দশ মিনিট
দশ মিনিট
ছোট ছোট টুনি লাইটের আলোয় আলোকিত রায় বাড়িটা অনুরাধার মুখের মিষ্টি হাসিতে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।
অনুরাধা, নামে রাধা কথাটা থাকলেও দেখতে রাধার থেকে পুরোপুরি উল্টো। এর জন্য ছোটবেলা থেকে কম কথা শুনতে হয়নি রাধা কে। স্কুলের বন্ধুরা থেকে শুরু করে কলেজে এমনকি চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে তাকে শুনতে হয়েছে...
" সব ঠিক আছে শুধু গায়ের রংটা...!"
হ্যাঁ দেখতে অনুরাধাকে সুন্দর হলেও দোষ একটাই যেও কালো। রাধার মতো সুন্দর ,উজ্জ্বল গায়ের রং নয় ওর।
তাই বলে কি জীবনের হার মেনে নেবে? না একদমই না। অনেক চেষ্টার পর একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি পেলে রাধা। যে টাকা উপার্জন করতো তা দিয়ে বাবা-মার সাথে সংসারটা বেশ ভালভাবেই চলে যেত।
কিন্তু এভাবে আর চলে কদিন ...এবার সেই সময় এলো ...যখন বাড়ির লোকের থেকে পাড়া-প্রতিবেশীর মাথাব্যথা বেশি হয়.... হ্যাঁ রাধার বিয়ে। প্রতিবেশীদের চাপে শেষমেষ রাধার পাত্র দেখা শুরু হয়। ক্রমে ক্রমে অনেক পাত্র আসে দেখে আর চলে যায়। সবার একটাই সমস্যা 'গায়ের রং' । শেষে সবাই হাল ছেড়ে দেয় আর রাধাও নিজের বিয়ের আশা ত্যাগ করে দেয়।
এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর ফেসবুকে রাধার সাথে একটি ছেলের পরিচয় হয়, ঋষভ।
এখানে একটু ঋষভ এর পরিচয় দি,
ঋষভ চৌধুরী, আঠাশ বছর বয়সী একটি আই টি আই কোম্পানিতে নিযুক্ত কর্মচারী।
রাধার সাথে পরিচয় হওয়ার পর ওদের প্রথমে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়। তারপর সেই বন্ধুত্বের সাগর আরো গভীর হতে হতে ভালবাসার রূপ নেয়।
ঋষভ এর মানসিকতা আজকালকার ছেলেদের থেকে অনেকটাই আলাদা । রাধাকে সে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেয় আর একেবারে বাড়িতে এসে পাকা কথা বলে বিয়ের দিনও ঠিক করে যায়।
নিমেষেই যেন রাধার জীবনে আনন্দের জোয়ার নেমে আসে। যে রাধাকে শুধুমাত্র গায়ের রং এর জন্য একদিন চাকরি দেওয়া হয়নি সেই রাধা আজ স্বাবলম্বী হয়ে নিজের পছন্দের মানুষের সাথে বিয়ে করতে চলেছে।
* * * * * * * * * * * * * * * *
আজ অনুরাধার পুরো বাড়ি ছোট ছোট লাল, নীল, হলুদ, সবুজ টুনি লাইটের আলোয় ঝলমল করছে, তার থেকেও বেশি ঝলমল করছে অনুরাধার মুখের মিষ্টি হাসিটা।
গোধূলি লগ্নে বিয়ে ঠিক হওয়ায় বিকেল পাঁচটার মধ্যে অনুরাধা কনের সাজে রেডি। ওদিকে বিয়ের মন্ডপে সব নিমন্ত্রিত অতিথিদের আনাগোনাও শুরু হয়ে গেছে। সকাল থেকে বাড়িতে আত্মীয় স্বজনদের ভিড় লেগেই রয়েছে ,সাথে আছে চা,কফি আর ফুচকার স্টল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে সানাই এর আওয়াজ আর লোকজনের সমাহারও বেশ জোরালো হতে শুরু হয় । অবশেষে বর আসার সময় হয়।
কিন্তু একি...! বর তো আসেনা। ক্রমে লগ্ন পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে পুরোহিত মশাই তাড়া দিতে শুরু করে। আর এদিকে নিমন্ত্রিত অতিথিরা গুজগুজ ফুসফুস শুরু করে দেয়....
---- "তাইতো ভাবি ও মেয়ের সঙ্গে অমন রাজপুত্তুরের বিয়ে হয় নাকি কখনো ..! নিশ্চয়ই প্রথমে ওর আসল রূপটা দেখেনি তাই বিয়েতে রাজি হয়ে গেছে এখন সত্যিটা জেনে গেছে হয়তো তাই...."
----" হ্যাঁ গা হ্যাঁ। যা বলেছ , তা নাহলে অমন মেয়ের কখনো বে হয় ..?"
পাশের ঘরে বসে সমস্ত টা শুনতে আর বুঝতে পারে অনুরাধা। তবে সত্যিই কি অনুরাধা অভাগা ? ওর জীবনের আনন্দের জোয়ারটা এই ভাঁটার পূর্বাভাস ছিল..? ভাবতে ভাবতে বাম চোখের কোণা থেকে একফোঁটা অশ্রুকণা রাধার গাল বেয়ে লাল পেড়ে বেনারসিতে এসে পড়ে, একটার পর একটা পড়তেই থাকে।
প্রায় দশ মিনিট পর বরের গাড়ি ঢোকে। সব মেয়ে বউরা শঙ্খ ধ্বনি ও উলুধ্বনির মাঝে বরণ করে বরকে ঘরে তোলে।
আসলে আসার পথে বরের গাড়ির টায়ার পাংচার হয়ে গেছিল। তাই সেটা সারাই করে আসতে আসতে ঋষভ এর দশ মিনিট দেরি হয়ে গেল।
'শেষ ভালো যার সব ভালো তার ' -- বলে সবাই এবার বিয়েতে মনোনিবেশ করে। এবার সময় আসে কনেকে আনার,মুখে পান পাতা দিয়ে হবে রাধার প্রবেশ।
রাধার মা বারবার ডাকার পরও রাধা দরজা খুলছে না দেখে তার বাবাকে ডেকে আনে। এরপর বাবা-মা ও বাকিরা তাকে একশবার ডাকার পরও ভিতর থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় দরজা ভাঙা হয়। দরজা ভাঙ্গার সাথে সাথে রাধার বাবা দেখে রাধার বেনারসির আঁচলটা সিলিং ফ্যান থেকে লম্বা হয়ে নেমে এসে জড়িয়েছে রাধার গলার ফাঁস হিসেবে। সোনার গয়না দিয়ে মোড়া রাধার শরীরটা অচেতনভাবে পাখার সাথে ঝুলে আছে। আলতা মাখা পা দুটো মৃদুভাবে দুলছে।
সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে এবার। আর রাধাকে শুনতে হবে না যে ও 'কালো' .... কারণ কালো মেয়ের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই... সবার মুখ বন্ধ করে দিয়ে রাধা যাত্রা করেছে কোন এক নতুন অজানাতে .....যেখানে কালোরা মেয়েরাও বাঁচতে পারে তাদের ও সম্মান আছে।
কিন্তু শুধুমাত্র যদি বরের গাড়ি টা আরো দশ মিনিট আগে ঢুকতো হয়তো রাধাকে আজ এই পদক্ষেপ নিতে হতো না। হয়তো সে বিয়ে করে সুখে জীবন যাপন করতে পারত।
শুধু মাত্র এই দশ মিনিট রাধার জীবন নিয়ে নিল।

