ঘাসের আংটি
ঘাসের আংটি
রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম বাড়ী। আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে। এত দেরি করে দোকান বন্ধ করুন আমি। সাধারণত। কিন্তু শেষ গ্রাহক এলো ঠিক দোকান বন্ধ করার সময়। গ্রাহক ভগবানসরুপ। তার ইচ্ছের মর্যাদা দিতে হয়।
পরিবারের বড় ছেলে আমি। মা বাবার দিকে চেয়ে হন্যে হয়ে চাকরি খুজছি আমি। ভিক্ষুক যেমন দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে, সেইরকম আমিও দিনরাত মেহনত করছি, দ্বারে দ্বারে হাতজোড় করে জিজ্ঞেস করছি
" দাদা একটা চাকরি হবে?"। কোথাও গৃহপালিত কুকুরের অভ্যর্থনা, আবার কোথাও মনিবের বিশ্বস্ত দারোয়ানের গলাধাক্কা, আবার কোথাও বসিয়ে ; জল খাইয়ে -"এখন না , পরে আসুন " শোনা।
যাইহোক দোকানের কর্মচারী হয়ে আলুসিদ্ধ ভাত, বাবা - মার ওষুধের সিকিভাগ খরচ, আর ছোট ভাইয়ের ফি, কোনমতে চলে যায়, কিন্তু মন কি মানে, শত হোক ইঞ্জিনিয়ারিং এ মাস্টার্স করেছি ত।
পকেটে মোবাইলটা বেজে উঠলো। জানি কার ফোন। তৃণার। আমার একান্ত প্রিয় বান্ধবী। আসুন তৃণার সঙ্গে আলাপ করাই। তৃণা আর আমি, ওহ আমার নামটাই বলা হয়নি, আমি অনিকেত, অনিকেত ঘোষাল, একই সঙ্গে মাস্টার্স করা। প্রথম দিনেই দেখে ভালো লেগে গেছিলো। লম্বা, ৫'৭" এর কাছাকাছি হবে। চোখদুটো টানাটানা। সারাক্ষণ মুখে মিষ্টি একটা হাসি লেগেই আছে। প্রথম দিনেই আমাদের বেশ ভালো বন্ধুত্ব জমে উঠেছিল। দুজনেরই পয়লা বৈশাখে রবীন্দ্রনাথ, আর নজরুল জয়ন্তী তে নজরুল সঙ্গীত প্রিয়। কেউই মাছ পছন্দ করিনা। F.R.I.E.N.D.S এর ভীষণ ভক্ত আমরা দুজন। আড়ালে অনেকে আমাদের CHANDLER আর MONICA ও ডাকে। খালি একটা ব্যাপারেই মিলেনা। তৃণা রিয়াল মাদ্রিদ ভক্ত, আমি বার্সেলোনা।
সে যাই হোক, তৃণা অনেকবারই বলেছে যে এভাবে বন্ধু বন্ধু না থেকে কেউ না কেউ তো প্রেমে পা বাড়াই, বিয়ে থাও করি, আর আমি সব্বার বলেছি তৃণা আমি তোকে সত্যি ভালোবাসি, কিন্তু জানিস আরেকটু এগোতে ভয় হয়। তুই তো জানিসই তো আমার বাড়ির হাল। আমি চাকরি না পেলে পুরো সংসার ভেসে যাবে, আর তুইও কি পরিচয় দিবি বল। তৃণা মুখ বেঁকিয়ে বলতো, বলবো আমি বেকারের বেকারী চালাই, কিন্তু তোর সাথেই থাকবো। তৃণার আমার প্রতি এত টান দেখে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জেদ আরো চেপে বসেছিল। আসলে তৃনাকে হারানো ভয় দিন দিন আরো বেড়ে যাচ্ছে। মনে হয় তৃনাকে হারালে জগৎ টাকেই হারিয়ে ফেলবো।
তবে আজকাল অনুভব করি, তৃণার একটু একটু বদল আসছে। সেদিনও পার্কে আলগোছে হাত ছাড়িয়ে বললো, "অনি ,বাবা কিন্তু অনেক আলাপ আনছে, লেটেস্ট এনেছে নিউরো সার্জন, নাম শুভময় বোস। দেখতেও হান্দু। কিছু একটা কর। নাহলে বাড়িতে বলি কি করে?"
আমি " দেখ চেষ্টা করছি তো জানিসই, কি করবো বল? দাড়া শুভময়ের আগে আমিই আংটি পরাই।"
বলে একটা ঘাসের আংটি বানিয়ে পরিয়ে দিলাম।
তৃণা : " ঘাসের আংটি সারাজীবন টিকে নারে হাতে, টিকে সোনার", বলে বাড়ী চলে গেলো।
মনটা বেদম খারাপ হয়ে গেছিলো সেইদিন। সত্যি তো। কত অপেক্ষা করবে? ঠাকুর একটিবার তাকাও।
অন্যমনস্ক ভাবে এইসব কথা ভাবছিলাম। ফোনটা যে বেজেই যাচ্ছে খেয়াল নেই। তুললাম।
"কিরে এতক্ষণ লাগে ফোন তুলতে" তৃণার বিরক্তি পূর্ণ গলা।
" নারে দেরি হয়ে গেছে , বল"
"শোন সামনের সোমবার আমার এনগেজমেন্ট আর রেজিস্ট্রি।শুভর সাথে। আর আমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছাড়া বিয়ে করবনা। তো তুই আসবি কিন্তু।"
"সেকি তৃণা, কখন কিভাবে হলো? জানতেও পারলাম না? আর আমি বেস্ট ফ্রেন্ড হয়েই রইলাম? আংটি পড়ানোর পরেও?" একটা শুকনো হাসি দিলাম। যা আশঙ্কা ছিল তাই সত্যি হলো।
একটু চুপ করে ওপাশ থেকে তৃণার আওয়াজ " হ্যাঁ রে, ভেবে দেখলাম তুই কবে চাকরি পাবি, সে আশায় বসে থাকবো, নিজের তো একটা ভবিষ্যৎ আছে, আর তাছাড়া বাবাকে কি বলবো যে তোমার হবু জামাই দোকানের কর্মচারী?" বলে চুপ আবার।
কথাটা শেলের মত বিঁধল। সত্যি তো। কিন্তু তৃণার থেকে সত্যির আয়না দেখবো, আশা করিনি।
"হ্যাল্লো,শুনছিস?"
আমি " নারে ঠিকই, শুধুশুধু জীবন নষ্ট করে লাভ কি? যাইহোক ভালো থাকিস, কি আর বলবো?"
একটু থেমে বললাম। " Monica Chandler এর হলনা তাহলে, Dr. Robert এর হলো" বলে হাসি দিলাম। ওপাশেও হাসির আওয়াজ।
এনগেজমন্ট এর দিন গেলাম তৃণার বাড়ী। সাথে একটা ছোট প্যাকেট, আরেকটা চিঠি। চুপচাপ দিয়ে চলে এলাম ওর বৌদির হাতে। তৃণা কে দেখার মত সাহস আমার হলনা। তৃণার হাতে অন্য কেউ আংটি পরাবে, আর আমি হাততালি দেবো, সে বুকের পাটা আমার নেই। চলেই এলাম।
চিঠির লেখা
" তৃণা তোকে কিছু দেওয়ার সাধ্য আমার নেই, শুধু মন থেকে চাইবো তুই খুব খুশি থাকবি, যা চাইবি তাই যেনো হয় তোর। আমি বেকার রয়েই গেলাম। আসলে তুই আমার মনের শক্তি ছিলি তো। আজ লাগছে সেও শেষ। সংসারের ঘানি টানতে টানতে যে নিজেকে , নিজের ভালোবাসাকে কবে অদৃষ্টের হাতে বিকিয়ে দিয়েছি, টেরও পায়নি। সে যাইহোক প্রিয় বান্ধবী , তোর সাথে আর কোনোদিন হয়তো দেখা হবেনা, আর চাইবো দেখা না হোক, শুধু তোর সুখ চাইবো।
ছোট প্যাকেটটাতে সেই ঘাসের আংটিটা আছে। তুই সেদিন ফেলে দেওয়ার পর কুড়িয়ে রেখেছিলাম। আজ সেটাই দিচ্ছি তোকে উপহার হিসেবে। পুড়িয়ে ফেলে দিস,মুছে দিস পৃথিবীর বুক থেকে।"
ইতি
বেকার/ দোকানের কর্মচারী।