Sila Bhattacharyya

Drama Horror Classics

4.5  

Sila Bhattacharyya

Drama Horror Classics

ভাড়া বাড়ি

ভাড়া বাড়ি

6 mins
261


অনুপ্রেরণা - বদলির চাকরি


চাকরি জীবনে বহু মানুষকেই বহু জায়গায় বদলি হতে হয়। কেউ বা কোয়ার্টার পায়।কেউ আবার নিজেদের পছন্দসই ভাড়া বাড়ি খুঁজে নেয়। কেউ কেউ পরিবার সঙ্গে করে নিয়ে যান। কেউ আবার একাই থাকেন।যাই হোক, এবার আমি আমার গল্পটা বলি।

নিখিলেশ বসাক একজন এক ব্যাংক কর্মী। তিনি বদলি হন চন্দননগরে। সেখানে তিনি সপরিবারে থাকার মত একটি ভাড়া বাড়ি খুঁজছিলেন। পরিবার বলতে ছিল নিজের মা রানু দেবী আর ভাই অপরেশ বসাক। তিনি চন্দননগরে এক আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কলকাতা থেকে চন্দননগর রোজ রোজ ট্রেনে ভিড়ের মধ্যে যাতায়াত করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তাছাড়া শেষ বয়সে কলকাতার দু কামরার পাখির বাসা ছেড়ে মায়ের জন্যও নদীর ধারে একটা বড় বাড়ির ব্যবস্থা করার ইচ্ছে তারও ছিল মনে মনে। 

চন্দননগরে স্থানীয় এক আত্মীয়ের সাহায্যে একটি খুব সুন্দর দু রুমের ভাড়া বাড়ি পেয়ে গেলেন তিনি। বাড়িটা ঠিক যেমনটি তিনি চাইছিলেন প্রায় তেমনি।কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতার পাট চুকিয়ে মালপত্রসমেত মা আর ভাইকে নিয়ে নতুন বাসায় উঠলেন।অফিসও সেখান থেকে বলতে গেলে ঢিল ছোড়া দূরত্বে। ফলে খুব সহজে আর নির্ঝঞ্ঝাটে অফিস সংসার সামলাতে লাগলেন।

এই ভাবেই কেটে গেল কয়েকদিন, কয়েক মাস।

বাড়ির মালিক বাড়ি ভাড়া মাসের প্রথম দিকেই নিতে আসতেন। যাবার সময় নিয়ম করে বলে যেতেন - " আমাদের খুব ভালো লেগেছে আপনাদের।কোনো কিছু প্রয়োজন হলে নির্দ্বিধায় জানাবেন।" আশেপাশের লোকজন কারণে অকারণে মাঝে মধ্যেই প্রশ্ন করতেন - " আপনাদের এই বাড়িটা কেমন লাগছে। " নিখিলেশ বাবু বা বাড়ির বাকিরা প্রত্যুত্তরে বারবারই জানতে চেয়েছে " ভালো কিন্তু কেনো বলুন তো?" সে কথার উত্তর অবশ্য কেউই দেননি। প্রকারান্তরে এড়িয়ে গেছে সকলে।

এভাবেই কেটে যেতে লাগলো দিন। এর মধ্যে হঠাতই একদিন সামনে এলো ভয়ঙ্কর এক রহস্য। একতলা বাড়ি বলে রোজই জানলা দরজা বন্ধ করে ঘুমোতেন বাড়ির সকলে।একদিন হঠাৎ যে ঘরে ভদ্রলোকের মা রানু দেবী আর ছোট ভাই অপরেশ ঘুমোতেন, সেঘরেই গভীর রাতে বন্ধ দরজা ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলো। উঠে বসলেন দুজনেই কিন্তু দুজনের কারুরই শরীরে তখন নড়াচড়া করার মত সার নেই। কিছুক্ষন পর যদিও আওয়াজটা থেমে যায়। সেদিন আর কিছু হলো না। ওনারা কিছুক্ষন অপেক্ষা করে শুয়ে পড়লেন। যদিও ভয়ে আর অস্বস্তিতে দু চোখের পাতা এক করতে পারলেন না রানু দেবী। 

পরেরদিন বড় ছেলেকে জানালেন বিষয়টা। নিখিলেশ বাবু যদিও ব্যাপারটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না। বললেন," কোনো স্থানীয় লোক হয় তো কোনো বদ মতলবে বা ভয় দেখানোর জন্য কিছু করেছে। ও নিয়ে এত ভাবনার কিছু নেই। শোবার আগে চারদিক দেখে জানলা দরজাগুলো ভালো করে বন্ধ করে রাখলেই চলবে।"

