চির প্রতীক্ষা
চির প্রতীক্ষা
-রাই দিদি? তুমি এখানে? এই ভোরে ছাদে একা একা দাঁড়িয়ে কী করছ?
- খুব অস্বস্তি লাগছিল, তাই এখানে এসে দাঁড়ালাম।
- এখানে এসেও কি স্বস্তি পেয়েছো তুমি?
- মানে? কী বলছিস তুই? আমি তোর কথা কিছুই বুঝতে পারছিনা তুলি!
-কিছু না। মনে আছে আজ তোমার এন্ট্রান্স এক্সাম?
- ও! হবে হয়তো, আমি কী করব?
- আমি কি করব মানে! তুমি এক্সাম দিতে যাবে না?
- না।
- কেন?
- কী করব এক্সাম দিয়ে? তাছাড়া নার্সিং- এর চাকরিটা তো পেয়ে গেছি। যা হোক কিছু একটা করে নিজের খাবার জোগাড় করলেই তো হল ।
- নিজের খাবার জোগাড়! কী খাও তুমি? আজ ছ'মাস হয়ে গেল সকালে জল-মুড়ি আর দুপুরে নুন ভাত ছাড়া কিছু মুখে দিয়েছো তুমি?
- না। বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু দরকার ততটা খেলেই তো হল।
- বেঁচে আছো তুমি? একে বেঁচে থাকা বলে রাই দিদি ? দেখো, সোনা দিদি আমার, যাও আজ এক্সামটা দিয়ে এসো। কত সম্মান, কত ভালো একটা পরিচয় তোমার জন্য অপেক্ষা করছে । একটা নতুন জীবন পাবে তুমি! আমার কথাটা শোনো।
- চাইনা আমার সম্মান, চাই না পরিচয়, চাই না নতুন জীবন, আমি এই বেশ ভালো আছি। সকাল হতে চলল, মা উঠে পড়বে একটু পর, এই ঠান্ডায় তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস দেখতে পেলে চিৎকার করবে। যা ঘরে যা।
- তুমিও চল। তোমার সঙ্গে সব সময় থাকার জন্য, তোমার মন ভালো করার জন্য পিসিমনি আমাকে ডেকেছে। এখন তুমি এরকম করলে আমি কী করি বলতো?
- মা বুঝবে না রে আমার অবস্থাটা। শুধু মা কেন কেউ বুঝবে না । আমার ভেতরটা জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। বেঁচে থাকা জীবনের ধর্ম, তাই জোর করে বেঁচে আছি। কেউ বুঝবি না রে, তোরা কেউ বুঝবি না!!
2
-রাই?
- বলো মা?
- আজ পরীক্ষা দিতে যাবি না?
- না।
রাই-এর মা রাই-এর পাশে বিছানার উপর বসল, মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল - কেন মা? কেন অমন করছিস? যা হয়েছে ভুলে যা মা।
-সম্ভব নয় মা।
- কেনো সম্ভব নয়?
- সূর্যের আলো ছাড়া দিন হওয়া যেমন সম্ভব নয় , আমার পক্ষেও সব কিছু ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করা সম্ভব নয়।
কিছুক্ষণ রাই চুপচাপ তার মায়ের কাছে বসে রইল। -আমি একটু বেরোচ্ছি মা।
-কোথায় যাবি? একেই শীতকাল, তার উপর আজ সকাল থেকে মেঘ করে আছে। কোথায় যাবি তুই এই সময়?
- জানি না, ঘরে থাকতে ইচ্ছে করছে না। এমনি একটু ঘুরে আসি।
-একা একা এরকম ভাবে বাইরে বেরোস না মা! কতরকম বিপদ হতে পারে জানিস ?
- আমি রাস্তা পারাপার হতে জানি মা। চিন্তা করো না।
- শুধু রাস্তা পারাপার হওয়ার জন্য নয়, কতরকমের বাজে নোংরা ছেলে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে।
- কী হবে মা? তারা আমার কী করবে? আমার শরীরটাকে ছিঁড়ে খাবে বড়ো জোর, এর বেশি আর কী করবে?করলে করুক আমার কিছু এসে যায় না
– কেন রাই? তোর সম্মান রাখতে চাস না?
- না, কোনো ইচ্ছে নেই। কী করব সম্মান রেখে, কার জন্য
সম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচবো? আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমি বেরোচ্ছি মা। আসছি।
- দাঁড়া ,এইরকম নোংরা জামাকাপড় পরে, চুলটা পর্যন্ত ছাড়াসনি, এরমভাবে বাইরে বেরোবি ?
