ফেলে আসা দিনগুলো
ফেলে আসা দিনগুলো


ছোটবেলার কথা ভাবতে যেমন ভালো লাগে, কাউকে বলতেও তেমনই ভালো লাগে।ছোটবেলায় সকলেরই কত কত খেলার সঙ্গী থাকে। আমারও ছিল ঠিক তেমন। তার মধ্যে দুজন ছিল এক্কেবারে আমার সমবয়সি বন্ধু। তারা আমার সঙ্গে একই বাড়িতে ভাড়া থাকত।একজনের নাম ছিল লেখা। আর একজনের নাম ছিল বেলি।আর আমার নাম ছিল বেবি। আমরা তিনজনে যেখানে যেতাম, একসঙ্গে থাকতাম। লোকজন তিন বন্ধুকে একসাথে না দেখলেই জিজ্ঞেস করতো অন্যরা কোথায়।তিনজনই তখন ছিলাম বাড়ির সবচেয়ে ছোট তিন সদস্য। অতএব আদরও আমাদের একটু বেশিই ছিল।সবাই চোখে চোখে রাখত আমাদের , পাছে যদি আমরা কোথাও হারিয়ে যাই। বাড়ির সকল ভাড়াটে ঘরেই ছিল আমাদের অবাধ যাতায়াত। সকলেই খুব ভালোবাসত আমাদের। বাড়িতে কোনো ঘরে ভালো মন্দ কিছু রান্না হলেই আমাদের না দিয়ে কেউ খেত না। আমাদের সিমলা স্ট্রিটের এই বাড়িতে তখন কম করেও দশ বারো ঘর ভাড়াটে থাকত।ফলে গোটা বাড়িতেই শিশু কিশোর বাহিনী কম ছিল না। তাদের মধ্যে বারো তেরো বছরের একজন দাদাকে আমরা খুব মেনে চলতাম, বিশ্বাস করতাম। একদিন সেই বিশ্বাস থেকেই ঘটলো এক মজার কাণ্ড। আজ সেই গল্পই বলবো তোমাদের।
আমাদের বাড়িটা ছিল একদম বিবেকানন্দ রোডে, ট্রাম রাস্তার ওপর। একদিন বিকেল বেলা তিন বান্ধবী মিলে বসে বসে নিজেদের মত খেলছিলাম। ঐ দাদা এসে বলল," জানিস, ওদিকে একটা বিয়ে বাড়িতে ইয়াব্বর প্যান্ডেল লাগানো হয়েছে, দারুণ সাজিয়েছে। মেলা লোক যাতায়াত করছে সেখানে ।আরো আশ্চর্য্যের ব্যাপার সেই বাড়িতে একটা বৌ জ্যান্ত ঠাকুরের মত সেজেগুজে বসে আছে। দেখলে মনে হয় যেন স্বয়ং মা লক্ষ্মী কিংবা দুর্গা ঠাকুর মর্ত্যে নেমে এসেছেন। " এই কথা শুনে আমাদের খুব কৌতূহল হল। আমরা অনেক করে বললাম, "দাদা আমাদের নিয়ে চলো না। আমরাও দেখবো।" কিন্তু দাদাটা আমাদের কিছুতেই নিতে চাইলো না। উপরন্তু বলল, " বাড়িটা তো কাছেই।নিজেরাই গিয়ে বরং দেখে আয়। আমি নিয়ে যেতে পারবো না। আমি তোদের নিয়ে গেলে বকা খাবো বাড়িতে।"
সেদিন বিকেল বেলা আমার দুই বন্ধু টিফিন খেয়ে রোজের মতই খেলতে নামার জন্য ডাকতে এলো আমাকে।আমার তখনও কিছু খাওয়া হয় নি। মাকে বললাম, " মা খিদে পেয়েছে। তাড়াতাড়ি খেতে দাও"। মা বলল ," আমি বাথরুম থেকে এসে খেতে দিচ্ছি।" আমার দুই বন্ধু তখন বারবার বলতে লাগলো," চল না বেবি। দাদা তো বলল ঐ বাড়িটা নাকি কাছেই।মাসিমা কাজ সেরে আসতে আসতে আমরা ঘুরে আসি।" আমি রাজি হয়ে গেলাম।
এই সুযোগে বলে রাখি, আমাদের সকলেরই তখন কিন্তু বয়স হবে চার কি পাঁচ বছর। সুতরাং বুঝতেই পারছো, কতটা ছোট ছিলাম আমরা।যাই হোক , সাহস করে তিন বন্ধুতে মিলে বিয়ে বাড়ি দেখতে চললাম। কিছুই রাস্তাঘাট চিনি না। কি করেই বা চিনব। কোনোদিন তো ঐভাবে একা একা বেরোই নি। কিছুই খুঁজে না পেয়ে একসময় ভয় পেয়ে ছোটাছুটি করতে লাগলাম। রাস্তা গেলো হারিয়ে। তবু তিন বন্ধুতে হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পেলাম একটা বাড়িতে প্রচুর আলো জ্বলছে। বুঝলাম বিয়ে বাড়ি সেটা। ভাবলাম দাদা বুঝি এই বাড়িটার কথাই বলেছে।
গুটিগুটি পায়ে বিয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে আলো দেখছি তখন তিনজনে।আর মাঝে মাঝে এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজছি, যদি বউ ঠাকুর দেখা যায়।এমন সময়েই হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে আমাদের নাম ধরে ডেকে উঠলো, " এই বেবি, বেলি,লেখা, তোরা এখানে কি করছিস রে?" আমরা চমকে উঠে দেখলাম আমাদের বাড়ির এক মাসি এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের পেছনে।আমাদের তখন চিন্তা হল, মাসি এখানে কি ভাবে এলো? আমরা তো এখানে এসছি, সেটা কারুর জানার কথা নয়। বাড়িতে তো কাউকে বলে আসিনি কিছু। মাসির মুখটা দেখলাম গম্ভীর। আমাদের চুপ করে থাকতে দেখে মাসি ফের জিজ্ঞেস করলো, " কিরে, বল। এখানে কেন এসেছিস?" আমি মুখে আঙ্গুল দিয়ে বললাম," একা আসতে চাইনি মাসি। টোটোন দাদাকে বলেছিলাম নিয়ে আসতে। কিন্তু টোটোন দাদা তো কিছুতেই রাজি হল না। তাই ঠাকুরের মত বউ দেখতে নিজেরাই এসেছি।" মাসি এবার একটু মুচকি হেসে বলল," ধুর এটা কি বিয়েবাড়ি নাকি যে বউ দেখবি? আমার সাথে চল। আমি তোদের সুন্দর একটা বিয়েবাড়ি দেখাবো।" আমরাও সেই শুনে এক পায়ে খাঁড়া। মাসির হাত ধরে হাঁটতে লাগলাম। মাসি কিছুদূর আসার পর বলল, " ভালো জামাকাপড় না পরলে যে তোদের বিয়েবাড়িতে ঢুকতে দেবে না। আগে বরং এখন বাড়ি চল। তারপর সাজুগুজু করে ভালো জামাকাপড় পরে আমার সঙ্গে বিয়েবাড়ি যাস।"আমরাও ভেবে দেখলাম, সত্যিই তো মাসি কত ভালো। এই কথাটা তো ভেবে দেখিনি। তাই মাসির কথা মত তৈরি হয়ে নিতে মাসির হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরে এলাম।
এসে দেখি অদ্ভুত ব্যাপার। সবাই আমরা ফিরতেই জড়িয়ে ধরে,কোলে তুলে, আদর করে চুমো খেতে লাগলো।সকলেই যেন আমাদের দেখতে পেয়ে দারুন খুশি। আমরা যদিও বুঝলাম না কেন। মায়ের দেখলাম, চোখ মুখ লাল লাল, ফুলো ফুলো। ঠিক যেমন কান্নাকাটি করলে হয়। কিন্তু মাও আমাকে বকল না। কেউ কেউ আমাদের আবার বিস্কুট, জল খেতে দিল। আমরা ভাবলাম, আমরা হয় তো সাংঘাতিক ভালো কোনো কাজ করেছি। তাই সবাই এমন আদর করছে। যদিও আমার থেকে তিন বছরের বড় দিদির আচরণ দেখে খুব রাগ হল মনে মনে। দিদি খালি পর্দার আড়াল থেকে চড় দেখাচ্ছিল আমাকে।তখন বুঝিনি দিদি কেনো এমন করছে। পরে মায়ের কাছে শুনেছিলাম, সেদিন নাকি মা দিদিকে বলেছিল আমাকে চোখে চোখে রাখতে।কিন্তু দিদি সেই কথায় গুরুত্ব দেয় নি। ফলে সহজেই আমি নিজের অজান্তে দিদির চোখকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারি। আমাকে খুঁজে না পেয়ে মা সেদিন দিদিকে খুব বকাঝকা করেছিল।আরো শুনেছিলাম, আমাদের বিয়েবাড়ির লোভ দেখানোর জন্য টোটোন দাদাও নাকি বাড়িতে অনেক পিট্টি খেয়েছিল।
আমরা মাসিকে বাড়ি ফিরে অনেক করে বলেছিলাম," মাসি আমাদের বিয়েবাড়ি নিয়ে যাবে না?" কিন্তু মাসি কিছুতেই তখন মনে করতে পারলো না এমন কিছু কথা দিয়েছিল বলে। বরং বেশ গম্ভীর হয়ে আমাদের বলেছিল," এখন পড়তে বস। বেশি দুষ্টুমি করলে কেউ ভালোবাসবে না।বড়োদের না বলে তোমরা কোনোদিন আর কোথাও যাবে না।" তখন আমরা বুঝেছিলাম, বিয়েবাড়ি দেখতে যাবার কাজটা মোটেই ভালো হয় নি।
এখন বুড়ো বয়সে সেই সব কাণ্ড কারখানা মনে পড়লে নিজের মনেই খুব হাসি পায়। মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। তবে একা আনন্দ পেয়ে মজা নেই। তাই তোমাদেরও দিলাম সেই আনন্দের ভাগ।