সেই মতই ভেবে নিয়ে আশ্বস্ত হলেন দুজনে। রাত হলে কাজকর্ম সেরে শুয়ে পড়লেন সকলে। কিন্তু রাত বাড়তেই সেদিনও আবার আগের রাতের মতই জানলায় আওয়াজ শুনতে পেলেন। তবে তারপরের সময়টুকু আগের দিনের মত যদিও আর নিরুপদ্রবে কাটলো না। সেদিন আওয়াজটা হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই জানলাটা নিজে থেকেই আপনে আপ খুলে গেলো।দুজনের কেউই বুঝতে পারলো না কিছু। ভয়ে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো দুজনে। অথচ চাইলেও কি যেন এক অদম্য আকর্ষণে জানলার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিল না তারা। এমনকি উঠে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করার মত ক্ষমতাও ছিল না কারুর।ওই ভাবেই কেটে গেলো অনেকটা সময়।

পরদিন নিখিলেশ বাবু মা আর ভাইয়ের মুখে সব শুনে ঠিক করলেন বাড়ির মালিক ধ্রুব মল্লিককে জানাবেন সব কিছু। ধ্রুব বাবু যদিও সব শুনে কিছুক্ষন চুপ করে থাকলেন।তারপর আমতা আমতা করে বললেন," কাল তো রাতের দিকে হাওয়া বইছিল। তাই হয় তো অমন হয়েছে। ও কিছু না।" নিখিলেশ বাবুও সেই শুনে ভাবলেন তাই হয় তো হবে। তারপর তিনি নিশ্চিন্ত মনে অফিস চলে গেলেন। 

সেদিন হঠাতই অফিস গিয়ে জানতে পারলেন একদিনের ইন্সপেকশনের জন্য তাকে সেদিনই গুপ্তিপাড়া যেতে হবে। রাজ্য থেকে বড় একটি দল নাকি সেদিনই যাচ্ছে। তাই তাদের সঙ্গ দিতে হবে। নিখিলেশ সেই মত রওয়ানা দিয়ে দিলেন। সেখানে কাজ শেষ হতেই রাত হয়ে গেলো অনেক। বাড়িতে জানিয়ে দিলেন তার পক্ষে অত রাতে আর বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়। পরদিন সকালে ফিরবেন। সেই সাথে এও পইপই করে ভাইকে বলে দিলেন যেন বাড়ির দরজা জানলা বন্ধ করে ঘুমোয়। নতুন জায়গা। চোর ছ্যাচোরের নজর পড়লে বিপদ।

রানু দেবী আর অপরেশ সেদিন রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লেন। শোবার আগে দরজা জানলায় ছিটকিনি তো দিলেনই ,সেই সাথে আবার কড়াগুলোকেও বেঁধে দিলেন দড়ি দিয়ে । যাতে হাওয়া জোরে বইলেও না খুলে যায়।

সেদিন রাতে বেশ কিছুক্ষণ শোবার পর হঠাতই জানলাটা দড়ি সমেত খুলে যায়।রানু দেবী ধরমর করে উঠে বসলেন বিছানায়। তার মনে হল জানলায় যেন কে একজন দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত কোনো পুরুষ মানুষ। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। রানু দেবী শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে চিৎকার করে উঠলেন, " কে? কে ওখানে?" তারপর অন্ধকারে হাতরে কোনো মতে বালিশের পাশে রাখা টর্চটা হাতে তুলে নিয়ে সোজা জানলার দিকে তাক করে জানালেন। তীব্র আলোয় ভেসে গেলো জানলার বাইরের অনেকটা অংশ। সেই আলোতে তিনি দেখলেন,কেউ নেই সেখানে।

তবে শুধু সেই দিন নয়, এই ভাবেই কেটে যেতে লাগলো একের পর এক আতঙ্কের রাত্রি। কখনো মনে হত কেউ যেন পাশ কাটিয়ে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে, কখন হাওয়া বাতাস ছাড়াই দরজা জানলা ঠকঠকিয়ে কাঁপত। বাড়ির মালিককে বারবার জানিয়েও কোনো সুরাহা হচ্ছিল না। ধ্রুব বাবু প্রতিবারই শুনে বেশ অবাক হবার ভান করতেন। মনে হত যেন জীবনে প্রথমবার এমন কিছু শুনছেন। উল্টে ওনাদের বোঝাতেন, এসবই মনের ভুল। উপদেশ দিতেন," তেমন হলে নয় জানলা থেকে একটু দূরে বিছানা পেতে শোবেন।"

