্ধ্যা সন্ধ্যাবেলায় সান্ধ্য স্নান করে চলেছে । আজ বেশ ঠান্ডা, তার ওপর টিপটিপ করে অনবরত বৃষ্টি হয়ে চলেছে সারাদিন ধরে । মাঠে কাজকর্ম নেই, সকাল থেকে একা একা সন্ধ্যা শুধু ভাবতে থাকে কখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবে । আজ সোনাদীঘিতে কোনো জনপ্রাণী নেই, এত বৃষ্টি ও ঠান্ডাতে কে জলে নামবে । সন্ধ্যার মা চলে গেছে পাড়ার এক বাড়িতে কাজ করতে, বাবা গেছে মনিবের বাড়িতে কিছু কর্জের আশায় । সন্ধ্যার ঘরে ঘড়ি নেই, তাই অনুমান করে একাই সোনাদীঘির জলে নেমে দাঁড়িয়ে থাকে ।
সকাল থেকে বৃষ্টির প্রকোপে নিশীথ আর কোচিং ক্লাসে যায়নি । সন্ধ্যার সময় বাড়িতে মা-বাবা, ভাই-বোন, দাদু-ঠাকুমা সবাই মিলে একসাথে বসে চা ও তেলেভাজা খেতে ব্যস্ত । হঠাৎ দেওয়ালে ঝোলানো বিশাল ঘড়িটা ঢং ঢং করে সাতবার আওয়াজ করে ওঠে, নিশীথের বুকে যেন হাতুড়ি পিঠতে থাকে, দুখানা গরম চপ পকেটে রেখে বলে, "আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে কারণ আমার আজকের টাস্কটা যে নোট বুকে আছে সেটা অখিলের বাড়িতে ।" তাড়াতাড়ি একখানা ছাতা নিয়ে দ্রুতগতিতে পৌঁছায় সোনাদীঘির পাড়ে । চারিদিক অন্ধকার, কিছু দেখা যাচ্ছে না, ভালো করে নিরীক্ষণ করতে থাকে দীঘির জলে কেউ দাঁড়িয়ে আছে কি না । হঠাৎ জলের মধ্যে আওয়াজ হতে থাকে, একটা ছায়ার মতো কে যেন জল থেকে উঠে আসছে । কাছে আসতে দেখে সন্ধ্যা ঠক ঠক করে কাঁপছে ভেজা শরীরে, কিছু বলতে পারছে না ; শুধু কম্পিত গলায় বলে ওঠে, " বাবু তুমি এসেছো ? আমি তোমার জন্য এতক্ষন জলে দাঁড়িয়ে ছিলাম ।" নিশীথ ছাতাটা মাটিতে ফেলে ওকে আবেগাপ্লুত হয়ে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ; ওর শরীরের গরম স্পর্শে সন্ধ্যার শরীরে এক অনির্বচনীয় আনন্দ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয় । তাড়াতাড়ি পকেটে হাত দিয়ে কাগজে মোড়া দুটো গরম আলুর চপ ওর মুখের সামনে ধরে । চপে একটা কামড় দিয়ে চাপা গলায় বলে ওঠে, "বাবু, তুমি আমাকে এত ভালোবাসো ?"
