অপেক্ষা
অপেক্ষা
"আমি আছি তোমার অপেক্ষায় l" কথাটা বলে ওপাশ থেকে ফোন কেটে দিল সুশীল l এইরকমই করে সুশীল, যতই রাগ-অভিমান, ঝগড়া-ঝাটি হোক এই কথাটা বলতে কখনও ভোলে না সে l দেবশ্রী ফোনটা কিছুক্ষন কানে চেপে রেখে সুশিলের অদৃশ্য অস্তিত্ব মাখে,ঠোঁটে লুকোনো মধুর হাসি ফোটে l এই কথাটা শুনলে সেও আর রেগে থাকতে পারে না l মনটা কেমন যেন নেচে ওঠে তার l সুশীলের মধ্যে একটা জাদু আছে সেটা এখন সে তিল তিল করে অনুভব করতে পারে l সাহিত্যিক সত্যিই বলেছেন,"প্রেম যাকে ধরে, আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে l"
না হলে হঠাৎ অচেনা কোন মানুষ, একদিন সবচেয়ে চেনা,নিরাপদ হয়ে ওঠে কিভাবে! সুশীল যখন অনর্গল কথা বলে যায়, দেবশ্রীর শুনতে ভালো লাগে l তার থেকেও বেশি ভালো লাগে সুশীলের চোখদুটো l মায়ায় জড়ানো, নিষ্পাপ ছোট দুটো চোখ l রোদ্দুরে বন্ধ কিনা খোলা এই নিয়ে কম খেপিয়েছে সুশীলকে!
সুশীল রেগে গেলে অনেক অনেক কথা বলে, আর সে কথাগুলো এতটাই গুছিয়ে বলে যে সেটা কোন বক্তৃতার থেকে কোন অংশে কম নয় l দেবশ্রীর খুব ইচ্ছা করে প্রিয় মানুষটার অভিমান মাখা মুখটা দেখতে, রাগে কি নাকটা লাল হয়? সেটা জানতে খুব ইচ্ছা করে, আর ইচ্ছা করে সুশীলের চুলে বিলি কাটতে l মাঝে মাঝে ভীষণ ইচ্ছা করে বলতে,"বৃষ্টি হলে, তোমার চুলের ছাতার নীচে আমাকে আশ্রয় দেবে? "
কিন্তু পারে না l ফোনেতে কি আর সমস্ত আবদার-বায়না মেটানো সম্ভব l
তবে একবার দেখা দিয়েছিল সুশীল l প্রায় দু'মাস আগে l দিনটা খুব ভালো ভাবে মনে আছে l না দিন নয় সন্ধ্যা l অর্থাৎ সন্ধ্যাবেলা l তারিখ ছিল ১৫ই মার্চ l হঠাৎ করেই চলে এসেছিল সুশীল l যেমন অকস্মাৎ ঝড় ওঠে সমুদ্রে l
সমুদ্রই বটে, নাহলে সুশীল কেন বলে,"তুমি মহা সমুদ্রের মত, আমাকে ভাসতেও দেবে না আবার ডুবতেও দেবে না l শুধু হাবুডুবু খাওয়াবে l"
সেদিনের আগেও অনেকবার সুশীলকে দেখা-সাক্ষাতের কথা জিজ্ঞাসা করেছে, কিন্তু প্রতিবারই সুশীল কোন না কোন কারণ দেখিয়ে 'না' বলে দিয়েছে l তাহলে ১৫ই মার্চ কী হয়েছিল তার? সেই উত্তর আজও পায়না দেবশ্রী l শুধু চোখের সামনে ভেসে ওঠে মুহূর্তগুলো l পরিষ্কার দেখতে পায় সে l
সুশীল ফোন করে বলল,"তোমার হোস্টেল কটার সময় বন্ধ হয়?" কথাটা শুনে বুকটা ধরফর করে উঠেছিল দেবশ্রীর l আমতা আমতা করে বলল,"ওই..সাড়ে ছ'টা l"
"তাহলে আজ হবে না l এখনই পাঁচটা কুড়ি l হোস্টেলের সামনে যেতে যেতে আরো আধঘণ্টা l ঠিক আছে পরে একদিন দিন দেখা হবে l
"না শোনো, সাতটা পর্যন্ত হলেও ঢুকতে দেবে l একটু বকা শুনতে হবে এই আর কী l তুমি আসতে পারো l"
দেবশ্রী বেহালার একটা বেসরকারি নার্সিং ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করে l সোশ্যাল মিডিয়াযর মারফত সুশীলের সাথে আলাপ l সুশীলের একটা কবিতা পড়েই প্রেমে পরে যায় l কবিতার লাইনগুলো মাঝে মধ্যে সে গুন গুন করে l ভবিশেষ করে শেষ দু'লাইন বুকের মধ্যে একপ্রকার তিরের মত বিঁধে রয়েছে এখনও l
কোষ পচা স্বাদে, বিষাক্ত জিভ
জড় মন অদৃশ্য, স্পর্শ সজীব..
তারপর সুশীলের সাথে কথাবার্তা শুরু হয় l যত সময় পেরোয় ততই নিজেকে দুর্বল লাগে দেবশ্রীর l কত বিষয় নিয়েই আলোচনা হয় তাদের- মহাভারত, রামায়ণ থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ l এমনভাবে যেন একটা গোটা যুগ পেরিয়ে গেছে দু'জনার l কিন্তু আজও নির্দিষ্ট করে কোনো প্রেমদিবস নেই তাদের l কেউ কাউকে,"আমি তোমাকে ভালবাসি তুমিও কি আমাকে ভালোবাসো?" বলে প্রস্তাব দেওয়া-নেওয়া হয়নি আজও l এই ব্যাপারটা আরো বেশি উপভোগ করে দেবশ্রী l সে বলে,"এই তুমি আমাকে কবে প্রপোজ করবে শুনি?"
সুশীল উত্তর দেয়,"কালl"
সন্ধ্যা ছ'টা l দেবশ্রীর কাছে আবার ফোন এলো l
"আমি তোমার কলেজের সামনে, গীতাঞ্জলি পার্কে বসে আছি l তুমি কোথায়?"
"এই তো, চলে এসেছি l পাঁচ মিনিট l
বুকটা একটা অজানা ভয়ে, আনন্দে ভোরে উঠল l পার্কের সামনে পৌঁছে দেবশ্রী ফোন করল,"কই তুমি?"
"এই যে আমি l রবীন্দ্রনাথের নীচে বসে আছি l"
কথাটা শোনামাত্র দেবশ্রীর চোখজোড়া বিদ্যুৎ বেগে ছুটে গেলো, পার্কের একদম শেষ প্রান্তে l সে দেখল,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূর্তির নীচে সবুজ গেঞ্জি সুশীল বসে বসে পা-দোলাচ্ছে আর তার দিকেই তাকিয়ে আছে l সামনে এসে দেবশ্রীর সামনে ফুটে উঠল, সম্ভবত দু'বছর চুল দাড়ি না কাটা সুশীলের মুখটা l
সুশীল কিন্তু দেবশ্রী দেখে একটু অবাক হল না অথচ ঠোঁটে তার চাপা হাসি l দেবশ্রী পাশে বসলো l কিছুক্ষণ আড়চোখে দু'জনের শুভদৃষ্টি হল l সুশীল খুব সাহসি, দেবশ্রীর হাত দুটো চেপে ধরে বলল,"দেখি তো,তোমার হাতে আমি লেখা আছে কিনা!"
দেবশ্রী বুঝতে পারলো এটা স্রেফ হাত ধরার বাহানা মাত্র l সব বুঝেও চুপ করে বসে রইল সে l কিছুক্ষণ পর দেবশ্রী তার খুনসুটি শুরু করে দিল l কত যে কিল ঘুষি হজম করতে হয়েছিল সেটার হিসাব নেই l তবে শাস্তি হিসেবে তাঁর চোখ দুটো টেনে দিয়ে সুশীল বলেছিল,"আরেকটু টানা হলে মন্দ হতো না l"
সেদিন আর তেমন কথাবার্তা এগোয়নি তাদের মধ্যে l সময় যেন মরুভূমিতে এক টুকরো বরফের মত গলে যাচ্ছিল l
পার্ক থেকে বেরিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটা শুরু করল দুজনে l এইবার দেবশ্রীর সাহসী হওয়ার সময়, আঙুলে আঙুল ঢেকা ঢেকিতে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে আঙ্গুলে আঙ্গুল গুজে দুটো হাত এক করে দিল দেবশ্রী l তবে রাস্তা পার হওয়ার সময় দেবশ্রী রীতিমত অবাক হল একটা কথা শুনে,"আমি কিন্তু রাস্তা পার হতে পারি না l" সুশীলের মুখে দুষ্টুমি ভরা হাসি l দেবশ্রীর হাত ধরে রাস্তা পার হয়ে হোস্টেলের সামনে, সুশীল আবদার জুড়ে দিল চুমু না খেয়ে সে যাবে না l এদিকে দেবশ্রীর হৃদয়যন্ত্র বিপদ সীমায় গিয়ে ঠেকেছে l এ আবার কেমন আবদার! প্রথম সাক্ষাতেই চুমু l সামনে হোস্টেল, এখন কি করবে সে? শেষমেষ সুশীল চুমুর স্বাদ পেল তবে জুলফির উপর l দেবশ্রী পেল চোখের নীচে l সেই স্পর্শ যেন এখনও লেগে আছে দু'জনার চামড়ায় l তারপরের দিনগুলো কিছুতেই কাটতে চায়না দেবশ্রীর l সুশীলের অবস্থা সে জানেনা l সুশীল তখন এইসব নিয়ে কথা বলত না l দেবশ্রীর নিজেকে কেমন একটা ক্ষ্যাপা ক্ষ্যাপা অনুভব করছিল l
তারপর আবার দেখা হওয়ার কথা উঠেছিল কিন্তু আর হলো কই!
মারণ ভাইরাস গ্রাস করল সারা বিশ্বকে l জীবকূল অস্থির, স্বতন্ত্র হয়ে উঠল l একদিন আবার পুরো দেশজুড়ে কারফিউও লাগুছিল, পরে
চোদ্দদিনের সমস্ত ভারতবর্ষজুড়ে লকডাউনের ঘোষণা l নিরাপত্তার খাতিরে মানুসের চলাফেরাতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ হল l লোকডাউনের চলাকালীন কেউ বাইরে বেরোতে পারবে না l জরুরী জিনিসপত্র আগে থেকে মজুত করে রাখার উপদেশ দেওয়া হল l এমনকি একজন মানুষ অন্যএকজন মানুষের থেকে দূরত্ব রেখে কাজ,আলাপ করার রীতি চালু হল l সর্বক্ষণ কাপড়ে ঢেকে রাখতে হচ্ছে বদনটাকে l বাতাসে করোনা নামক জীবিননাশক ভাইরাস উড়ে বেড়াচ্ছে l ছোয়াছুয়ি তে সব থেকে বেশি সক্রামণ হওয়ার সম্ভবনা, তাই জলের সাথে কৃত্রিম এলকোহল মেশানো senitaisar ঘর, পকেট দখল করে বসল l মানুষ বাতাস থেকে শুধু অক্সিজেন নয় তার সাথে 'করোনা' ও তার থেকে বেশি 'ভয়'নামক জীবাণু নেওয়া শুরু করেছে l বহিঃবিশ্বেও এই একই পরিস্থিতি l বলাবাহুল্য সম্পূর্ণ পৃথিবী বিশ্রাম পেয়েছে l যুগ যুগ ধরে সেও তো ঘুরে যাচ্ছে, সেও বুড়ো হচ্ছে, তার বুকটাও ভিতর থেকে সম্পদ লোভে ফাঁপা হয়ে যাচ্ছে l তাই সামান্য বিশ্রাম তার প্রাপ্য l শুধমাত্র আপাতকালীন পরিসেবা, ব্যবস্থা গুলো বিশ্রাম থেকে বঞ্চিত হয়েছে l পৃথিবী বিশ্রাম পেলেও তারা কোনোদিন পাবে না l
শেষে স্কুল-কলেজ সহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিরতি নিল l সুতরাং দেবশ্রীকেও বেহালা ছেড়ে, সুশীলের সান্নিধ্য থেকে দূরে, নিজের বাড়ি ফিরতে হল l দেবশ্রী প্রথমে বুঝতে পারেনি, যে সুশীলের থেকে তাকে এতদিন দূরে থাকতে হবে l আগে জানলে আরো একবার যাইহোক করে দেখা করে নিত l তবু ভালো,সেদিন সুশীলের সুমতি হয়েছিল l নাহলে আর কোনোদিন দেখা হবে কীনা কে জানে? কারণ ভবিষ্যত নিষ্ঠুর বিপক্ষের ন্যয় অকস্মাৎ হানা দিয়ে, প্রস্তুতির ক্ষীণতম শক্তি কেড়ে নেয় l
এখন প্রতিটা মুহূর্ত দেবশ্রী অপেক্ষা করে, খবরের কাগজে প্রত্যেকদিন অনুসন্ধান চালায়- কোরোনার প্রকোপ কোমল কিনা, কবে আবার সব কিছু স্বাভাবিক হবে, সে কলেজ যেতে পারবে l মানুষ প্রাণ ভোরে প্রাণবায়ু গ্রহণ করতে পারবে l দেবশ্রীর অন্তরে মাঝে মধ্যেই একটা প্রশ্ন ওঠে,"এইরকম পরিস্থিতি যদি না হত, সুশীলের এতটা কাছে কী সে আসতে পারতো?"
যখনই দেবশ্রী ভীষণভাবে সুশীলের তার প্রতি অগাত ভালোবাসা বুঝতে পারতো, তখনই কঠিন হীরের মত তরল চোখটা কে গ্রাস করে l আবেগীসুরে সে সুশীলকে জিজ্ঞাসা করে,"আমাদের দেখা হবে তো?"
প্রতুত্তরে সুশীল বলে,"ও গো আমার পনেরতম, সমুদ্র মন্থন থেকে তোমাকে পেয়েছি l শুধু আমার তুমি l"
এই সামান্যটুকু কথা শুনে দেবশ্রীর মন ভালো হয়ে যায় l দিন যায়, কালো রাত আসে l কখনও আকাশ সাজে তারায়, কখনও তারাহারা আকাশ গুমরে থাকে কালো মেঘে l
এখন এক একটা দিন গোটা একটা বছরের মত কাটছে তাদের...