সারা দিন কোনরকমে কেটে যেত। রাত হলেই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতেন সকলে। নিখিলেশ বাবু ঠিক করলেন এবার থেকে রাতের বেলাও আলো জ্বালিয়ে শোবেন।তাতে ঘুমোতে একটু অসুবিধা হলেও মনের মধ্যে চেপে বসে থাকা অস্বস্তি কমবে অনেকটা। সেই মত কিছুদিন আলো জ্বালিয়েই ঘুমালেন সকলে। বেশ নিরুপদ্রবেই কিছু রাত কেটে গেলো। তিন জনেই ভাবলেন বিপদ বুঝি কেটে গেছে। কিন্তু ভুল ভাঙতে সময় লাগলো না বেশি।

সেদিন ছিল অমাবস্যা। মাঝ রাতে হঠাৎই ঘরের আলো সব নিভে গেলো।রানু দেবীর ঘুম ভেংগে গেল সাথে সাথে। মনে হল কেউ বা কারা যেন কানের পাশে চাপা স্বরে কথা বলছে, হাসছে। ততক্ষনে ঘুম ভেঙেছে দুই ভাইয়েরও। তারাও শুনলেন সেই রক্ত হিম করা শব্দ। নিখিলেশ বাবু এবার ফস করে হাত বাড়িয়ে মোমবাতিটা জ্বালাতেই থেমে গেলো সব। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্বলে উঠলো ঘরের সব আলো।

তারা ভোর হতেই স্থির করলেন এই বাড়িতে আর বেশিদিন কাটানো চলবে না।প্রতিবেশীদেরও জানালেন সব কথা।ওনারা কেউ বললেন, "চোর নয় তো? " কেউ আবার শুনে ঝাড়ফুঁক করতে বললেন। অফিসের লোকজনও নানা রকম বুদ্ধি দিল। নিখিলেশ বাবুর যদিও ততদিনে বাড়ির ওপর থেকে সব মায়া কেটে গেছে। তিনি নতুন উদ্যমে বাড়ির খোঁজ শুরু করলেন।

এর মধ্যে রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে, চিন্তায় ক্লান্তিতে শরীর খারাপ হতে লাগলো রানু দেবীর। তার মধ্যে আবার একদিন রাতে অশরীরী কার্যকলাপ চরমে পৌঁছলো। সমস্ত খাট মাঝ রাত্রিরে হঠাৎই দুলতে শুরু করলো। মনে হচ্ছিল খাটের পাশেই কেউ যেন দাঁড়িয়ে আসুরিক শক্তিতে গোটা খাট নাড়াচ্ছে। 

কোনরকমে সেই রাত কাটিয়ে পরেরদিনই তারা ধ্রুব বাবুকে ডেকে ভাড়া মিটিয়ে দিল। তারপর চন্দননগরে সেই আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠলো। সেখানে দিন দুই কাটিয়ে নতুন বাসা ভাড়া নিলো নিখিলেশ বাবু। 

মাসখানেক পরে নিখিলেশ বাবুর একদিন হঠাৎই পুরনো পাড়ার একজনের সাথে দেখা হয়। সেই তখন বলে, " আপনারা ওই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন, ভালই হয়েছে। ওই বাড়ি আসলে ধ্রুব বাবুর কাকার তৈরি। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। ওই বাড়িতে তিনি গলায় দড়ি দিয়ে মারা যান।ভদ্রলোকের বাড়িটি খুবই পছন্দসই ছিল। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বানিয়েছিলেন। উনি মারা যাবার পর পরই শোকে দুঃখে ওনার স্ত্রীও মারা যান। ওনারা আজও বাড়িটার মায়া কাটাতে পারেননি। ধ্রুব বাবু একমাত্র ওয়ারিস হওয়ায় বাড়িটা পেলেও তিনিও থাকতে পারেননি। ভাড়া দিয়ে অন্য বাড়িতে স্ত্রী পরিবার নিয়ে চলে যান। স্থানীয় লোক সবই জানে। কিন্তু ধ্রুব বাবু ওই বাড়ির পলিটিক্যাল লিডার। তাই ওনার বিরুদ্ধে কেউ কিছু খবর দিতে ভয় পায়। কিন্তু কোনো ভাড়াটেই ওই বাড়িতে মাস ছয়েকের বেশি থাকতে পারেনি।" নিখিলেশ বাবু সব শুনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, " ভাগ্যিস বাড়িটা পাল্টালাম। নাহলে হয় তো....। আচ্ছা চলি। ভালো থাকবেন। নমস্কার।"


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama