STORYMIRROR

Dipanwita Kundu

Romance

4  

Dipanwita Kundu

Romance

রাহি

রাহি

8 mins
20

-আজ বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। মা বলেছে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে। যা বলার আছে তাড়াতাড়ি বলো। 

- তুই এখনি চলে যা, তোকে আমি আসতে বলেছি নাকি নিজেই তো আমাকে ফোন করে ডাকলে, নইলে এত কাজের মাঝে কে আসে !  

-বেশ আমার ভুল হয়ে গেছে ; তুমি তোমার কাজ নিয়ে থাক আমি চললাম।

-বাব্বা, এত রাগ! তা কাল থেকে এই রাগ কাকে দেখাবি

শুনি?

- রাগ কেন করতে যাব ? রাগ আমি তার উপরই করি যে

আমার....

- যে তোর ... ? ওহ... তুই তার কথা বলছিস, যাকে তুই এখনও পর্যন্ত তোর মনের কথাটা বলতেই পারলি না ?

আমি আর বীভানের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না । ওর চোখের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে মুখটা নিচের দিকে করে বললাম - হুম্।

-কাল তো তুই প্যারিস চলে যাচ্ছিস, যাবার আগে একবার তাকে সব কথা বলেই দে না ?

- না, সে অন্য কারোকে ভালোবাসে। সে অন্য কারোকে নিয়ে ভালো আছে। আমি কেন বলবো তাকে? তাছাড়া সে ভালো থাক, আমি শুধু এটাই চাই। আর কিছু না। 

- তাহলে তুই নিজের পরিবার, আপনজন সকলকে ছেড়ে এত দূরে কেন চলে যাচ্ছিস? শুধু মাত্র ওই একটা মানুষের জন্য সকলকে কেন কষ্ট দিচ্ছিস?

-আমি করোকে কষ্ট দেওয়ার জন্য যাচ্ছিনা। আমি আমার জীবনটাকে নিয়ে আনার নতুন ভাবে বাঁচতে চাই, আমি এখানে থাকলে মনে যার বিভান! তাছাড়া প্যারিসের এত ভালো একটা কলেজে যখন অ্যাডমিশন পেয়েছি তখন সেই সুযোগ আমি হারাতে চাই না।

-হুম, বুঝলাম। চলনা পুকুর পাড়ে ওই বট গাছটার তলায় গিয়ে বসি? চারিদিকটা বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে ।

- হ্যাঁ, চলো।

কাল আমি এত দূরে চলে যাচ্ছি বিভান, অথচ তোমার মনে লেস মাত্র দুঃখ নেই ! আমার জন্য তোরার মনে কোনো কষ্ট নেই, কোনো অনুভূতিই নেই। এর পরও আমি কীভাবে বলবো যে আমি তোমায় ভালোবাসি? তাই তো আমি এত দূরে চলে যাচ্ছি। তোমার সামনে আমি আর থাকতে পারবনা। আমি ভেঙেচুরে শেষ হয়ে গেছি।

-কী রে, দীপাসা? কী এত ভাবছিস ? কথা বলছিস

না যে?

-না, তেমন কিছু না। তারপর, তোমার রাহি কেমন আছে? - হ্যাঁ, ভালোই আছে, মেয়েটা বড্ড জেদি। এত অভিমান কলে যে, কী বলব!

-তার অভিমান ভাঙানোর জন্য কোনো মানুষকে কাছে পেয়েছে বলেই তো অভিমান করে। ওটাকে অভিমান বলে ধরো না, ওটা কাছে তোমাকে আরও কাছে পাওয়ার অভিনয় ।

-হবে, হয়তো।

- বিয়ে কবে করছো?

- রাহি যেদিন রাজি হবে।

– তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছো বুঝি?

- না।

- তবে?

– এখনও আপাতত বিয়ের কথা ভাবিনি। পড়া কমপ্লিট করি তারপর বলব না হয়।

আমি কিছুক্ষন চুপ থেকে বললাম – ততদিনে সে যদি অন্য কারোর হয়ে যায় ?

- হবে না।

- বাব্বা! এত কনফিডেন্স ?

-হ্যাঁ, সে শুধু আমার, আমার একার। আর কারোর না।

- যাক, তাও ভালো।

-হুম, তখন থেকে তুই শুধু আমার আর রাহির কথা বলে যাচ্ছিস। নিজের কথা বল এবার। তোর মনের মানুষের

নামটা অন্তত বল।

- কী করবে তার নাম জেনে ?

- কী আবার করব? তুই যখন এখানে থাকবি না; তখন তার সাথে যোগাযোগ করে সে কেমন আছে, কি করছে, সেটা তোকে জানিয়ে দেবো।

-কোনো দরকার নেই। আমি তাকে ভুলে যেতে চাই। তাছাড়া আমি তোমার নম্বরও ডিলিট করে দিয়েছি আমার ফোন থেকে। 

- আমার নম্বর ও .....! কেনরে, আমি আবার কী করলাম? - না তুমি কিছু করোনি, কিন্তু আমি তোমার সাথে আর যোগাযোগ রাখতে চাই না। 

- তুমি রাহিকে নিয়ে ভালো থাকো। 

- সে না হয় বুঝলাম; কিন্তু আমার সাথে যোগাযোগ না

রাখার কী আছে ?

-ছাড়ো না, আমার এসব কথা বলতে ভালো লাগছে না।

- না তোকে বলতেই হবে। তুই হটাৎ আমার সাথে এমন কেনো করছিস? আমি কি কিছু অন্যায় করেছি তোর সাথে? বা আমার কোনো কাজে তুই কি কষ্ট পেয়েছিস?

- বিভান, তোমার ড্রইং-এর কাজ এখন কেমন চলছে? 

- দেখ তুই কিন্তু কথাটা এড়িয়ে যাচ্ছিস। বলনা আমাকে কেনো এমন করছিস?

- তোমাকে যেটা জিজ্ঞেস করলাম সেটা বলোনা?

- তিন মাস আগে একটা এঁকেছিলাম, তার পর থেকে

আঁকার মতো আর কিছু মনেই ধরেনি।

- কী ছিল? ল্যান্ডস্ক্যাপ ভিউ? নাকি পোর্ট্রেট ভিউ ?

- পোর্ট্রেট ভিউ।

- কার ছবি এঁকেছিলে?

- রাহির।

-বাহ, ভালো। আমি বিভানের কথাগুলো আর সহ্য করতে পারছি না, খুব কষ্ট হচ্ছে , রাহির কথা শুনে মাথার মধ্যে যেনো আগুন জ্বলে যাচ্ছে আর বুকের ভেতরে একটা চাপা কষ্ট হচ্ছে - সন্ধ্যে হয়ে গেলো বুঝলে। অন্ধকারে এভাবে দুজনে পুকুর পাড়ে একা একা বসে থাকা ঠিক হবে না। চলো বাড়ি ফিরে যাই।

- আকাশে পূর্ণ চাঁদ। জলে তার পূর্ণ প্রতিফলন। অন্ধকার কোথায়? আর এত গাছ পালা, আমি; তার পরও

নির্জন কোথায় ?

- কাল সকাল ৮টার মধ্যে আমাকে বেরোতে হবে , অনেকটা জার্নি আছে। আজ একটু রেস্ট নিই ঘরে গিয়ে।

- গোছগাছ সব হয়ে গেছে ?

-হ্যাঁ।

 - প্যারিসে সব ঠিকঠাক করা আছে তো? কোনো অসুবিধায় পড়তে হবে না তো সেখানে গিয়ে?

- না। কোনো অসুবিধে হবে না, আমার বাবার পরিচিত একজন ওখানে থাকে, ওই একই কলেজে পড়ে। ওই সব ঠিক করে রেখেছে।

- আচ্ছা তুই যে আমার নম্বর ডিলিট করে দিয়েছিস, আমাকে দেওয়া তোর সব কথা কি তুই ভুলে গেলি তাহলে?

-ভুলবো কেন ? তোমাকে সবসময় সব বিপদ থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমি নিয়েছিলাম । কিন্তু এখন আর তার প্রয়োজন নেই।

– কেন নেই?

-তা বলতে পারব না। প্রয়োজনের থাকলেও বলতে পারো অধিকার নেই।

-তা, তোর অধিকার কে কেড়ে নিল?

- এসব বাজে বকতে আমার আর ভালো লাগছে না।

- হ্যাঁরে দিপাসা? কী হয়েছেরে তোর? কেনো এমন করছিস?

- বললাম তো বাজে বকতে আমার ভালো লাগছে না।

- বেশ্। তুই কী চাস বল? 

- আমাদের তিনমাসের পরিচয়। আমি কীই বা চাইতে পারি তোমার কাছে? তাছাড়া আমি যা চাই তা তুমি কি দিতে পারবে ?