-হ্যাঁ।
আর কোনো কথা না বলে রাই বেরিয়ে গেল। রাই-এর মা বিছানার উপরেই পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল। আর চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল।
রাই হাঁটতে হাঁটতে তাদের বাড়ি ছাড়িয়ে অনেকটা দূর চলে এসেছে। চারিদিক অন্ধকার করে এসেছে। এক্ষুনি বৃষ্টি নামল বলে। তাই রাস্তায় লোকজনের চিহ্নমাত্র নেই। রাই এক দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে হেঁটে চলেছে।
দিনটা ছিল রবিবার। তুমুল বৃষ্টি সেদিন। রাই-এর বাবা মা, তার মামাবাড়িতে ছিল। বৃষ্টির জন্য বাড়ি ফিরতে পারেনি তারা। রাই ঘরে একা। দুপুর বেলা রাই গল্প বই পড়ছিল সোফায় শুয়ে শুয়ে। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ার শব্দ শোনা যায়। রাই গিয়ে দরজা খোলে- ঈশান! তুই! এখানে এখন?
ঈশান কোনো কথা না বলে ঘরের ভিতর ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিল। তারপর রাই এর কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে কাছে টেনে বলল - কেন কোনো প্রবলেম আছে?
- না প্রবলেম নেই, কিন্তু..
- চিন্তা করিস না আমি কাকীমাকে জানিয়েই এসেছি, তাছাড়া আমাদের তো বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে , এখন আর প্রবলেম কোথায়?
- ও... আচ্ছা। বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে কিন্তু বিয়ে তো এখনও হয়নি মশাই।
- বেশ তো, চল আজই বিয়ে করে নিই।
- আজই মনে?!!
- মনে এক্ষুনি । তাহলে আর কোনো প্রব্লেম থাকবে না নিশ্চয় ।
- বাজে বকিস না। তুই পুরো ভিজে গেছিস, যা জামাটা বদলে নে আগে।
- অগত্যা। ঈশান জামাটা বদলাবার জন্য ভেতরের রুমে যাবে এমন সময় রাই ছুটে গিয়ে পিছন দিক থেকে ঈশানকে জড়িয়ে ধরে।
-এই পাগলি মেয়ে, হলো টা কী?
- কিছু না।
-দাঁড়া আমি জামাটা বদলেনি আগে।
- না। তোকে কিছু করতে হবে না।
- মানে?
রাই ঈশান-এর জামার বোতাম খুলে জামা খুলে ফেলে। ঈশানকে সোফার উপর বসিয়ে তার কোলের উপর বসে। তার গালে চুমু খায়, তার পর গলায়, ঘাড়ে। ঈমান ও রাইকে আদর করতে থাকে। তারা একে অপরের মধ্যে মিশে যেতে থাকে। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি আর দরজা, জানলা বন্ধ একটা ঘরের মধ্যে দুই নির্মম আত্মার অমর প্রেমগাথা রচিত হয়। অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। রাই আর ঈশান একটা চাদরের নীচে বস্ত্রহীন অবস্থায় একে অপরকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে।
- একি রাই ? তোর চোখে জল কেন?
- কিছু না, এমনি।
- বল, বল আমায়? কী হয়েছে আমার পাগলিটার?
- তুই আমাকে ছেড়ে কখনোও চলে যাবি না তো ঈশান ?
- কোথায় যাব আমি? আমার মন মন প্রাণ শরীর সব নিয়ে বসে আছিস তুই। তোকে ছেড়ে কোথায় যাব আমি?
- জানিনা। বড্ড ভয় করে রে। তুই চলে গেলে আমি শেষ হয়ে যাব। তোকে ছাড়া আমি মরে যাব।
- দূর পাগলি মেয়ে। এমন কথা বলতে নেই।
এই যে ম্যাডাম, দেখে হাঁটুন! এক্ষুনি তো অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যেত!
-সরি, দাদা। বুঝতে পারিনি।
রাই দেখে সে অনেক দূর চলে এসেছে। এখনও মেঘ সেরম অন্ধকার করেই আছে। একবার ভাবল বাড়ি ফিরে যাবে। কিন্তু বাড়ি না ফিরে সে আবার সামনের দিকেই হাঁটতে লাগল।
ছ'মাস আগে একদিন সন্ধ্যেবেলায় ঈশান, রাইদের বাড়িতে এসেছিল। রাই এর মা ঈশান-এর জন্য চা বানাতে রান্নাঘরে গেছে। বাড়িতে আর কেউ ছিল না।ঈশান সেই সুযোগে রাই কে জড়িয়ে ধরেছে।
- কী হচ্ছে ঈশান? মা এক্ষুনি চলে আসবে। দেখলে কী ভাববে বলত?
- কি আবার ভাববে? আমি আমার বউকে একটু আদর করতে পারবো না? অত ভয় কীসের?
- তাই? ভয় করছে না বুঝি?
- না, মোটেও না।
রাই এবার ঈশান এর ঠোঁটের উপর ঠোঁট রেখে চুমু খেতে লাগল, ওদিকে কিছুক্ষণ পর ঈশান বুঝতে পারল কাকীমা আসছে। সে রাই-এর কাছ থেকে সরে যেতে চাইল। কিন্তু রাই তো তাকে কিছুতেই ছাড়ছে না, সেই অসমাপ্ত চুম্বন যেন শেষ হবারই নয়। তারপর রাই একসময় ছেড়ে দেয়। রাই-এর মা তারপরই ঘরে ঢোকে। রাই-এর মা ঈশানকে দেখে জিজ্ঞাসা করে - কী হল ঈশান? এত হাপাচ্ছো কেন?