দেখতে দেখতে ওদের সম্পর্কটা গভীর হয়ে ওঠে, কানাঘুষো হওয়াতে নিশীথের বাড়িতে খবরটা পৌঁছায় । শ্যামসুন্দরবাবু নিশীথের বাবা শিবসুন্দর এবং মা উমাদেবীকে তলব করে বলে ওঠেন, "তোমাদের আস্কারায় আমার একরত্তির নাতিটা গোল্লায় যেতে বসেছে । তোমরা এরখম বাবা-মা যে ছেলে কি করছে না করছে তার খবর পর্যন্ত রাখো না । এখন গোটা গ্রাম আমায় ছিঃছিঃ করছে, আমার মান-মর্যাদা তোমরা ধুলোয় লুটিয়ে দিলে । থাক অনেক হয়েছে, এবার বাকিটা আমায় করতে দাও ।"
দু-চার দিনের মধ্যে ওর রেজাল্ট বের হবে, ঘুর্ণাক্ষরেও জানতে পারে না ওর বাবা এবং দাদু মিলে পার্শবর্তী গ্রামের এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সুকমল ব্যানার্জীর একমাত্র কন্যা আধুনিকার সাথে ওর বিবাহ স্থির করে ফেলেছে বংশ মর্যাদা দেখে এবং সন্ধ্যার বাবা-মাকে শাঁসিয়ে এসেছে যাতে ওদের মেয়ে কখনো ভুল করেও নিশীথের দিকে না তাকায় । সন্ধ্যার মা-বাবা সন্ধ্যাকে জানিয়ে দেয় ওরা বড়ো লোক, ওদের দিকে তাকাতে নেই নতুবা ওরা তোর যৌবনের রক্ত-মাংস চুষে-খেয়ে তোকে ছুঁড়ে রাস্তায় ফেলে দেবে পাতিতার অপবাদ দিয়ে । তখন তোর জীবনটা নরক হয়ে যাবে । পরীক্ষার ফল বেরুনোর দুদিন আগে মা উমাদেবী জানিয়ে দেয় আধুনিকার সঙ্গে ওর বিয়ের কথা ।
নিশীথের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে, বুকের ভিতরটা ঢিপ ঢিপ করতে থাকে । এখন সন্ধ্যা একটু পরিণত হয়েছে, ওকে নিয়ে দূর এক জায়গাতে নিরালায় এক বট গাছের নিচে বসে সমস্ত জানায় । যাদের বিদ্যা-বুদ্ধি কম তাদের আমরা সাধারণত বোকা বলে থাকি, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা বোকা নয়, সহজ-সরল । অনেকে তাদের সহজ সরল প্রকৃতিকে বোকামো ভেবে নজর আন্দাজ করলেও তারা হয়তো ওদের থেকে বেশি বুদ্ধি রাখে পুঁথিগত বিদ্যা না থাকলেও ।
সন্ধ্যা : নিশীথ বাবু, তোমরা তো অনেক বড়ো মানুষ, আমরা কি তোমাদের সমকক্ষ হতে পারি । আমি তো সব সময়ে তোমায় সুখী দেখতে চাই, তুমি আধুনিকাকা বিয়ে করে সুখে-শান্তিতে থাকলে আমার তাতেই আনন্দ । আমি তো তোমাকে বেশিদিন না দেখে থাকতে পারবো না, তাই তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ, আমায় কথা দাও তুমি আমার এই অনুরোধটা রাখবে ?
নিশীথ : বেশ আমি কথা দিলাম, তোর কথা রাখবো ।
সন্ধ্যা : তোমার আধুনিকার সাথে বিয়ে হলে তোমার তো ঘরের কাজের জন্য একটা কাজের মেয়ের দরকার হবে । তুমি আমায় কথা দাও আমায় তোমাদের ঘরের কাজ করবার সুযোগটুকু অন্তত দেবো, দেখো আমি খুব ভালো করে তোমাদের ঘর মোছা, বাসন মাজা, কাপড় ধোয়া সব করে দেবো । মনে মনে জানবো আমি তো তোমার সেবা করবার সুযোগটা পেয়েছি ।
নিশীথ : মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না, ভেতরটা মুচড়ে ওঠে, ভারাক্রান্ত গলায় আস্তে করে বলে, "কথা দিলাম।"
পরীক্ষায় খুব ভালো ফল করে নিশীথ আনন্দে মোটরসাইকেল চালিয়ে দ্রুতগতিতে ঘরে ফিরতে গিয়ে অকস্মাৎ এক ট্রাকের সাথে ধাক্কায় ছিটকে পড়লো রাস্তা থেকে প্রায় পনেরো ফুট দূরে । প্রাণে বেঁচে গেলেও পায়ের ওপর মোটরসাইকেল পড়ে যাওয়ায় গোড়ালির হাড় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় । লোকজন তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দেয় । অতন্ত্য দুঃখের সঙ্গে ডাক্তার জানায় পায়ের গোড়ালি থেকে আঙ্গুল সমস্ত হাড়গুলো অজস্র টুকরো হওয়াতে কেটে বাদ দিয়ে আর্টিফিশিয়াল লিম্ব লাগাতে হবে ।
সংবাদ প্রচার হওয়া মাত্র সুকোমলবাবু জানিয়ে দেন উনি ওনার মেয়েকে কোনো খোঁড়া ছেলের হাতে তুলে দিতে পারবেন না । একাকী হসপিটালে রোগশয্যায় পায়ে প্লাস্টার নিয়ে শুয়ে নিশীথ ভাবতে থাকে সারা জীবনে ও আর সুস্থ মানুষের মতো হাঁটতে পারবে না। রোজ কত কত লোকজন আসে আর দেখে সান্তনা দিয়ে যায় ; ভাবতে থাকে মানুষের জীবনের গতি কখন কিভাবে পরিবর্তিত হবে কেউ বলতে পারে না । সন্ধ্যা নেমে আসায় এক নার্স এসে জানালাটা বন্ধ করতে করতে বলে, "কত কত লোকজন এসে চলে গেলো কিন্তু এরখম অসময়ে এসে এক আনপড় মেয়ে কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে, বল্লেও যায় না । আমি বলে দিয়েছি এখন উনি বিশ্রাম নিচ্ছেন ।"
নিশীথ : সমস্ত কষ্ট ভুলে আনন্দে অধীর হয়ে নার্সকে বলে শিগ্গিরি ওকে আসতে দাও ।
কাঁচুমাচু মুখে একটা পুরানো কাচা শাড়ি পড়ে মাথার চুলগুলোকে সুন্দর করে বেঁধে চোখে কাজল লাগিয়ে সন্ধ্যা মাথা নিচু করে সামনে এসে দাঁড়ায় । আলতো করে পায়ের প্লাস্টারের ওপর হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করে, "বাবু, তোমার খুব লেগেছে নয় ?"
নিশীথ : হ্যাঁ, বেশ জোরে লেগেছিলো তাই তো কেটে বাদ দিতে হবে । এখন হয়তো কাঠের পা লাগাতে হবে ।
সন্ধ্যা : না না বাবু, তোমার অত সুন্দর পা কেটো না । কাঠের পা কি সত্যিকারের হয় নাকি ?
নিশীথ : কি করবো বল, এছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই ।
সন্ধ্যা : বাবু, আমার পা কেটে জোড়া লাগালে হবে না ? অবশ্য আমি তো মাঠে কাজ করি তাই কালো আর একটু মাটির গন্ধ রয়েছে । তুমি বোলো না যদি ডাক্তারে কেটে লাগিয়ে দেয় ।
নিশীথ : চোখ দুটো জলে ভোরে ওঠে, ঢোঁক চিপে বলে ওঠে, " আজ থেকে আমাকে বাবু না ডেকে নাম ধরে ডাকবি, তোর পা কাটলে কষ্ট হবে না ?"
সন্ধ্যা : বা রে, কষ্ট হবে কেন, আমি জানবো আমার পা সারা জীবন তোমার সঙ্গে আছে । কিন্তু তুমি কাঁদছো কেন ? আসলে বাবু তুমি ঠিক বুঝতে পারছো না ।
শ্যামসুন্দর : এতক্ষন আড়াল থেকে সব লক্ষ্য করছিলেন, সামনে এসে সন্ধ্যার সামনে দাঁড়িয়ে ওর মাথায় হাত রেখে বলে ওঠেন, "ও কি বুঝতে পেরেছে জানিনা কিন্তু মা আমি তোমাকে বুঝতে পেরেছি । তুমি একদিন আমাদের বংশের কুলবধূ হবে । ভালোবাসা মানে যাকে ভালোবাসি তার জন্য ত্যাগ স্বীকার করা কোনো কিছুর প্রত্যাশা না করে অন্যথায় ভালোবাসা একটা কথার কথা বা প্রহসন মাত্র । তা মা তুমি যখন আমার নিশীথের জন্য এতবড়ো ত্যাগ স্বীকার করতে পারো, তখন দুটো বইয়ের পাতা মুখুস্ত করা তোমার কাছে বড়ো ব্যাপার নয় । কথা দাও তুমি আমার ও নিশীথের জন্য একটা কাজ করবে কারণ তোমার বয়স বেশি নয় ।”
সন্ধ্যা : একটু থতমত খেয়ে বলুন কি করতে হবে ?
শ্যামসুন্দর : তুমি পিএইচডি করে দেখাতে পারবে ?
সন্ধ্যা : সেটা কি ?
শ্যামসুন্দর : সেটা তোমাকে নিশীথ বুঝিয়ে দেবে ।
নিশীথের ডাক্তারি পড়বার সাথে সাথে সন্ধ্যা এক এক করে ম্যাট্রিক, বারো ক্লাস, গ্রাজুয়েশন, মাস্টার্ড ডিগ্রি এবং পিএইচডি সমাপ্ত করে একদিন শ্যামসুন্দরবাবুর কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলে, " knowledge is greater than caste & religion, notwithstanding love is greater than all " জ্ঞ্যান জাতি এবং ধর্মের থেকে বড়ো তথাপি ভালোবাসা সকলের থেকে বড়ো ।