বিভান এবার আমার হাতটা তার হাতের মধ্যে রেখে বলল – বলেই দেখনা একবার। 

- আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। তার হাতের মধ্যে থেকে আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম তার থেকে। নইলে এই আলতো চাঁদের আলোতেও সে আমার চোখের জল স্পষ্ট দেখতে পেত। - - কীরে মুখ ফিরয়ে নিলি যে?

– বেশ। কিছু দিতেই যখন চাও, তখন একটা গান শোনাও না!

- গান ? !

– কেন? তুমি তো মাঝে মাঝে গান গাও। আজ আমার জন্য একটা গান শোনালেই বা!

- ঠিক আছে। কিন্তু আমি ভালো গাইতে পারিনা আগেই বলে রাখছি।

 - আমি তোমার খারাপটাই শুনতে চাই।

বিভান রবিঠাকুরের একটা গান ধরলো- " আমার মল্লিকা বনে যেদিন প্রথম ধরেছে কলি

আমার মল্লিকা বনে....."

গানটা শেষ হবার পরও সুরতরঙ্গ গুলো যেন অসীম থেকে ছুটে এসে আমার হৃদস্পন্দনকে থামিয়ে দিতে চাইছে। আমি আর কোনো কথা বলতে পারলাম না। অবশেষে বিভানই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- চল। এবার ফিরে যাই তবে?

-হ্যাঁ, চলো,

- আমি উঠে পড়তেই বিভান আমার ডান হাতটা ধরে বলল - আজ আমায় একটা কথা দিবি?

- বলো, কী কথা?

- রাহির সাথে যেদিন তোর দেখা হবে, সেদিন থেকে তুই

আমাকে ভুলে যাবি। 

- মানে?!! এটা কি সম্ভব নাকি ? কারোর সাথে পরিচয়

করা মানে কি কারোকে ভুলে যাওয়া?

-না তা নয়। তবে...

-তবে কী?

-হয়তো তুই আমার কাছ থেকে আমার রাহিকে কেড়ে নিতে পারিস তাই।

- তুমি আমাকে এই চিনেছ?

আমার খুব রাগ হলো কথাটা শুনে তারপর নিজেকে কিছুটা শান্ত করে বললাম- চিন্তা করো না, আমি সেরকম কিছু করব না। কিন্তু আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না, এখানে তোমাকে ভুলে যাওয়ার কথা আসছে কেন? - - কারণ আমি তোকে আর কোনো কষ্ট দিতে চাই না।

-তাহলে আছে এটা মেনে নিচ্ছো যে, তুমি আমায় কষ্ট দিয়েছো? 

- হবে হয়তো।

বিভান যে কি বলে যাচ্ছে, ওর কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না– আমি তোমাকে ভুলে যাব এই কথাটা দিতে পারছিনা, কারণ মনের উপর আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি। তবে তোমার রাহির সাথে পরিচয় হবার পার তোমার সামনে আর কোনোদিন আসব না, এই কথাটা দিচ্ছি।

- যাক, নিশ্চিন্ত হলাম ।

-তা কালই তো আমি চলে যাচ্ছি; তোমার রাহির সাথে কখন পরিচয় করাবে ?

- সেটা এখন সময়ের অপেক্ষাতেই থাক।

- বেশ, তবে তাই। চলো এবার ফিরতে হবে ।

                      2

 এই মাত্র কলকাতা এয়ার্পোটে এসে পৌঁছালাম, এখন সকাল আটটা। আমার ফ্লাইট আটটা চল্লিশে। এখান থেকে ব্যাঙ্গালোর, ব্যাঙ্গালোর থেকে সোজা প্যারিস। আমাকে ছাড়তে বাবা, মা আর বিভান এসেছে। ওহ! বলাই হয়ে ওঠেনি-বিভান আমার সিনিয়র, আমার থেকে বছর তিনেকের বড়ো। মা-বাবার সাথেই আগে ওর পরিচয় হয়েছিল কোনো একটা বিয়ে বাড়িতে বোধ হয়, তারপর আমার সাথে বন্ধুত্ব। যাই হোক, এখন থাক সে কথা। পরে যদি কোনোদিন তোমাদের সাথে কথা বলায় সুযোগ হয়, সেদিন বলব।

মা বাবাকে, কোনোমতে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। বিভানের কী একটা কাজের জন্য রয়ে গেল। কী কাজ তা অবশ্য জানায় নি। আজ ওর সাথে একটাও কথা বলতে পারিনি, ওর দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারিনি; কিন্তু এবার কথাটা না বলে আর পারলাম না – আর কবে দেখা হবে জানিনা, তুমি বলেছিলে রাহির সাথে দেখা করার জন্য আমায় সময়ের অপেক্ষায় থাকতে?