- ও কিছু নয় কাকীমা, আমি আর রাই দুজনেমিলে একটা খেলা খেলছিলাম কিনা।
- খোলা! ওই কী খেলা ?
- কে কতক্ষণ নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখতে পারে।
রাই এর মা হাসতে হাসতে বলেছিল- তোমাদেরও যেমন, বুঝিনা বাবা।কিছুদিন পর বিয়ে করবে আর এখনও ছেলেমানুষী গেলো না। নাও চা টা খেয়ে নাও।
- ঈশান আড় চোখে দেখল তার অবস্থা দেখে রাই মুখ নামিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। ঈশান-এর অভিমান হয় রাই-এর উপর। ঘন্টা খানেক পর যাই ঈশান বাড়ি ফেরার জন্য রাই-এর ঘর থেকে বেরোতে যাবে এমন সময় রাই ঈশানের হাতটা টেনে ধরে বলে – অভিমান হয়েছে আমার উপর? কথাটা বলেই রাই গিয়ে ঈশানকে জড়িয় ধরে।
ঈশান রাই-এর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে- এত দুষ্টু কেন তুই ? সারাক্ষণ দুষ্টুমি করিস। আমার পাগলীটা। চল, আমারে এবার বেরোতে হবে। আমি আসি ?
- এবার করে আসবি?
- জানিনা। দেখি, যখনই সময় পাব ছুটে তোর কাছে চলে আসব। বুঝলি ?
- কথা দে আসবি।
- আচ্ছা বাবা, কথা দিচ্ছি আসব আমি তোর কাছে।
ঈশান বেরিয়ে যাওয়ার প্রায় দুঘন্টা পেরিয়ে যায়। ঈশান পৌঁছে সাধারণত ফোন করে দেয়। তার বাড়ি রাই-এর বাড়ি থেকে ঘন্টা খানেকের রাস্তা। তাই ঈশান-এর বাড়ি পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে তখনও ফোন করেনি। এদিকে রাই-ফোন করে যাচ্ছে। বার বার রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে। দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছিল রাই। আরও প্রায় আধ ঘণ্টা কাটে। তারপর ঈশান-এর বাড়ি থেকে ফোন আসে। তারা জানায় ঈশান-এর রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সেখানেই মারা যায় ঈশান।
3
রাই একটা নদীর ধারে এসে বসেছে। শীতকালে নদীতে জল খুব কম। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও পড়তে শুরু করেছে। রাই নদীর জলের দিকে তাকিয়ে আছে। নদীর জল, পাড়ে পড়ে থাকা বালি কণাগুলোকে প্রতিমুহূর্তে কথা দিয়ে যাচ্ছে- সে ফিরে আসবে। কিন্তু বাস্তবে এমনটা হবে না কোনোদিন। বয়ে যাওয়া নদীর জল উৎস স্রোতে ফিরবে না আর কোনোদিন।
ঈশান মারা যাবার পরও, ওর ওই মুখটা দেখে মনে হয়নি যে ও মারা গেছে। ওর সেই সুন্দর মুখ, স্নিগ্ধ দুটো চোখ যেন তখনও প্রানবন্ত । রাই ঈশান-এর মৃতদেহ আকড়ে বসেছিল অনেকক্ষণ। তাকে নিজের কাছে রেখে দেওয়ার জন্য খুব লড়াই করেছিল, কিন্তু পারেনি। তার কাছ থেকে ছাড়িয়ে ঈশানকে নিয়ে চলেগিয়েছিল।
ঈশান-এর চলে যাওয়ার পর থেকে রাই-এর চোখ দিয়ে এক ফোঁটাও জল গড়ায়নি। সে জানে ঈশান আর ফিরবে না কোনোদিন, তবুও আশা করে, সে একদিন ফিরে আসবে, তাদের বিয়ে হবে, সংসার করবে। এটা আশা নাকি তার অভিশপ্ত ভবিষ্যৎ সে নিজেও জানেনা। জানতে চাই-ও না। শুধু সে এটুকু জানে তার হারাবার মতো আর কিছু নেই, নতুন করে পাবার মতোও কিছু নেই। শুধু নিশ্বাসে, নিশ্বাস চেপে বেঁচে থাকার লড়াই তার।
বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বড়ো হতে শুরু করেছে, কিছুক্ষনের মধ্যেই অঝোর বৃষ্টিতে চারিদিক ধোঁয়ার মতো হয়ে গেল। নদীর পাড়ে স্থির হয়ে বসে থাকা একটা মেয়ে ক্রমশ ঝাপসা হয়ে গেল।