- তা, তোর আর ধৈর্য ধরছে না বুঝি? আমাকে ভুলে এ যাওয়াটা তোর জন্য এত জরুরি?

- কোনটা জরুরি আর কোনটা জরুরি নয়, এবার না হয় আমাকেই সেটা বুঝে নিতে দাও। আমাকে এবার যেতে হবে। 

- হ্যাঁ, আর শোন মন দিয়ে পড়া শুনা করিস। নিজের স্বপ্নগুলো পূরণ করার চেষ্টা করিস

- আর কিছু?

- এই নে

বিভান ম্যাগাজিন এর মত কিছু একটা আমার হতে ধরিয়ে দিল।

- এটা কী!?

-ঋত্বিকা।

-হ্যাঁ, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু এই পত্রিকাটা নিয়ে আমি কী করব?

- পত্রিকা নিয়ে লোকে যা করে তুইও তাই করবি। প্যারিসে গিয়ে তো আর এই বাংলা পত্রিকা পাবিনা, তাই এটা রেখে দে তোর কাছে। কখনও বাংলা পড়তে মন গেলে পড়িস। বাংলার শিল্পীদের ছুঁয়ে দেখিস।

- এবার সত্যিই দেরি হয়ে যাচ্ছে। এবার আমি আসি?

বিভান তামার হাতটা ধরে বলল - সত্যিই চলে যাচ্ছিস? বিভানের এই একটা কথা আমার হৃদয়কে এমন ভাবে আঘাত করল যে, মনে হল আমি যেন আমার শরীরের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলেছি। আমার দেহের সমস্ত ভর আমি যেন আমার হাতের মধ্যে দিয়ে ওপর মানুষটির হাতে দিয়ে দিতে চাইছি। তবুও আমি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে কোনোমতে আটকে যাওয়া গলা থেকে স্বর বেরকরে বললাম – আমাকে আটকে রাখার মতো কেউ নেই যে! তুমিও ভালো থেকো। রাহিকে ভালো....

আমার কথাটা শেষ হতে না দিয়েই বিভান আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে চলে গেল।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পার হয়ে গেলো। অনেকক্ষণ আগেই আমি কলকাতা ছড়িয়ে এসেছি। আমার ভেতরে যে কী চলছে, তাই আমি জানি না। কী মনে করে পত্রিকার পাতাগুলো অন্যমনস্কভাবে উল্টেপাল্টে দেখছিলাম। হঠাৎ দেখলাম, পত্রিকার একটা পুরো পাতা জুড়ে আমার ছবি । একদিন বিভানের সাথে একটা বনে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ছবিটা সেখানেরই। সেই রোজি পিংকের চুড়িদারটা, এলোমেলো চুল দিয়ে মুখের খানিকটা অংশ ঢাকা, অফুরন্ত হাসি, বসন্তের হালকা রোদের জন্য আলতো ভাবে ঢেকে যাওয়া আমার চোখের পাতা, ব্যাকগ্রাউন্ডে অস্পষ্ট বসন্তের সবুজ কচি পাতা আর বাহারি ফুল। ছবিটা বিভানের আঁকা।ওই, ওই তো নীচটায় ওর সইও রয়েছে। আর ছবিটার নামের জায়গাটায় লেখা - রাহি। তার নীচেই

বিভাগের লেখা কয়েকটা লাইন -

         মেয়েটাকে সেদিন প্রথম দেখেছিলাম,

             সেদিন ছিল বসন্ত। 

          বসন্তের বাসন্তীকে হার মানিয়েছিল

                তার সৌন্দর্য।

         সেদিন নাম জানা ছিল না তার,

        বসন্ত চুপিসারে এসে বলেছিল- রাহি,

  তারপর পরিচয়, বন্ধুত্ব, হাতের উপর হাত রাখা;

          তার প্রেমিক আছে জেনেও-

       তাকে না ভালোবেসে থাকতে পারিনি।

            তাকে হারাবো জেনেও, 

         তাকে কাছে পেতে দ্বিধা করিনি।

       তাই নিজের এই দুই হাতের প্রয়াসে-

      মনের সমস্ত প্রেম উজাড় করেছি দিয়েছি

                  এই ছবিতে।

            পারলে খোঁজ নিয়ে দেখো

              সে আর কেউ নয়,

               সে আমার প্রেম,

               সে আমার রাহি ।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance